Home গল্প পড়ন্ত বিকেল -হেলাল আনওয়ার

পড়ন্ত বিকেল -হেলাল আনওয়ার

ঠিক কখন যে হুঁশ ফিরলো তা মনে নেই। গত কদিন জ্বর জ্বর চলছে অনবরত। স্কুলে যাবার পথে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সহপাঠীরা লবিদদের বাড়িতে দ্রুত খবর দিলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এসব লবিদ কিছুই জানে না। যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন দেখতে পেলো সে হাসপাতালে শুয়ে আছে। আর মারুফা তার পাশে অথৈ চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে আছে।
লবিদ মাকে জিজ্ঞেস করে, আম্মু আমি এখানে কেন?
মা চোখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে তুমিতো অসুস্থ। তাই-
কেন মা আমার কী হয়েছে?
তাতো জানি না বাবা। তবে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলে তো-।
ও তাই-?
লবিদ আবার মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। কথা বলার মতো শক্তিও যেন নেই তার। খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখ মেলে তাকালে যেন সারা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। শুয়ে থাকলেও তার মাথা চক্কর দিচ্ছে।
মারুফা ছেলের দিকে তাকিয়ে আবেগ থামাতে পারে না। কেন যে এমন হলো এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। ডাক্তারকে সকালে জিজ্ঞাসা করলেও তেমন কোনো উত্তর দেননি। কেবল বললেন পরীক্ষা না করে বলা যাচ্ছে না। মারুফার টেনশন আরো বেড়ে গেলো।
নার্স এসে বারোটার দিকে ব্লাড নিয়ে গেলো পরীক্ষা করার জন্য। মারুফা দেখেই যেন আঁতকে উঠলো। এসব দেখতে সে একেবারেই অনভ্যস্ত। জীবনে এত সব মোকাবেলা করতে হবে তা সে ভাবতেও পারেনি। নার্সদের কাছে কিছু জানতে চাওয়ার আগেই তারা বললো- তেমন কিছু না খালাম্মা। আপনার ছেলে খুব দ্রুত সেরে উঠবে। বেশি ভেবে লাভ নেই।
লবিদ হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে ভাবে বাড়ির কথা। স্কুলের সহপাঠীদের কথা। পাড়ার বিনা, রিনা, রানা ও চমকদের কথা। বৈশাখের দুরন্ত বিকেলের কথা। ঘুড়ি উড়ানোর কথা। এসব মনে করে তার দু’চোখ বেয়ে ঝর্ণার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কষ্টে যেন তার বুকটা ভারি হয়ে আসে।
সে ভাবে- আবার সে কি সুস্থ হয়ে বন্ধুদের সাথে কানামাছি খেলতে পারবে? গোল্লাছুট খেলতে পারবে? গাজীদের আমবাগানে ভরদুপুরে দাঁড়িয়াবাঁধা কিংবা হাডুডু খেলতে পারবে? মারুফা লবিদের পাশে চিন্তাক্লিষ্ট মনে বসে আছে। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে- এখন কেমন লাগছে বাবু?
– ভালো লাগছে আম্মু। তবে-
– তবে মানে?
– মানে ভাবছি-
– কী এতো ভাবছো বাবা?
– ভাবছি কবে যে আবার সুস্থ হয়ে বন্ধুদের সাথে খেলতে পারবো!
– এতসব ভাবার তোমার দরকার কী? ডাক্তার না বলেছেন তুমি তাড়াতাড়িই ভালো হয়ে যাবে!
– আর কতদিন লাগবে আম্মু! আমার আর এখানে একটুও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এখনই এখান থেকে বের হতে পারলে আমি ভালো হয়ে যেতাম।
– নারে বাবা। এতো ধৈর্যহারা হলে চলবে?
– সত্যি আম্মু, আমি একটুও এখানে থাকতে পারছি না।
– না বাবা তা হয় না। ডাক্তার বললেই আমরা এখান থেকে চলে যাবো।
লবিদ আর কোনো কথা না বলে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।
মারুফা পাশে বসে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। লবিদ কিছুটা আরাম বোধ করে। ধীরে ধীরে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। মা খুশি হয়। কারণ, গত রাতে সে একটুও ঘুমুতে পারেনি। সারা রাত নির্ঘুমে কেটে গেছে তার।
শাহেদ হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠে। তিন তলায় লবিদদের কেবিন। শাহেদ হাঁপাতে থাকে। সমস্ত শরীর তার ঘেমে গেছে। তবু হাসতে হাসতে কেবিনে ঢুকলো।
লবিদ চুপচাপ শুয়ে আছে। সে ভাবছে আর ভাবছে। জানালা খুলে সে বাইরে তাকালো। বাহ কী চমৎকার বিকেল! সাথে হালকা বাতাস। তার মনে পড়ে ছোট্টবেলার ঘুড়ি উড়ানোর কথা। গতবার সে টুটুলকে দিয়ে একটা ঘুড়ি বানিয়ে নিয়েছিলো। তারপর আব্বুকে অনেক বলে কয়ে বাজার থেকে সুতো আনিয়ে নিয়েছিলো। আব্বু অবশ্য প্রথমত রাজিই হননি। তারপর আম্মু আর আমি আব্বুকে বোঝালে তিনি রাজি হন। তবে শর্ত দেন সামনের পরীক্ষায় আমাকে আরো ভালো ফলাফল করতে হবে। আর বেশি রোদে যেন দৌড়াদৌড়ি না করি।
