সেদিন মাসুদ যাচ্ছে রাতুলদের বাড়ির দিকে। রাতুলের মায়ের অবস্থা খুব খারাপ শুনার পর থেকে মাসুদ আর ঘুমাতে পারছে না। মাসুদকে রাতুলের মা খুব আদর করে। তারও কারণ আছে। রাতুল আর মাসুদ সেই ক্লাস থ্রি থেকে একই সাথে পড়ালেখা করে আসছে। তবে চতুর্থ শ্রেণির শেষদিকে তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয়। এ বন্ধুত্ব আজো অটুট আছে। দু’জনের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দু’জনে সমঝোতা বুঝে।
রাতুলের বড় ভাই সাগর বুঝে উঠতে পারছে না তার পিতাহারা ছোট ভাই কেন মাসুদের সাথে ওঠা বসা করছে। কারণে-অকারণে দু’জনে একসাথে চলাফেরা করে। একজন একজনকে না দেখলে পেটের ভাত হজম হতো না। সম্পর্কে মাঝে মাঝে সাগরের বড় ভাই হানা দিতে চেষ্টা করতো। রাতুলের একটা হিরো সাইকেল ছিল। আর দু’জনে স্কুল ছুটির পর, এ সাইকেল নিয়ে অজানা উদ্দেশে বের হতো। মাসুদ লজিং থাকতো রাতুলদের বাড়ির পাশে।
এসএসসি পরীক্ষার মাত্র কয়দিন পূর্বে রাতুল আর মাসুদকে একসাথে দেখতে পায় রাতুলের বড়ভাই সাগর। একেতো বাঘের ভয় তার ওপর রাত হয়। দু’জনে থতমত খেয়ে বাড়ির দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে গেলে সাগর জিজ্ঞাসা করে, এই মাসুদ, তোমার বাড়িতে পড়ালেখা নেই! দু’জনে সারাক্ষণ টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছো। তোমাকে রাতুলের সাথে আর যেন না দেখি। পাশে থাকা ছোটভাই রাতুলকে চোখ রাঙিয়ে হন হন করে চলে গেল বাজারের দিকে। দু’জনের সম্মুখ স্বপ্ন চলে যাচ্ছে হাতের বাইরে।
দু’জনে হালকা অভিমান করে যে যার অবস্থানে চলে যায়।
আজ ক্লাসে রাতুল আর মাসুদ অনেক তফাতে বসে।
তাদের এহেন ভাব দেখে আরেক মানিকজোড় বন্ধু মিলাদ বলে, কী ব্যাপার; আজ দুই বন্ধুতে কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে! এসব বলতে বলতে ক্লাসে স্যার আসায় আর বেশি কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু লেইজার পিরিয়ডে দু’জনকে চেপে ধরে বসলে তখন আরো মজার বিষয় বের হয়ে আসে। রাতুলের সেই হিরো সাইকেলটি নিয়ে ফেলেছে তার বড় ভাই। আজ দু’জনে পায়ে হেঁটে এসেছে।
মাসুদ ক্লাসে থার্ডবয় হলেও রাতুলও কম না। রাতুলের হাতের লেখা সুন্দর এবং মুখস্থশক্তিও ভালো। তার কমন করার শক্তি প্রখর। সমস্যা এক জায়গায়। রাতুল কখনো ফুল অ্যানসার করে আসতে পারে না। এ সমস্যার ফলে সে পড়ে থাকে সাতের বাইরে। অথচ রাতুলের বাবা ও মা দু’জনে শিক্ষক। রাতুল কিছুটা নিয়মে থাকলেও একটু আকুলি বিকুলি করে সময় নষ্ট করতে চায়। অপর দিকে মাসুদ তার পরিবারের বড় ছেলে। কিন্তু পড়া পড়া চাপ আর