Home বিশেষ রচনা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) -ইকবাল কবীর মোহন

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) -ইকবাল কবীর মোহন

অনেক অনেক দিন আগের কথা। দুনিয়াজোড়া তখন ছিল ঘোর অন্ধকার। আঁধারে আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল মানুষের সমাজ। কালো অন্ধকার মানুষের মনকেও গ্রাস করে বসেছিল। তারা তখন শুধু ভুল করত। অন্যায় করত। সে কত রকমের অন্যায়। কোন ভালো কাজই তারা করতে চাইত না। সুন্দর ও ন্যায়ের কথা তারা ভুলেই গিয়েছিল। তাই তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল। তাদের না ছিল ধর্ম, না ছিল কর্ম। তাদের মধ্যে ছিল না মায়ামমতা কিংবা ভালোবাসা। মানবতা বলতে কিছুই তখনকার মানুষ বুঝতো না। তারা আল্লাহকে ভুলে পশু কিংবা গাছের পূজা করতো। কেউ বা করতো আগুনের পূজা। এভাবেই নানা রকম ভুলের মধ্যে তারা হাবুডুবু খাচ্ছিল। শুধু কি তাই! তাদের আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র ও ঝগড়া ফাসাদ তাদের মধ্যে লেগেই থাকত। মদ, জুয়া, বেহায়াপনা এসবে তারা সর্বদাই লিপ্ত থাকত। সকল খারাপ কাজই ছিল তাদের পেশা।
সুদূর আরবের মক্কা নগরীতেও অন্ধকার কম ছিল না। বরং সেখানে ছিল পাপ অন্যায়ের লীলাভূমি। মানুষ সেখানে অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল। তাই আল্লাহর বড় দয়া হলো। তিনি মানুষকে পাপ ও অন্যায়ের পথ হতে আলোর পথে আনতে চাইলেন। আল্লাহ তো আর দুনিয়ায় আসেন না। তিনি শুধু পথ খুলে দেন। মানুষের মাধ্যমেই তিনি সেই পথ দেখান। এ কাজ যারা করেন তারা হলেন নবী-রাসূল। সেই সময়ে আরবের সমাজেও তিনি নবী পাঠালেন। তিনি হলেন আমাদের প্রিয় নবী। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা)।
তখন ৫৭০ ঈসায়ী। রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। রাত শেষে সুবহ সাদিকের শুভক্ষণ। জান্নাতি বাতাসের আনাগোনা আর পাখিদের মধুর কলতান। সেই সুন্দর সময়ে জন্ম নিলেন শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা)। তিনি জন্ম নিলেন কুরাইশ বংশে।
সুন্দর মক্কা শহরের সর্দার গোত্রের নাম কুরাইশ। হাসেমি গোষ্ঠী কুরাইশ গোত্রেরই সেরা গোষ্ঠী। মানমর্যাদায় এই গোষ্ঠী সবার শীর্ষে। সেই গোষ্ঠীরই সর্দার আবদুল মুতালিব। জ্ঞানে, গুণে তিনি কুরাইশদের মধ্যমণি। তার ছোট ছেলের নাম আবদুল্লাহ। মা আমিনা নবীজির মাতা। বেশ নম্র, ভদ্র ও অসাধারণ গুণবতী মহিলা তিনি। তারই কোলজুড়ে এলেন শিশু নবী মুহাম্মদ (সা)। মায়ের মন বেহেশতি আমেজে যেন ভরে গেল অপূর্ব সুন্দর মুহাম্মদের আগমনে। তারপরই হলদে নরম রোদের রূপ ছড়িয়ে সূর্য উদিত হলো মক্কায়। গাছের থিরে থিরে আর ফুলের পাপড়িতে যেন আনন্দের ঢেউ লাগল। পাখিরা মধুর গানে ভরিয়ে দিল মক্কা নগরীর আকাশ বাতাস। এক নতুন জামানার দ্বার খুলে গেল মক্কায়।
ফুলের মত মায়াবী আর চাঁদের মত সুন্দর মুহাম্মদকে পেয়ে মা আমিনার মন ভরে উঠলো। সোনার চাঁদ মুহাম্মদকে পেয়ে আমিনার মনে যে কি তোলপাড়। কে দেখে সেই আনন্দ। সাত রাজার ধন কোলে পেয়ে মার মনে যেন বিষাদের ঝাপটা লাগে থেকে থেকে। মনটা কেঁদে ওঠে। মা কাঁদেন ঠোঁট চেপে। কেন কাঁদেন? কাঁদবেন না কেন? মুহাম্মদ যে পিতৃহারা এতিম। ছেলের জন্মের ছয় মাস আগেই আবদুল্লাহ দুনিয়া ছাড়েন। বাণিজ্যের জন্য দূর দেশে গিয়েছিলেন তিনি। পথেই হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান আবদুল্লাহ।
