Home দেশ-মহাদেশ মরুভূমি ও তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া -মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

মরুভূমি ও তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া -মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

লিবিয়া বহুলাংশে মরুভূমি ও তেল-সমৃদ্ধ দেশ। দেশটি নিকট অতীতে শক্তিশালী বিপ্লবী নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের জন্য সুপরিচিত ছিল। লিবিয়া একটি আরব দেশ এবং আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে এর অবস্থান। দেশটির উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে মিসর, দক্ষিণ-পূর্বে সুদান, দক্ষিণে নাইজার ও শাদ, পশ্চিমে আলজেরিয়া এবং উত্তর-পশ্চিমে তিউনিসিয়া। লিবিয়ার ঐতিহ্যবাহী তিনটি অঞ্চল হলো ত্রিপোলিতানিয়া, ফেজ্জান ও সাইরেনাইকা।

লিবিয়া আফ্রিকার চতুর্থ বৃহত্তম দেশ এবং বিশ্বের ১৬তম বৃহত্তম দেশ। প্রমাণিত তেল মজুদের দিক দিয়ে বিশ্বে লিবিয়ার অবস্থান দশম। লিবিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী ত্রিপোলি দেশের পশ্চিম অংশে এবং অপর বৃহত্তম নগরী বেনগাজি পূর্ব অংশে অবস্থিত। দেশটির সরকারি ভাষা আরবি। মুদ্রার নাম লিবীয় দিনার।
লিবিয়ার মোট ভূমির শতকরা ৯০ ভাগ সাহারা মরুভূমি, বাকি ১০ ভাগ লিবীয় মরুভূমি। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত লিবিয়া ছিল একটি গরিব দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদ খুব কম থাকার কারণেই লিবিয়া তখন গরিব ছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালে তেল আবিষ্কারের ফলে দেশটি অপ্রত্যাশিত পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। তেলের আয় দিয়ে লিবিয়ায় কৃষি ভূমির উন্নয়ন এবং অন্যান্য পন্থায় জনগণের কল্যাণ সাধন করা হয়।
লিবিয়ার আয়তন ১৭ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪১ বর্গ কিলোমিটার (৬ লাখ ৭৯ হাজার ৩৮৩ বর্গ মাইল)। জনসংখ্যা ৬৪ লাখ ১১ হাজার ৭৭৬ জন। জনগণের শতকরা ৯৭ ভাগ মুসলিম। জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে বারবার ও আরব শতকরা ৯৭ ভাগ। অবশিষ্টদের মধ্যে আছে গ্রিক, মালটিজ, ইতালীয়, মিসরীয়, পাকিস্তানি, তুর্কি, ভারতীয় ও তিউনিসীয়। লিবিয়া উত্তর-দক্ষিণে চওড়ায় ৯৩০ মাইল এবং পূর্ব পশ্চিমে লম্বায় ১ হাজার ৫০ মাইল। উপকূল রেখা ১ হাজার ৪৭ মাইল।
লিবীয় জনগণের জীবনধারায় দেশের বিশাল শুষ্ক এলাকা এবং পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যকার ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পার্থক্যের প্রভাব রয়েছে। তবে তেল আবিষ্কারের ফলে জনগণের জীবনধারা বহুলাংশে বদলে গেছে।
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে বেশির ভাগ মানুষ আরবিতে কথা বলে এবং ইসলাম অনুসরণ করে। অন্যান্য এলাকার প্রায় সবাই আরব বংশোদ্ভূত, অনেকে আবার মিশ্র আরব ও বারবার।
জনগণের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের কাছাকাছি বসবাস করে এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ উত্তর-পূর্ব উপকূলের কাছে বাস করে। কিছু কিছু লিবীয় মরূদ্যানে বাস করে। অন্যান্যরা বেদুইন, তারা চারণভূমির সন্ধানে তাদের মেষ, ছাগল ও উট নিয়ে স্থান বদল করে।
তেল আবিষ্কারের আগে বেশির ভাগ লিবীয় পল্লী এলাকায় কৃষক ও পশুপালক হিসেবে কাজ করতো। বর্তমানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লিবীয় শহরে বাস করে এবং তারা শহুরে চাকরিতে নিয়োজিত। পল্লী এলাকায় বসবাসকারী যেসব লোক সমাজের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতো, তারা এখন ইউরোপীয় স্টাইলের পোশাক পরে।
বর্তমানে প্রায় সকল লিবীয় শিশু স্কুলে যায়। লিবিয়ার মোট জনসংখ্যার সাক্ষরতার হার শতকরা ৮২.৬ ভাগ। পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৯২.৪ ভাগ এবং নারীদের ৭২ ভাগ।
লিবিয়ার সবচেয়ে উর্বর এলাকাগুলো হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উচ্চভূমি। রাজধানী ত্রিপোলি উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। বেনগাজি উত্তর-পূর্বের প্রধান শহর। লিবিয়ার বাদবাকি এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশাল সাহারা মরুভূমি। সেখানে মরুঝড়ে বালিরাশি সদা চলমান। তবে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বে আল-কুফরাহে একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ হ্রদ রয়েছে। সেখান থেকে এক বিরাট এলাকার কৃষিভূমিতে পর্যাপ্ত পানি জোগান দেয়া হয়। উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে ওঠানামা করে। সাগরের বায়ু সমৃদ্ধ নি¤œ তাপমাত্রা বয়ে আনে, কিন্তু দক্ষিণের গরম বায়ু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠিয়ে দেয়। উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব লিবিয়ায় বছরে ২০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়।
