Home ধারাবাহিক উপন্যাস আল কেমিস্ট মূল : পাউলো কোয়েলহো -অনুবাদ : আসিফ...

আল কেমিস্ট মূল : পাউলো কোয়েলহো -অনুবাদ : আসিফ হাসান

চতুর্থ খন্ড

এরপর থেকে প্রতিদিন ছেলেটা কূপের কাছে গিয়ে ফাতিমার অপেক্ষায় থাকে। সে তার কাহিনী শোনায়। মেয়েটি তাকে সাহস জোগায়, গুপ্তধনের সন্ধানে যেতে বলে। সে-ও মাকতুবের কথা বলে। সে আরো বলে, ‘মরুভূমি আমাদের পুরুষদের আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়, আর সবসময় তারা ফেরে না।’
‘আমরা জানি, আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যারা ফেরে না, তারা মেঘের অংশ হয়ে যায়। কেউ কেউ ফিরে আসে। তখন অন্য নারীরাও খুশি হয়, কারণ তখন তাদের মনে হতে থাকে, তাদের স্বামীরাও ফিরে আসবে। আমিও স্বামীর অপেক্ষায় থাকা নারী হবো।’
‘আমি মরুভূমির নারী। আমি এজন্য গর্বিত। আমি চাই, আমার স্বামী স্বাধীনভাবে বালিয়াড়িতে ছুটতে থাকুক।’
ফাতিমা তাকে বলে, বাতাসে বালিয়াড়ি বদলে যায়, কিন্তু মরুভূমি বদলায় না।
ছেলেটা ফিরে এসে একটা খেজুর গাছের নিচে বসে। সে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দুটি বাজ দেখতে পেল। পাখি দুটি যেন তাকে লক্ষ্য করেই গোত্তা খেল বিশেষ ভঙ্গিমায়। একটি বাজ আরেকটিকে আক্রমণ করল।
সে আরো ভালোভাবে পাখি দুটি দেখল। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু একটু চিন্তা করতেই সবকিছু পরিষ্কার বুঝতে পারল। কেউ হামলা করতে আসছে মরূদ্যানে!
ছেলেটা মরূদ্যানের সর্দারের কাছে সব খুলে বলল। তিনি সব শুনে প্রস্তুতি নিলেন।
ছেলেটা তার তাঁবুতে ফিরছিল নীরবে হেঁটে। এখন মরে গেলেও তার কোনো অতৃপ্তি থাকবে না। সবকিছুর মালিকই আল্লাহ। যেকোনো সময়ই তো সে মরতে পারত।
বিকট শব্দ শুনে থতমত খেয়ে গেল। একটা তীব্র দমকা বাতাস তাকে মাটিতে ফেলে দিল। এলাকাটা এত ধূলিময় হয়ে পড়েছিল, যে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তার সামনে একটা বিশাল সাদা ঘোড়া, ভয় জাগানিয়া চিৎকার করছে।
ধুলার অন্ধকার কেটে গেলে ছেলেটা যা দেখল, তাতে কেঁপে উঠল। পুরো কালো পোশাক পরা এক অশ্বারোহী তার সামনে, কাঁধে একটা বাজ। চোখ দুটি ছাড়া চেহারাসহ পুরো শরীর ঢাকা পাগড়িতে। তিনি জিনের পাশ থেকে সুতীক্ষè ধারালো, বিশাল একটা শমশের বের করলেন। চাঁদের আলোতে তরবারিটা চমকাচ্ছিল।
‘কে বাজ দুটির দিকে তাকানোর সাহস করেছিল?’ লোকটি তাকে ধমক দিয়ে বললেন। তার ধমকে এত জোর ছিল, মনে হলো আল-ফেয়ুম মরূদ্যানের পঞ্চাশ হাজার খেজুর গাছে তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
‘আমি,’ ছেলেটার জবাব।
আগন্তুক তার তরবারি একটু নামালেন। সেটা ছেলেটার কপাল স্পর্শ করল। এক ফোঁটা রক্তও বের হলো।
অশ্বারোহী পুরোপুরি নিশ্চল, ছেলেটাও। ছেলেটা পালানোর কোনো চেষ্টা করল না। তার মধ্যে আনন্দের একটা ঢেউ খেলে গেল।
‘তুমি কেন পাখি দুটির যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে গেলে?’
‘পাখি দুটি যা বলতে চেয়েছিল, আমি কেবল তা-ই পড়েছি, তারা মরূদ্যানটিকে রক্ষা করতে চেয়েছিল।’
তিনি আবার বললেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছা বদলতে কে পারে?’
‘আল্লাহই সেনাবাহিনী সৃষ্টি করেছেন, তিনি বাজপাখিও সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ আমাকে পাখিদের ভাষা শিখিয়েছেন। সবকিছুই একই হাতে লেখা।’ ছেলেটা জবাব দিল। সে কথাগুলো শিখেছিল তার উটচালকের কাছে।
আগন্তুক তরবারি নামালেন। ছেলেটা বেশ স্বস্তি পেল। তবে তখনো সে পালানোর কথা ভাবেনি।
মনে হলো ছেলেটার কথার ধরনে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি জানতে চাইলেন, সে কেন এখানে এসেছে।
‘আমি এসেছি নিয়তির টানে।’ ছেলেটা বলল।
‘আমি তোমার সাহস পরীক্ষা করছিলাম,’ আগন্তুক বললেন। ‘পৃথিবীর ভাষা বোঝার জন্য সাহসের খুবই প্রয়োজন।’
ছেলেটা অবাক হলো।
‘কখনো দম হারাবে না, এমনকি লক্ষ্যের একেবারে কাছে গিয়েও,’ তিনি বলতে থাকলেন। ‘মরুভূমিকে অবশ্যই ভালোবাসবে। কিন্তু তাকে কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করবে না। কারণ মরুভূমি সবাইকে পরীক্ষা করে। এটা প্রতিটি পদক্ষেপে বদলায়। একটু অমনোযোগী কেউ হলেই সে তাকে মেরে ফেলে।’
‘কাল যদি শত্রুরা এখানে আসে, আর তখনো যদি তোমার ঘাড়ে মাথাটা থাকে, তবে আমাকে খুঁজে বের করো,’ আগন্তুক বললেন।
তারপর ঘোড়া ছোটালেন।
‘আপনি কোথায় থাকেন,’ ছেলেটা চিৎকার করে বলল। ঘোড়সওয়ার তখন ছুটছেন। তিনি দক্ষিণ দিকে ইঙ্গিত করলেন কেবল।
আল কেমিস্টের সাথে দেখা হলো ছেলেটির।

