Home ধারাবাহিক: দুর্গম পথের যাত্রি দুর্গম পথের যাত্রী -আসাদ বিন হাফিজ

দুর্গম পথের যাত্রী -আসাদ বিন হাফিজ

গত সংখ্যার পর

খালিদ, আকরামা ও সাফওয়ান তাকালো পরস্পরের দিকে, ভয় ও আতঙ্কের বদলে তাদের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। আকরামা বলল, ‘এমনটাই হয় সরদার, মরণ ঘনিয়ে এলে মানুষের বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়। আমরা কতদিন মদিনা ঘেরাও করে বসে রইলাম, তাদের কিছুই করতে পারলাম না। শহরে ঢোকার পথ আটকে দিল খাল কেটে। এবার? এবার নিজেই ছুটে আসছে মক্কায়। পালানোর কোন পথ নেই। এবার তাকে আমরা পিষে মারবো।’
‘কালসাপকে শহরে ঢুকতে দেয়া যাবে না।’ বলল সাফওয়ান। খালিদ বলল, ‘আমরা পথেই তাকে নিঃশেষ করে দেবো।’
কালবিলম্ব না করে তিন সেনাপতির নেতৃত্বে তিনটি বাহিনী ছুটলো মদিনার পথে। খালিদ সঙ্গে নিল তিন শ’ বাছাই করা অশ্বারোহী। বাতাসের বেগ কেটে ওরা ছুটলো মদিনার দিকে। মক্কা ও মদিনার পথ পাহারা দিত কাফেরদের বিশ্বস্ত গোয়েন্দারা। তাদের কাছ থেকেই খালিদ খবর পেল, মুসলমানরা কারা আল গাইয়ামের দিকে এগিয়ে আসছে। কারা আল গাইয়াম থেকে বড়জোর তারা এখন ত্রিশ মাইল দূরে আছে। খালিদ ঘোড়া ছুটালো কারা আল গাইয়ামের দিকে। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের আগেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া।
কারা আল গাইয়াম মক্কা থেকে মাত্র ত্রিশ মাইলের পথ। মরুভূমির বিশাল বিস্তারে কঠিন এক পার্বত্য এলাকা। ছোটবড় নানা টিলায় ছেয়ে আছে পর্বতমালা। এই টিলা পূর্ব-পশ্চিমে কয়েক মাইল লম্বা। দু’পাশে টিলার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মদিনা যাওয়ার প্রশস্ত পথ। মদিনা থেকে যারা মক্কায় প্রবেশ করে তারা সাধারণত এই পথটিই ব্যবহার করে। খালিদ ভেবে দেখলো, সংখ্যায় কম হওয়ার পরও যারা এই টিলায় আগে পৌঁছতে পারবে তাদেরকে পরাভূত করা কঠিন ব্যাপার। টিলার আড়ালে লুকিয়ে তারা সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারবে এবং প্রতিপক্ষ কাছে এলে তাদের টার্গেটও বানাতে পারবে। তাই খালিদ সিদ্ধান্ত নিল, যে করেই হোক, সে ওখানে মুসলমানদের আগে পৌঁছবে এবং সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সৈন্যদের এমনভাবে বিন্যস্ত করবে যাতে কোন মুসলমানই সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে না পারে।
প্রাণপণ ঘোড়া ছুটিয়ে অর্ধেক পথ পেরিয়ে এলো তারা। পথে ছোট্ট এক ওয়েসিসের পাশে খানিক থেমে ঘোড়াকে পানি পান করালো। সৈনিকদের উদ্দেশ করে খালিদ বলল, ‘বন্ধুরা, মুহাম্মদ ও তার সাথীরা আমাদের মুখে তিন-তিন বার কলঙ্কের কালি মেখে দিয়েছে। আজ সেই কলঙ্কের কালি মুছে ফেলবার দিন। মদিনা থেকে আজ তারা অনেক অনেক দূরে। তারা আসছে মক্কা কব্জা করতে। আসছে আমাদের ইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দিতে। আমাদের দেবতা উজ্জা ও হোবলের মহিমা ম্লান করতে। আমাদের নারীদের দাসী বানাতে। আমরা তাদের আগেই কারা আল গাইয়ামে গিয়ে অবস্থান নেবো। দেবতা উজ্জা ও হোবলের নামে শপথ নাও, একজন মুসলমানকেও আমরা প্রাণ নিয়ে পালাতে দেবো না। এবার আমরা কড়ায় গন্ডায় আমাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো। এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। এ লড়াই মক্কার পবিত্রতা রক্ষার লড়াই। এ লড়াই সম্মানিত দেবতাদের সম্মান রক্ষার লড়াই। প্রাণ দেবে কিন্তু মান দেবে না। পৃথিবীকে আবার জানিয়ে দাও, কোরাইশ বংশের রক্ত এখনো পানি হয়ে যায়নি, আমাদের বাহুতে মর্চে ধরেনি।’
