Home স্মরণ আমাদের প্রিয়কবি নজরুল ইসলাম -ইকবাল কবীর মোহন

আমাদের প্রিয়কবি নজরুল ইসলাম -ইকবাল কবীর মোহন

কবি নজরুল আমাদের সবার কাছে অতি পরিচিত নাম। আমাদের প্রিয় মানুষও তিনি। কাজী নজরুল বাংলার সেরা কবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অসংখ্য কবিতা, ছড়া, গান, গল্প ইত্যাদি রচনা করে তিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন। তার লেখা ছিল অসাধারণ। লেখা ও গানে তিনি এ দেশের মানুষের মন ভরে দিয়েছিলেন। তার গানে ছিল মানুষ জাগার ছন্দ, তার লেখায় ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কবি নজরুল কয়েক সহ¯্র গানের রচয়িতা ও সুরকার। সঙ্গীত রচনার জন্য তিনি অনেকের কাছে ‘বুলবুল কবি’ বলেও খ্যাত ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় ছিল বিদ্রোহের সুর ও বাণী। তবে এই বিদ্রোহ ছিল অন্যায়, অসত্য, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে। তাঁর এই বিদ্রোহী লেখা এ দেশে ইংরেজ শাসনের বিষদাঁত ভেঙে দিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।  কবির আগুনঝরা লেখার জন্য তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার এসব লেখা আজও গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছে প্রেরণার বিষয়। এ কবিকে নিয়ে তাই আমাদের অনেক গর্ব।
উপমহাদেশের মুসলমানদের জাগ্রত করার জন্য নজরুল অসংখ্য ইসলামী গান ও কবিতা লিখেছেন। এ জন্য তাঁকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি বলা হয়। নজরুলের কবিপ্রতিভা ছিল বিচিত্রধর্মী। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গীতিকার, সুরকার, বাদক, গাল্পিক, ঔপনাস্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গায়ক ও অভিনেতা। বাংলাভাষায় তিনিই সার্থক গজল ও কাওয়ালির ¯্রষ্টা।
কবি নজরুল ১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম হাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুল মাত্র ৯ বছর বয়সে ১৯০৮ সালে পিতা ফকির আহমদকে হারান। ফলে তাঁদের সংসারে দেখা দেয় চরম টানাপড়েন। ছোট্ট বালক নজরুলকে তাই কাজে লেগে যেতে হয়। তিনি আর কী কাজ করবেন? মসজিদে মুয়াজ্জিনের চাকরি নিলেন। নামাজের সময় আজান দেয়াই ছিল তার প্রধান কাজ। এ সময় লেখাপড়ায়ও মন দেন তিনি। দশ বছর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
সংসারের অভাব-অনটন নজরুলের পিছু ছাড়েনি। দারিদ্র্যপীড়িত নজরুল তাই মক্তব ছেড়ে ‘লেটো’ যাত্রাদলে যোগ দিয়ে গান করতেন। পরে ‘লেটো’ দল ছেড়ে বর্ধমানের মাথরুন হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখানেও আর্থিক অনটনে লেখাপড়া করতে না পেরে তিনি স্কুল ত্যাগ করেন এবং কবিগানের আখড়ায় যোগ দেন। সেখান থেকে বের হয়ে আসানসোলের এক রুটির দোকানে কিছুদিন চাকরি করেন। সে সময় ১৯১৪ সালে কাজী রফিক উল্লাহ দারোগার সাথে তার পরিচয় ঘটে। দারোগা সাহেব নজরুলকে এনে ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। এখানে তার মন টিকল না। তাই তিনি ফিরে যান নিজ গ্রামে। সেখানে সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। লেখাপড়া আর তেমন এগোয়নি। ১৯১৭ সালে দশম শ্রেণীর প্রি-টেস্ট পরীক্ষাকালে নজরুল সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে পেশোয়ারের নওশেরাতে চলে যান। তিন মাস সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করে কবি করাচি সেনানিবাসে ফিরে আসেন। কর্মদক্ষতার কারণে নজরুল অতি অল্প সময়ে ‘ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার’ পদে উন্নীত হন। ১৯২০ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙে যাবার পর নজরুল সেনাবাহিনী ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। তখন থেকেই তাঁর সত্যিকারের সাহিত্যজীবনের সূচনা ঘটে। তারপর থেকে তাঁর বিচিত্র জীবন শুরু হয়। সে অনেক  দীর্ঘ কাহিনী। বড় হলে তোমরা জানতে পারবে নজরুলের আরো অনেক না জানা ইতিহাস।