তারপর একদিন বিকেলে ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিলাম। অনেক উপরে উঠেছিলো আমার ঘুড়িটি। আমি আব্বুকে ডেকে দেখালাম। আব্বু অনেক পুলকিত হলেন আমার সাথে সাথে।
বেলা পাটে যাচ্ছে। বিকেলের রোদও প্রায় পড়ে গেছে। আব্বু আমাকে বললেন, নাও এবার সুতো গুটিয়ে ফেলো। নইলে রাত হয়ে যাবে। ওদিকে আবার মাগরিবের আজান হবে। নামাযে যেতে হবে কিন্তু।
লবিদ আব্বুর কথাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে ঘুড়ির সুতো গোছাতে থাকে। তৎক্ষণাৎ মাগরিবের আজান হলো। আব্বু নামাজের জন্য মসজিদে চলে গেলেন।
মারুফা ছেলের নীরবতা দেখে জিজ্ঞেস করলো- এতো চুপচাপ কেন আব্বু?
– না আম্মু এমনিতেই
– খারাপ লাগছে?
না আম্মু। এইতো আমি বেশ ভালো আছি!
ওর ভালো থাকার কথা শুনলে মারুফার খুব ভালো লাগে। ওইতো আমার ভালো-মন্দের একমাত্র কারণ। ও ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকি। আর ওর শরীর খারাপ হলে আমরাও মন থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মারুফার দুচোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। ছলছল করে ওঠে তার ক্লান্ত মন। ছেলের অবস্থা ভালো। তবু ডাক্তারের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত যেন তার মনের চিন্তা দূর হচ্ছে না।
আব্বু আব্বু!
লবিদ ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর দেয়- জি আব্বুজি।
– এখন কেমন লাগছে?
– ভালো লাগছে আব্বুজি-। আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
– এইতো ছিলাম একটু বাইরে।
– আব্বু জানেন আপনার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে।
কেন?
– আপনার মুখটা শুকনো কেন আব্বুজি?
– কই নাতো
– নিশ্চয় আপনি দুপুরে কিছু খাননি?
– আরে পাগল নারে। এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
মারুফা শাহেদের দিকে তাকালো। সত্যিই মুখটা বড় শুকনো। মাথার চুলগুলো ভীষণ এলোমেলো। একেবারে পাগলের মতো দেখাচ্ছে। মারুফার মনের ভেতর মুহূর্তেই ধপ করে ওঠে।
শাহেদের হাতে একটি খাম। সম্ভবত ওর মধ্যেই আছে লবিদদের ডাক্তারি রিপোর্ট। শাহেদের দিকে অসহায় করুণ নেত্রে তাকিয়ে মারুফা আস্তে করে জিজ্ঞেস করেÑ
– তোমার হাতে-
– বাবুর ডাক্তারি রিপোর্ট
– কী অবস্থা-?
– হ্যাঁ ভালো-। ল্যাবের লোকেরা বলছে তেমন কোনো মারাত্মক সমস্যা না।
– তাহলে?
– মানে আমি বা ওরা এসব ভালো বুঝি না। ডাক্তার দেখে তারপর বিস্তারিত বলবেন।
– আহা তুমি তাহলে জলদি করে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করো
– আহা যাচ্ছিতো-
– তার আগে একটু হাত মুখ ধুয়ে আস। এখানে কিছু খাবার আছে। একটু খেয়ে তারপর যাও।
শাহেদ আচ্ছা বলে হাত মুখ ধুতে গেলো।
– আম্মু ডাক্তার কখন আসবেন?
– এইতো পাঁচটার দিকে উনি আসবেন।
– তারপর কি আমরা বাড়ি যাবো?
– হ্যাঁ। তারপর আমরা বাড়ি যাবো বাবা।
– তুমি আব্বুকে বলে এবারও আমাকে ঘুড়ি বানিয়ে দিবে?
– তোমারতো শরীর খারাপ। তারপর যদি সারাদিন রোদে টো টো করে বেড়াও তাহলে আরো সমস্যা হবে।
লবিদের মন খারাপ হয়ে যায়। তার দু চোখ ছল ছল করে ওঠে। চোখ মুখ বিবর্ণ হয়ে আসে।  সে বিনয়ের সাথে বলে- না, আম্মু! আমি আর রোদে রোদে যাব না। ছায়ায় বসে বসে উড়াবো।
-আচ্ছা, আগে বাড়ি যাই। তারপর দেখা যাবে।
এরই মধ্যে শাহেদ কেবিনে ফিরে এলো। এখন আর তার মুখটা চিন্তাক্লিষ্ট নয়। বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ যেন মুছে গেছে। একটা লম্বা দম নিয়ে বলে-মারুফা ভালো সংবাদ-
মারুফা চমকে ওঠে। কী সেই ভালো সংবাদ?
– আমি বাবুর রিপোর্টটা ডাক্তার সাহেবকে দেখালাম।
– ডাক্তার সাহেব কি বললেন?
– বললেন বাবুর সব রিপোর্ট ভালো।
শাহেদের কথা শেষ হতে না হতেই মারুফা বললো- আলহামদুলিল্লাহ। এইমাত্র তার মাথা থেকে পাহাড় সমান দুশ্চিন্তা নেমে গেলো। নিজেকে যেন সে ভীষণ হালকা মনে করতে থাকে। লবিদের মুখখানি জড়িয়ে হাসতে হাসতে চুমো দিলো।
পরম করুণাময়ের শুকরিয়া জানিয়ে পড়ন্ত বিকেলে তারা সকলেই প্রশান্তচিত্তে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়।

SHARE

Leave a Reply