Home প্রচ্ছদ রচনা ঈদুল আজহা ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়–ক সকল ঘরে -হারুন...

ঈদুল আজহা ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়–ক সকল ঘরে -হারুন ইবনে শাহাদাত

ঈদের খুশি ছোট বড় সবার জন্য। সবাই মিলে এই দিন হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে খুশিতে মেতে উঠি আমরা। ধনী-গরিবের ব্যবধান মুছে ফেলার সওগাত নিয়ে প্রতি বছর দুই দিন আমাদের মাঝে আসে ঈদ। ধনী বিত্তবান মুসলমানদের দায়িত্ব গরিবদেরকে ঈদের আনন্দে শরিক করতে আল্লাহর বিধান অনুসারে তাদেরকে সাহায্য করা। যে সমাজব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকির, উঁচু-নিচু সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে ঈদের খুশি ভাগ করে নিতে পারে না, সেখানে ঈদের আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়। মুসলমানদের মাঝে বিশ্বমানবতার প্রতি ভালোবাসার শক্তিকে শাণিত করতে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে ঈদুল আজহা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-
‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন!
দুর্বল! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি উঠে রণি’ দূর বাণীর, –
আজিকার এ খুন কোরবানির!’     (কোরবানি)
ঈদুল আজহা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের পরীক্ষার দিন। ঈদুল আজহার ঈদ উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে এক কিশোরের আত্মত্যাগের মহান স্মৃতি। সেই মহান আত্মত্যাগী কিশোর কে? তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছো? হঁ্যাঁ, ঠিক বলেছো। তিনি হলেন, মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর পুত্র হজরত ইসমাইল আ:, যাঁর সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘এই কিতাবে ইসমাইলকেও স্মরণ কর। তিনি ছিলেন ওয়াদার সত্যতাবিধানকারী এবং তিনি ছিলেন রাসূল ও নবী।’ ‘তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে সালাত ও জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি স্বীয় পালনকর্তার নিকট পসন্দনীয় ব্যক্তি ছিলেন।’ (সূরা মারিয়াম : ৫৪-৫৫)
আল্লাহর নির্দেশে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ: তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কোরবানি করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পুত্র ইমাইল আ: দ্বিধা ও ভয়হীন চিত্তে খুশি মনে আল্লাহর ইচ্ছা ও পিতার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ধারালো ছুরির নিচে গলা পেতে দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের এমন মহিমা সত্যি তুলনাহীন। পিতা-পুত্র দু’জনই ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং নবী।
ইবরাহিম আ:-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হজরত ইসমাইল আ: ছিলেন মা হাজেরার গর্ভের একমাত্র সন্তান। তাঁর জন্মের সময় হজরত ইবরাহিম আ:-এর বয়স ছিল ৮৬ বছর। ইসমাইল আ: যখন শিশু সেই সময় তাঁকে ও তাঁর মা হাজেরাকে পিতা ইবরাহিম আ: আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় রেখে আসেন। সেই সময় মক্কা ছিলো জনমানবহীন মরুপ্রান্তর। ইবরাহিম আ: দোয়া করেন, তাঁর দোয়ার বরকতে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে জমজম কূপের হৃষ্টি হয়। অতঃপর ইয়েমেনের ব্যবসায়ী কাফেলা বনু জুরহুম গোত্রের লোকেরা মা হাজেরার সম্মতিক্রমে সেখানে চাষাবাদ শুরু করেন। কিছু দিনের মধ্যেই মক্কা হয়ে ওঠে সুজলা-শ্যামলা সমৃদ্ধ জনবহুল নগরী।