পারিবারিক বাজার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পঞ্চম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার পূর্বে লজিং-এ চলে যায়। সে চপল ছেলে হলেও পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী এবং খেলাধুলাপ্রিয়। বন্ধুবৎসলও বলা যায়। মাসুদ অনেক ভালো হওয়ায় সবাই তাকে সমীহ করতো। এটার অবদানও কিন্তু মিলাদের।
মিলাদ রাতুলের মুখের কথা শুনে রাতুলকে হোস্টেলে আসার পরামর্শ দেয়। আর বলে, দেখো রাতুল, তুমি যদি ভাল রেজাল্ট করতে পারো তাহলে তোমার বড় ভাইয়ের যেমন ভুল ধারণা ভেঙে যাবে তেমনি মাসুদকেও সে ভালো জানবে। রাতুল এ পরামর্শটি বাড়িতে গিয়ে তার মাকে বললে তা সানন্দে মেনে নেয়। অবশ্য বাবা মাত্র বছরখানেক পূর্বে গত হয়েছেন।
রাতুল হোস্টেলে আসার পর ভালোভাবে পড়তে লাগল।
টেস্ট পরীক্ষায় পূর্বের তুলনায় রাতুল ভালো রেজাল্ট করে। রাতুলকে একদিন তার বড়ভাই সাগর হোস্টেলে দেখতে আসে বিকেল বেলায়। এসে মিলাদ ও মাসুদকে দেখতে পায়। কিন্তু মিলাদের সাথে কথা বললেও মাসুদের সাথে কথা বলেনি। এতে মাসুদ কিছু মনে না করলেও রাতুল কষ্ট পেয়েছে।
রাতুলদের কালে ফরমফিলাপ করার সময় একজন ভাল ছাত্রের সাথে অপেক্ষাকৃত কম ভালো ছাত্রটির বসার সুযোগ বাতলে দিতেন স্যারেরা। ফলে ওই ছাত্রটিও ভালো রেজাল্ট করে বসতো। টেস্টের পর কামাল সব হ্যান্ডনোট কপি করে রাতুলকে দিয়ে দিলে রাতুলও সে মোতাবেক পড়ালেখা করে যাচ্ছে।
বোর্ড পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেড়ে গেছে দু’জনের কষ্ট। দেখা না হওয়ার কষ্ট, গল্প করতে না পারার কষ্ট। বিরহের সময় সহজে কাটে না। বোর্ড পরীক্ষার নব্বই দিন পার হতেই রেজাল্ট বের হলো কোন এক বৃহস্পতিবার। তখন আবার বেশিরভাগ সময় বৃহস্পতিবারে রেজাল্ট দিতো বোর্ড কর্তৃপক্ষ। রেজাল্টে দু’জনে ফার্স্ট ডিভিশন পায়। তবে মাসুদ গণিতে লেটার মার্ক পায়। রাতুলদের বাসার সবাই খুশি। বড়ভাই মিষ্টির আয়োজনও করে। মিষ্টি খেতে খেতে সাগর তাকে জিজ্ঞাসা করে নকল টকল করিসনি তো! রাতুল বলে আমার রেজাল্টের পেছনে পুরোটাই মাসুদের অবদান। তার হ্যান্ডনোট এবং পরীক্ষার হলে পাশাপাশি বসাতে গণিতে পাস করতে পেরেছি। গণিতের দিন ও তো সবাইকে পাস করাতে গিয়ে এক্সপেল্ড হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আল্লাহ রহমত করেছেন সবার কল্যাণে। তার মা ও বড় ভাই সব শুনে অবাক হয়ে গেছে।
রাতুলের মা আয়েশা বেগম রাতুলকে বলে, ওকে একটু আসতে বলিস। ও কতো না ভালো বন্ধু। এ রকম ভালো বন্ধু হলে সবার কল্যাণ হবে। জানো মা, ও কিন্তু লজিং থেকে পড়ালেখা করে। ও খুব ভালো ছেলে। ছেলের মুখে মাসুদের প্রশংসা শুনে মা ও ভাই তাকিয়ে আছে। সাগর কিছুই বলছে না।
