ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র পশ্চিম এশিয়ার একটি আরব দেশ। দেশটি এককালে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার সংযোগস্থল ছিল। আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে দক্ষিণ আরবজুড়ে দেশটির অবস্থান। ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। আয়তন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৭০ বর্গ কিলোমিটার (২ লাখ ৩ হাজার ৮৫০ বর্গ মাইল)। জনসংখ্যা ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯২ হাজার ৭৭৯ জন। জাতিগতভাবে জনসংখ্যার প্রায় সবাই আরব, তবে অল্প সংখ্যক আফ্রো-আরব, দক্ষিণ এশীয় ও ইউরোপীয় রয়েছে। জনসংখ্যার ৯৯.১ শতাংশ মুসলিম। এদের মধ্যে ৬৫ ভাগ সুন্নি এবং ৩৫ ভাগ শিয়া। বাকি শূন্য দশমিক ৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ইহুদি, হিন্দু ও খ্রিষ্টান। ইয়েমেনের সরকারি ভাষা আরবি। মুদ্রার নাম ইয়েমেনি রিয়াল।
ইয়েমেনের উপকূল রেখা প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার (১২০০ মাইল)। ইয়েমেনের সীমান্তে রয়েছে উত্তরে সৌদি আরব, পশ্চিমে লোহিত সাগর, দক্ষিণে এডেন উপসাগর ও আরব সাগর এবং পূর্ব-উত্তর পূর্বে ওমান। ইয়েমেনের প্রশাসনিক এলাকা ছয়টি অঞ্চল (৪টি উত্তর ইয়েমেনে ও দুটি দক্ষিণ ইয়েমেনে), ২২টি গভর্নরেট ও ৩৩৩টি জেলায় বিভক্ত। সাংবিধানিকভাবে ইয়েমেনের রাজধানী সানা নগরী বলা হলেও নগরীটি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ কারণে ইয়েমেনের রাজধানী সাময়িকভাবে দক্ষিণ উপকূলের বন্দর নগরী এডেনে স্থানান্তর করা হয়েছে। ইয়েমেনের ভূখন্ডে প্রায় ২০০টি দ্বীপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এগুলোর মধ্যে আরব সাগরের সোকোত্রা দ্বীপটি বৃহত্তম। লোহিত সাগরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দ্বীপ হলো হানিশ দ্বীপপুঞ্জ, কামারান ও পেরিম। দ্বীপগুলোর বেশ কয়েকটি আবার আগ্নেয়গিরি। এগুলোর মধ্যে জাবাল আল তাইরে সর্বশেষ ২০০৭ সালে অগ্ন্যুৎদগিরণ ঘটে।
ইয়েমেনকে ভৌগোলিক ভাবে চারটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করা যায় : পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমি, পশ্চিমাঞ্চলীয় উচ্চভূমি, পূর্বাঞ্চলীয় উচ্চভূমি ও পূর্বের রাব আল খালি।
ইয়েমেনের গোটা লোহিত সাগর উপকূল রেখা বরাবর তিহামাহ (তপ্তভূমি) খুবই অনুর্বর ও সমতল উপকূলীয় ভূমি গঠন করেছে। শুষ্কতা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি উপহ্রদের উপস্থিতিতে এলাকাটি বহুলাংশে জলাভূমি হয়ে আছে। তাছাড়া এখানে বিস্তৃত অর্ধচন্দ্রাকৃতির বালিয়াড়ির উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। তিহামায় বাষ্পীভবন এতই বেশি যে, উচ্চভূমি থেকে নেমে আসা পানির স্রোতধারা কখনই সাগরে পৌঁছায় না। তবে এগুলো মাটির মধ্যে পানির মজুদ রক্ষায় অবদান রাখে। আজকাল এই পানি কৃষিতে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। সানার ৫০ কিলোমিটার উত্তরে মাদার গ্রামে ডায়নোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা হয় এলাকাটি এককালে কর্দমাক্ত সমতল ভূমি ছিল।
তিহামাহ পশ্চিম উচ্চভূমির ঢালে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে। এই এলাকায় বছরে একশ’ মিলিমিটার থেকে এক হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে এখানে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হয়। এখানে দিনের বেলা গরম তবে রাতে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে নেমে যায়।
মধ্যাঞ্চলীয় উচ্চভূমি একটি বিস্তৃত উঁচু উপত্যকা যার উচ্চতা ২ হাজার মিটার। এই এলাকা পশ্চিম উচ্চভূমির চেয়ে বেশি শুষ্ক। তবে বর্ষাপ্রবণ বছরগুলোতে এখানে ব্যাপক চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়। পানি ঘাটতি হলে এখানে সেচ দিয়ে গম ও বার্লি উৎপাদন করা হয়। সানা এই এলাকায় অবস্থিত। ইয়েমেনের সর্বোচ্চ স্থান জাবাল আন নবী শুয়াইব যার উচ্চতা ৩ হাজার ৬৬৬ মিটার। পূর্বে রাব আল খালি মরুভূমির ইয়েমেনি অংশ বেশ নিচু এবং এখানে প্রায় কোন বৃষ্টিপাতই হয় না। উট চরানো বেদুইনরাই এখানকার একমাত্র বাসিন্দা।