খালিদের এই তেজোদীপ্ত ভাষণে উদ্দীপনার একটা ¯্রােত যেন বয়ে গেল সৈন্যদের ওপর দিয়ে। তিনশত অশ্বারোহী সমস্বরে চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিল, ‘জয় হোবল, জয় উজ্জা, জয় কোরাইশ, জয় খালিদ।’
গর্বে ফুলে উঠলো খালিদের বুক। উন্নত হলো মস্তক। সে তার ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে বলল, ‘চলো।’ সাথে সাথে তিনশ অশ্বারোহী ছুটলো মুসলমানদের ধ্বংস সাধনের জন্য।
ওরা যখন কারা আল গাইয়ামে পৌঁছলো, ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। খালিদ প্রথমে ঘোড়াগুলোকে বিভিন্ন টিলার আড়ালে এমনভাবে লুকিয়ে রাখলো, যাতে যখন ইচ্ছা চটজলদি তাদেরকে মূল রাস্তার নিয়ে আসা যায়। এরপর সৈন্যদের ছড়িয়ে দিল বিভিন্ন টিলায়। তাদের হাতে তীর-ধনুক। একদলকে বসিয়ে রাখলো ঘোড়ার পাশে। সৈন্যদের বলল, মুসলমানদের দেখলেই হামলা করে বসবে না। আমি তাদের টিলার অভ্যন্তরে নিয়ে আসতে চাই। খবর পেয়েছি, ওরা সংখ্যায় চৌদ্দশর অধিক হবে না। পুরো দলটি টিলায় প্রবেশ করার পর আমি আকাশে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করবো। তখন একদল ঘোড়সওয়ার তাদের পথ আগলে দাঁড়াবে। টিলার ওপরে যারা অবস্থান করবে তারা থমকে যাওয়া মুসলিম বাহিনীর ওপর শুরু করবে তীরবৃষ্টি। ওরা পিছু হটতে চাইলে তাদের পথ আটকাবে পেছনের অশ্বারোহীরা। তীরবৃষ্টির হাত থেকে প্রাণ নিয়ে যারা বিভিন্ন টিলার আড়ালে ও গিরিপথে পালাতে চেষ্টা করবে তাদের পদতলে পিষ্ট করবে লুকিয়ে থাকা অশ্বারোহীরা। মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে মুহাম্মদকে, এবার তাকে সেই মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’
সৈন্যদের নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে খালিদ তার বিশ্বস্ত ও চৌকস একদল অশ্বারোহীকে ডেকে নিলো। বলল, ‘তোমরা মদিনার পথে দু’জন, দু’জন করে এগিয়ে যাবে। পালা করে এক ঘন্টা পর পর মুসলমানদের গতিবিধির রিপোর্ট করবে আমার কাছে।’
খালিদের নির্দেশ পেয়ে অশ্বারোহী দলটি মুহূর্তে হারিয়ে গেল মরুভূমির বিশাল বিস্তারে। অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হলো খালিদের। প্রথম দলটি ফিরে এসে জানাল, ‘মুসলমানরা এখনো প্রায় পনেরো মাইল দূরে আছে। তাদের গতি খুব মন্থর। সঙ্গে অনেক বকরি, ভেড়া, উট। এই পশুর পালকে তাড়িয়ে আনতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে তাদের।’
খালিদ চিন্তায় পড়ে গেল। আপনমনেই বলল, ‘ওরা সঙ্গে এত পশু আনছে কেন?’
পাশ থেকে এক সঙ্গী বলল, ‘যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে খাবে কী, এই ভয়েই হয়তো ওরা এত পশু সঙ্গে আনছে।’
অপর সঙ্গী বলল, ‘ওরা তো মক্কাতে পৌঁছতেই পারবে না, এই পশু ওদের কী কাজে লাগবে?’
