Home নাটিকা বুদ্ধিমান ও পথিক নাট্যরূপ : -হুসনে মোবারক

বুদ্ধিমান ও পথিক নাট্যরূপ : -হুসনে মোবারক

দৃশ্য-১
(এক দেশে ছিল এক বুদ্ধিমান। তার মাথা ভালো কাজ করলেও ধনসম্পদ কিছুই ছিল না। তার কাজই ছিল হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। একবার সেই বুদ্ধিমান লোকটি হাঁটতে হাঁটতে এক মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছল। চলার পথে হঠাৎ এক গেঁয়ো পথিকের সাথে দেখা। পথিকটি একটি উটে চড়ে পথ চলছে। উটের পিঠে দুই দিকে দু’টি বস্তা ঝুলানো ছিল।)
বুদ্ধিমান     : (লোকটি পথিককে দেখেই একটি লম্বা সালাম দিল) আসসালামু আলাইকুম। স্বাগতম! সুস্বাগতম!! তোমাকে দূর থেকে দেখেই খুব খুশি হয়েছি আমি। পায়ে হাঁটা আর ক্লান্তির কথা না হয় বাদই দিলাম ভাই, একা একা পথ চলতে গিয়ে একেবারে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন যতক্ষণ এক সাথে পথে চলব, প্রাণ খুলে দু’চারটে কথা বলতে পারব, নাকি বলো?
পথিক : তোমার কথা শুনে অনেক খুশি হলাম। আমিও ভাই একা চলতে চলতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে নিজেই গান গাওয়া শুরু করলাম। তবে ভাই, পায়ে হাঁটা আর উটে চড়ার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আসলে পায়ে হাঁটাই ভালো। তা ছাড়া তোমার যদি উট, ঘোড়া বা গাধা না থাকে, তাহলে তা চোরে নেয়ার ভয় থাকবে না; ঘাস, লতাপাতা খোঁজারও কোনো চিন্তা থাকবে না। কবি ঠিকই বলেছেন-
চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, যার নেই গাধা
ঘাস পাতা খড়ের তরে মন নেই বাধা।
বুদ্ধিমান : না ভাই, এটা কেমন কথা! যদি কারো গাধা না থাকে তাহলে তো তার বোঝা নিজের মাথাতেই চাপবে। পথ যদি দূরের হয় তাহলে তো পায়েরই কষ্ট। তবে হ্যাঁ, আমার কিন্তু হেঁটে পথ চলতে তেমন খারাপ লাগে না।
তা ভাই, উটের বোঝা দু’টি অনেক ভারী বলে মনে হচ্ছে! বস্তা দু’টিতে কী বোঝাই করেছো?
পথিক : একটিতে রেখেছি গম আর অন্যটিতে বালু আর মাটির ঢেলা।
বুদ্ধিমান : কী বললে! বালু আর মাটির ঢেলা! কিন্তু কেন, তোমার বাড়িতে কি বালু আর মাটির ঢেলা নেই?
পথিক : তা থাকবে না কেন? আসলে ওসব আমি কোনো কাজের জন্য নিচ্ছি না। এক বস্তা গম উটের পিঠে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিলো না। তাই বুদ্ধি করে আরেক বস্তা ভর্তি করলাম বালু আর মাটি দিয়ে; যাতে উটের পিঠে দুই পাশ থেকে বস্তা দু’টি ঝুলে থাকে।
বুদ্ধিমান : হা হা হা..। আজব বুদ্ধি আবিষ্কার করেছো দেখছি। একেবারে বুদ্ধির ঢেঁকি! আরে ভাই, এর চেয়ে ভালো হতো না যদি গমগুলোকে দু’টি বস্তায় সমান সমান করে ঢেলে নিতে। তাহলে বস্তা উঠানো-নামানো যেমন সহজ হতো, তেমনি উটের কষ্টও কম হতো।
পথিক : বাহ বাহ! সুন্দর বুদ্ধি তো তোমার! শত চিন্তা-ফিকির করেও আমার বুদ্ধি এত দূর পৌঁছায়নি। বোঝা যাচ্ছে, তুমি সত্যিই একজন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও মহাপুরুষ।
বুদ্ধিমান : না না, ওসব কিছু না। তবে ভাই এটাতো খুবই সহজ হিসাব।
পথিক : না ভাই, আমি তোমার কথা একদম মেনে নিতে পারছি না। তোমার যে বুদ্ধি তা দিয়ে তুমি নিশ্চয়ই অনেক ধনসম্পদের মালিক হয়েছো। আর এখন সখের বশে হেঁটে হেঁটে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছো।
বুদ্ধিমান : না ভাই তুমি ভুল বুঝছো। সত্যি বলতে কি, এই দুনিয়ায় আমার একটা কানাকড়িও নেই। এই যে এখন তোমার সাথে চলছি, অথচ আগামীকাল আমার ভাগ্যে কী আছে, কী কাজ করব আর কিইবা খাবো তাও জানি না।
পথিক : এ্যাঁ, তুমি দেখছি একেবারে নিঃস্ব, ফতুর মানুষ। কিন্তু আমি একেবারে বুদ্ধিহীন হবার পরও আমার বাড়িতে ১০টি উট, ১০০টি ভেড়া ও ৫০টি গরু আছে। এ ছাড়া বাড়ি, জমি, চাকর-বাকর সবই আছে। অথচ এত বুদ্ধি মাথায় রেখেও তুমি নিঃস্ব ফকির? তাহলে এতসব জ্ঞান-বুদ্ধি আর লেখাপড়ার ফায়দা কী? জ্ঞান-বুদ্ধির অর্থ যদি এই হয় যে, ফালতু খেয়াল-খুশিমতো যেদিকে মন যায় সেদিকেই পথ চলব, তাহলে সত্তর বছর মূর্খ থাকাও উত্তম। না, ভাই তোমার মতো ফলহীন বুদ্ধিমানের সাথে পথ চলা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।
বুদ্ধিমান : ঠিক আছে আমি অন্য পথেই যাচ্ছি। তবে যাবার আগে একটা সত্যি কথা বলি। আসলে ভাই, আমার পরিশ্রম করতে ভালো লাগে না। আমার ইচ্ছে হয়, সারাদিন ঘুরে বেড়াই। আর খাবার সময় হলে কেউ এসে আমাকে খাবার দিয়ে যাক। আমি যদি রাজা হতাম তাহলে হয়তো ঘুরে ঘুরে জীবনটাই পার করে দিতে পারতাম!
পথিক : কেবল বুদ্ধিমান হলেই হয় না, সে বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর জন্য পরিশ্রম করতে হয়। নইলে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।

