Home উপন্যাস রত্নদ্বীপের আতঙ্ক -আহমেদ বায়েজীদ

রত্নদ্বীপের আতঙ্ক -আহমেদ বায়েজীদ

গত সংখ্যার পর

৭.
সন্ধ্যার পর বাংলো থেকে বের হলো অয়ন, ফাহাদ আর মাহি। ট্রলারে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে গবেষকের বাড়ির ওপর আজ থেকেই নজর রাখবে। কঅ ঘটে ও বাড়িতে, কারা আসে যায় সব কিছু দেখা চাই। ব্যাগ থেকে বের করে কিছু জিনিসপত্র সাথে নিলো অয়ন। বেড়াতে গেলে টর্চলাইট, ছোট চাকু, বাইনোকুলারসহ কিছু সামগ্রী সব সময় সঙ্গে রাখে ও। রুমে তালা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। সালাম মিয়া ও অয়নের আব্বুর বাসায় ফিরতে আরও রাত হবে আগেই বলে গেছে। বাইরে অন্ধকার খুব গাঢ় নয়, আবার ঝকঝকে জোছনাও নেই। পরিবেশটা সুবিধাজনক হওয়ায় স্রষ্টাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল অয়ন। হেঁটে এসে গবেষকের বাড়ির সামনে না থেমে পার হয়ে আরও সামনে গেল। পঞ্চাশ গজের মত সামনে গিয়ে একটি গাছের ছায়া দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। জায়গাটা গাছের ছায়া থাকার কারণে একটু বেশিই অন্ধকার লাগছে। দূর থেকে কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই। গবেষকের বাড়ির দিকে তাকালো অয়ন। সামনের ঘরটা অন্ধকার, ভেতরের ঘরে সৌর বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। সঙ্গীদের কাজ বুঝিয়ে দিল অয়ন। প্রয়োজনীয় মুহূর্তের জন্য কিছু সঙ্কেতও শিখিয়ে দিল। সিদ্ধান্ত হলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফাহাদ আর মাহি সামনের অংশে নজর রাখবে আর অয়ন পেছনের দিকটা দেখার চেষ্টা করবে। সম্ভব হলে ঘরের কাছাকাছি যাবে।
ওদেরকে দাঁড়ানোর জায়গা দেখিয়ে দিয়ে অয়ন রাস্তা থেকে নেমে গেল। বাড়িটার দক্ষিণ পাশটা ফাঁকা জায়গা। তবে মাটি ভরাট করা। হয়তো কেউ কিনে ভরাট করে রেখেছে বাড়ি করার জন্য। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করলো অয়ন। উঁকি দিয়ে দেখলো দেয়ালের ভেতরে প্রায় পাঁচ ছয় হাত ফাঁকা জায়গা তারপর ঘর। ফাঁকা জায়গায় দু-একটা ছোট ফলের গাছ আছে। প্রয়োজনে ওগুলোর আড়াল ব্যবহার করা যেতে পারে বলে ভেবে রাখলো। হঠাৎ বাড়ির সামনের বারান্দায় আলো জ্বলে উঠলো। একটু থামলো অয়ন। কয়েক সেকেন্ড পর দরজা খোলার শব্দ পেল। শরীর নিচু করে চেয়ে রইলো নিঃশব্দে। দরজা দিয়ে বের হলো একটা ছায়া মূর্তি। আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। লাভলুকে চিনতে পারলো অয়ন। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা হেঁটে রাস্তায় উঠলো। রাস্তায় উঠে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলো, হাতে টর্চলাইট। অয়নের কপালে ভাঁজ পড়লো। আর বিশ পা হাঁটলেই লাভলু পৌঁছে যাবে ফাহাদ আর মাহির কাছে। ওরা কি করছে এখন? সময়মতো লুকাতে না পারলে ধরা পড়ে যাবে। লাভলুকে সেই জায়গাটা পার হয়ে যেতে দেখলো অয়ন। সবকিছু স্বাভাবিক তাই কোন ভুল হয়নি বোঝাই যায়। আধা মিনিট পর একটা পাখির ছোট্ট ডাক শুনলো রাস্তা থেকে। কণ্ঠটা মাহির। অর্থাৎ ওকে ডাকছে। চলে এলো অয়ন রাস্তায়। অয়নকে দেখে রাস্তার পাশের ঝোপে আড়াল থেকে চুপিসারে বেরিয়ে এলো। ইশারায় সবকিছু ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করলো অয়ন। তারপর লাভলু যেদিকে গেছে সেদিকে পা বাড়ালো।