হজরত ইসমাইল আ:-এর বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর। তিনি তখন দুরন্ত এক কিশোর। কিন্তু তাঁর সমস্ত দুরন্তপনা বাধা পড়েছিলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আনুগত্য আর মহান পিতা নবী ও রাসূল হজরত ইবরাহিম আ:-এর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বন্ধনে। আল্লাহর নেয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন পিতা-পুত্র দু’জনই। আল্লাহর আদেশে মক্কার অনতিদূরে মিনা প্রান্তর আজও পিতা-পুত্রের ত্যাগ ও কোরবানির ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। প্রতি বছর আল্লাহর মেহমান হাজীরা এই ময়দানে এখনো লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানি করেন। পিতা-পুত্রের ত্যাগের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে আল্লাহ-তায়ালা ঈদুল আজহার দিন সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য গৃহপালিত পশু কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।
ঐতিহাসিক সেই ঘটনা সবার জানা। মিনার ময়দানে বর্ষীয়ান পিতা ইবরাহিম আ: আল্লাহর আদেশে প্রিয় পুত্র ইসমাইল আ:-কে নিজের হাতে কোরবানির সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম আ:-কে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কোরবানির আদেশ করেন। আল্লাহর আদেশের কথা শোনার পর চৌদ্দ বছরের তরুণ ইসমাইল আ: ঈমান ও আত্মত্যাগের যে একমাত্র নমুনা উপস্থাপন করেছেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ না করলে পিতার পক্ষে পুত্র কোরবানির ঘটনা সম্ভব হতো কি না সন্দেহের অবকাশ আছে। কোরবানির ঘটনার সময় হজরত ইসমাইল আ: নবুওয়াত লাভ করেননি। তখন তিনি আল্লাহর প্রিয় নবী ও রাসূল খলিলুল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু) হজরত ইবরাহিম আ:-এর প্রিয়পুত্র। নবীপুত্র ও পরবর্তীতে নবী ইসমাইল আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও দৃঢ় ঈমানের পরিচয় দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে তাঁর সেই দৃঢ়তার কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে- সেই ছেলেটি যখন তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে পৌঁছে, তখন (একদিন) ইবরাহিম তাকে বলল, ‘পুত্র আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বল, তোমার মত কী?’ সে বলল, ‘যা কিছু আপনাকে হুকুম দেয়া হচ্ছে, তা আপনি করুন! আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ শেষে যখন এই দুইজনই আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল এবং ইবরাহিম পুত্রকে ললাটের অভিমুখে শয়ন করিয়ে দিলো এবং আমরা আওয়াজ দিয়ে বললাম, ‘হে ইবরাহিম তুমি তো স্বপ্নকে প্রমাণ করে দেখালে! আমরা সৎ লোকদেরকে এরূপ প্রতিফলই দান করে থাকি। নিঃসন্দেহে ইহা একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষার ব্যাপার ছিলো। আমরা একটি বড় কোরবানির বদলে সেই ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর তার প্রশংসা ও গুণ পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রচলিত রাখলাম। সালাম ইবরাহিমের প্রতি।’ (সূরা সাফফাত : ১০২-১০৯)
হজরত ইবরাহিম আ:-এর সামনে হজরত ইসমাইল আ:-এর বদলে একটি দুম্বাকে কোরবানির জন্য আল্লাহতায়ালা পেশ করেন। হজরত ইসমাইলকে আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করতে উদ্যোগী হওয়ায় আল্লাহতায়ালা তাঁকে আরেক পুত্র ইসহাক আ:-কে দান করার সুসংবাদ দান করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তাকে ইসহাক সম্পর্কেও সুসংবাদ দিলাম।’ (সূরা সাফফাত : ১১২)
ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহতায়ালাকে তাঁর নিয়ামতকে আরো বাড়িয়ে দেন ইসহাক আ:-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন।
