সামিহা কেবল কথা বলে। যখন কেউ আর ওর কথা শুনতে চায় না তখন সে ছাদে গিয়ে পাখির সাথে, ফুলের সাথে, গাছের সাথে বলে যায় তার মনের কথা।
এক বিকালে সামিহা সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। গ্রিল-ঘেরা সুন্দর ছাদ। ছাদের একদিকে দু’টি রুম। একটিতে ওর নানাভাই হাবিব সাহেব থাকেন। তিনি সাংবাদিক, জ্ঞানী মানুষ। ছাদের এই ঘরটাতে তিনি বইপত্র পড়েন এবং লেখালেখি করেন। এখানে সামিহার অবাধ বিচরণ। অন্য ঘর মেহমানদের জন্য বরাদ্দ।
স্বচ্ছ নীল আকাশ। রোদের তেমন উত্তাপ নেই। সামিহা আকাশের দিকে মুখ তুলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে আকাশকে। এতটুকু মেয়ের অবাক করা প্রশ্ন শুনে আকাশ তো মনে মনে দারুণ খুশি। কেননা, এমন করে কেউ কখনো কিছু জানতে চায়নি তার কাছে। এক সময় মুখ খুললো আকাশ। আর প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বেশ হাঁপিয়েও উঠলো। তবু একটুও রাগ না করে এক সময় সে খলখলিয়ে হেসে উঠলো।
সামিহা বললো, ও আকাশ তুমি হাসছো কেন? বল না তোমার কয়টি ছেলেমেয়ে? আকাশ বললো, আমার দু’টি ছেলে। চাঁদ আর সুরুজ।
সূর্যটা কি তোমার বড় ছেলে?
তুমি ঠিক ধরেছো। সূর্য বড় আর চাঁদ ছোট।
তারারা কি তোমার নাতি-পুতি?
তা বলতে পারো। আমার বড় ছেলেটা কখনো নিয়ম ভঙ্গ করে না। সে প্রতিদিন পুব আকাশে উদয় হয়। সারাদিন হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পশ্চিম আকাশে গিয়ে ডুবে যায়।
কিন্তু তোমার ছেলেটা অমন রাগী কেন? তার মুখের দিকে তো তাকানোই যায় না। দুপুরে রূপার থালার মতো জ্বল জ্বল করে আর ড্রাগনের মতো ফোঁস ফোঁস করে। বাপরে বাপ, কী গরম তাপ ঢালতে থাকে! আমার গা পুড়ে যায়। ছাদে আমার নয়নতারা গাছটা নেতিয়ে পড়েছে দেখেছো? ওকে তুমি বকা দাও না কেন?
ছোট্ট মেয়ের কথা শুনে আকাশ হাসতে হাসতে বললো, ছেলেটার স্বভাবই এমন। সকালে আর বিকালে ওর মাথাটা একটু ঠান্ডা থাকে কিন্তু দুপুরে সত্যি ওর মাথাটা গরম হয়ে যায়। ওর তো অনেক কাজ। কাজ করতে করতে কার না মাথা গরম হয় তুমিই বলো! সূর্যের কাজের কথা শুনে সামিহা দু’হাতে মুখ ঢেকে হেসে কুটিকুটি। হাসতে হাসতেই বললো, তুমি যে কী বল না ছাই! ওর আবার কী কাজ! সে তো কেবল আগুনের মতো তাপ ছড়ায় আর সারাদিন ধরে আকাশটা পাড়ি দেয়। তুমি কি জানো, এবার আমি দাদাবাড়িতে গিয়েছিলাম। তোমার ছেলেটার জন্য পুকুরের পানি শুকিয়ে কাদা কাদা হয়ে গেছে, একটু ডুবসাঁতারও খেলতে পারলাম না।
তাই? তবে তুমি যাই বলো না কেন, আমার ছেলেটা কিন্তু অনেক ভালো ভালো কাজ করে। সেসব কি তুমি জানো?