এই সময় লাভলু অনেকটাই এগিয়ে গেছে। তবে হাতে লাইট থাকার কারণে ওরা ওকে হারালো না। চুপিসারে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চললো পেছন পেছন। রাস্তাঘাটে ওরা ছাড়া আর কোন লোক নেই। দ্বীপে আটটা মানে অনেক রাত। ট্রলার ঘাটের পথ ধরলো লাভলু। আবাসিক হোটেলগুলোর রুমে রুমে লাইট জ্বলছে, কয়েকজন টুরিস্ট বাইরে বের হয়ে গল্প করছে। একটি চায়ের দোকানে হারিকেনের আলোয় দু’তিনজন দ্বীপের বাসিন্দা বসে আছে। একপাশ ঘেঁষে চুপচাপ চলে এলো ওরা। কেউ দেখলো বলে মনে হলো না। ট্রলার ঘাটের কাছাকাছি এসে লাভলু টর্চলাইট জ্বাললো না আর। দূর থেকে নজর রাখতে এবার সমস্যায় পড়লো অয়নরা। তবু চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। এখনও অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তির মত দেখা যাচ্ছে; কিন্তু ঘাটের গাছপালা বেষ্টিত জায়গায় গেলে আর দেখতে পারবে না। তবু এগোতে থাকলো ওরা। আয়ন আশায় আছে টর্চ যেহেতু হাতে আছে মাঝে মধ্যে জ্বালবেই। ঘাটের কাছাকাছি এসে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালো তিনজন। ঘাট তখন প্রায় একশো গজ সামনে। এবার অয়নের ধারণাই সত্যি হলো। লাইট জ্বাললো লাভলু। প্রথমে মাটির দিকে লাইটের আলো ফেললো এরপর হাত দিয়ে টর্চের মুখ চেপে ধরলো। একই কাজ পরপর দুবার করলো। এরপর আবার অন্ধকার। ঘাটে একটি মাত্র ট্রলার ভিড়ে আছে, তবে কোন লোকজন নেই। একা লাভলু সমুদ্রের দিকে মুখ করে চেয়ে আছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা। দুই মিনিট পেরিয়ে গেল। কিছুই ঘটলো না। মাহি ইশারায় কিছু বলতে চেষ্টা রকলো অয়নকে। অনেকটা ‘কি বুঝলে’ টাইপের ইশারা। অয়ন মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললো। লাভলুর লাইট জ্বালানোর ধরনটা অয়ন বুঝতে পেরেছে। নিশ্চয়ই কাউকে সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাকে? এমন কেউ কি আছে ঘাটে, কিংবা সমুদ্রে! আরও আধা মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর জবাব পাওয়া গেল। সমুদ্রে একটি ইঞ্জিন চালু হওয়ার শব্দ পেল ওরা। ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগলো শব্দটা। অন্ধকার ফুঁড়ে একটা কাঠামো স্পষ্ট হলো সমুদ্রের বুকে। ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে আসছে ঘাটের দিকে। ঘাটের কাছাকাছি এসে লাইট জ্বলে উঠলো অচেনা কাঠামোটার ভেতরে। এবার চিনতে পারলো। বড় আকারের একটি স্পিডবোট। উপরে ট্রলারের মত ছাউনি, চারপাশ আটকানো। সামনের দরজার জায়গাটাও বন্ধ। ভেতরের লাইটের আলো ছিটকে বাইরে আসছে।
ধীরে ধীরে ঘাটে ভিড়লো বোট। ট্রলারটির পাশ ঘেঁষে জায়গা নিলো। খুলে গেল সামনের দরজা। সাথে সাথে লাভলু উঠে গেল বোটে। এরপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এখন কি করা উচিত তাই ভাবছে অয়ন। এ সময় মাহি বললো-
‘মনে হচ্ছে বোটের ভেতরে আরো লোকজন আছে।’
‘তা তো আছেই, আমার মনে হচ্ছে বড় কেউ হবে। নইলে এতবড় বোটে সাধারণ লোকজন চলে না। আবার সাধারণ কেউ হলে তো লাভলুদের বাড়িতে গিয়েই কথা বলতো। সেদিন যেমন দুটো লোককে দেখেছিলাম বাড়িতে।’ ফাহাদ বললো মাহির কথার সুরে।
‘তোমরা এখানে দাঁড়াও, আমি দেখছি।’ ওদের প্রসঙ্গে না গিয়ে অয়ন আদেশের সুরে বললো কথাটা।
‘কোথায় যাবে অয়ন ভাইয়া।’ প্রশ্ন করলো মাহি।
‘বোটটার কাছাকাছি গিয়ে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করবো। তোমরা এখানেই দাঁড়াও।’
‘তুমি একা যাবে কেন? একসাথে যাই। একা গেলে কোন বিপদ হতে পারে। ওরা তো আর ভালো লোক নয়।’ ফাহাদ বললো।
অয়ন বললো- ‘একসাথে সবাই বিপদে পড়লে বাঁচাবে কে? তোমরা যদি দেখ আমি বিপদে পড়েছি তাহলে বাঁচাতে চেষ্টা করবে। সেটা সম্ভব না হলে বাংলোতে ফিরে গিয়ে আব্বুকে জানাবে।’
‘কিন্তু ভাইয়া…’ মাহি মিনমিন স্বরে কিছু বলতে চেষ্টা করলো। ওকে থামিয়ে দিল অয়ন।