অতঃপর কাবা পুনর্নির্মাণকালে পিতা-পুত্র যে দোয়া করেছিলেন তা আল্লাহ কবুল করেন। তার দোয়ার বরকতে প্রথমত, কাবাগৃহে যেমন হাজার হাজার বছর ধরে চলছে তাওয়াফ ও সালাত এবং হজ ও ওমরাহর ইবাদত, তেমনি চলছে ঈমানদার মানুষের ঢল। দ্বিতীয়ত, সেখানে সারা পৃথিবী থেকে সর্বদা আমদানি হচ্ছে ফল-ফলাদির বিপুল সম্ভার। তাঁদের দোয়ার তৃতীয় অংশ মক্কার জনপদে নবী প্রেরণের বিষয়টি বাস্তবায়িত হয় তাঁদের ইন্তেকালের আড়াই হাজার হাজার বছর পরে ইসমাইলের বংশে শেষনবী মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে। ইসমাইল আ: মক্কায় আবাদকারী ইয়েমেনের বনু জুরহুম গোত্রে বিবাহ করেন। তাদেরই একটি শাখা গোত্র কুরাইশ বংশ কাবাগৃহ তত্ত্বাবধানের মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। এই মহান বংশেই শেষনবীর আগমন ঘটে। উল্লেখ্য যে, হজরত ইসমাইল আ: সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ৯টি সূরায় ২৫টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
ইসমাইল সম্পর্কে শেষ নবী ও রাসূল হজরত মোহাম্মদ সা: বলেন, ‘সর্বপ্রথম স্পষ্ট আরবি ভাষা ব্যক্ত করেন ইসমাইল। যখন তিনি ছিলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সের তরুণ।’ এখানে ‘স্পষ্ট আরবি’ অর্থ বিশুদ্ধ আরবি ভাষা এটাই ছিল কুরাইশি ভাষা, যে ভাষায় পরে কুরআন নাজিল হয়।
হজরত ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ:-এর ত্যাগ ও কোরবানির মহান শিক্ষার আলোকে যদি আমরা ঈদুল আজহা উদযাপন করি, তাহলে সবার আগে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কে কত বড় কোরবানির পশু কিনলাম? কয়টা ফ্রিজ ভরতে পারলাম তার মধ্যে কোরবানির আনন্দ ও খুশি বা আল্লাহর সন্তুষ্টি কোনো কিছু নিহিত নেই। আল্লাহতায়ালা চান ঈদের এই দিনে তার বান্দারা সবাই মিলে খুশিতে শামিল হবে। পথের ধারে বসে কোনো শিশু অনাহারের যন্ত্রণায় কাঁদবে না। নতুন জামা, সেমাই, পায়েস, কোরমা-পোলাও ও কোরবানির গোশতে তারও অধিকার আছে। সামর্থ্যবান মুসলমানদেরকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। হজরত ইবরাহিম আ:-এর মতো প্রিয় পুত্রকে কোরবানির মতো বড় কোন পরীক্ষা নয় আত্ম-অহঙ্কার, গর্ব, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভেঙে উঁচু-নিচুর পার্থক্য ভুলে শোষণমুক্ত ইনসাফভিত্তিক সমাজ গড়ার শপথ নেয়ার দিন ঈদুল আজহা। গৃহপালিত পশু কোরবানির সাথে সাথে মনের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে। ঈদের এই খুশির দিনে আমরা কাউকে দূরে সরিয়ে রাখবো না। যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো পাশের এবং কাছের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। সাহায্য, সহযোগিতা, দান খয়রাত করার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো, প্রথমে দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করার। এর একটি বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ভিত্তি আছে। আমরা যদি একটু খেয়াল করে দেখি, তাহলে অতি সহজেই বুঝতে পারবো, সবারই কিছু না কিছু দরিদ্র আত্মীয়স্বজন আছে, আশপাশ পাড়া-প্রতিবেশী তো আছেই। তাই সবাই যদি এই বিধান মতো সহযোগিতার হাত বাড়াই তাহলে ঈদের খুশি থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না। গাঁয়ের ওই কুঁড়েঘর কিংবা শহরের বস্তি, রেলস্টেশন ও রাস্তার পাশের পথশিশুটির কথাও তোমাকে আমাকে ভাবতে হবে। যদি আমরা হজরত ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ:-এর মতো আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চাই তাহলে ঈদের দিনের ঈদুল আজহার এই খুশির বার্তা বছরের প্রতিদিন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবহবান রাখতে পারলেই ঈদের খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়বে সবার ঘরে।

SHARE

Leave a Reply