সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই মা বললেন, তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমরা আজ ঢাকা যাবো। কথাটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল শাহেদের। ডিসেম্বরে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে শীতের ছুটিতে দাদুর কাছে বেড়াতে এসেছিল শাহেদেরা। শাহেদেরা বলতে শাহেদ, তার বাবা, মা আর বোন নুজাইফা। শাহেদের বয়স দশ বছর। সে ঢাকার একটা স্কুলে পড়ে। বাবার চাকরির জন্য তাদের ঢাকায় থাকা। মা একটা স্কুলের টিচার। বড় বোন নুজাইফা এবার এসএসসি পাস করেছে। বাবার কাজ আর মায়ের স্কুলকেন্দ্রিক ব্যস্ততা থাকার কারণে কোথাও তেমন ঘুরতে যাওয়া হয় না। শাহেদের জন্ম ঢাকায় এবং সে জীবনের দশটি বছর অতিক্রম করেছে ঢাকার ইটপাথরে ঘেরা চার দেয়ালের মধ্যে। তার দাদুর বাড়ি গ্রামে হলেও কখনো গ্রাম দেখা হয়নি। তবে গ্রামের অনেক গল্প সে বই পড়ে জেনেছে। সেখানকার লোকদের অতিথিপরায়ণতা, সহজ সরল জীবন যাপনের কথা। তবে তা নিজের চোখে দেখার লোভ সে সংবরণ করতে পারেনি। আর তাই শীতের ছুটিতে বাবা ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইলে সে দাদুর বাড়ি যাবে বলে জেদ ধরে। তার দাদুর বাড়ি ঢাকা থেকে অনেক দূরে আর একটি বিভাগীয় শহর আছে রাজশাহী। এই রাজশাহী শহরের দুর্গাপুর থানার অন্তর্গত। বাবার মুখে মাঝে মাঝে এই গ্রামের কিছু কিছু গল্প শুনেছে শাহেদ।
তার দাদু গ্রামের সবচেয়ে ধনী কৃষক পরিবার। তাদের বাড়িতে রয়েছে কয়েক জোড়া হালের গরু। যদিও তা এখন আর জমিচাষে ব্যবহার হয় না। রয়েছে পুকুর, আম বাগান। নিজেদের পুকুরের বড় মাছের স্বাদ আলাদা। দাদু তাকে নিয়ে পুকুর ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর জাইলা (যে জাল দিয়ে মাছ ধরে) চাচাকে দিয়ে বড় বড় মাছ ধরেছেন তাদের জন্য। দাদু নিজে যতœ করে রেখেছেন এই মাছগুলো। এক একটা মাছের ওজন পাঁচ থেকে দশ কেজি। নিজ চোখে না দেখলে হয়তো কখনো বিশ্বাস হতো না তার। তাদের রয়েছে অসংখ্য খেজুরগাছ। প্রত্যেক দিন সকালে গাছ থেকে গাছি রস নিয়ে আসেন। কি যে মজার গন্ধ কাঁচা রসের! মাতাল করে দেয় শাহেদকে। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও সে দুই গ্লাস করে রস খেয়ে ফেলে। আর এই রস যখন আগুনে জ্বাল দিয়ে পাটালি তৈরি করা হয়, তখন অন্য রকম এক মোহনীয় ঘ্রাণ বের হয়।
পাটালির আগে তৈরি ঝুলাগুড় পানিতে রেখে চিট করে খেতে আরো মজা। জাইলা চাচা তাকে নিয়ে গিয়ে নারকেল পেড়ে খাওয়ান। আবার আদর করে শাহেদকে বলেন, আমার ছোট বাপ্ আছচে। তা বাপরে কইত যে রাখি। বাপের নরম নরম পা খ্যান মাটিতে রাখলে ব্যথা পাবি। শাহেদ তার কথা শুনে আর মনে মনে হাসে। কি যে ভাবেন জাইলা চাচা। শাহেদ কত বড় হয়েছে। সে একা একা কম্পিউটার চালাতে পারে। ছাদে গিয়ে গাছে পানি দেয়। পাখিদের সাথে কথা বলে। আর জাইলা চাচা তাকে কি সব বলেন। অবশ্য সেসব কথা শুনে ইচ্ছা হয়, সে পাখির নরম তুলতুলে বাচ্চা হয়ে জাইলা চাচার সাথে থেকে যায়। জাইলা চাচা অনেক গল্প বলেন। জিনের গল্প, ভূতের গল্প, নাক কাটির গল্প, ডাকাত-চুরের গল্প, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার গল্প। আরও কত কি! তার কাছে জিনের গল্প ভালো লাগে।
চাচা একবার ভুল করে অনেক রাতে নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন। তখন তার বয়স আঠারো-উনিশ হবে। দেখতে সুদর্শন। টকটকে অ্যাপেলের মতো চোয়াল। তিনি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন সে পথের মাঝে একটা পুরনো বাড়ি ছিলো। সে বাড়িতে থাকে একটা জিন। তাও মেয়ে জিন। চাচাকে দেখে সে জিন চলে এসেছে। তাকে নিয়ে যাবে। চাচা জিনের সাথে এক ঘন্টাব্যাপী ধস্তাধস্তি করে। সেখান থেকে ফিরে আসে। এই গল্প তিনি অনেকবার শুনিয়েছেন। শাহেদেরও ভালো লাগে। কিন্তু আজ মায়ের কথা শুনে দাদুর, জাইলা চাচার কথা বারবার মনে পড়ছে।
তারা এই কয়টা দিন কত আদরে রেখে ছিল শাহেদকে। অথচ আজকে আবার চলে যেতে হবে ঢাকায়। সেই যান্ত্রিক জীবনে। যেখানে কেউ গল্প শুনায় না শাহেদকে। নিজে থেকে পড়ে জেনে নিতে হয়। যেখানে সত্যি জিনের কাহিনী কেউ জানে না। বইয়ের পাতার মিথ্যে জিনে ছড়াছড়ি। যেখানে মানুষই জিন। অথবা জিনই মানুষ!