‘কোন কিন্তু নয়, যা বলছি তাই করো।’ বিসমিল্লাহ বলে সামনে পা বাড়ালো অয়ন। সোজা না গিয়ে কিছুটা ঘুরে ডানদিক দিয়ে ঘাটের জেটিতে উঠলো। চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। চারপাশটা দেখে নিলো আরো একবার ভালো করে। সিদ্ধান্ত নিলো বোটের পাশের ট্রলারটায় উঠবে। দুটো একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, তাই একটা থেকে আরেকটার সব কিছু না বোঝার কথা নয়। আস্তে পা ফেলে ট্রলারে উঠলো অয়ন। ভেতরটায় একবার উঁকি দিয়ে ছাদে উঠে এলো চুপিসারে। ছাদে হাঁটার ঝুঁকি নিলো না। ক্রলিং করে এগোতে লাগলো। বোটের ভেতর থেকে অস্পষ্ট কথাবার্তা ভেসে আসছে। তবে কি বলছে তা বোঝার উপায় নেই। ধীরে ধীরে নিজের শায়িত শরীরটাকে বোটের পাশে নিয়ে এলো অয়ন। কান পাতলো বোটের গায়ে। ভেতরের কথা এবার অনেকটাই স্পষ্ট। কথা শুনে বুঝলো তিনজন লোক আছে ওখানে। লাভলুর কণ্ঠ চিনতে সমস্যা হলো না। তবে অন্য দুটোর একটি কণ্ঠ বেশি কথা বলছে। বেশ মোটা কণ্ঠ, কথার ভঙ্গিও আদেশসুলভ। অয়ন কান পেতে শুনতে লাগলো কথা-
‘ঠিক আছে লাভলু, তোমরা যা করেছো খারাপ না। কিন্তু কথা হচ্ছে দুই মাসের বেশি হয়ে গেল এখনও কাজ শেষ করতে পারলে না। আরো লোক লাগলে বলো। ওদিকে গবেষক রিপোর্ট ফাইনাল করেছে। পার্টি কাজ শুরু করতে চায় দ্রুত। তাদের তো প্রস্তুতি নিতেও সময় লাগবে।’ মোটা কণ্ঠটা বললো।
‘জি বস বুঝতে পারছি, আমাদের কাজও প্রায় শেষ, কালকের অপারেশনটা সাকসেস হলে দেখবেন সব পালাতে শুরু করেছে।’ লাভলু কৈফিয়তের সুরে বললো।
‘কালকের কাজটা ভালোভাবে করা চাই লাভলু।’ এবার তৃতীয় আরেকটি কণ্ঠ কথা বললো, কণ্ঠটা চিকন। ‘পর্যাপ্ত লোক দেয়া হবে। তিনটে হোটেলেই অপারেশন চালাতে হবে। টুরিস্ট এবং কর্মচারী সবার মনে ভয় ধরিয়ে দিতে হবে।’
‘দরকার হলে দু-একটা লাশ ফেলে দিও।’ মোটা কণ্ঠটা বললো।

৮.
কথাগুলো শোনার সাথে সাথে মস্তিষ্কে নোট করে নিতে লাগলো অয়ন। একমনে শুনছে ও। তাই খেয়াল করেনি বোটের পেছন দিক থেকে একটি ছায়মূর্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছে। যখন খেয়াল করলো তখন আর কিছুই করার নেই। লোকটার কথা কথা শেষ হতেই ঠক্ করে এটা শব্দ শুনে নিজের ডান দিকে তাকালো অয়ন। ঘাড় ফেরাতেই দেখলো একটা মানবমূর্তি লাফ দিয়ে বোটের ছাদ থেকে ট্রলারের ছাদে পড়লো। ওর শরীর থেকে এক ফুটের বেশি দূরে নয়। অয়ন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর দুই বাহু চেপে ধরলো লোকটা। হাতে প্রচন্ড জোর লোকটার। অয়ন বুঝলো এর সাথে জোরাজুরি করে লাভ নেই, তাতে বরং বাহু দুটো ভেঙে যেতে পারে। অয়নকে ধরেই চিল্লাতে শুরু করলো সে- স্যার, চোর ধরছি, স্যার চোর। বোটের সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সবাই। লাভলু তার হাতের টর্চ লাইটের আলো ফেললো অয়নের মুখে। সাথে সাথে বললো- ‘স্যার এই চ্যাংড়াটা কয়দিন ধরেই আমাদের ডিস্টার্ব করছে। এখানে কি করছিস তুই হারামজাদা।’
অয়ন কিছু বললো না। যে ওকে ধরেছে সে বললো- ‘লুকিয়ে কান পেতে আপনাদের কথা শুনছিল। আমি বোটের পেছনে শুয়ে আছিলাম। ব্যাটা এত মন দিয়ে আপনাদের কথা শুনছে যে আমি ধরতে আসছি তাও দেখে নাই।’
‘ভেতরে নিয়ে আয় ওকে।’ সেই মোটা কণ্ঠটা বললো এবার। বলেই সবার আগে ভেতরে ঢুকলো সে। লাভলু আর সেই লোকটা মিলে অয়নকে নিয়ে গেল বোটের ভেতরে। বোটের দুই পাশে ফোমের কুশন দেয়া বেঞ্চি। সামনের ডান দিকে ড্রাইভিং হুইল। অনেকটা ছুড়ে দেয়ার মত করে অয়নকে বেঞ্চিতে বসিয়ে দিল ওরা। সব মুখ একবার দেখে নিল অয়ন। ওকে যে ধরেছে সেই লোকটা পুরনো একটা প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা। পায়ে দুই ফিতার স্যান্ডেল। বোটের ড্রাইভার হতে পারে। তবে লোকটার দশাশই শরীর দেখে মনে হলো আর যাই হোক গায়ে দানবের শক্তি আছে। বাহু দুটো এখনও ব্যথা করছে। সামনের বেঞ্চিতে বসা দুজনের বয়স পঞ্চাশের কোটায়। গায়ে টি শার্ট-জিন্স আর পায়ে কেডস দু’জনেরই। মোটা লোকটা কথা বললো প্রথমে। মোটা কণ্ঠ শুনে অয়ন বুঝলো এতক্ষণ কর্তৃত্বের সুরে সেই কথা বলেছে। তার মানে এদের মধ্যে নেতা সে। ‘এই কে তুই, এখানে কি করছিস?’