‘এ নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ওদের পশুগুলো তখন আমাদের রসনা পরিতৃপ্ত করবে।’
খালিদ ওদের এসব রসালাপে যোগ না দিয়ে অশ্বারোহী দু’জনকে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমরা ফিরে যাও। প্রতিঘণ্টায় ওদের অগ্রগতির খবর আমাকে জানাবে।’ অশ্বারোহী দু’জন পুনরায় ফিরে গেল মরুভূমিতে।

মুসলমানরা এগোচ্ছিল ধীরগতিতে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল কারা আল গাইয়ামের দিকে। তারা জানতো না ওখানে তাদের জন্য কী ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে। খালিদের পাতা ফাঁদের দিকেই তারা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল। খালিদ ঘুরে ঘুরে সে ফাঁদের ফাঁকফোকর খতিয়ে দেখে ফাঁদকে আরো নিখুঁত করে তুলছিল।
মহানবীর নেতৃত্বে মুসলমানদের কাফেলা এগিয়ে চলেছে মক্কার দিকে। গতি খুবই মন্থর। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। রোদের তাপ কমে গেছে। দেখতে দেখতে রক্তবর্ণ সূর্যটা হারিয়ে গেল মরুভূমির বিশাল বিস্তারে। নেমে এলো রাত। বাতাস খুব দ্রুতই শীতল হয়ে এলো। মক্কা থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে ছোট্ট এক ওয়েসিসের পাশে আফফান নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করলেন মহানবী। রাতটা ওখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সাহাবীদের বিশ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি তার গোয়েন্দা দলকে বললেন, ‘সামনে পথ কতটা নিরাপদ সে খবর নাও। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে কারা আল গাইয়াম ও তার আশপাশের কী অবস্থা জানাবে আমাকে। যারা আগে গেছে তাদের সাথেও যোগাযোগ করবে।’ গোয়েন্দা দল বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনিও বিশ্রামে গেলেন।
মুসলমানরা বিশ্রাম করলেও বিশ্রাম ছিল না খালিদের। সে একবার এই টিলায় তো আবার ওই টিলায় চড়ছিল। সৈন্যদের সাহস জোগানোর জন্য তাদের শোনাচ্ছিল কোরাইশদের অতীত বীরত্বগাথা। আবার নেমে আসছিল গিরিপথে। শেষে ঘুরতে ঘুরতে মদিনার দিক থেকে গিরিপথে প্রবেশের মুখে এসে দাঁড়াল খালিদ। গোয়েন্দা দলকে সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘মুসলমানরা রাতের জন্য যখন বিশ্রামে চলে গেছে তখন আর পাহারার প্রয়োজন নেই। তোমরা মুসলমানদের চোখে ধরা পড়ে গেলে তারা এই ফাঁদে ধরা নাও দিতে পারে। তাই তাদের এড়িয়ে চলাই এখন কর্তব্য।’ সালারের নির্দেশ পেয়ে ফিরে এলো কোরাইশ গোয়েন্দারা।
রাতের শেষ প্রহর। সাহাবীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে, কেবল জেগে আছে পাহারাদাররা। হঠাৎ মহানবীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি খুব দ্রুত কোন অশ্বারোহীর এগিয়ে আসার পায়ের ধ্বনি শুনতে পেলেন। বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক সওয়ার মহানবীর তাঁবুর পাশে এসে ঘোড়া থেকে নামল। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন মহানবী। বললেন, ‘তোমার চেহারা বলছে তুমি কোন সুখবর নিয়ে আসোনি। ব্যাপার কী বলতো?’
এটা ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের শেষ দিন। গোয়েন্দা একটু দম নিয়ে বললো, ‘আমরা আর একটু হলেই কোরাইশদের পাতা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছিলাম।’
‘ঘটনা খুলে বলো।’
‘গতকাল দুপুরের একটু পর। আমি কারা আল গাইয়ামে এক পাহাড়ের আড়ালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এক সময় ঘোড়ার সম্মিলিত পদধ্বনি ভেসে এলো। ব্যাপার কী দেখার জন্য আমি এক সুবিধাজনক গোপন স্থান বেছে নিলাম। দেখলাম মক্কার দিক থেকে একদল অশ্বারোহী দ্রুত এগিয়ে আসছে। একটু পরেই তারা কারা আল গাইয়ামে এসে পৌঁছলো। তারা এগিয়ে না গিয়ে কারা আল গাইয়ামেই আস্তানা গাড়লো। আমি সালারকে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, খালিদ বিন ওয়ালিদ এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে সৈন্যদেরকে কারা আল গাইয়ামের সুবিধাজনক জায়গাগুলোতে এমনভাবে সন্নিবেশ করেছে যে, মদিনার দিক থেকে সেই গিরিপথে একবার কেউ প্রবেশ করলে আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারবে না। মনে হয় তারা আপনার অগ্রগতির খবর পেয়ে গেছে। তাই মক্কার প্রবেশপথে তাদের সবচে চৌকস সেনাপতিকে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
মহানবী বললেন, তারা সংখ্যায় কত হবে?’