লিবিয়ার অবশিষ্ট অংশে মরু আবহাওয়া বিরাজ করে। সেখানে দিনে গরম, রাতে ঠান্ডা এবং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে। লিবিয়ায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৯২২ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
লিবিয়ার প্রধান প্রধান কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে বার্লি, টক ফল, খেজুর, জলপাই, বাদাম, টমেটো ও গম।
ব্রোঞ্জ যুগের শেষ দিক থেকে লিবিয়ায় বারবাররা বসবাস করে আসছিল। ফিনিশিয়ানরা পশ্চিম লিবিয়ায় বাণিজ্যিক ঘাঁটি স্থাপন করে এবং প্রাচীন গ্রিক উপনিবেশবাদীরা পূর্ব লিবিয়ায় নগর-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। লিবিয়া রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হওয়ার আগে কার্থাজিনিয়ান, পার্সিয়ান, মিসরীয় ও গ্রিকরা লিবিয়া শাসন করে।
লিবিয়া এককালে খ্রিষ্টধর্মের অন্যতম আদি কেন্দ্র ছিল। পাশ্চাত্যের রোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর লিবিয়া অঞ্চল সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বর্বরদের দখলে ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে আরব বিজয়ে এই অঞ্চলে ইসলামের আগমনে বর্বরতার অবসান ঘটে। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনিশ সা¤্রাজ্য এবং সেন্ট জনের নাইটরা ত্রিপোলি দখল করে। ১৫৫১ সালে এই অঞ্চলে উসমানীয় শাসন শুরু হয়। উসমানীয় শাসন ইতালির লিবিয়া দখলের আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, ইতালি সাময়িক সময়ের জন্য ১৯১১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালিয়ান লিবিয়া উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে উত্তর আফ্রিকান অভিযানে লিবিয়া গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এলাকা ছিল। লিবিয়া ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ ও ফরাসি কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৬৯ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে বাদশাহ ইদরিস ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর দ্রুত সামাজিক সংস্কার শুরু হয়। এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে তার নিজ হাতে ক্ষমতা পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হন। ২০১১ সালে পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তক্ষেপের সহায়তায় লিবিয়ায় সশস্ত্র বিদ্রোহ হয় এবং তাতে মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। সেই থেকে লিবিয়া ক্ষমতার শূন্যতা এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
বর্তমানে কমপক্ষে দুটি রাজনৈতিক সংস্থা লিবিয়ার সরকার বলে দাবি করছে। কাউন্সিল অব ডেপুটিজ বা প্রতিনিধি পরিষদ বৈধ সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, কিন্তু রাজধানী ত্রিপোলির ওপর এই সংস্থার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা ত্রিপোলির পরিবর্তে তবরুকের সাইরেনাইকা নগরীতে বৈঠক করে থাকে। অপরদিকে ২০১৪ সালের জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস ২০১২ সালের লিবিয়ান জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস নির্বাচনে নির্বাচিত জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেসের বৈধ ধারাবাহিকতা হিসেবে দাবি করে আসছে। উল্লেখ্য, জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ভেঙে দেয়া হয়, কিন্তু তখনই এর সংখ্যালঘু সদস্যরা পুনরায় সংগঠিত হয়। লিবিয়া ডন ও জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ত্রিপোলির সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের নভেম্বরে তবরুক সরকারকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার ঐ ঘোষণা সহিংসতার হুমকির মধ্যে দেয়া হয়েছে বলে তা প্রত্যাখ্যান করে।
লিবিয়ার বহু অংশ এই দুই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিভিন্ন ইসলামপন্থী, বিদ্রোহী ও উপজাতীয় মিলিশিয়ারা বেশ কতকগুলো নগরী ও এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। জাতিসংঘ তবরুক ও ত্রিপোলি ভিত্তিক উপদলগুলোর মধ্যে শান্তি আলোচনার আয়োজন করছে। একীভূত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে একটি চুক্তি ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছে। ঐ চুক্তির শর্ত মোতাবেক নয় সদস্যের প্রেসিডেন্সি কাউন্সিল এবং ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা হবে এবং এর দু’বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় ঐক্য সরকার নামক নতুন সরকারের নেতৃবৃন্দ ২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল ত্রিপোলি পৌঁছেছে। এরপর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের একটি জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) নতুন জাতীয় ঐক্য সরকারকে (জিএনএ) সমর্থন দিতে ভেঙে দেয়া হয়েছে। হ

SHARE

Leave a Reply