লাভলু বললো স্যার এইটা ঐ টুরিস্ট স্পটের কন্ট্রাক্টরের ছেলে। ভীষণ বিচ্ছু। ওর সাথে আরও দুইটা আছে। ক’দিন ধরেই ওরা আমাদের পেছনে লেগেছে।’
‘তাই নাকি! তা তোর সাথের দুটো কই? আামদের পেছনে লেগেছিস এবার বুঝবি বাছাধন। এই আবু দেখতো আশপাশে ওর সঙ্গীদের পাওয়া যায় কি না! একসাথে খাতির যতœ করি সবাইকে। যা ধরে নিয়ে যায়।’
ভয় পেয়ে গেল অয়ন। ওরা ধরা পড়লে সেটা আরও খারাপ হবে। সাহায্য করারও কেউ থাকবে না। বললো- ওরা এখানে আসেনি, আমি একাই এসেছি।’
নেতা লোকটা আবার বললো- ‘তোমার কথায় আর বিশ্বাস নেই বাছা, আবু তুই যা খুঁজে দেখ। লাভলু তুমিও বের হও আবুর সাথে। আর শোন, যা বলেছি ঠিকঠাক মত করবে।’
‘এটাকে কী করবেন বস?’ অয়নকে দেখিয়ে লাভলু জানতে চাইলো।
‘ও আমাদের কাছেই থাকবে। ওর বাপকে কাবু করতে এইটা একটা দামি অস্ত্র। আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এটা আমাদের কাছে থাকবে। আর ওর বাপ যদি কথা না শোনে তাহলে ওকে টুকরো টুকরো করে ওর বাপের কাছে উপহার হিসেবে পাঠাবো।’ একটু চিন্তা করে আবার বললো-‘শোন তুমি, আজ রাতেই ওর বাপকে একটি চিঠি দেবে। বলবে আগামী আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে তার দলবল নিয়ে দ্বীপ না ছাড়লে তার ছেলের লাশ পাবে। দেখি ব্যাটা কই যায়!’
চিকন লোকটা বললো- ‘দাঁড়াও তোমরা বাইরে যাওয়ার আগে ছোকড়াটাকে বেঁধে রেখে যাও। এইসব বিচ্ছুদের বিশ্বাস নেই। এদেরকে ধরে রাখতে গেলে হাতে কামড় দিয়ে পালাতে পারে। এরকম দামি একট জিনিস স্বেচ্ছায় যখন হাতে এসে ধরা দিয়েছে তাকে তো আর হাত ছাড়া করা যাবে না।’ কণ্ঠের মত শরীরটাও চিকন তার।
‘বেচারা, এই তোকে কে বলেছে এখানে মরতে আসতে, তুই জানিস তুই কোথায় এসেছিস? সাপের লেজে পা দেয়ার শখ হয়েছে। এবার বুঝবে মজা। আমাদের পেছনে লাগতে এসেছো।’ বলে অয়নের গাল ধরে টেনে দিল। ভঙ্গিটা আদর করা হলেও প্রচন্ড জোর ছিল হাতে। ব্যথায় উঁহ শব্দ করে উঠলো অয়ন। ওকে ব্যথা পেতে দেখে যেন মজা পেল ওরা। এক সাথে হেসে উঠলো আবু, লাভলু আর চিকন লোকটা।
আবু বোটের পেছনের একটা বাক্সের ভেতর থেকে মোটা নাইলনের দড়ি বের করলো। লম্বাভাবে শুইয়ে দিয়ে সিটের সাথে বেঁধে ফেললো অয়নকে। হাত আলাদা করে বাঁধলো, শরীর পেঁচিয়ে বাঁধলো বেঞ্চির সাথে। নড়তে গিয়ে অয়ন টের পেল কি শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ওকে। এদিক ওদিক নড়লেই নাইলনের দড়ি বসে যাচ্ছে চামড়ায়। বেশি নড়াচড়া করলে চামড়া ছিলে যেতে সময় লাগবে না। তাই চুপচাপ থেকে চিন্তা করতে লাগলো। অযথা মাথা গরম করে কিছু হবে না। আগে এদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। পালানোর সুযোগ আসবেই, তবে প্রস্তুত থাকতে হবে সেই সুযোগের জন্য। এরা যা বলছে তা করতেও পারে। কারণ দ্বীপে দু’দুটো খুন, ডাকাতি-ছিনতাই সবই এরা করেছে বোঝা-ই যাচ্ছে। আগামীকাল আবার আবাসিক হোটেলগুলোয় ডাকাতির পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রয়োজনে খুনও করতে বলা হয়েছে। দ্বীপের দখল নেয়াই এদের উদ্দেশ্য সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়, কিন্তু কারা এরা? দ্বীপ দখল করেই বা কি করবে। এমন নয় যে ঘরবাড়ি তৈরি করে থাকতে শুরু করার জন্য অন্যদের তাড়াতে চাইছে। নিশ্চয়ই অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। লাভলু আর গবেষকা দ্বীপে এদের প্রতিনিধি হয়ে সব কাজ করে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে আরও লোক আনা হয়। ওরা বলেছে গবেষক তার রিপোর্ট ফাইনাল করেছে, পার্টি দ্রুত কাজ শুরু করতে চায়। কিসের রিপোর্ট, কারা সেই পার্টি, কি কাজ শুরু করবে? সব কিছু মিলিয়ে উঠতে পারলো না অয়ন। তাই আপাতত দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। আগে এদের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করতে হবে।