পরদিন সকালে অস্ত্র হাতে নিয়ে দুই হাজার লোক পুরো আল-ফেয়ুম মরূদ্যানে শত্রুর অপেক্ষায় থাকল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সূর্য মধ্য আকাশে ওঠার আগ দিয়ে অনেক দূরে পাঁচ গোত্রীয় লোক দেখা গেল। অশ্বারোহী সৈন্যরা মরূদ্যানে ঢুকল উত্তর দিক থেকে, মনে হলে তারা শান্তিপূর্ণ মিশনে বের হয়েছে। তবে তাদের সবার পোশাকের নিচে অস্ত্র লুকানো ছিল। তারা আল-ফেয়ুম মরূদ্যানের সর্দারের সাদা তাঁবুতে ঢুকেই তাদের তরবারি আর রাইফেল বের করল। তারা ফাঁকা তাঁবুতে আক্রমণ চালালো।
মরূদ্যানের লোকজন মরুভূমি থেকে আসা অশ্বারোহীদের ঘিরে ফেললো। শিশুদের খেজুর গাছের আড়ালে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। কী ঘটছিল, তারা বুঝতে পারছিল না। নারীরা তাদের তাঁবুতেই ছিল। তারা তাদের স্বামীদের সুরক্ষার জন্য দোয়া-দরুদ পড়ছিল। তারাও যুদ্ধ দেখল না। মাটিতে লাশ না পড়া পর্যন্ত দিনটা অন্য সব দিনের মতোই মনে হচ্ছিল। অশ্বারোহী সৈন্যদের একমাত্র কমান্ডারকেই হত্যা থেকে রক্ষা করা হলো। ওই বিকেলে তাকে সর্দারের সামনে হাজির করা হলো। কেন সে মরুভূমির ঐতিহ্য লঙ্ঘন করে আক্রমণ করেছে জিজ্ঞাসা করা হলো। সে বলল, অনেক দিন যুদ্ধ করে করে তারা ক্ষুধা আর পিপাসায় ধুঁকছিল। আবার যাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারে, সেজন্যই এই আক্রমণ।
সর্দার তাদের দুর্দশার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু মরুভূমির ঐতিহ্য লঙ্ঘনের জন্য তাকে অবমাননাকরভাবে হত্যা করার হুকুম দিলেন।
এবার সর্দার এবং মরূদ্যানের অন্য মুরব্বিরা ছেলেটিকে মোবারকবাদ জানালেন আগাম হুঁশিয়ারি দেওয়ার জন্য। তারা তাকে পঞ্চাশটি স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। সর্দার তাকে তার উপদেষ্টা পদেও নিয়োগ করলেন।