‘আনুমানিক তিন থেকে চার শ’, সবাই অশ্বারোহী।’
এক সাহাবী বললেন, ‘তারা আমাদের অগ্রগতির খবর পেয়ে থাকলে ধরে নিয়েছে আমরা মক্কা অবরোধ করতে যাচ্ছি। তারা আমাদের আসল উদ্দেশ্য জানে না বলেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে।’
‘আল্লাহর কসম!’ মহানবী স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘কোরাইশরা আমাদের যতই উত্তেজিত করুক না কেন, কিছুতেই নিজেদেরকে আমরা যুদ্ধে জড়াবো না। আল্লাহ আমার নিয়ত জানেন। আমরা খুনখারাবি ও মারামারি করার জন্য মক্কা আসিনি। আমরা এই দুম্বা, ভেড়া ও বকরি নিয়ে মক্কায় এসেছি ওমরা হজ পালন করার জন্য, এই পশুগুলো কোরবানি করার জন্য। যদি আমি আমার নিয়ত পাল্টে ফেলি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। এমনটা আমি কখনোই করবো না।’
এ পরিস্থিতিতে কী করা উচিত এ নিয়ে বিশিষ্ট সাহাবীরা বৈঠকে বসলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের পরামর্শ চাইলে সাহাবীগণ নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করলেন। রাসূল (সা) মনোযোগ নিয়ে সবার কথা শুনলেন। সাহাবীদের পরামর্শ অনুযায়ী মহানবী (সা) বিশজনের একটি দল তৈরি করলেন। তাদের বললেন, ‘তোমরা কারা আল গাইয়ামের গিরিগুহা মুখে পৌঁছে যাবে কিন্তু গিরিপথে প্রবেশ করবে না। যদি কোরাইশরা তোমাদের আক্রমণ করে তবে পিছু হটে আসবে। অগ্রগামী বাহিনী ভেবে ওরা তোমাদের ওপর আক্রমণ না করে পুরো বাহিনীর যদি অপেক্ষা করতে থাকে তবে গুহামুখের অদূরে এমনভাবে অপেক্ষা করবে যাতে ওরা মনে করে তোমরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পিছু হটে আসবে, আবার একটু পর ফিরে যাবে আগের জায়গায়। এভাবে আমাদের জন্য তোমরা অধীরতা প্রকাশ করবে। তাতে ওরাও আক্রমণ না করে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। আর আক্রমণ করলে বারবার পিছু হটবে, একটু পর আবার ফিরে যাবে। এতে ওরা ধরে নেবে, আমরা পেছনেই আছি। এভাবে দুপুর পর্যন্ত আটকে রেখে তোমরাও এক সময় পালিয়ে এসে জাতুল হানজাল পর্বতের গিরিপথ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করবে। ইতোমধ্যে আমরা জাতুল হানজাল পর্বত পেরিয়ে মক্কায় পৌঁছে যাবো।’
জাতুল হানজাল মক্কার অদূরে এক দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল। এ পর্বতে তেমন কোন গিরিপথ নেই। দুর্গম বলে এদিক দিয়ে সাধারণত কেউ যাতায়াত করে না। উঁচুনিচু টিলা মাড়িয়ে এ পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করা অনেক কষ্টকর। সাহাবীদের পরামর্শ অনুযায়ী এ দুর্গম পথেই মক্কায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন মহানবী। কারণ তিনি এবং সাহাবীরা এটা ভালো মতই উপলব্ধি করতে পারছিলেন, কারা আল গাইয়াম পাহাড়ে যেহেতু অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে, মরুভূমির অন্যান্য পথেও নিশ্চয়ই ওঁৎ পেতে আছে দুশমন। অতএব সেসব পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
মহানবীর এ সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক ছিল। জাতুল হানজাল পর্বতে কোরাইশদের কোন পাহারা ছিল না। এ পর্বত মদিনার পথে ছিল না বলে কোরাইশরা ধারণাই করতে পারেনি মুসলমানরা এ পথে মক্কায় প্রবেশ করবে।
ফজরের আগেই মহানবী (সা) চৌদ্দশ সাহাবী নিয়ে জাতুল হানজালের পথ ধরলেন এবং নির্বিঘেœ সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। পশুগুলো পার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলেও দুপুরের আগেই তিনি জাতুল হানজাল অতিক্রম করলেন।