‘তোমরা যাও এবার, বাইরে দেখ ও দুটোকে পাও কি না? বেচারার একা থাকতে ভাল-াগছে না বোধ হয়।’ লাভলু আর আবুকে বললো নেতা লোকটা। বলেই হো হো করে হেসে উঠলো।
ঝোপের আড়ালে বসে ঘটনাটা টের পেল ফাহাদ আর মাহি। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও অয়ন যে ধরা পড়েছে সেটা বুঝলো। কিছুটা ভয় পেলেও সাহস হারালো না। সিদ্ধান্ত নিলো অয়নকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। এ সময় বোটের দরজা খুলে দুটো লোক বেরিয়ে আসতে দেখলো। তারা টর্চলাইট জ্বেলে আশপাশে খুঁজতে লাগলো কিছু একটা। লোক দুটো যে ওদের দু’জনকেই খুঁজছে বুঝতে সময় লাগলো না। কারণ অয়নের সাথে তার সঙ্গীরা থাকবে এটা ওদের জানার কথা। কণ্ঠ শুনে লাভলুকে চিনতে পারলো। এই মুহূর্তে ধরা পড়া চলবে না। বরং অয়নকে বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে। অয়নের বুদ্ধিটাই কাজে লাগাবে চিন্তা করলো। বাংলোয় গিয়ে অয়নের আব্বুকে সব খুলে বলবে। এরা ভয়ঙ্কর লোক, যা কিছু করতে পারে। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে গাছের আড়াল রেখে পিছু হটতে শুরু করলো ফাহাদ আর মাহি। দ্রুত পৌঁছে গেল বাংলোয়।
সে রাতেই অয়নের আব্বুর রুমের সামনে একটি চিঠি পাওয়া গেল রত্নদ্বীপ ছাড়ার হুমকি দিয়ে। অন্যথায় তার ছেলের লাশের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। রাতেই তাকে ঘটনা খুলে বলেছে ফাহাদ আর মাহি। শুরু থেকে যা যা ঘটেছে, ওরা দ্বীপে আসার পর যা দেখেছে সব। টুরিস্ট স্পটের কাজ বন্ধ করার জন্যই যে এতকিছু হচ্ছে সেটা বললো ওরা। সব শুনে কিছু বলেননি অয়নের আব্বু। ওদেরকে ঘুমাতে যেতে বলে নিজের ঘরে যান তিনি।

৯.
ধীর ধীরে চোখ খুললো অয়ন। নড়তে গিয়ে টের পেল ও বাংলোয় নেই। সারা শরীর বাঁধা। আস্তে আস্তে সব মনে পড়লো রাতের কথা। এখন ক’টা বাজে বুঝতে পারলো না। তবে বাইরের আলো দেখে বোঝা যায় রাত পেরিয়ে আরেকটি দিন হয়েছে অনেক আগেই। ঘাড় ঘুরিয়ে বোটের চার পাশটা দেখলো অয়ন। কেউ নেই, থাকার কথাও নয়। অয়নকে রাতে ট্রলার ঘাটে অনেকক্ষণ জেরা করার পর ওরা বোট চালু করে মাঝ সমুদ্রে আসে। ফাহাদ আর মাহি ধরা পড়েনি। কতক্ষণ পর আবু বোটে ফিরে এসেছে আর লাভলু বাড়ি চলে গেছে। এরপর নিজেদের মাঝে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। অয়ন চুপ করে থাকতে থাকতে একটা বুদ্ধি আঁটে মাথায়। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। নড়াচড়া নেই দেখে একজন ধাক্কা দেয় অয়নের গায়ে। কিন্তু তাতেও শব্দ নেই দেখে ভাবে ঘুমিয়ে গেছে। নেতা লোকটি কণ্ঠে নকল আফসোসের ভান করে বলে- ‘আহারে! বাচ্চা ছেলে সন্ধ্যে থেকে কিছু খায়নি, তার ওপর এত খাটুনি গেল। বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
অয়নকে কি করবে সেটা নিয়ে ওদের মাঝে কথা হয় অনেকক্ষণ। একবার ওদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলো। আবার বললো তাতে ধরা পড়তে পারে। কথা শুনে বুঝেছে ওরা কুয়াকাটায় থাকে। একটা হোটেলে উঠেছে। হোটেলের নামটাও মনে আছ অয়নের। মোটা লোকটা বাইরে থেকে এলেও চিকনটি এলাকার লোক। মোটুর সাগরেদ হিসেবে কাজ করে। ধরা পড়ার আশঙ্কায় হোটেলে নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। দ্বীপে গবেষক আর লাভলুর বাড়িতে রাখার কথাও হলো কিন্তু সেটা বাতিল হলো ওর আব্বু পুলিশ নিয়ে হানা দিতে পারে এই আশঙ্কায়। বললো- এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে কেউ খুঁজেও না পায়।
বোট ড্রাইভার আবু বললো- ‘স্যার এইডারে বোটে বাইন্ধ্যা রাখেন, তাইলে কেউ আর টের পাইবো না।’
আবুর প্রস্তাব মনে ধরলো নেতা লোকটির। তার নাম আজগর। রাতের কথায় অন্তত তাই বুঝেছে অয়ন। চিকনা একবার তাকে আজগর ভাই বলে সম্মোধন করছে। তবে চিকনার নাম বলতে শোনেনি কারও মুখে।