– কী করে জানবো? তাকে দেখলেই যে আমার ভয় লাগে
– তা হলে শোনো। সূর্য সকালে পুব আকাশে উদয় হওয়ার আগেই রাতের আঁধার ভয়ে কেমন দৌড়ে পালায়, দেখেছো? তখন গাছে গাছে পাখিরা আনন্দে গান গাইতে শুরু করে। ভোরের নির্মল বাতাস আর সূর্যের নরম আলো ছোট বড় সবার সুস্বাস্থ্যের জন্য চমৎকার। যে ছেলেমেয়েরা সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই মিষ্টি আলোর পরশ শরীরে মেখে নেয় তাদের শরীর ও মন দুই-ই ভালো থাকে। অন্যরকম এক ভালোলাগার আনন্দে তাদের মনটা নেচে ওঠে। তারপর পড়তে বললে সে পড়া আর মন থেকে মুছে যায় না।
– আমি তো জানি সে কথা। সকাল হলেই পাখি গান গায়। সূর্যমামার ভয়ে অন্ধকার পালিয়ে যায়। কিন্তু বেলা দশটা বাজতে না বাজতেই তার মেজাজ যেন গরম হতে থাকে। আবার শীতের দিনে তার মুখটাও দেখা যায় না। শীত বুড়িটার ভয়ে কুয়াশার আড়ালে কেমন পালিয়ে থাকে।
এ কথা বলেই সামিহা হাসতে শুরু করলো। আকাশ বললো, ও মেয়ে তুমি দেখি সব দিকেই নজর রাখো। শুধু শীতেই নয়, বর্ষাকালেও আমার ছেলেটার মেজাজ ঠান্ডা থাকে। তারপর আবার গরম। গরম না হলে যে, পৃথিবীর একটি প্রাণীও বাঁচতো না। সূর্যের আলো এবং তাপ আছে বলেই তো সবাই সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে পারে।
– তাই?
– আরো আছে। সূর্যের তাপ তোমাদের পৃথিবীর জীবাণু ধ্বংস করে। তাইতো তোমরা জীবাণুমুক্ত বায়ু পাও। পানি বাষ্প হয়ে উবে যায় আকাশে তারপর মেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘ থেকে সেই পানি আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীতে। তোমাদের ডাক্তাররা বৃষ্টির পানিকে ডিসটিল ওয়াটারের সাথে তুলনা করে থাকেন। গাছপালা সূর্যের আলোকশক্তিকে শোষণ করে খাদ্য প্রস্তুত করে।
– বাহ্ তুমি তো আমার নানার মতো অনেক কিছুই জানো।
– আমি অনেক কিছুই জানি।
– তা হলে তো সূর্যটা আমাদের অনেক উপকারই করে থাকে। তবে ওর মাথাটা একটু গরম। আর চাঁদটা কি তোমার ছোট ছেলে? ওকে খুব ভালো লাগে। রাতে কী সুন্দর আলো দেয়! আমরা বলি জোছনা। জোছনা রাতে আমার ঘুমই আসতে চায় না। ছাদে নানা ভাইয়ের কাছে কতো গল্প শুনি। নানা ভাই মেঘের গল্প, তারার গল্প, চাঁদের গল্প, সূর্যের গল্প আরো অনেক গল্প শোনান আমাকে।
তোমাকে একটা গোপন কথা বলি।
– বলো না, আমি কাউকে বলবো না।
কথা শুনে আকাশ হেসে ফেললো। বললো, না না, তুমি সবাইকেই বলতে পারো। আসলে তোমাদের প্রিয় চাঁদ মামার নিজস্ব কোনো আলো নেই। রাতে সূর্য যখন পৃথিবীর আড়ালে চলে যায় তখন সূর্যের আলো গিয়ে পড়ে চাঁদের ওপর, তাই চাঁদটা অমন আলোয় ভরে ওঠে। আর সেই আলোটাই চাঁদের বুক থেকে পৃথিবীতে গিয়ে পড়ে। বারো ঘণ্টা পর আবার তোমরা সূর্যের মুখ দেখতে পাও। আমার বড় ছেলেটা অনন্তকাল ধরে আগুনের পিন্ডের মতো জ্বলছে তো জ্বলছেই। তার কোনো অবসর নেই। একটা মজার কথা বলি তোমাকে। তোমাদের পৃথিবীটা লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে। যে কারণে দিন-রাত্রি হয়।
সামিহা চোখ টানটান করে বললো, পৃথিবী ঘুরছে? কই, আমি তো কখনো টের পাই না। আকাশ বললো, ওখানেই তো মজা তুমি আর একটু বড় হলে সব জানতে পারবে।
তা পারবো কিন্তু ভূমিকম্প হলে তো আমরা সবাই বুঝতে পারি তাই না। ভয়ে আমরা ঘর ছেড়ে দৌড়ে রাস্তায় চলে যাই। পৃথিবীটা কি সত্যি ঘুরছে? তুমি ঠিক বলছো তো?