কারা আল গাইয়ামের গুহামুখে পৌঁছে গেল মহানবীর পাঠানো বিশজন অশ্বারোহীর দলটি। ওদের দেখেই আনন্দে নেচে উঠল খালিদের মন। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার এতদিনের স্বপ্ন তার সফল হতে যাচ্ছে। তিনি সৈন্যদের হামলা না করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু দীর্ঘসময় গুহামুখের অদূরে অপেক্ষা করে দলটি ফিরে গেল। খালিদ বুঝলেন, মূল বাহিনীর পৌঁছতে দেরি দেখে ওরা ফিরে গেছে। অপেক্ষা করতে করতে খালিদ যখন অধৈর্য হয়ে পড়েছে সে সময় দেখলেন দলটি আবার ফিরে এসেছে। ধারণা করলেন, মূল বাহিনীর দেখা পেয়েই আবার ফিরে এসেছে অগ্রগামী বাহিনী। কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও মূল বাহিনীর দেখা মিলল না। অশ্বারোহী দলটি আবার ফিরে গেল। এভাবেই চলতে থাকলো লুকোচুরির খেলা। বিশ অশ্বারোহীর দলটি আসে আবার ফিরে যায়। এক পর্যায়ে দুপুরের একটু পর আবার ফিরে এলো দলটি।
অস্থিরতা পেয়ে বসলো খালিদকে। ওরা কোত্থেকে আসে আর কোথায় যায়? গিরিপথে প্রবেশ করে না কেন? তবে কি মুসলমানরা তাদের গোপন প্রস্তুতির খবর পেয়ে গেছে? খালিদ তার দুই সৈন্যকে ডাকলো। তাদের বলল, ‘তোমরা বণিকের বেশে উটে চড়ে মদিনার পথে অগ্রসর হও। মুসলমানরা ঠিক কোথায় আছে এবং কী করছে সে খবর নিয়ে ফিরবে।’ উষ্ট্রারোহী দু’জন বণিকের বেশে হারিয়ে গেল মরুভূমিতে।
এগোতে এগোতে তারা সেখানে এসে পৌঁছলো, যেখানে মুসলমানরা রাতে বিশ্রাম নিয়েছিল। ওরা সেখানে দেখলো, মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে, দাগ আছে তাঁবুর খুঁটির, কিন্তু ধারে কাছে কোনো জনমানব নেই। যা বুঝার বুঝে নিলো ওরা। ছুটলো কারা আল গাইয়ামের দিকে। সন্ধ্যার একটু পর ফিরে এলো তারা। বলল, ‘মুসলমানরা যেখানে ছিল সেখানে নেই। কোন দিকে গেছে তারও কোন নিশ্চিত চিহ্ন রেখে যায়নি।’
খালিদের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়লো ব্যঙ্গ, ‘তোমাদের চোখ কি আজকাল আর মানুষ দেখতে পায় না?’
‘পায়, যদি সেখানে মানুষের দেহ থাকে। অশরীরী আত্মাকে আমরা কখনোই দেখতে পাই না।’
‘তারা কোন দিকে গেছে তাও বলতে পারো না?’
‘না, বাতাসে বালুতে রেখে যাওয়া দাগ মুছে গেছে।’
খালিদ ভাবল, তাহলে কি তারা আমাদের ওঁৎ পেতে থাকার খবর কোনভাবে জেনে গেছে? তারা আবার ফিরে গেছে মদিনায়। আমরা যেন ধাওয়া করতে না পারি সে জন্য ক্ষুদ্র একটি দলকে রেখে গিয়েছিল আমাদের ধোঁকা দেয়ার জন্য। কিন্তু না, মুহাম্মদকে যতদূর জানি এতটুকুতেই পালিয়ে যাওয়ার লোক সে নয়। তাহলে? তাহলে কি ওরা মক্কায় চলে গেছে কোনো ভিন্ন পথে?’
রাত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খালিদের উদ্বেগ ও অস্থিরতা। খালিদের মনে হলো, আরে, তাইতো! বিকেলে মুসলমানদের দলটি ফিরে যাওয়ার পরতো আর ফিরে আসেনি!
অস্থিরতায় সারারাত ঘুম হলো না তার। তার মন বলছিল একবার নিজেই আফফান পর্যন্ত গিয়ে দেখে আসে। এই অস্থিরতার মধ্যেই রাত কেটে গেল। রাগী সূর্য আগুনের হলকা ছুড়ে দিল মরুভূমিতে। খালিদ কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এসময় হাঁপাতে হাঁপাতে এক অশ্বারোহী ছুটে এলো তার কাছে। বলল, ‘আমি যা দেখেছি তা দেখবে এসো।’
‘কী দেখেছো তুমি?’
‘তুমি আমার সাথে এসো, স্বচক্ষেই তুমিও তা দেখতে পাবে।’
‘আগে বলো কী দেখেছো?’
‘ধূলির মেঘ। কোন কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছে মক্কার দিকে।’
খালিদ ঘোড়ায় লাফিয়ে চড়লো। গিরিপথ ধরে এগিয়ে গেল মক্কার দিকে। শেষ মাথায় গিয়ে সঙ্গীর দেখাদেখি সেও ঘোড়া ছেড়ে উঠে গেল টিলার মাথায়। স্পষ্ট দেখতে পেল কাফেলার রেখে রাওয়া ধূলিমেঘ উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। খালিদ বসে পড়লো টিলার ওপর। বললো, ‘খোদার কসম, কোরাইশ বংশে মুহাম্মদের মত বুদ্ধিমান আর কেউ জন্মগ্রহণ করেনি। আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সে তার গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছে। মক্কায় পৌঁছা এখন তার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
‘আপনি কি নিশ্চিত, মুহাম্মদ আমাদের জাল ছিন্ন করে সত্যি মক্কা অবরোধ করতে যাচ্ছে?’