আবুর প্রস্তাবটা কেমন হয় চিকনার কাছে জানতে চায় আজগর। কতক্ষণ চিন্তা করে সায় দিলো চিকনা। তবে বললো কুয়াকাটা ঘাটে অনেক বোট আর লোকজন থাকে। এই বাচ্চা চিল-াচিলি- করলে লোকজন টের পেয়ে যাবে।
তারপর সিদ্ধান্ত নিল ওকে বোটেই বেঁধে রাখবে, তবে বোট কুয়াকাটা নেবে না। ডেরায় রাখবে বললো। আরেকটা বোট নিয়ে ওরা কুয়াকাটা ফিরবে। ডেরা কি বুঝতে পারলো না অয়ন। তবে কথাবার্তায় বুঝলো দ্বীপের আশপাশেই হবে জায়গাটা। আবুকে ডেরার দিকে বোট ঘুরাতে বললো আজগর। বোটের দিক পরিবর্তন টের পেল অয়ন। প্রায় আধাঘন্টা চলার পর বোটের গতি কমলো। সমুদ্র ছেড়ে অন্য কোথাও প্রবেশে করেছে বোট। একসময় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। পুরোপুরি থেমে গেল বোট। সবার আগে বোট ছেড়ে নামলো আবু। কতক্ষণ পর আরেকটি বোট এসে ভিড়লো এই বোটের গায়ে। নেমে গেল আজগর আর চিকনা। দু’জনেই অয়নের মুখের ওপর উঁকি দিয়ে দেখলো ঘুমিয়েছে কি না। আজগর বললো- ‘থাকো বাছা, ঘুমাও তুমি আমরা চললাম। কাল সন্ধ্যার অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে এখানেই কষ্ট করে থাকতে হবে।’ এরপর চিকনাকে উদ্দেশ করে বললো কাল সন্ধ্যায় লোকজন যারা আসবে তাদের কাছে ওর জন্য কিছু খাবার পাঠিয়ে দিতে।
হাত নাড়াতে চেষ্টা করলো অয়ন; কিন্তু পারলো না। নাইলনের দড়ি বসে যাচ্ছে চামড়ায়। চারদিক তাকিয়ে উপায় খুঁজলো। যে কোন ভাবে এখান থেকে মুক্ত হতে হবে। নইলে আজ আবার খুন খারাবি ঘটবে দ্বীপে। ওর আব্বুকেও কাজ গুটিয়ে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করবে ওরা। দ্বীপটা দখল করতে ওরা যে কোন কিছু করতে পারে। তবে এ সবই ঠেকানো সম্ভব অয়ন এখান থেকে পালাতে পারলে। কথা শুনে বুঝেছে সন্ধ্যার আগে এই বোটে কেউ আর আসবে না ওরা। তার মানে অয়ন পালালেও ওরা সেটা টের পাবে সন্ধ্যায় যখন দলবল নিয়ে ডাকাতি করতে আসবে। আর এর আগেই যদি পুলিশকে জানানো যায় তাহলে ওদেরকে হাতেনাতেই ধরা সম্ভব।
একটু মোড়ামুড়ি করতেই যে টুলটায় ওকে শোয়ানো হয়েছে সেটা নড়ে উঠলো। অয়নের সন্দেহ হলো টুলটা পাটাতনের সাথে জোড়ানো নেই। আরও জোরে শরীরটাকে ডানে বামে নাড়িয়ে দিল ও। এবার কাজ হলো বাম দিকে বোটের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পুরো টুলসহ বোটের মেঝেতে কাত হয়ে পড়লো অয়ন। ডান কাঁধে চোট পেল তবে গায়ে মাখলো না সেটা। আশপাশে তাকালো কোন কিছু সহযোগিতা পাওয়া যায় এই আশায়। পেল না তেমন কিছু। পায়ের দিকে তাকালো। সামান্য একটু পরিবর্তন দেখতে পেল। বেঞ্চিতে মোট দুইটা কুশন পাশাপাশি রাখা। মাথার দিকে একটা আর কোমড় থেকে নিচের দিকে একটা। মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে পায়ের অংশের কুশনটা টুল ছেড়ে অনেকখানি বেরিয়ে গেছে। আশার আলো দেখতে পেল অয়ন। কুশনটা পুরোপুরি বের হয়ে গেল পায়ের বাঁধন ঢিলে হয়ে যাবে। পা দিয়ে আস্তে আস্তে বাইরের দিকে ঠেলতে লাগলো কুশনটাকে। প্রতিবারে দু’এক সেন্টিমিটার করে সড়ছে সেটা। দশ মিনিট এভাবে করার পর প্রায় অর্ধেকটা সরে গেছে; কিন্তু ততক্ষণে পায়ের শক্তি কমে এসছে। কয়েক মিনিট জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলো একই কাজ। এবার আগের চেয়ে দ্রুত সরতে লাগলো কুশনটা। কয়েকবারের চেষ্টায় পুরোটা বেরিয়ে গেল টুল ছেড়ে। শক্ত বাঁধনের মাঝ থেকে প্রায় দুই ইঞ্চি মোটা কুশনটা সরে যাওয়ায় পায়ের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। একটু চেষ্টা করতেই দড়ি থেকে পা বের করে ফেলতে পারলো অয়ন।
