Home গল্প গল্পটা আমাদের -শাহাদাৎ সরকার

গল্পটা আমাদের -শাহাদাৎ সরকার

আমার বয়স তখন সাত-আট হবে। স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। রোজ সকালে উঠে মক্তবে গিয়ে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করছি। আর প্রাইমারিতে যেতে শুরু করেছি। বাবার বয়স তখন পঁচিশ কী ছাব্বিশ। মাথায় কালো কালো চুল। ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেহের আকৃতি কিছুটা ছোট। চোখের ভেতরে বাদামি মণিতে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে হাজার স্বপ্নের বসবাস।
বাবার হাত ধরে আমার স্কুলে যাওয়া শুরু। তুলতুলে কোমল হাত ধরে বাবা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতেন আমাকে। একবার বর্ষায় আমি বাড়ির পাশের ডোবাতে পড়ে গিয়ে ছিলাম। বাবা মাকে সেকি বকাবকি করছিলেন। তারপর থেকে মা কখনো কোথাও আমাকে একলা ছাড়েননি। বাবার এই ভালোবাসাটায় আমাকে হয়তো বাবাভক্ত করে তুলেছিলো। মা যে ভালোবাসতেন না এমন নয়। তবে সেটা ছোট মাথায় ধরতো না। একবার জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছিল। সেকি জ্বর। জ্বরের চোটে চোখ মেলতে পারছি না। আবোল-তাবোল বকছি। ওষুধ খেয়ে কোন কাজ হচ্ছে। মায়ের চোখেও কোন ঘুম নেই। দুই দিন ধরে কিছু খাওয়া দাওয়া নেই। আমাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে মা পাশে বসেছেন। ওঠার কোন নামজিগির নেই। দাদা-দাদী বলেও মাকে ওঠাতে পারেননি। আমার জ্বর ছাড়লেই তবে তিনি ওঠেন।
বাবাকে দেখতাম বাজারের সবচেয়ে নতুন জিনিসটা আমাকে দেয়ার চেষ্টা ছিলো তাঁর। মাও কম না। অনেক মজার মজার পিঠা করে খাওয়াতেন। মায়ের হাতের রান্না অমৃত ছিলো, এখনো সেই স্বাদ যেনো জিহ্বায় লেগে আছে। মা একটু ঝগড়াটে। একবার এক ভিক্ষুক কাউকে না বলে আমাকে কোলে নিয়ে ছিলো। তাতেই মায়ের অগ্নিমূর্তি। সেই ভিক্ষুক আমার কৈশোরে কতবার যে এই কথাটা বলেছে তার ইয়ত্তা নেই। বাবা আর মায়ের আদরে আদরে বড় হয়েছি আমি। আর সে কারণে একটু অন্য রকম ছিলাম। যে কোনো কথা বলে দিতাম মুখের ওপর। এটা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। আর সেদিন বাবা মাকে ডেকে যেই বললেন, ‘শুনেছো গালিবের মা, তোমার ছেলে নাকি আমার বাবা হবে। সে বলে, আচ্ছা বাবা! আমিও কি একদিন তোমার বাবা হবো?’
আজ আর বাবার সেই কালো চুলগুলো কালো নেই। তাতে সাদা রঙ ধরেছে। হাত-পায়ের চামড়াগুলো ঝুলে গেছে। বাবার বাদামি চোখ এখন ঘোলাটে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আগের মতো চোখেও দেখেন না। কথাগুলো বেঁধে যায়। যেন ছোট্ট বাবু, কথা ফুটছে তাঁর। আধো আধো ভাবে কথা বলেন। বাবার দেহে দীর্ঘ পরিশ্রমের ছাপ। তাই আগের মতো চলতে পারেন না। এখন আমিই তার সম্বল। যে বাবা আমাকে হাত ধরে হাঁটা শিখেয়েছেন। আজ তাঁর হাত ধরেই আমাকে নিয়ে যেতে হয়। মায়ের শরীর ত্রিশ বছরের সংসার জীবনের চাপে আজ আর চলতে পারে না। বিছানায় শুয়ে দিন কাটে। চোখ দুটো চেয়ে থাকে। কী সব বলতে চান। বলতে পারেন না। ভেতর থেকে কে যেন তার কণ্ঠনালি চেপে ধরে আছে। মায়ের চোখে মুখে না-বলা কথার ছাপ।
সেই শৈশবের না বুঝে বলা কথা ফিরে আসে কালের নিয়মে।

SHARE

Leave a Reply