‘আহাম্মক, আমাকে এ প্রশ্ন করছো কেন, তুমি দেখতে পাচ্ছো না তারা আমাদের জাল কেটে বেরিয়ে গেছে!’
খালিদ আর কোনো কথা না বলে তরতর করে নেমে এলো টিলা থেকে। লাফিয়ে ঘোড়ায় চেপে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘তোমরা সবাই বেরিয়ে এসো। মদিনার কাফেলা তোমাদের ধোঁকা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মক্কায়। প্রাণের মায়া ছেড়ে ঘোড়া ছুটাও মক্কার দিকে। যদি পথেই ওকে আটকাতে না পারো তবে সে মক্কা অবরোধ করে বসবে। বিজয় ছিনিয়ে নেবে সে। মক্কার অলিতে গলিতে গড়াগড়ি খাবে তোমাদের স্ত্রী-সন্তানেরা। কই, আড়াল থেকে ছুটে এসো তোমরা। মালসামান কিছুই সাথে নেয়ার দরকার নেই। শুধু অস্ত্র আর ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসো। নিজেদের বাড়িঘর বাঁচাতে ছুটে এসো। মা- বোনদের বাঁচাতে ছুটে এসো। ছুটে এসো দেবতাদের সম্মান বাঁচাতে।’
খালিদ পাগলের মতো ডাকছিল সবাইকে। লোকজন কিছু বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝলো, মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে। তারা সেনাপতির ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে এলো যার যার অবস্থান ছেড়ে দিয়ে। খালিদের চারপাশে এসে জড়ো হলো তারা। খালিদ বলল, ‘মদিনার মুসলমানরা আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। তারা আমাদের ফাঁকি দিয়ে মক্কার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি নিজে দেখেছি তাদের ছুটন্ত ঘোড়ার ধূলিমেঘ। চলো চলো, মক্কাকে রক্ষা করার জন্য সর্বস্ব পণ করে চলো আমরাও ফিরে যাই বজ্রের বেগে।’
তিন শ’ অশ্বারোহী মুহূর্তে সেখানে সমবেত হয়ে গেল। খালিদ তাদের নিয়ে তীব্রগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল মক্কার দিকে।

আজ খালিদের ঘোড়া যখন মদিনার সন্নিকটে তখন তার মনে পড়লো সেদিনের ঘটনা। সেদিন সে ভাবতো, মুহাম্মদের কাছে কোন জাদু নেই, আছে বুদ্ধি ও অপূর্ব রণকৌশল। এ রণকৌশল যে জানে না খালিদ এমন নয়, যদি সে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো তবে সেও রণক্ষেত্রে জাদু দেখাতে পারতো। কিন্তু কবিলার সরদার হচ্ছে আবু সুফিয়ান। লোকটা ধুরন্ধর কিন্তু ভিতু ও কাপুরুষ। তার বিষয়বুদ্ধি যতটা প্রকট রণনীতি ততটাই দুর্বল। তার কারণেই মুহাম্মদের কাছে বারবার তাদের পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে। বদরে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবেলায় মুহাম্মদ মাত্র তিন শ’ তেরোজন সৈন্য নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। ঘটনাটা খালিদকে এতটাই বিহবল ও উত্তেজিত করেছিল যে, সে তখন শপথ নিয়েছিল, সময় আসুক, আমিও মুসলমানদের তিন গুণ শক্তিকে পরাজিত করে দেখিয়ে দেবো ওয়ালিদের বেটাও যুদ্ধের জাদু জানে। যখন সে শুনলো, মুহাম্মদ চৌদ্দশ সাহাবী নিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে আসছে তখন সে সেই কারণেই মাত্র তিন শ’ অশ্বারোহী নিয়ে কারা আল গাইয়ামে অবস্থান নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তিন শ’ সৈন্যের হাতে মুসলমানদের চৌদ্দশ সাহাবীর নাস্তানাবুদ ও পরাজিত হওয়ার দৃশ্য দেখে পৃথিবী যেন বলে, জাদু মুহাম্মদের হাতে নয়, জাদু আছে খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে। কিন্তু মুহাম্মদ যখন তার সঙ্গীদের নিয়ে খালিদের জাল ছিন্ন করে কারা আল গাইয়াম অতিক্রম করে গেল তখন সে উপলব্ধি করলো, মুহাম্মদের বুদ্ধি, যুদ্ধের রণকৌশলের কাছে খালিদ এখনো শিশু। মাত্র বিশজন অশ্বারোহী পাঠিয়ে তিন শ’ অশ্বারোহীর দলকে বোকা বানিয়ে নির্বিঘেœ সরে পড়া এবং চৌদ্দশ সাহাবীর দলটিকে নিরাপদে অবরোধস্থল থেকে সরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে অনন্য যুদ্ধ চালের কারণেই। খালিদের নিজের শক্তিমত্তা, বুদ্ধি ও রণকৌশলের ওপর যে আস্থা ছিল, এ ঘটনা তাতে বড় রকমের এক ফাটল তৈরি করেছিল। সে তখন ভাবছিল, মুহাম্মদ যদি সত্যি সত্যি মক্কা কব্জা করে নেয় তবে সমগ্র কোরাইশ সম্প্রদায় তাকে ধিক্কার দেবে। আবু সুফিয়ান তিরস্কার করে বলবে, ‘কিহে ওয়ালিদের বেটা, এ জন্যই কি তোমাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলাম।’ এ ঘটনা কেবল আমাকে নয়, আমার বাপকেও অপমানিত করবে, যে বাপ চিরকাল কোরাইশদের শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। দুঃখে, অপমানে খালিদের তখন নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল।