নবীজির দাদা আবদুল মোতালিব। তিনি শিশু নবীকে হালিমা নাম্নী এক দাইয়ের কাছে সঁপে দিলেন। আরবের রীতি মতো হালিমা খুশি মনেই ফুটফুটে শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন। শিশুকে কোলে তুলে হালিমার মন ভরে গেল সুন্দর শিশুর রূপ দেখে। হালিমা মুহাম্মদকে নিয়ে বাড়ি চললেন। মক্কা থেকে বেশ দূরে হালিমার বাড়ি। হালিমার সাথে ছিল একটা রোগা ও দুর্বল গাধা। চলতে ফিরতে গাধাটার বেশ কষ্ট হতো। হাঁটতে গেলে পড়ে যেত। প্রায় আধমরা অবস্থা। সেই গাধার পিঠে শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে চড়ে বসলেন হালিমা। বড়ই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। এমন আধমরা গাধা নিয়ে কিভাবে যাবেন এতদূরের পথ তাই তার চিন্তা। কিন্তু কি আশ্চর্য ঘটনা! শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে গাধার পিঠে যেই চড়লেন আর অমনি গাধা লাফিয়ে উঠলো। রোগা দুর্বল গাধা যেন শক্তি পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠলো। আর খুব দ্রুতই পৌঁছে গেল হালিমার বাড়িতে। হালিমা তাতে অবাকই হলেন। তবে তার রহস্য বুঝে উঠতে পারলেন না।
শিশু মুহাম্মদ মায়ের বুক ছেড়ে হালিমার ঘরে এলেন। অভাব অনটন আর নানান দুঃখে কাটছিল হালিমার সংসার। তা ছাড়া সে অঞ্চলে ফসল ফলতো না। গাছপালায় ফল ধরতো না। কুয়া-পুকুরে পানি থাকতো না। গরু, ছাগল, ভেড়া ঘাস খেতে পেতো না। তাই এদের দুধও হতো না। এমনি অবস্থায় শিশু মুহাম্মদ হালিমার গৃহে পৌঁছা মাত্রই তাঁর বাগান ফলে ফুলে ভরে উঠলো। খেত খামার ভরে গেল ফসলে ফসলে। সবুজ ঘাসের সমারোহ দেখা দিল। ছাগল, ভেড়া গম খেয়ে মোটা তাজা হলো। আর প্রচুর দুধ দিতে লাগলো। সেখানকার মানুষের অভাব ঘুচে গেল। কারো কোন দুঃখ আর রইলো না। দয়ার নবী শিশু মুহাম্মদের কারণে আল্লাহ অসীম রহমত ঢেলে দিলেন হালিমার দেশে। হালিমা সহসাই বুঝতে পারলেন শিশুটি যেনতেন শিশু নয়। চাঁদের মত মুখ, সোনার চেয়ে দামি এই শিশু তার মনপ্রাণ কেড়ে নিলো। তার মুখের দিকে চেয়ে প্রাণ জুড়ায় হালিমার। বুকে তুলে তাকে আদর করেন। চুমু খান। আর ভাবেন শিশুটকে নিয়ে। সে যেন এক বিরাট রহমতের শিশু। হালিমার আদরে যত্নে মুহাম্মদ (সা) বড় হতে থাকেন। ঘরে বসে থাকেন না, তিনি তার দুধভাইদের সাথে মাঠে যান, মেষ চরান। এভাবে দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেল। আর কতদিন। মায়ের কোলে ফিরে যাবার জন্য নবীজির মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। মা আমিনাও ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। কখন সোনামণি তার কোলে আসবে। এমন সময় একদিন হালিমা শিশু মুহাম্মদকে আমিনার কোলে তুলে দিলেন। মা মহা খুশি। ছেলেকে বুকে ধরে আদর করেন, চুমু খান তিনি। মমতার যেন শেষ হয় না। কিন্তু না মায়ের আঁচলও সইলো নবী মুহাম্মদের। তিনি খুব বেশি দিন মায়ের মমতা পেলেন না।
হজরতের বয়স তখন ছয় বছর। মা ছেলেকে নিয়ে মদিনার পথে বেরুলেন আবদুল্লাহর কবর জিয়ারাতে। বহু দূর মক্কা থেকে। কষ্ট করে হলেও গেলেন সেখানে। কিন্তু ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে মা আমিনা মারা গেলেন। অবুঝ শিশু মুহাম্মদ এবার পুরোপুরি এতিম হয়ে গেলেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও শূন্যতা বোঝার জন্যই হয়তো আল্লাহ তাকে শৈশবেই এতিম বানালেন। যাই হোক নবীজি কিন্তু মনভাঙা হলেন না। চাচা ও দাদার আদরে তিনি বড় হতে থাকলেন।
আরবে তখন চরম দুুর্দিন। ভীষণ বিশৃঙ্খলা আর হানাহানিতে সমাজ ভরপুর। এসব দেখে তাঁর মন কেঁদে উঠলো। তিনি ভাবতেন কিভাবে এদের দুঃখ দূর করা যায়। কিভাবে তাদের স্বভাব চরিত্র বদলানো যায়। নিরাশায় বসে বসে তিনি শুধু এসব কথাই ভাবতেন। তিনি মাঝে মাঝে ওপর দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখতেন। নীল আকাশ। সীমা-পরিসীমা নেই এই বড় আকাশের। কোথায় এর শুরু? কোথায় তার শেষ? তিনি ভেবেই পেতেন না কিছু। শুধু অবাক হতেন আর মাঝে মধ্যে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন।
