গল্প লিখছি বলে ভেবো না গুলপট্টি মারছি। তবে হ্যাঁ, এটি একটি জীবনের গল্প, বেঁচে থাকার গল্প। তোমরা কি কেউ আরপি ভাইয়াকে চেন? শোন তাহলে- বছর দুয়েক আগের কথা, সবেমাত্র এসএসসি কমপ্লিট করে কলেজে এসেছি। শহরের বড় নামকরা কলেজ। যেদিন প্রথম এলাম, হাঁ করে দেখতে দেখতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। কলেজের ছেলেরা বেশ পরিপাটি। দামি সু, ধবধবে সাদা শার্ট, পাশ কাটিয়ে গেলে একটা কড়া পারফিউম নাকে এসে লাগে। আমি গাঁয়ের তেলে-জলে মানুষ। তাই চোখ বড় বড় করে দেখলাম। হোস্টেলে থাকতে হলো। তিন তলায় একটা রুম পেলাম। বেশ বড়সড় একটা রুম। লাগেজপত্র নিয়ে সেদিনই রুমে উঠলাম। ফর্সামতো একটি ছেলে এগিয়ে এলো। উজ্জ্বল ফর্সা; ঘন কালো চুল, আমার দুই বছরের বড় হবে। বিছানাপত্র গোছাতে আগাগোড়ায় সাহায্য করল। আমি তখনো জানতাম না যে ইনি চোখে ভালো দেখতে পান না। জানতে পারলাম রাতে। বাড়ি ছেড়ে এত দূরে আসতে মন খারাপ হচ্ছিল। মাকে ছেড়ে কখনো একা থাকিনি তো তাই। ইস, গ্রামে কী মজাটাই না হয়। আর এখন কি না…।
“কী নাম তোমার?” ভয় পেয়ে পাক খেয়ে ঘুরে বসলাম। ফর্সা মতো ছেলেটা কখন যে পাশে এসে বসে আছে টেরই পাইনি। শহরের ছেলেদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা আমার জানা নেই। তুমি করে বলবো নাকি আপনি, ভাবতে ভাবতে ঘাম এসে গেল। শেষমেশ ঢোক গিলে বললাম, “আমি ইমন, ইমু বলেও ডাকতে পারেন। আপনার নাম? ছেলেটি হেসে বলল, ‘মাছুম’ শুধু মাছুম?
একটু কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম। “না, মাছুম ইবনে হাফিজ”। ভয়টা কেটে গেছে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম শহরের ছেলেদের সাথে আমি বেশ ভালোভাবেই কথা বলতে পারি। অনেকটা হালকা লাগছে। কথা বলে জানতে পারলাম তিনি আরপিতে আক্রান্ত। আরপি মানে ৎবঃরহরঃরং ঢ়রমসবহঃড়ংধ। একটা ভয়ানক চক্ষুব্যাধি। চোখে তেমন একটা দেখতে পান না। সাইড ভিউ জিরো বললেই চলে। মাইনাস সেভেন পাওয়ারের চশমা দিয়েও বোর্ডের লেখা দেখতে পান না। সুন্দর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে ভাইয়া বললেন, “আমি তবু বেশ ভালো আছি। সব কিছুকে নিজের মতো করে দেখি ঝাপসা ঝাপসা। যেমনটা আর কেউ দেখে না। ইচ্ছে করলেও না।”
আমার খুব খারাপ লাগল। ভাসা ভাসা চোখ, ভারী মিষ্টি চেহারা। কে বলবে ইনি আরপিতে আক্রান্ত। ভাইয়া প্রতিদিন আমার সাথে কলেজে যেতেন। নিজেই যেতেন, আমি শুধু দেখতাম সিঁড়িতে ঠিকমতো পা ফেলছেন কি না। একই সাথে খাবার রুমে যেতাম। ভাইয়ার খাওয়া খুব তাড়াতাড়ি শেষ হতো, তাই আমিও কম খেতাম। মাস তিনেক পর দেখা গেল আমি শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে গেছি।
এখনও খুব মনে আছে, বিকেলে আমি আর ভাইয়া কলেজের পেছনে বসতাম। সবুজ খোলা মাঠ। হরেক রঙের ফুলের বাগান। প্রকৃতি ভাইয়ার চোখের জন্য বেশ সহায়ক, তাই। আমার যেদিন প্রাইভেট থাকত ভাইয়া একাই বসে থাকতেন। আমি আসা না পর্যন্ত। মাছুম ভাইয়া ছিলেন প্রচন্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলতেন, “ইমু, আমি কি অক্সফোর্ডের টিচার হতে পারব?”
আমি বলতাম, “কেন পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।”
ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর যেদিন হোস্টেল ছেড়ে চলে আসব, সেদিন ভাইয়া খুব কেঁদেছিলেন। আমিও। কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল ভাইয়ার আমাকে ছেড়ে চলে যেতে।
সেদিন ফোনে কথা হয়েছিল। এখন মিরপুর বাঙলা কলেজে ইংরেজিতে অনার্স করছেন। ভাইয়া জানালেন জাপানের একটা দল নাকি আরপির প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে। তবে এখনো বাজারে আসেনি। পরীক্ষামূলকভাবে ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ চলছে। সফল হলে বাজারে আসবে।
ফোনে বললেন, “ইমু তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। আমার জন্য দোয়া করো।”
জাপানের গবেষক সফল হবেন কি না জানি না। তবে আমি বিশ্বাস করি ভাইয়া একদিন দেখবেন, দেখবেন। তোমরাও দোয়া করবে, যাতে আল্লাহ তায়ালা আরপি ভাইয়াকে পূর্ণ সুস্থতা দান করেন।