সূর্য ডোবার পর ছেলেটি দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করল আল কেমিস্টের ডেরায়। আল কেমিস্ট তার কথা শুনলেন। তারপর অপেক্ষায় না থেকে পিরামিডের দিকে রওনা হতে বললেন। তিনি সাথে যাবেন বললেন।
‘কাল, তুমি তোমার উটটি বিক্রি করে একটা ঘোড়া কিনবে। উট আসলে প্রতারক। তারা হাজার হাজার কদম এগিয়ে যায়, মনে হয় তারা কখনোই ক্লান্ত হবে না। কিন্তু হঠাৎ একসময় হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে, মারা যায়। ঘোড়ারা ক্লান্ত হয় ধীরে ধীরে। তারা কত দূর যেতে পারবে, জানা যায়। হঠাৎ করে মারা যায় না।’
পরের রাতে ছেলেটা একটা ঘোড়া নিয়ে আল কেমিস্টের ডেরায় হাজির হলো। আল কেমিস্টও প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। তিনি তার শিকারি বাজ নিয়ে চলতে শুরু করলেন। শুরু আরেক নাটকীয়, রোমাঞ্চকর, শিহরণ জাগানিয়া সফর। কখনো প্রাণের সন্ধানে বিষধর গোখড়ার গর্তে হাত প্রবেশ করা, কখনো চুপিসারে ডাকাত বেদুইনদের পাশ কাটিয়ে চলা। একবার তো এক বেদুইন দল তাদের সবকিছু কেড়ে নিল। তাদের বন্দি করে নির্যাতন করা হয়েছিল। বিস্ময়কর ক্ষমতা করায়ত্ত করে তারা মুক্তি পেয়েছিল। নিজেকে শক্তিমান করার, প্রকৃতিকে নিজের কথায় চলার মতো শক্তি ছেলেটি অর্জন করতে পেরেছিল। তার কথায়, সাইমুমের তান্ডব বইয়ে দেওয়ায় মুগ্ধ হয়েছিল এক মরু সেনাপতি।
‘কী হতো, যদি আমি মরূদ্যানেই থেকে যেতাম,’ চলার পথে একবার ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেছিল আল কেমিস্টকে।
‘কী হতো বলছি। তুমি হতে মরূদ্যানের উপদেষ্টা। অনেক ভেড়া আর অনেক উট কেনার মতো অর্থ তোমার থাকত। তুমি ফাতিমাকে বিয়ে করতে, তোমরা দুজনেই এক বছর সুখী থাকতে। তুমি মরুভূমিকে ভালোবাসতে শিখতে। পঞ্চাশ হাজার খেজুর গাছের প্রতিটিকে চিনতে। সেগুলোর বাড়তে থাকা তুমি লক্ষ্য করতে, ঠিক যেভাবে পৃথিবী সবসময় বদলায়। আর তুমি শুভ লক্ষণ, অশুভ লক্ষণ নিয়ে আরো অনেক জানতে। কারণ মরুভূমি হলো সেরা শিক্ষক।

‘দ্বিতীয় বছরের কোনো একসময় তোমার গুপ্তধনের কথা মনে পড়ত। শুভ লক্ষণ বারবার তোমাকে বলত সেগুলোর সন্ধান করতে, তুমি অগ্রাহ্য করতে থাকতে। তুমি তোমার জ্ঞান ব্যয় করতে মরূদ্যান আর সেখানকার বাসিন্দাদের কল্যাণে। লোকজন তোমাকে পছন্দ করত, ভালোবাসত। তোমার উটগুলো তোমাকে সম্পদ আর ক্ষমতা এনে দিত।

‘তৃতীয় বছরেও তুমি গুপ্তধন খোঁজার কথা মনে করতে। তুমি রাতের পর রাত মরূদ্যানে হেঁটে বেড়াতে। ফাতেমা অসুখী হতো, তার মনে হতো, তার জন্যই তুমি গুপ্তধনের সন্ধানে বের হতে পারোনি। কিন্তু তুমি তাকে ভালোবাসতে। সে-ও প্রতিদানে তোমাকে ভালোবাসা দিত। তোমার মনে পড়তো, সে তোমাকে থেকে যেতে বলেনি। কারণ মরুভূমির নারী জানে, তাকে তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ফলে তুমি তাকে দোষ দিতে পারো না। কিন্তু মাঝে মাঝে তুমি বালু আর মরুভূমির ওপর দিয়ে ছোটাছুটি করতে। তোমার হয়তো মনে হতো, তুমি যদি চলে যেতে, তবেই ফাতিমা তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসত। তখনো গুপ্তধন খুঁজতে যাওয়ার তাগিদ আসতো।

‘তারপর চতুর্থ বছরে তাগিদ আসা বন্ধ হয়ে যেত, কারণ তুমি তো ওই প্রেরণা কাজে পরিণত করোনি। বিষয়টা সর্দার লক্ষ্য করতেন। তিনি তোমাকে উপদেষ্টার পদ থেকে বরখাস্ত করতেন। তবে তত দিনে তুমি ধনী বণিকে পরিণত হয়েছ। বিশাল তোমার ব্যবসা, অনেক তোমার উট। কিন্তু বাকি জীবনে তোমার কেবল মনে হবে, তুমি তোমার লক্ষ্যপানে ছুটে চলোনি।
‘তখন হয়তো মনে হবে চলার জন্য। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

[চলবে]

SHARE

Leave a Reply