নজরুলের আরেক নাম দুখু মিয়া। তাঁর জীবনে অনেক দুঃখ ছিল ঠিকই। কিন্তু এ জন্য তাঁর নাম দুখু মিয়া হয়নি। মা-বাবার দুঃখ ছিল অনেক। তাদের সন্তান হয়ে বাঁচত না। পর পর চার চারটি সন্তান শৈশবেই মারা যায়। তাই মা-বাবার  মনে ছিল অনেক কষ্ট ও অশান্তি। নজরুলের জন্মের পর তাই মা-বাবা তাঁর নাম দেন ‘দুখু মিয়া’। তবে দুখু দুঃখ নিয়েই বেঁচেছিলেন। শুধু তাই নয়। এই দুখু মিয়া এক সময় বিশ্বকেও জয় করেছিলেন। গরিব পিতামাতার ঘরে জন্ম হলে কি হবে, তাঁর জীবনে ছিল অনেক অর্জন। বাংলাসাহিত্যের জগতে তিনি সুখের ঝড় বইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নজরুল তাঁর কথা, সুর, গান ও কবিতায় সকল মানুষের কথা লিখেছেন। তবে তাঁর লেখায় শিশুসাহিত্যের প্রভাব দেখা যায় বেশি। শিশুদের জন্য তাঁর লেখাগুলো অপূর্ব। শিশুদের মনমানসিকতা তাঁর কাছে ছিল বেশ পরিচিত। আর সেটাই জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর ছড়া, গান ও কবিতায়। তাঁর শিশুজীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরা থাকায় তিনি শিশুদের জীবনকে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই শিশুদের খেয়ালিপনা, ভাবালুতা, বাধা-বন্ধনহীনতা ইত্যাদি কবির লেখায় উঠে এসেছে প্রাণবন্ত হয়ে।
শিশুদের জন্য লেখা কিন্তু কম কথা নয়। বড় বড় কবি সাহিত্যিকরাও এ কাজে ছিলেন ব্যর্থ। শিশুদের কথা সহজ, কিন্তু তাদের উপযোগী লেখা অত্যন্ত কঠিন। এ জন্য শিশুদের গভীরভাবে ভালোবাসতে হয়। তাদের মনের ভাব বুঝতে হয়। নজরুল শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আর তাই তিনি শিশু মনের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। শিশুদের জন্য কবির লেখাগুলো পড়লেই যে কেউ এর সত্যতা বুঝতে পারবে। তোমরা নিশ্চয়ই ছোটবেলায় কবির ‘প্রভাতী’ কবিতা পড়েছো। তিনি কী সুন্দর ভাষায় খুকুমণিকে ভোর বেলায় ঘুম থেকে জেগে ওঠার কথা বলেছেন। কবি লিখেছেন,
ভোর হোলো, দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে ঐ ডাকে
জুঁই শাখে ফুল-খুকী ছোট-রে,
খুকুমণি ওঠরে ।
আমাদের এই প্রিয় কবি নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক সময় জীবনের ত্রান্তিলগ্নে পৌঁছান। ১৯২৮ সালে কবি তাঁর মা জাহেদা খাতুনকে হারান। ১৯৩০ সালে কবির দ্বিতীয় পুত্র ‘বুলবুল’ ইন্তেকাল করে। ফলে কবি গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। ১৯৩৯ সালে কবির পতœী প্রমীলা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। ফলে চিন্তায় চিন্তায় কবির স্বাস্থ্যক্ষয় শুরু হয়। অবশেষে ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই থেকে কবি স্তব্ধবাক হয়ে যান। এরপর কবি আর সেরে উঠতে পারেননি। ১৯৭২ সালে কবিকে বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় নিয়ে আসেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রবিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইন্তেকাল করেন। ঐদিন অপরাহ্নে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়।

SHARE

Leave a Reply