পা দুটো যেন জমে গেছে। স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো বেশ কিছুক্ষণ। শরীর ঘেমে গেছে এরই মধ্যে। তবে বসে থাকার সুযোগ নেই। এবার হাতের বাঁধন খেলায় মনোযোগ দিলো। পা ভাঁজ করে উঠে বসতে চেষ্টা করলো। টুলটা পিঠে নিয়ে কোন মতে বসতে পারলো। হাত দুটো পেটের কাছে বাঁধা ছিল। মাথা নিচু করে মুখটা সেখানে নিতে চেষ্টা করলো, শোয়া অবস্থায় যেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মুখটা পুরোপুরি হাতের কাছে গেল না। হাত দুটোকে টেনে কিছুটা উপরে উঠাতে পারলে কাজটা সহজ হবে। তাই করলো। দড়িতে টান লেগে চামড়া ছিঁড়ে গেল কিন্তু কেয়ার করলো না। মুখ আর হাত এক জায়গায় হতেই দাত দিয়ে দড়ির গিঁট খুলতে শুরু করলো। টান লেগে গিঁট আরও শক্ত হয়ে গেছে তাই সহজে খুলছে না। তবে এক সময় অয়নের পরিশ্রমের কাছে হারতে হলো সেটাকে। দ্রুত নিজেকে মুক্ত করলো। কিন্তু ততক্ষণে শরীরের শক্তি সব শেষ হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। এমনিতেই কাল সন্ধ্যা থেকে কিছু পেটে পড়েনি। তার ওপর এত পরিশ্রম। কোনরকম শরীরটাকে টেনে নিয়ে পাশের বেঞ্চিটায় শুয়ে পড়লো। পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে কিছুটা শক্তি ফিরে এলো শরীরে। চারদিকে তাকিয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজলো। সামনের দরজায় ওরা রাতেই তালা লাগিয়ে গেছে। বিকল্প পথে বের হতে হবে।
যাওয়ার আগে বোটটি সার্চ করার চিন্তা মাথায় এলো। কাজে লাগবে এমন কোন কিছু পাওয়া যেতে পারে। পেছনের দিকে এক কোণে দুটো কাগজের স্টেশনারি বক্স দেখলো অয়ন। বেশি কিছু পাওয়া গেল না বক্স দুটোতে। একটাতে একটা খাম পাওয়া গেল আজগর আলীর নাম ঠিকানা লেখা। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে ভেবে অয়ন সেটা নিয়ে নিলো। এবার বের হওয়ার জায়গা খুঁজতে লাগলো। বেড়ার গায়ে একটা জানালার সিটকানি ধরে টান দিতেই খুলে গেল। উঁকি দিয়ে বাইরে তাকালো। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো খোলা বাতাসে। বের হওয়ার আগে পায়ের কেডসের মধ্যে হাত দিয়ে ছোট ফোল্ডিং ছুরিটা পেল জায়গা মতো। অয়ন ছোট বলে হয়তো ওরা শরীর সার্চ করেনি। টর্চ লাইটা রয়ে গেছে ফাহাদের কাছে। তখনই মনে পড়লো ওদের কথা। ধরা যেহেতু পড়েনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাবাকে সব জানিয়েছে। আর সব জানলে বাবা বসে থাকার পাত্র না। ছুরিটা হাতেই রাখলো অয়ন। জায়গাটা কোথায় এখনও জানে না। আগেই প্রস্তুত থাকা ভালো। একবার যেহেতু বের হতে পারছে তাহলে আর ধরা পড়া যাবে না।
বোটের জানালা দিয়ে মাথাসহ শরীরের অর্ধেকটা বের করে দিল অয়ন। ঐ অবস্থায়ই শরীরটাকে ঘুরিয়ে চিত হয়ে গেল এরপর হাত বাড়িয়ে বোটের ছাদের কিনার ধরলো। এবার বের করে আনলো পুরো শরীর। এক ঝটকায় উঠে এলো ছাদে। চারদিক তাকলো, না আশপাশে কেউ নেই। জায়গাটা চিনতে চেষ্টা করলো। চারপাশে গোলপাতার গাছ। তার মাঝে একটা খালের মতো জায়গা। জায়গাটায় নিয়মিত লোকজন যাতায়াতের ছাপ রয়েছে। মাটিতে বোট ভেড়ানোর চিহ্ন আছে অনেক জায়গায়। জলাশয়টা একেবেকে পূর্বদিকে চলে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনলো অয়ন। সমুদ্র থেকেই হয়তো এই জায়গাটায় এসেছে বোট। এটা যদি ওদের ডেরা হয় তাহলে বলতে হবে এই জায়গাটা নিয়মিতই ব্যবহার করে দুষ্কৃতকারীরা। সেদিন ড্রাইভারকে তোলার জন্য লাভলু এরকম একটি গোলপাতার বন থেকেই বোট নিয়ে বেরিয়েছিল। হতে পারে এটাই সেই জায়গা। আর কিছু না ভেবে এবার যাওয়ার চিন্তা করলো অয়ন। নেমে এলো বোট থেকে। জলাশয় থেকে একটা পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে। পথটা দিয়ে নিয়মিত লোক চলাচল হয় বোঝাই যাচ্ছে। সে পথটা ধরেই এগোলো অয়ন। কতদূর হাঁটার পর পথ ছেড়ে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। কারও সামনে পড়তে চায় না। কতদূর এসে একটা রাস্তায় উঠেছে পথটা। এবার জায়গাটা চিনতে পারলো অয়ন। ওদের বাংলোর সামনে দিয়ে দ্বীপের উত্তর দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে এটা সেই রাস্তা। তার মানে লাভলুদের ডেরাটা দ্বীপের উত্তর মাথায়। এবার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল অয়ন।

১০.
