“তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়।”
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বঙ্গাব্দের প্রথম মাস বৈশাখকে তাঁর প্রলয়োল্লাস কবিতায় এভাবেই স্বাগত জানিয়েছেন। পুরাতন আর জীর্ণতার ঝঞ্জাল বিদায় করে নতুন আশায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহবান নিয়ে আসে বৈশাখ। বৈশাখের চিরসাথী দুরন্ত কালবৈশাখী ঝড় আর বৃষ্টির নির্মলতা। নতুন বছরকে বরণ করার রীতি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রত্যেক জাতির মধ্যেই আছে। এই দিন তারা তাদের শিকড়ের সন্ধান করে থাকে। নববর্ষের আয়োজনে থাকে একবিংশ শতাব্দীর এই আলো-ঝলমল উজ্জ্বলতার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য তাদেরকে কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সেই ছবি নতুন প্রজন্মের কাছে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার প্রয়াস। অনাগত দিনগুলো আরো সুন্দর, আরো সমৃদ্ধ হয় মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে সবাই মিলে সেই প্রার্থনা করেন বছরের এই দিন।
রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বৈশাখকে আহবান করেছেন এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনার রঙে রাঙা ঐতিহ্যকে ছন্দের মালায় সাজিয়ে :
“সকল দীনতা ক্লেদ লুপ্ত করা, জড়তার চিহ্ন মুছে যাক;
বিজয়ী বীরের মত নির্ভীক সেনানী তুমি
এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ॥
অগণ্য অসংখ্য বাধা ওড়ায়ে, প্রবল কণ্ঠে তুলি তীব্র পুরুষ হুঙ্কার
হে বৈশাখ! এস ফিরে বজ্রের আগুনে দীপ্ত-আল্লার দু’ধারী তলোয়ার,
ভ্রষ্ট গুমরাহ যত নির্বোধের অহমিকা, শূন্যগর্ভ দম্ভ, আস্ফালন
চূর্ণ করি এস তুমি শঙ্কাশূন্য রণাঙ্গনে সমুজ্জ্বল সেনানী যেমন
নিঃশঙ্ক আল্লাহর শের-দীপ্ত আবির্ভাবে যারা পলাতন ফেরুপাল, কাক,
সুরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ॥”
চৈত্রের আগুনপোড়া প্রকৃতি বৈশাখে নতুন রূপে সাজে। বছরের এই প্রথম দিনে গ্রামবাংলার খোলা প্রান্তরে বসে বৈশাখী মেলা। গ্রামের মেলাগুলোয় আগের দিনে থাকতো শিশু-কিশোরদের জন্য নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সাপের খেলা, পাতার বাঁশি, মাটির খেলনা, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, বাদামটানা, মোয়া, খাজাসহ নানা আয়োজন। সময় বদলের সাথে সাথে গ্রাম্যমেলার রূপ বদল হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের জন্য মজা হারিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতার অধঃপতনের ঢেউ লেগেছে সেখানেও জুয়া, যাত্রার অশ্লীলতার পসার কারণে শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। শহরের মূল আয়োজনগুলোও হয় বড়দের জন্যই। শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা করে তেমন কেউ আর এখন ভাবে না। আমাদের নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের সাথে পরিচিত করতে শুধু তাদের জন্য পৃথক আয়োজনের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু উদ্যোগ ও সহযোগিতার অভাব যে তাতে সন্দেহ নেই।
বাংলা নববর্ষের সাথে যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে তার সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করাতে হবে। বাংলা বর্ষপঞ্জি ১৫৮৪ ঈসায়ি বা খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সম্রাট আকবর এর প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এ সন বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। নতুন এই সালটি আকবরের রাজত্বকালে প্রবর্তন করা হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। এর কারণ কী? কারণ এই দিন সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন এ নতুন নাম ছিল তারিখ-ই-এলাহি। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন আকবরের এ বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখা এবং রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে এ নতুন সনের প্রবর্তন করা হয়। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে কৃষকদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করা এক জটিল ব্যাপার। কারণ চন্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ১১-১২ দিনের ব্যবধান এবং এই কারণে ৩১ চন্দ্রবর্ষ ৩০ সৌরবর্ষের সমান। সে সময় চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা হতো কিন্তু ফসল উৎপাদন ও সংগ্রহ করা হয় সৌরবর্ষ অনুসারে। সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বের শুরু থেকেই এ সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বিজ্ঞানসম্মত এবং কাজের উপযোগী বর্ষপঞ্জির প্রয়োজন অনুভব করেন। এ জন্য তিনি মোগল দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ শিরাজীকে একটি বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব দেন। তার প্রচেষ্টায় হিজরি ৯৬৩ সালের মুহররম মাসের শুরু থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়। মজার ব্যাপার হলো, বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছে ৯৬৩ অব্দ ধরেই। অর্থাৎ জন্মদিনের দিনই বঙ্গাব্দের বয়স ৯৬৩ বছর। শুরুর বছর যেহেতু মুহররম মাসের সাথে বৈশাখ মাসের মিল ছিল তাই এ মাসকেই প্রথম মাস ধরে গণনা শুরু হয়। আগে বঙ্গ বা বাংলাদেশে শক বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল। শক বর্ষপঞ্জি অনুসারে চৈত্র মাস ছিল বছরের প্রথম মাস। তারপর থেকে চাঁদের হিসাব অনুসারে হিজরি অব্দ এবং সূর্যের হিসাব অনুসারে বঙ্গাব্দ প্রচলিত আছে আমাদের দেশে। চন্দ্রবর্ষের হিসাবে এ দেশের মানুষ তাদের ইবাদত বন্দেগি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। সৌরবর্ষ বঙ্গাব্দ অনুসারে এ দেশের কৃষক জমিতে ফসল ফলায়। অবশ্য দেশের অফিস আদালত এবং ব্যবসাবাণিজ্য চলে বর্তমান দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সহজভাবে চলতে সৌরবর্ষভিত্তিক গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে। গ্রেগোরিয়ান অব্দকে অনেকেই ইংরেজি অব্দ বলে ভুল করে। আসলে এটি ইংরেজি অব্দ নয়, গ্রেগোরিয়ান বা ঈসায়ি অব্দ। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন হজরত ঈসা (আ)। তাঁর জন্মদিনকে প্রথম দিন ধরে জ্যোতির্বিদ গ্রেগোরিয়ান এ অব্দ চালু করেন। এ জন্য একে ঈসায়ি অব্দ বলা হয়। হজরত ঈসা (আ) কে খ্রিষ্টানরা যিশুখ্রিষ্ট বলেন, তাই এ বর্ষ গণনাপদ্ধতিকে খ্রিষ্টাব্দও বলা হয়। অনেকে প্রবর্তকের নামানুসারে গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জিও বলে থাকে। বঙ্গাব্দ ও গ্রেগোরিয়ান অব্দের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয়। দু’টিই সৌরবর্ষভিত্তিক। বাংলা সনের সাথে ৫৯৩ যোগ করলে ঈসায়ি সন পাওয়া যায়।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গাব্দের প্রথম মাসটিকে আহবান করেছেন নতুন রূপে জীবনকে সাজানোর আহবানে :
“এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিঃশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥”
আমাদের এই সুন্দর দেশ নতুন বছরে আরো সুন্দর হোক। দেশ থেকে অন্যায় অবিচার, অনাচার, দুর্নীতি অনিয়মের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। শিশু-কিশোর হত্যার মতো নিমর্মতা বন্ধ হোক। “সকল দীনতা ক্লেদ লুপ্ত করা, জড়তার চিহ্ন মুছে যাক;/বিজয়ী বীরের মত নির্ভীক সেনানী তুমি/এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ॥”