হ্যাঁ গো মেয়ে আমি ঠিক ঠিকই বলছি।
অজানা সব কথা শুনে সামিহা এবার গালে আঙুল ছুঁইয়ে ভাবতে লাগলো। তাকে ভাবতে দেখে আকাশ বললো, সামিহা তুমি এতো কী ভাবছো? আমাকে বলো। সামিহা বললো, শুনেছি পৃথিবীর মানুষ নাকি চাঁদে গিয়ে বসবাস করবে, কথাটা কি ঠিক? আকাশ বললো, তুমি ঠিকই শুনেছো। বিজ্ঞানীরা রাত দিন গবেষণা করে চলেছে কী করে চাঁদে গিয়ে বসবাস করা যায়। এবার সামিহা হি হি করে হেসে বললো, তুমি যে কি বলো না ছাই। অতটুকু চাঁদে কয়টা মানুষ ধরবে?
সামিহা, চাঁদটা কিন্তু মোটেও ছোট না। অনেক দূরে থাকে বলে ছোট দেখায়। দূরত্ব যত বেশি হবে জিনিসটা তত বেশি ছোট দেখাবে।
Ñ কিন্তু চাঁদটিকে আমি তো দেখি একটা রুটির সমান।
এ দিকে অনেকক্ষণ মেয়েকে না দেখতে পেয়ে তানিয়ার মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো। তিনি হাতের কাজ রেখে গলা চড়ালেন। সামিহা তুমি কোথায়, কোনো সাড়া নেই। তখন তিনি এ ঘর সে ঘর খুঁজে সিঁড়ি টপকে উঠে গেলেন দোতলার ছাদে। তার বিশ্বাস মেয়ে তার নানার ঘরেই আছে। কেননা নানার ঘরে বসে নানার কাছে গল্প শোনা ছাড়াও ছড়া-ছবির বইও সে পড়ে। সামিহা নানার বাসায় বেড়াতে এলে কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না।
সে যাই হোক, তানিয়া ছাদে গিয়ে দেখলেন তিনি যা ভেবেছেন ঠিক তাই। মেয়ে তার নানার খাটে ঘুমিয়ে আছে। তবে ঘুমের মধ্যেই সে হাসছে, আবার আপন মনে কী সব কথাও বলছে। তানিয়া ডেকে তুললেন মেয়েকে। তখন সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। সামিহা বিছানায় বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলো তার মায়ের দিকে। তারপর বললো, ‘মা জানো, সব মানুষ একদিন চাঁদে চলে যাবে। আমরাও কি যাবো মা?
– এ কথা কে বলেছে তোমাকে?
– আকাশ বলেছে। কিন্তু আমি যাবো না। চাঁদে ফুল নেই, পাখি নেই, আমি গিয়ে কার সাথে কথা বলবো?
এর মধ্যেই হাবিব সাহেব বাইরে থেকে ফিরে এলেন। নানাকে দেখেই সামিহা বললো, নানা ভাই সূর্যটা কি আকাশের বড় ছেলে? নানা ভাই হো হো শব্দে হেসে উঠে মেয়ে তানিয়াকে বললেন, তানিয়া, তোর মেয়ে দেখছি পৃথিবী ছেড়ে এখন আকাশের খবর নিতে শুরু করেছে। তারপর নাতনীকে বললেন, সুর্যটা যে আকাশের বড় ছেলে তা কী করে জানলে?
– আকাশ বলেছে। আরো বলেছে, তার বড় ছেলে খুব ভালো। তার অনেক কাজ, একটুও বিশ্রাম নেয় না।
– চাঁদ-সুরুজের গল্প তো সকালে আমি তোমাকে শোনালাম। আবার আকাশও বলেছে, ভালো! তবে সে কিন্তু মিথ্যা বলেনি। চাঁদ, সূর্য, গাছপালা, নদী, মেঘ এর সবাই মানুষের কল্যাণে, পৃথিবীর কল্যাণে একটানা কাজ করে চলেছে। কেউ বসে থাকে না। কাজে ফাঁকি দেয় না। আর আমরা অযথা সময় নষ্ট করি। কাজে ফাঁকি দেই। পড়তে বসে ফাঁকি দেই। দশজনের কল্যাণের কথাতো কখনো চিন্তাও করি না।
এবার সামিহা বিজ্ঞের মতো বললো, আমারও তো অনেক কাজ তাই না? আমি বই পড়ি, ছবি আঁকি, হাতের লেখা লিখি, পুতুল খেলি। আবার স্কুলে ভর্তি হতে হবে। মেয়ের কথা শুনে তানিয়া মুচকি হেসে বললেন, এবার নিচে চলো। আর পাকামো করতে হবে না। মুখ হাত ধুয়ে নাস্তা করে নানাভাইয়ের কাছে পড়তে হবে। নানাও বললেন, নানু ভাই, এবার মায়ের সঙ্গে যাও। ভালো জীবন গড়তে হলে আগে চাই পড়ালেখা।