যখন খালিদ বুঝলো, মুসলমানদের চালের কাছে হেরে গেছে, তখন আহত বাঘের মতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে। বিলম্ব না করে তার জানবাজ তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে ছুটলো মক্কার পথে। তাদের গতি এতটাই তীব্র ছিল যে, চোখের পলকে পার হয়ে যাচ্ছিল পাহাড় পর্বত। ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল পেছনের আকাশ। কিন্তু তাতেও খালিদের মন ভরছিল না। তার মনে হচ্ছিল পথ যেন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। কিছুতেই নাগালে আসছে না মক্কা। পাঁচ মাইলের পথ তাকে কাবু করতেই যেন হয়ে যায় দশ মাইল। একটু পর পর সে তাকাচ্ছিল মক্কার পানে, কিন্তু কোথায় মক্কা, সামনে শুধু ধু-ধু বালুর সমুদ্র।
সীমাহীন পেরেশানি নিয়ে সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে খালিদ পৌঁছলো মক্কায়। সেখানে সে কী দেখবে এই ভাবনায় সে ছিল অস্থির। কিন্তু মক্কায় পৌঁছে সে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পেল না। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো খালিদ। ঘোড়ার পদধ্বনি শুনে মক্কার ফটকে এসে জড়ো হলো নারী ও শিশুরা। আবু সুফিয়ান এগিয়ে খালিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল, ‘এসো বিজয়ী বীর, নিশ্চয়ই তোমার কৌশল এবার কাজে লেগেছে এবং মুহাম্মদ নিহত হয়েছে?’
এবার বিস্মিত হওয়ার পালা খালিদের। বলল, ‘কী বলছো আবু সুফিয়ান! মুহাম্মদ মক্কা অবরোধ করেনি?’
ধুরন্ধর আবু সুফিয়ানও বিস্মিত হলো, বললো, ‘মানে কি, মুহাম্মদকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতলে তুমি, আর আমাকে জিজ্ঞেস করছো মুহাম্মদ মক্কা অবরোধ করেছে কি না? মুহাম্মদকে হত্যা না করে কোন মুখ নিয়ে তুমি মক্কায় এলে?’
খালিদের উদ্বেগ ও পেরেশানি কিছুটা দূর হলো। মক্কা এখনো আক্রান্ত হয়নি এটা অনেক বড় স্বস্তির খবর। কিন্তু তাহলে মুহাম্মদ কই? সেকি অতর্কিতে রাতের আঁধারে হামলা করার জন্য কোথাও আত্মগোপন করে আছে, নাকি আমাদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে ফিরে গেছে মদিনায়? খালিদ মনের পেরেশানি চেপে রেখে আবু সুফিয়ানের প্রশ্নের জবাবে বললো, ‘আবু সুফিয়ান! মুহাম্মদের সাথে আমাদের দেখা হয়নি। সে আমাদের ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে। বিশজন অশ্বারোহী পাঠিয়ে ধোঁকা দিয়েছে আমাদের। দিনভর তাদের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছি, কিন্তু তারা আমাদের ফাঁদের ধারে কাছেও আসেনি। রাত কেটেছে চরম উৎকণ্ঠায়, কখন তারা আসবে এই চিন্তায় সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। দুপুরের একটু আগে আমার এক অশ্বারোহী এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখালো। দেখলাম, দূরে আকাশে উড়ছে ধূলিমেঘ। বুঝলাম, মুহাম্মদ আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে ছুটে আসছে মক্কার দিকে। বিলম্ব না করে ছুটলাম আমরাও। ভেবেছিলাম, এতক্ষণে সে মক্কা অবরোধ করে ফেলেছে। কিন্তু তোমরা বলছো সে আসেনি। তাহলে মুহাম্মদ ও তার চৌদ্দশ সাহাবী, অঢেল উট, বকরি, ভেড়া, দুম্বা এসব গেল কই? মক্কার আশপাশে কোথাও কি তারা গোপন কোন জায়গায় আস্তানা গেড়েছে? তারা কি রাতের আঁধারে হামলা করার কথা চিন্তা করছে?’
