Home প্রচ্ছদ রচনা সোনালি রঙের ঢেউয়ে আসে হেমন্ত -কামরুল আলম

সোনালি রঙের ঢেউয়ে আসে হেমন্ত -কামরুল আলম

ধানগাছের ডগায় জমে আছে শিশিরবিন্দু। শিশিরভেজা ধানক্ষেতের আলপথ ধরে বিলে মাছ ধরতে যাচ্ছে একদল কিশোর। হ্যাঁ বন্ধুরা, তোমাদের আজ হেমন্তকে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। হেমন্ত আমাদের ঋতু-বৈচিত্র্যের সীমাহীন সৌন্দর্যেরই অংশ। যদিও শহরের বহুতল ভবনের স্বচ্ছ কাচের ভেতর নানা রঙের পর্দা টাঙানো ঘরে বসে হেমন্তকে দেখা সম্ভব নয়। হেমন্তকে দেখতে হলে চোখ মেলে তাকাতেই হবে। যেতে হবে আবহমান বাংলার গ্রামাঞ্চলে। যারা গ্রামের বাসিন্দা, তারাও চোখ খুলে না তাকালে হেমন্তকে দেখতে পাবে না!
‘কার্তিক ও অগ্রহায়ণ’ এ দুই মাসকে আমরা হেমন্তকাল হিসেবে জানি। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। স¤্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকা তৈরির সময় ‘অগ্রহায়ণ’ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ‘অগ্র’ এবং ‘হায়ণ’ এ দুই অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুুম’। বর্ষার শেষদিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে পরিপক্ব হয় ধান। অগ্রহায়ণে ফসল ঘরে তোলা হয়। বলা হয়ে থাকে, ‘মরা’ কার্তিকের পর আসে সার্বজনীন লৌকিক উৎসব ‘নবান্ন’। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘শস্যোৎসব’। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালের ফিরনি-পায়েস অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নের উৎসবে আয়োজন করা হয় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। লাঠি খেলা, বাউল গান, নাগরদোলা, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা ইত্যাদি বসে গ্রাম্য মেলায়।
শরতের সাদা কাশফুল ও ¯িœগ্ধ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আসে হেমন্ত। থাকে না পাখির গুঞ্জন, বর্ষার রিমঝিম শব্দ, কোকিলের কুহুকুহু গান। চোখ জুড়ানো মনমাতানো ফুলের বাহার না থাকলেও ফুলের সৌরভে সুরভিত হয় হেমন্তের দিনগুলো। এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, শাপলা, পদ্ম, কামিনী, হিমঝুরিসহ নাম না জানা হরেক রকম ফুল।
এককালের গ্রামবাংলায় হেমন্তই ছিল উৎসব আনন্দের প্রধান মৌসুম। ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ আর ধান বানার গান ভেসে বেড়াতো বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখর হতো বাড়ির আঙিনা। এখন তো প্রযুক্তির কল্যাণে নানা যন্ত্রপাতির আবির্ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব। নবান্ন আর পিঠাপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হতো সবাই। ‘রুট পিঠা’ বা রুট শিরনির প্রচলন ছিল এক সময় গ্রামবাংলায়। নতুন ধানের চালের গুঁড়ি দিয়ে গোলায় তোলা ধানশূন্য ক্ষেতে ন্যাড়ার আগুনে পুড়ে বিশেষ পদ্ধতিতে এই পিঠা তৈরি করা হতো। পিঠা তৈরির পর সবার মাঝে বিতরণ করা হতো শিরনি আকারে। কি বন্ধুরা, জিভে পানি আসছে বুঝি? কালে কালে তো এই রুট শিরনিও এখন বিলুপ্ত প্রায়।
হেমন্তের প্রথম ভাগে শরতের অনেক বৈশিষ্ট্য থেকে যায়। দুই ঋতুকে আলাদা করা প্রায় সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় আকাশ থেকে খন্ড খন্ড মেঘ সরে যায়। আমরা দেখতে পাই এক বিশাল নীল আকাশ, যে আকাশের দিকে তাকালে আমাদের মন আরও উদার ও প্রশস্ত হয়। মহান আল্লাহর সৃষ্টির কারুকাজ উপলব্ধি করা যায় যে আকাশের দিকে তাকালে। কবির ভাষায়Ñ
“হেমন্তের এই আকাশখানি
কী যে গাঢ় নীল-
বুঝতে হলে থাকতে হবে
আকাশসম দিল!”
সত্যি, কী অপরূপ এই হেমন্তের চিত্র। খুব ভোরে একটু শীতল বাতাস, সেই সঙ্গে ঘাসের ও ধানগাছের ডগায় জমতে শুরু করা শিশিরের বিন্দু বিন্দু কণা জানিয়ে দেয় হেমন্তের আগমনী বার্তা। আমাদের প্রধান ফসল ধান পেকে মাঠের পর মাঠ যেন সোনালি-হলুদ রঙে সেজে ওঠে। কৃষকের মুখে দেখা দেয় এক অনাবিল হাসি। এই হেমন্ত কালেও বৃক্ষরাজি থাকে সবুজে ভরা। খাল-বিল, নদী-নালা আর বিলজুড়ে দেখা যায় সাদা-লাল শাপলা আর পদ্মফুলের মেলা। নদী ও হাওর-বিলে পানি বেশ নেমে যায়। তখন জেলেরা একটি ভিন্ন আনন্দের অনুভূতিতে মাছ ধরা শুরু করেন। শান্ত নদীতে ভেসে চলে এক বা একাধিক নৌকা। এমন দৃশ্য কার না ভালো লাগে!
হেমন্তের শেষদিকে দূর দেশ থেকে দল বেঁধে ছুটে আসে অতিথি পাখি। শীত বা তুষারপ্রবণ অঞ্চল থেকে এসব পাখি ছুটে আসতে শুরু করে আমাদের দেশে কিছুটা উষ্ণতার আশায়। এক শ্রেণীর পাখিশিকারি এসব অতিথি পাখি শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাখি বিক্রি করতে দেখা যায় তাদের। এটা কিন্তু মোটেই ভালো কাজ নয়।
হেমন্তের শেষ দিকে এসব দৃশ্য দেখেই শীতের আগমনী বার্তা টের পাওয়া যায়। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তকে বিদায় জানানোর পর কনকনে ঠান্ডা শীতের তীব্রতায় টের পাওয়া যায় হেমন্তের আবহাওয়া কতো মনোরম। যদি সারা বছরই হেমন্তকাল হতো! গরমও না, ঠান্ডাও না, এমনকি বৃষ্টিও না! সত্যি এক মনোরম আবহাওয়া নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে হেমন্ত আসে।
কবি-সাহিত্যিকগণ তাঁদের কাব্য-ছড়ার উপকরণ হিসেবে বাংলার ঋতু-বৈচিত্র্যকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। হয়তোবা গ্রীষ্মের গরমে- মেজাজ থাকে চরমে, তাই বর্ষা ও বৃষ্টি নিয়ে ছড়া-কবিতা বেশি লিখতে দেখা যায় কবিদের। তারপর শরৎ-হেমন্ত কিংবা শীত ও বসন্তকাল নিয়ে কবিতা বা ছড়া লিখেননি এমন কবি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর হেমন্ত, সে তো ঋতুর রানী! তাকে নিয়ে ছড়া-কবিতা না লিখে থাকা যায়? মোটেই না।
হেমন্ত প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গেলে নীল আকাশ, নদীকূলের কাশফুল, মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে সাদা বকের উড়াউড়ি, শিউলি ফুলের মনকাড়া সৌন্দর্য, নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ প্রভৃতিকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। এক চমৎকার ঋতু এই হেমন্ত। কী শান্ত, ¯িœগ্ধ, অপরূপ তার রূপের বাহার! হেমন্তের সকালে খালি পায়ে কেউ যদি সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, শিশিরের শীতল স্পর্শে শিউরে উঠবে গা। ভেজা পায়ে এক ধরনের শিহরণ অনুভূত হয় তখন। শিহরণ জাগে হৃদয়ে। আর তাইতো ছড়াকার তখন এইভাবে ছড়া কাটেনÑ
“শিশির ভেজা ঘাসের ডগা
মাঠে সোনার ধান
কী অপরূপ হেমন্তকাল
আল্লাহতায়ালার দান।”
কে ডেকে আনে এই হেমন্তকে? সবুজ পাতার খামে করে হলুদ গাঁদা চিঠি পাঠিয়ে কে ডেকে আনল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা এই ঋতুরানীকে। হেমন্তের বর্ণনা দেয়ার পাশাপাশি কবি সুফিয়া কামালের মনে এই প্রশ্নটাও উঁকি দেয়Ñ
“সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে।

