“ওরে রাক্ষুসী! তোর খিদা মিটব কবে?” দাঁড় টানতে টানতে বলে ওঠে হারান মাঝি। না, এ ভর্ৎসনাভরা কথাগুলো কোনো মানবীর উদ্দেশে নয়। বরং বিপুলা পদ্মার উদ্দেশে। কিন্তু এ তীব্র বাক্যবাণ পদ্মা নদীর বুকে সামান্য আঁচড় কাটেনি, কাটবেও না। সে কথা হারান মাঝিও জানে। তবুও সে মাঝে মাঝেই এ তিরস্কারের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।
বিয়াল্লিশ বছর জীবনের সমস্তটাই হারান মাঝি কাটিয়েছে পদ্মার বুকে। নদীর সাথে আজন্ম পরিচয় তার। কিন্তু সে এ নদীর বুকেই হারিয়েছে তার সবকিছু। একটা রাত! মাত্র একটা রাতের মধ্যেই পদ্মা গ্রাস করে নিয়েছে তার সামান্য জমি আর পুরো পরিবারটাকে। কিন্তু খেয়ালি পদ্মা রেহাই দিয়েছিল তার ছোট ছেলেটাকে। না জানি বিধাতা কোন পরিহাসের জন্য এই ছোট্ট শিশুটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
সবকিছু হারিয়ে হারান মাঝি আঁকড়ে ধরে ছেলেটাকে। তাকে ঘিরেই সে তার স্বপ্ন গড়ে তোলে। নিজ হাতে ছেলেটাকে সে নৌকা বাইতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে ক্রুদ্ধ পদ্মার বিরুদ্ধে যুঝতে। প্রবল ঝড়ে যখন সব নৌকা কূলে চলে যায়, প্রমত্তা পদ্মার বুকে তখন ঠুনকো নৌকাটা নিয়ে ভেসে থাকে হারান মাঝি। তখন বাপ-বেটা হয়ে ওঠে নদীর সম্রাট। দু’জনের কাছে এ ঝড় ভয়ঙ্কর নয়, উপভোগ্য। বিরাট বিরাট ঢেউয়ের সাথে ক্রমাগত লড়াই করে দু’জনে।
আজ আকাশটা বিকাল থেকেই বড্ড গম্ভীর হয়ে আছে। অতি শান্ত হয়ে আছে পদ্মা। আকাশটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় হারান মাঝি। তারপর বিড় বিড় করে বলে, “থম মাইরা আছে আকাশডা। মনে হয় খেইপ্যা উটব রাক্ষুসী।” কথাটার ইঙ্গিতটা বুঝে যায় পাশে দাঁড়ানো রসুল। বলে, “তাইলে নাও খুলতিছি বাজান।”
হারান ঘাড় নাড়ে। কিছুক্ষণ পর নৌকা নিয়ে নদীর বুকে নামে বাপ-ছেলে। ততক্ষণে বাতাসের বেগটাও বেড়ে গেছে। হারান মাঝি শক্ত হাতে হাল ধরে। বেপরোয়া চোখে বড় বড় ঢেউগুলোর দিকে তাকায় রসুল। তার এ অদম্য, বেপরোয়া চাহনিতে খুশি হয় হারান মাঝি। পদ্মা পাড়ের সন্তান তো এমনই হবে; নির্ভীক, অকুতোভয়।
পদ্মার সর্বগ্রাসী রূপটার দিকে তাকিয়ে থাকে হারান মাঝি। নিজের অজান্তেই বলে ওঠে সে, “ওরে রাক্ষুসী! তোর খিদা মিটব কবে?”
ততক্ষণে হাওয়া অনেক বেড়েছে। বেড়েছে ঢেউয়ের উচ্চতা। মাতাল হয়ে উঠেছে পদ্মা। শক্ত হাতে হাল ধরে হারান মাঝি। আর নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ঝড়ের অপরূপ নির্মমতাকে উপভোগ করে রসুল। দু’হাত দুইদিকে ছড়িয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। যেন ক্রুদ্ধ পদ্মার উদ্দেশে বলতে চায়, দেখ রাক্ষুসী! দেখ! আমি তোকে পরোয়া করি না।
ঢেউয়ের উচ্চতা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে নৌকার ওপর। তখন পানি সেচে ফেলছে রসুল। হঠাৎ বড় একটা ঢেউ আছড়ে পড়ে নৌকাটার ওপর। সাথে সাথে আরেকটা ঢেউ আক্রমণ করে নৌকাটাকে। মোচার খোলার মতো নৌকাটা ঢেউয়ের তোড়ে উল্টে যায়।
হারান মাঝি প্রবল বাতাস ছাপিয়ে চিৎকার করে ছেলের উদ্দেশে, “বাজান! নৌকার থাকি দূরি সার যাবিনি কিন্তু।”
কয়েক হাত দূরে ভেসে থাকা রসুল মাথা নাড়ে। দু’জনে মিলে নৌকাটা সোজা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তখনই একটা ঢেউয়ের পাহাড় ভেঙে পড়ল ওদের ওপর। আবার নৌকাটা উল্টে গেল। হারান মাঝি পাগলের মতো আঁকড়ে ধরল নৌকাটাকে। উন্মত্ত নদীর বুকে অসহায়ভাবে ভেসে আছে সে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো রসুলের দিকে। কিন্তু কোথায় ও? কিছুক্ষণ আগেই তো ও ভেসে ছিল সামান্য দূরে। কিন্তু এখন আর ওকে দেখা যাচ্ছে না। উন্মাদের মতো চারদিকে তাকায় হারান মাঝি। দু’চোখ ভরা আশা নিয়ে খুঁজতে থাকে ছেলেকে। কিন্তু কোথাও দেখা যায় না রসুলকে।
আস্তে আস্তে ঝড়টা কমে আসে। ক্রুদ্ধ নদীবক্ষ ধীরে ধীরে শান্ত হয়। পুব আকাশে দেখা দেয় সোনালি আভা। ঝড়ের পর প্রকৃতি অনেক শান্ত, সৌম্য।
একটা নৌকার মাঝি হারানকে দেখে তুলে নেয় তার নৌকায়। কিন্তু হারান মাঝির ব্যস্ত দু’টি চোখ ঘুরে বেড়ায় নদীর বুকে। থেকে থেকে বুকফাটা চিৎকার করে সে, “রসুল! বাজান আমার! রসুল!”
কিন্তু এ অসহায় ডাক পৌঁছায় না পদ্মার অতল উদরে ঠাঁই নেয়া রসুলের কাছে।