খালিদের কথায় চিন্তায় পড়ে গেল আবু সুফিয়ানও। বললো, ‘এ কেবল দুঃসংবাদ নয়, বড় ভয়েরও খবর। আমি বুঝতে পারছি না এ অবস্থায় কী করা উচিত?’
‘আবু সুফিয়ান, তুমি কি মক্কার চারদিকে এই রাতেই খন্দক বানাতে পারবে, যেমন বানিয়েছিল মদিনায় মুহাম্মদ? বাঁচার এখন এটাই পথ।’
‘কি করে তা সম্ভব! তার চেয়ে চারদিকে গুপ্তচর পাঠাও। খবর নাও মুহাম্মদ কোথায় আছে? আকরামা ও সাফওয়ানকে খবর পাঠাও। শহর রক্ষার জন্য মক্কার চারদিকে সৈন্য মোতায়েন করো।’
‘আবু সুফিয়ান! বুঝতে পারছি না কী করবো? তুমি তার সন্ধানে লোক পাঠাতে পারো, কিন্তু দেখবে তারা আসার আগেই মুহাম্মদ মক্কা আক্রমণ করে বসেছে। দেবতাদের কসম! তারা আসছে ঝড়ের গতিতে। কারা আল গাইয়ামের গিরিগুহায় প্রবেশ না করে তারা যে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। জানি না এই সয়লাব কখন কিভাবে আঘাত হানবে মক্কার ওপর।’
‘খালিদ, শান্ত হও। ভয়ে তোমার স্বর কাঁপছে।’
‘আবু সুফিয়ান! তুমি আমাদের সরদার তাই কিছু বলতে পারছি না। তোমার মতো ভিতু ও কাপুরুষ কোন গোত্রের সরদার হলে তাদের ভাগ্যে পরাজয় ও লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী জুটবে? আমাকে ভিতু বলছো তুমি, অথচ তোমার কাপুরুষতার কারণেই প্রতিটি ময়দান থেকে আমরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে এসেছি।’
তারা যখন এসব বাদানুবাদ করছে সে সময়ই আকরামা ও সাফওয়ান তাদের বাহিনী নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলো। কারা আল গাইয়াম থেকে খালিদ যখন বেরিয়ে এসেছে তখন দূর থেকে দেখেছে তারা কারা আল গাইয়াম থেকে ধূলিমেঘ মক্কার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আনন্দে তাদের হৃদয় ভরে গেল। মনে মনে বলল, সাবাস বাপের বেটা। তাহলে মুহাম্মদ ঠিকই তোমার জালে ধরা দিয়েছে। মুহাম্মদকে ঘায়েল করে তোমার মক্কার দিকে ছুটে যাওয়াই প্রমাণ করে এবার তুমি বিজয়ের সুসংবাদ দেয়ার জন্যই এমন পাগলের মত ছুটছো। যাও বন্ধু, আমরাও আসছি। এই বলে তারাও তাদের বাহিনীকে নিয়ে ছুটলো মক্কার দিকে।
খালিদ তার অকৃত্রিম বন্ধু আকরামা ও সাফওয়ানকে দেখেই চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আকরামা, সাফওয়ান! মুহাম্মদ আমার জাল কেটে বেরিয়ে এসেছে। মরু সাইমুমের চাইতেও তার আগমন ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ আমাদের জন্য। ভুলে যাও মক্কার সরদার কে? মুহাম্মদ এই নামটি ছাড়া ভুলে যাও আর সবকিছু। নিজেকে বাঁচাও। পারতো নিজের জন্মভূমি মক্কাকে বাঁচাও। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের বাঁচাও। দেবতাদের ইজ্জতের কসম! তুফান আসছে। এতদিন আমরা আক্রমণ করেছি মুহাম্মদকে, সে নিজেকে রক্ষা করেছে। এবার সে আক্রমণ করতে আসছে, পারলে নিজেকে রক্ষা করো।’    (চলবে)

SHARE

Leave a Reply