রাত ৯টা। পড়ছে সাফিন। মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ ঘরে এলো সাঈদা। হন্তদন্ত হয়ে। সাফিনের সামনের চেয়ারে বসলো ধপ করে। নাক মুখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। কপাল আধভেজা। ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে কী যেন বললো এক নাগাড়ে!
প্রথমে চমকে উঠলো সাফিন। না, ওটা সাঈদা। কয়েকবার তাকিয়ে নিশ্চিত হলো। মোলায়েম কণ্ঠে বললো-
‘কিরে আপু! কী হয়েছে? খুলে বলো তো সব !’
‘কে যেন কল করেছিলো! আব্বুর মোবাইলে? আব্বু তোমাকে ডাকে এখুনি।’
এক নিঃশ্বাসে বললো সাঈদা। উঠে দাঁড়ালো সাফিন। বই বন্ধ করতে করতে বললো ও ‘আচ্ছা! এই ব্যাপার ! তো ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? চলো।’
সাঈদা আগে ছুটছে। অনুসরণ করছে সাফিন। মাথায় চিন্তার ঝড়। চাচা তাকে কেন ডাকছেন। পড়ার সময়তো চাচা ডাকেন না। অন্তত ৮-৯ বছরে তাই দেখেছে সে। আজ কি ব্যাপার! আল্লাহ তায়ালাই মালুম।
সাফিন লজিং থাকে সাঈদাদের বাড়ি। সাফিনের গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট। তার বাবার নাম শমসের আলী। দিনমজুর ছিলেন। জায়গাজমি এক কালে কিছু ছিলো। অসুখে পড়ে সব গেছে। তবু অসুখ ভালো হয়নি। চিকিৎসাবস্থায় মারা গেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আমিনা বেগমের। দুই সন্তান নিয়ে কী করবেন কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে নামেন জীবনসংগ্রামে। এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করেন। কাজ পেলে খাবার জুটতো। না হলে অনাহার।
এমনি দুঃখ কষ্টের সময় এগিয়ে এলেন আফসার আলী। বড় ছেলেকে একটা কাজ দিলেন। ছোটোখাট কাজ। অল্প বেতন। আর সাফিনকে নিয়ে এলেন সিঙ্গাইরে। দিয়ে গেলেন তার নিঃসন্তান বন্ধু সাবিতের বাসায়। গ্রামের মানুষ তাকে সাবিত বিএসসি ডাকে। বিএসসি পাস করেই তিনি চাকরি নেন। ধল্লা বাজার প্রাইমারি স্কুলে। আগে থেকেই তিনি খুব হাসি খুশিতে থাকতেন। বিয়ের পরেও ছিলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা তদবির করেও যখন বাবা হতে পারলেন না, বাবা ডাক শুনতে পেলেন না তখন তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। এই গুরুগম্ভীর লোকটা সাফিনকে পেয়ে খুশি। উচ্ছল প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। সাফিনকে নিজের সন্তানের মতো বড় করে তোলেন। সাফিন তার তত্ত্বাবধানেই লেখাপড়া করে। এসএসছি পাস করে। ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি নিয়ে।
‘ছোট আব্বু আমায় ডেকেছেন?’ ঘরে ঢুকেই বললো সাফিন। সাফিন তাকে এভাবে ডাকে। অবশ্য আড়ালে আবডালে চাচাও ডাকে। সাবিত বিএসসি তাকে কাছে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে পরম মমতায় বললেন-
‘তোমার ভাই কল করেছিলো। তোমার মা অসুস্থ। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যাও। পরে প্রয়োজন হলে আমরাও আসবো।’ এমন কথায় সাফিনের অন্তর কেঁপে উঠলো। মায়ের এমন কী হলো যে তাকে যেতে বলছে। তবে কি তিনি আর নেই। না, আর ভাবতে পারে না সে। চোখে সর্ষে ফুল ভাসছে। ছোট আম্মু ভাত বেড়ে দিলেন। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। কেমন যেন লাগছে। তৃষ্ণা নেই। ক্ষুধাও যেন নেই। সব কিছু তিক্ত মনে হচ্ছে!
সাঈদা ব্যাগ গুছিয়ে আনলো। ঝটপট করে। এত তাড়াতাড়ি ব্যাগ গোছানো সম্ভব সাঈদাকে না দেখলে সাফিনের বিশ্বাসই হতো না। সাঈদার বয়স আট বছর। ইতোমধ্যেই সে সব কাজ শিখেছে। তার নামটা সাফিনই রেখেছে। নিজের নামের প্রথম অক্ষরের সাথে মিলিয়ে। তার জন্ম হলে সাফিন ভীষণ খুশি হয়। পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিলায়। মসজিদে মসজিদে মিলাদ পড়ায়। সাফিন খাচ্ছে না দেখে ধমকে উঠলো সাঈদা। দু-এক লোকমা মুখে পুরেই উঠলো সাফিন। পোশাক চেঞ্জ করলো। ছোট আম্মু কিছু পিঠা দিলেন ব্যাগে। এক রকম জোর করে। পথে খাবার জন্য। রাস্তাঘাটের জিনিস তিনি নিজে খান না। অন্যকে খেতেও দেন না। আসলেই অপরিচিত কারো থেকে কিছু খাওয়া ঠিক নয়। কোন সময় কী বিপদ নেমে আসে বলা যায় না। কথায় আছে না! সাবধানতার মার নেই!