অয়ন যখন নিজেদের বাংলোয় ঢুকলো ঘড়িতে তখন দুপুর প্রায় ১২টা। ছেলেকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হলো ওর বাবা। সেই সকাল থেকে মনমরা হয়ে বাংলোয় বসেছিলেন তিনি। কী করবেন তাই নিয়ে ভেবে কাটিয়েছেন কাল রাত থেকে। চেহারা দেখে অয়ন বুঝলো সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি বাবা। ফাহাদ, মাহি, এমনকি সালামের চেহারও বিধ্বস্ত। ওর কথা চিন্তা করে সবার মনের ওপর দিয়ে কি রকম ঝড় বয়ে গেছে সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। সময় নষ্ট না করে দ্রুত সব খুলে বললো বাবাকে। নিজের বুদ্ধিমত পরামর্শও দিলো সাথে।
সেই সময় থেকে ফাহদ আর মাহিকে পাঠানো হলো গবেষকের বাড়ির ওপর নজর রাখতে। ওরা কেউ বাড়ি থেকে বের হয় কি না, বের হয়ে কোথায় যায় তা দেখতে হবে। সেই সাথে ওদের এমন ভাবে নজরদারি করতে বললো যাতে তারা ওদের দেখতে পায়। চোখে ধুলো দেয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। নজরদারি করতে দেখলো ওরা বুঝতে পারবে না অয়ন ফিরে এসেছে। ভাববে অয়নের খোঁজ পাওয়ার জন্যই ওর বন্ধুরা ঐ বাড়ির ওপর চোখ রাখছে। একই সময় সালাম মিয়া বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। তাকে বলা হলো স্পিডবোট নিয়ে দ্বীপের পশ্চিম দিকে যেতে। অয়নের আব্বু সেখান থেকে বোটে উঠবেন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কুয়াটাকা যাবেন তিনি। এই থানার ওসি তার পরিচিত। এখানে কাজ শুরু করার পর থেকেই পরিচয়। তাকে নিয়ে সন্ধ্যায় সন্ত্রাসীদের ধরার ব্যবস্থা করবেন। অয়ন ঘরেই শুয়ে বসে কাটালো একা।
সন্ধ্যায় সব কিছুই পরিকল্পনামত হলো। লাভলুদের ডেরায় ত্রিশজন পুলিশের একটি দল ওঁৎ পেতে ছিল বিকেল থেকে। লাভলু সেখানে গিয়েছিল ডাকাতদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে। দু’টি বোটে ডাকাতরা আশামাত্র তাদের গ্রেফতার করা হলো। দু’জন অবশ্য পালাতে পেরেছে। বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হলো গবেষক ড. শাহেদকে। বেশ কিছু যন্ত্রপাতিও জব্দ করলো পুলিশ সেখান থেকে। আর কুয়াকাটার আবাসিক হোটেল থেকে আটক হলো আজগর আর তার সহযোগী সেই চিকনা। ওসির অনুরোধে পরদিন সকালে থানায় গেল অয়নের আব্বুর সাথে ওরা সবাই। ওসির কাছে শুনলো সব ঘটনা। ড. শাহেদ একজন ভূতাত্তিক গবেষক। বিদেশে থাকতেন তিনি। মাস তিনেক আগে রত্নদ্বীপে কাজ করার জন্যই তাকে দেশে নিয়ে আসে আজগরের কোম্পানি। দ্বীপের আশপাশে প্রচুর খনিজসম্পদ আছে বলে তারা জানতে পারে। তাই গবেষকের কাজ ছিল খনি চিহ্নিত করা আর লাভলুর কাজ ছিল নানান ঘটনা ঘটিয়ে দ্বীপের বাসিন্দা ও টুরিস্টদের ভয় দেখিয়ে দ্বীপ থেকে তাড়ানো। কারণ দ্বীপটাতে যেভাবে দিনদিন টুরিস্টদের ভিড় বেড়ে চলেছে তাতে তারা গোপনে খনি থেকে সম্পদ চুরি করতে পারবে না। ওসি জানালেন ঢাকায় রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। কাল রাতেই আজগরের প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে খনি অনুসন্ধানবিষয়ক বেশ কিছু ডকুমেন্ট পেয়েছে পুলিশ। অফিসটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।
ওসি সাহেবকে আবারও ধন্যবাদ দিলেন অয়নের আব্বু। একে একে সবাই হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এলো থানা থেকে।
(সমাপ্ত)

SHARE

Leave a Reply