রাতুলের মায়ের অসুস্থতার কথা যখন শুনে তখন মাসুদ অস্থির হয়ে যায়। ও যেন সবাইকে তার মা-এর মতো মনে করে।
পাশের বাড়ির কারো কোন সমস্যা হলে সে হুমড়ি খেয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। মানুষের উপকারে আসতে পারাটাকে সে কৃতিত্ব মনে করে। সে মানুষকে ভালোবাসে।
সেদিন মাসুদের বাড়ির পাশে একটা উঁচু পুলে একটি যাত্রীবাহী রিকশাওয়ালা টেনে উঠাতে পারছে না। পেছন থেকে মাসুদ দৌড়ে এসে ঠেলে দিলে রিকশা উঠতে সক্ষম হয়। মাসুদ যাত্রীদের বলল, আপনাদের মাঝে মানবতা বলতে কিছু নেই। আপনারা একটু উদার হলে সবার জন্য কল্যাণ হয়। আমি দুঃখিত। কথাগুলো বলতে চাইনি। বাস্তবতা আমাকে বাধ্য করেছে। রিকশাওয়ালা ও যাত্রীরা লজ্জা পেল। মাসুদকে ধন্যবাদ জানালো এবং দোয়াও করল। আসলে শিক্ষা এভাবে হয়। দোয়া এভাবেই আসে।
আজ রাতুল তার মায়ের অসুস্থতার কথা বলে মাসুদকে নেয়ার প্রস্তাব দিলে মাসুদ রাজি হয় এবং যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
মাসুদ বন্ধুর মাকে দেখতে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন সে তার মাকে দেখতে যাচ্ছে। এখানে তার আনন্দ। আজ মাসুদ যাবে বন্ধুর মাকে দেখতে। অপর দিকে রাতুল বসে ভাবছে তার গর্ব করা বন্ধুকে বাড়িতে এনে মায়ের সাথে পরিচয় করে দিবে। মাসুদ বাসায় যাওয়ার পর রাতুলের ছোট বোন দৌড়ে গিয়ে ভাই ভাবী ও মা-কে ডেকে আনে।
মাসুদকে পেয়ে আয়েশা বেগম খুব খুশি। আয়েশা বেগমকে মাসুদ কদমবুসি করে পাশে বসতে না বসতেই রাতুলের বড় ভাই সাগর এসে হাজির। সাগর কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর মাসুদকে বলে তুমি আসলে খুব ভালো ছেলে এবং রাতুলের ভালো বন্ধুও বটে।
মাসুদ বলে, কি বলেন ভাইয়া। আপনি আমাদের বড় ভাই। আপনার সেদিনের শাসনে আমরা ভালো রেজাল্ট করার পথ বের করেছি। তা ছাড়া আমার কোন বড় ভাই নেই। তাই আমি সাদরে গ্রহণ করেছি বলে আজ আপনাদের সম্মান বেড়েছে। আমাদের জন্য সব সময় দোয়া করবেন। আমরা যেন ভালো মানুষ হতে পারি। মানুষের কল্যাণ করতে পারি।
সাগর মাথা তুলে মাসুদের দিকে তাকালে দেখে, মাসুদের চেহারায় পুরো দেশের স্বপ্ন যেন খেলে যাচ্ছে। সাগর অবাক চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে অতি নীরবে প্রস্থান করলে মা আয়েশা বেগম মাসুদের মাথায় হাত তুলে বলে জীবনে বড় হও। সকল সুন্দরে তোমাদের ফুল ফুটুক। দেশ ও দশের কল্যাণে স্বপ্ন বুনতে বুনতে এগিয়ে যাবে সম্মুখ পানে। আমার প্রত্যাশা তোমাদের মঙ্গল হোক। হ