দৃশ্য-২
(পথচারী ভিন্ন পথ ধরে হাঁটছে। কিছু দূর যাওয়ার পর পথচারী একদল ডাকাতের খপ্পরে পড়ল।)
ডাকাত : বস্তায় করে কী নিয়ে যাচ্ছো।
পথিক : (ভয়ে ভয়ে) ইয়ে মানে… ইয়ে…।
ডাকাত : বলবি না, আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা।

(চাকু বের করে বস্তা দু’টির একটি এক ঘায়ে কেটে ফেলল। ঘটনাক্রমে বস্তাটি ছিল বালু আর মাটির ঢেলার।)
এ্যাঁ, এ দেখছি বালু বের হচ্ছে।
তুই আসলেই একটা গাধা। নইলে মরুভূমিতে বাস করেও কেউ কি বালু আর ঢেলা উটের ওপর বহন করে নিয়ে যায়?

(ডাকাতরা চলে যায়)

পথিক : (আনন্দে উল্লসিত হয়ে) এ রকম বোকামি হাজারবার করাও ভালো। বোকার মতো বালু আর ঢেলা বোঝাই না করলে আমার কষ্টের উপার্জন গিয়ে পড়তো ডাকাতদের হাতে।
(এরপর থেকে বোকা লোকটি একশো উট বোঝাই করলেও একপাশে গম ও অন্য পাশে বালু বোঝাই করতো। কারো বুদ্ধি পরামর্শে কান দিতো না। মানুষ তার বুদ্ধির বহর দেখে হাসি-তামাশা করলে জবাবে সে বলতো, আমি এমন কিছু জানি, যা তোমরা জানো না।)

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী

SHARE

Leave a Reply