তিনি দেখতেন মানুষ মাটির তৈরি পুতুল বানাচ্ছে। এর সামনে মাথা নত করছে। পুতুলের পূজা করছে। আর তাদের কাছেই কিছু চাইছে। তিনি এসব দেখে অবাক হন। তিনি বুঝতে পারেন সচল মানুষ একটা নির্জীব পুতুলের কাছে কিছু পাবে কিভাবে? তিনি দেখেন মানুষ মদ খায়। জুয়া খেলে। কন্যাসন্তান হলে তাকে জীবন্ত কবর দেয়। সমাজের মানুষগুলোকে তিনি মারামারি-কাটাকাটি করতে দেখে অবাক হন। এসব তাঁর মনকে বিষিয়ে তুলে। অথচ এ সমাজেই তিনি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না। সদা সত্য কথা বলেন। মানুষের উপকার করেন, আমানতের হেফাজত করেন। তাই সবাই তাকে আল আমিন বলে ডাকে। আল আমিন হলে কি হবে। মানুষের অকল্যাণ দেখে তিনি স্থির থাকতে পারেন না। তাই ভাবলেন যুবকদের তিনি ভালো করবেন। তাদের মধ্যে ভালো গুণের সৃষ্টি করবেন। আর এভাবেই সমাজের খারাবি দূর করবেন তিনি। তাই যুবকদের নিয়ে তিনি গড়লেন হিলফুল ফুজুল।
বিরাট আরব সমাজ। এ সমাজকে বদলানো ছিল খুবই কঠিন। মুহাম্মদ (সা) তাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি ভেবেছেন। সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছেন। এ জন্য ভেবে ভেবে কত দিন কত রজনী একাকী কাটিয়েছেন হেরা পর্বতের গুহায়। অবশেষে তিনি নবুওয়ত পেলেন। পেলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তির নির্দেশ। মানবতার কল্যাণের বাণী তিনি এবার মানুষকে জানাতে ব্যাপৃত হলেন। কিন্তু মানুষ বড় পাষন্ড। আরবদের মন খুবই কঠিন। তাদের মন ছিল অন্ধকারে পরিপূর্ণ। তাই আল্লাহর বাণী তাদের পছন্দ হলো না। তারা মুহাম্মদকে ভালবাসতো। আপন বলে জানতো। কিন্তু আল্লাহর বাণী বা ইসলামের কথা বলায় তারা তাকে গালিগালাজ করল। ভর্ৎসনা করলো। নিষ্পাপ মুহাম্মদকে মারধর করতেও পাপিষ্ঠরা পিছপা হলো না। অবশেষে নবীজির প্রাণ পর্যন্ত নিতে চাইলো শত্রুরা। নবীজি সত্যের পথ থেকে তাতেও বিরত হলেন না। জুলুম ও নির্যাতনের মুখেও তিনি দ্বীনের পথে অটল থাকলেন।
দীর্ঘ তেরো বছর মক্কায় ন্যায় ও সত্যের প্রচারে নবীজি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যারাই সত্যকে গ্রহণ করলো তাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল। কাফের মোশরেকদের নির্যাতন আর সহ্য করা গেল না। তাই নবীজি আল্লাহর হুকুমে দূর দেশ মদিনায় হিজরত করলেন। সেখানেও বহু চড়াই উতরাই হলো। কাফেরদের সাথে বহু যুদ্ধ হলো। অবশেষে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা হলো মদিনায়। এবার নবীজি মক্কায় তার দেশে ফিরে যাবার মনস্থ করলেন। তাই বিনা রক্তপাতে ও যুদ্ধে মক্কা বিজিত হলো ১০ হিজরি সালে। নবীজি তার মিশন শেষে করলেন। মক্কায়ও এবার ইসলামের বিজয় পতাকা উড়লো। আল্লাহর দ্বীন তখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। চারিদিকে সুখ ও শান্তির সুবাতাস বইছিলো। অন্ধকার দূর হয়ে আলোর মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল সর্বত্র। এমন সময় নবীজি দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। দুনিয়ায় কায়েম করে গেলেন এক সুখের রাজ, সুন্দর সমাজ। মানুষ আজও এই দ্বীন ও সমাজের খোঁজে ব্যাকুল হয়। নবীজির দ্বীনকে পেয়ে মানুষ ধন্য হয়। জান্নাতের পানে এগিয়ে যায়। এসো আমরাও আল্লাহর দ্বীন ইসলাম ও নবীজির সড়ক বেয়ে বেহেশতি নিবাসের সন্ধানে পথ চলি।

SHARE

Leave a Reply