বিদায় নিয়ে বেরুলো সাফিন। রাস্তার বাস কাউন্টার পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন সাবিত বিএসসি। রাত ৮টার পর এমনি গাড়ি পাওয়া মুশকিল। দু-একটা যা-ই পাওয়া যায় পেসেঞ্জারে ঠাসা। গাড়ির অপেক্ষা না করে সাফিনকে সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন সাবিত বিএসসি। প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে গাবতলী পৌঁছলো সিএনজি। পাওনা চুকিয়ে নেমে পড়লো সাফিন। ছুটলো নাবিল কাউন্টার বরাবর। কয়েকজন টানাটানি করলো মাঝপথে। কাউন্টারগুলোর এই এক সমস্যা। কে কোথায় যাবে না জেনেই টানাটানি করবে। কেউ হাত ধরে। কেউ কেউ আবার ব্যাগ ধরে। টানাটানির মধ্য অনেকে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। কী করবে কিছু বোঝার আগেই ব্যাগ নিয়ে ছিনতাই করে ভোঁ দৌড়। কবে যে এই অবস্থা বন্ধ হবে! আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নাবিল কাউন্টারে পৌঁছলো সাফিন। টিকেট নেই। সব বিক্রি হয়েছে। বাধ্য হয়ে বেশি টাকায় টিকেট নিলো। ৬০০ টাকায়। দশটার গাড়ি এলো ১১টায়। গালির বুলেট ছোটাচ্ছে কেউ কেউ। গাড়িতে উঠতে কেউ কেউ। বসছে যার যার নির্দিষ্ট সিটে। সাফিনও উঠে বসলো। আরো অনেক পরে গাড়ি স্টার্স্ট নিলো। চলতে শুরু করলো একটু একটু করে। একটু এগিয়ে গতি বেড়ে গেলো। এবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে গাড়ি। প্রশস্ত পিচঢালা রাস্তার বুক চিরে। তবু সাফিনের মনে হলো আস্তে চলছে। ঠিক মেঠোপথে গরুর গাড়ির মতো।
সাফিনদের বাড়িটা ছোট। তিনটা ঘর মাত্র। দুটো ঘরের নিচে পাকা, ওপরে টিন। বাড়ির এক পাশে বাঁশঝাড়। আরেক পাশে আম-কাঁঠালের গাছ।
বাড়িতে অনেক মানুষের আনাগোনা রোগী দেখতে আসছে কেউ। কেউ আসছে সান্ত¡না দিতে। সকালে বাড়িতে পৌঁছলো সাফিন। মায়ের ঘরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে। আমেনা বেগম উঠতে চেষ্টা করলেন। এতদিন ঠিক মতো বসতে পারতেন না। শুধু শুয়ে থাকতেন। সাফিনকে দেখে উঠে বসলেন। কোলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন মুখ, কপাল, গাল। দীর্ঘ সময় মায়ের বুকে থেকে সুখ খুঁজে পেলো সাফিন। অফুরান সুখ, যা শুধু অনুভব করা যায়। কাউকে বোঝানো যায় না। ঢাকা থেকে আনা আপেল, কমলা, আঙুর মাকে খাওয়ালো সাফিন। নিজের হাতে কেটে। মা-ছেলের মুখে কতক্ষণ কথার যেন খই ছুটছিলো। দীর্ঘ সময় কথা বলে মাকে শুয়ে রেখে বাইরে বেরুলো সাফিন। অন্যদের সাথে দেখা করলো। কথা বললো নানা বিষয়ে। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শুনে ভাবীর ঘরের দিকে পা বাড়ালো। এতক্ষণ একমাত্র ভাতিজী সিলমীর কথা মনেই ছিলো না। সিলমীও ঘুমে ছিলো। ঘুম ভাঙতেই তাকে দেখলো। দেখেই ডাকতে শুরু করলো- ছোট আব্বু, ছোট আব্বু বলে। সাফিন তাকে কোলে নিলো। এক বুক আদর দিয়ে তার মাকে দিতে চাইলো। কিন্তু সিলমী গেলো না মায়ের কোলে। সাফিন তাকে কোলে নিয়ে কয়জন মুরব্বির কাছে গেলো। পরামর্শ করলো মাকে হাসপাতালে নেয়ার বিষয়ে। আমজাদ চাচা হাসপাতালে না নেয়ার পক্ষে। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন দেখো বাবা, শমসের মারা যাবার পর তোমরা অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছো। এখন সংসারে উন্নতি করেছো। এটা ধরে রাখা উচিত। মনে নেই তোমার বাবার চিকিৎসার জন্য জমিজায়গাও বেচে দিয়েছো। কী লাভ হলো এত টাকা খরচ করে। তিনিও গেলেন, না ফেরার দেখে, জমির টাকাগুলোও খোয়া গেলো। শোন তোমার মাকে তো দু-একবার নিয়েছো হাসপাতালে। এখন বাড়িতে ওষুধ পাতি খাওয়ায়। যে কয়দিন হায়াত আছে সেবা যতœ করো আর কি! রফিক চাচা তার কথার প্রতিবাদ করে বললেন এটা ঠিক নয় আমজাদ ভাই। কে কয়দিন বাঁচবে, কার কোথায় হায়াত ফুরাবে আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তাই বলে অসুস্থ ব্যক্তিকে ফেলে রাখা যায় না। উচিতও নয়। আরো কয়েকজন পক্ষে-বিপক্ষে কথা বললেন। সাফিনের কাছে রফিক চাচার কথাই ভালো লাগলো। যুক্তিযুক্ত মনে হলো। আরে দুনিয়ার ধন সম্পদ কয়দিন থাকে। অর্থ আজ না থাকলেও কাল আসবে। কিন্তু মা চলে গেলে আর কি আসবেন। সাফিনরা হাসপাতালের সিদ্ধান্ত নিলো। সালিমের কিছু টাকা ব্যাংকে ছিলো।
বৃহস্পতিবার সকালে মাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলো ওরা। দ্রুত ভর্তি করালো। কিছু টাকা একজনের হাতে গুঁজে দিয়ে। না দিলে দেরি করাতো। ওরা টাকা ছাড়া নড়তেও চায় না। আসলেই হাসপাতালগুলোয় ভোগান্তির শেষ নেই। সাফিন ডাক্তারের সাথে আলাপ করলো। পূর্বের কাগজপাতিও দেখালো। ডাক্তারের নির্দেশে দুটো ইনজেকশন দেয়া হলো। ইনজেকশনের একটু পরই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সালিম বাড়ি চলে যায়। আর মায়ের পায়ের কাছে বসে থাকলো সাফিন। যদিও তার হাসপাতালের ভেতরটা ভালো লাগে না। কেমন যেন পরিবেশ। অসহ্য এক অদ্ভুত গন্ধ। রসহীন নিষ্ঠুর এক জগৎ। সময় কাটতে চায় না।
একটু চোখের পাতা বন্ধ করতেই ঘুম এলো। সে কী রাজ্যের ঘুম! ভোর ৪টায় যখন তার ঘুম ভাঙলো তখন অনেক কিছুই ঘটে গেছে। বুঝতে পারিনি সে। ঘুমে থেকে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভবও নয়। যখন বুঝলো তখন আর তার কিছুই করার নেই। মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। দুই চোখে তপ্ত অশ্রুর ঢেউ। কাঁপা কাঁপা হাতে কোন রকম ভাইয়াকে কল করলো।
অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছে। আরো আসছে। বাঁশ কাটা, খবর খনন করা, কাপড় আনা সবই অন্যরা করছে। হাসপাতাল থেকেও চাচাতো ভাইয়েরা লাশ এনেছে। সাফিন কিছুই করেনি। নির্বাক নিস্তব্ধ হয়েছে। ঠিক পাথরের মূর্তির মতো। জুমার আগেই গোসল দেয়া হলো। জুমা শেষে অনুষ্ঠিত হলো জানাজা। বাবার কবরের পাশেই দাফন করা হলো।
পড়ন্ত বিকেল। পশ্চিম আকাশে সূর্যটাকে একটা হলুদ বেলুনের মতো লাগছে। সিগ্ধ, কোমল। কে বলবে! এই সূর্যটা দিনমান তীব্র রোদ ছড়িয়েছে! আঙিনায় কোনের আমগাছের নিচে চেয়ারে বসে আছে সাফিন। তাকিয়ে আছে পশ্চিম দিকে। মৃদু হাওয়া গায়ে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ভাবছে সাফিন। ছোট আব্বুরা কেন এলো না! তারা তো সবার আগেই খবর পেয়েছে। তাহলে কি তারা তাকে ভালোবাসে না। না, এটা হতে পারে না। এমন ভাবাও অন্যায়। ছোট আব্বু-আম্মু তাকে ভীষণ ভালোবাসে। সাঈদার জন্ম হবার পরও। তবে কি জ্যামে পড়েছে না কোন বিপদে পড়েছে। হঠাৎ কারো পদশব্দ শুনে পেছনে তাকালো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ছোট আব্বুকে দেখে দিশে হারালো সাফিন। বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে…।