ইয়েমেনের উদ্ভিদ জগৎ খুবই বৈচিত্র্যময়। এখানকার উদ্ভিদ জগতে গ্রীষ্মম-লীয় আফ্রিকান, সুদানি উদ্ভিদ ভৌগোলিক অঞ্চল এবং সাহারো-আরবীয় অঞ্চলের গাছপালার একটা সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমাঞ্চলীয় পর্বতমালা এবং উচ্চ সমভূমিগুলোর একাংশে সুদানি প্রাধান্য রয়েছে, কেননা এই অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। সাহারো-আরবীয় গাছপালার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় উপকূলীয় সমভূমি, পূর্বাঞ্চলীয় পর্বত এবং পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলীয় মরু সমভূমিতে। ইয়েমেনি গাছপালার একটা বিরাট অংশ সুদানী অঞ্চলের গ্রীষ্মম-লীয় আফ্রিকান গাছপালার মতো।
ইয়েমেন এককালে সাবিয়ানদের (বাইবেল অনুযায়ী শেবা) আবাসভূমি ও বাণিজ্যিক রাষ্ট্র ছিল। রাষ্ট্রটি এক হাজার বছর ধরে সুনামের সাথে টিকেছিল। সে সময় সম্ভবত আধুনিক কালের ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার বহু অংশ এই রাষ্ট্রের অংশ ছিল। ২৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চল ইহুদি-প্রভাবিত হিমিয়ারা রাজ্যের শাসনাধীনে চলে যায়। চতুর্থ শতাব্দীতে এখানে খ্রিষ্টধর্ম পৌঁছে। এখানে তখন আগে থেকেই ইহুদি ধর্ম ও স্থানীয় পৌত্তলিকতা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে দ্রুত ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করে এবং ইয়েমেনি সৈন্যরা ইসলামের প্রাথমিক বিজয়ের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নবম শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইয়েমেনে বেশ কয়েকটি রাজবংশের আবির্ভাব ঘটে, সেগুলোর মধ্যে রাসূল রাজবংশ ছিল সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সমৃদ্ধশালী। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দেশটি উসমানীয় ও ব্রিটিশ সাম্রারাজ্যের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর উত্তর ইয়েমেনে ইয়েমেন জাইদি মুতাওয়াক্কিল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯৬২ সালে ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র সৃষ্টি করা হয়। দক্ষিণ ইয়েমেন ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এডেন আশ্রিত রাজ্য নামে ব্রিটিশ আশ্রয়ে থেকে যায়। ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেনি রাষ্ট্র একীভূত হয়ে আধুনিক ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র গঠন করে।
ইয়েমেন একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরিব দেশ। দেশটিতে ২০১১ সালে আরব বসন্ত বা গণজাগরণের পর থেকে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং প্রেসিডেন্ট সালেহের সংবিধান সংশোধন পরিকল্পনা এবং তার আজীবনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বাতিলের প্রতিবাদে রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এই সংকট শুরু হয়। অতঃপর, চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট সালেহ পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বুহ মনসুর হাদির কাছে হস্তান্তর করা হয়। হাদি ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একক প্রার্থীর নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কিন্তু শিয়া মতাবলম্বী হুথি, আলকায়দা ও আল ইসলাহের মধ্যে সংঘাতের কারণে ক্ষমতার উত্তরণপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হুথিরা সানা দখল করে এবং পরে তারা এক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নিজেদেরকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার ঘোষণা দেয়। এরপর সৌদি আরব ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে কিন্তু তাতে গৃহযুদ্ধ থামেনি। হ