মুহিতের অনেক দিনের স্বপ্ন। দামি এক জোড়া অ্যাপেক্স জুতা কিনবে। একসাথে অনেক টাকা জমানো হয় না, তাই তার স্বপ্ন স্বপ্নেই খেলা করে। বন্ধুদের পায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে আমিও কিনবো এ রকম জুতা।
গত মাসে মুহিতের এক বন্ধু শহর থেকে গ্রামে এসেছে। জিন্স প্যান্টের সাথে কি সুন্দর খয়েরি রঙের এক জোড়া জুতা পরে আছে। বারবার মুহিত সেই জুতার দিকে তাকাচ্ছে দেখে শহরের বন্ধু বলল, এটা অ্যাপেক্স ব্র্যান্ডের শো-রুম থেকে কেনা, বাজারে নতুন এসেছে। মুহিত দাম জিজ্ঞেস করেনি। ভাবলো বেশি হলে ৮০০-৯০০ টাকা হবে। মুহিত ৩০০-৪০০ টাকার বেশি দামের জুতা কখনোই পরেনি। বন্ধুর পায়ে এত সুন্দর জুতা দেখে মনে মনে সাজাতে লাগলো ঐ রকম এক জোড়া জুতা কিনবে। তারপর পায়ে দিয়ে হাঁটবে, সাথে জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট। তাকে দেখতে কী দারুণ লাগবে। ভেবে পুলকিত হয় মুহিত। গ্রামের বন্ধুরা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে- অ্যাপেক্স ব্র্যান্ডের, বাজারে নতুন, অনেক দামি। সে কি আনন্দময় স্বপ্ন।
বাবাকে বলে রেখেছে আগামী মাসে জুতা কিনবে। এটা আর পরা যায় না, পুরনো তালি দেয়া। মুহিত জানে বাবার সীমিত আয় বেশি হলে ৩০০ টাকা দেবেন। মায়ের কাছে বলে ১০০ টাকা নেয়া যাবে। পাশের বাড়ির এক চাচাতো ভাইকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেছে মুহিত। চাচী কম দিলেও ৩০০ টাকা দেবেন। আরো ১০০ টাকা এদিক ওদিক থেকে জোগাড় হয়ে যাবে। প্রতিদিন প্রাইভেট, নিজের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে বাবাকে সংসারের কাজে সহযোগিতা করে মুহিত। ক্যালেন্ডারে দিন গুনে আর ভাবে কিছুদিন পর আমিও দামি জুতা পরে হাঁটবো।
মাস শেষে বাবা দিলেন ৩০০ টাকা, মায়ের কাছ থেকে ৫০ টাকা আর চাচী দিলেন ৪০০ টাকা। এক বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ করলো ৫০ টাকা। মোট ৮০০ টাকা নিয়ে অন্য এক চাচাতো ভাইসহ থানা সদরে গেলো দামি জুতা কিনতে। দুইজন এই দোকান, ঐ দোকানে যায় কিন্তু কোন জুতা কেনার মিল করতে পারছে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অ্যাপেক্সের দোকান দেখে মুহিতের চোখ বড় হয়ে গেলো। জুতা কিনতে এতো বড় দোকানে কখনো যায়নি মুহিত। মুহিত ভাবতো ঐ সব বড় বড় দোকান বড় লোকদের জন্য। বড়লোকের অনেক টাকা আছে, তাই তারা দামি জুতা পরে। আজ মুহিতের নিজের কাছে কেন যেন বড় লাগছে। এত বড় দোকানে এসেছে জুতা কিনতে। খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যায় ঐ স্বপ্নের প্রিয় জুতা। এটাই কিনবে মুহিত। জুতার গায়ে দাম লেখা আছে ৮৫০ টাকা। মুহিতের চোখ খুশিতে বড় হয়ে উঠলো। মনের ভেতর আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। ৮৫০ টাকার জুতা দোকানিকে বলে ৭০০ টাকা দিয়ে কিনতে পারবে। বাড়ি থেকে আসতে ৫০ টাকা খরচ হয়েছে। যেতে লাগবে ৫০ টাকা। আর ৭০০ টাকা জুতা। দোকানি মুহিতকে নরম সোফায় বসিয়ে নিজ হাতে পায়ে জুতা পরিয়ে বলল, আয়নায় দেখেন কেমন দেখাচ্ছে। মুহিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, দাম কত?
দোকানি বলল, ৮৫০ টাকা।
মুহিত দোকানির চোখে তাকিয়ে বলল, ৭০০ টাকা দেয়া যাবে না?
এগুলো সব একদামের জুতা- দোকানি বললো। এখানে কেউ দামাদামি করে না। গায়ে যে দাম লেখা আছে তা-ই দিতে হবে।
মুহিত মনে মনে ভাবে- আরো ৫০ টাকা বলি, প্রয়োজনে দু’জন হেঁটে বাড়ি যাবো।
মুহিত বলল, ভাই আরো ৫০ টাকা দেবো।
দোকানি কিছুটা বিরক্ত হলো এবং বলল, না হবে না, একদাম, অন্যটা দেখেন।
হঠাৎ করে মুহিতের মনটা বিষণ্ন হয়ে গেলে। যদি আর ১০০ টাকা থাকতো তাহলে জুতা কিনতে পারত। চাচাতো ভাইয়ের কাছে ৩০ টাকা আছে। মুহিতের থানা সদরে পরিচিত কেউ নেই যে, তার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেবে। অ্যাপেক্স শো-রুম থেকে বের হয়ে মুহিত বলল, চল বাড়ি যাই, আজ আর জুতা কিনবো না। চাচাতো ভাই বলল, চল অন্য দোকানে ৭০০ টাকার মধ্যে একজোড়া কিনে নিই।
মুহিত গম্ভীর হয়ে বলল, আজ আর জুতা-ই কিনবো না, বাড়ি চল। দু’জন বাড়ির পথে পা বাড়ালো। মুহিতের অজান্তেই মুহিতের চোখে ১০০ টাকার জন্য জুতা কেনার স্বপ্ন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।