আনল ডেকে মটরশুঁটি
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

সকাল বেলা শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হালকা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।

আরও এল সাথে সাথে
নূতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।

হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।
আগে হেমন্তকালকে বলা হতো ‘হিমঋতু’। আর শীতকালের নাম ছিল ‘শিশির’। কি বন্ধুরা, বিষয়টা অনেক মজার, তাই না? না জানা জিনিস নতুন করে জানলে সবারই মজা লাগে। ধরে নিচ্ছি তোমাদের কেউ কেউ এ বিষয়টি জানতে, কিন্তু অনেকেই জানতে না তো! হিমঋতু তথা হেমন্তের চিত্র আমাদের প্রিয় কবি মোশাররফ হোসেন খানের কবিতায় খুবই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি হেমন্তকে নিয়ে লিখেছেন-
“ভোর সকালে হিম হিম
সারা বাংলা জুড়ে,
হেমন্তের হাওয়া বেয়ে
হিমটা এলো উড়ে।
হিমটা এলো উড়ে-
কুয়াশার ছাতা মেলে
হিমালয় ঘুরে।

হিমেল ধোঁয়া ঐ যে ভাসে
গাছ-গাছালি দূর্বা হাসে
সবুজ পাতা ফুঁড়ে,
হেমন্তের চাদরখানি
সবই নিল মুড়ে।

হেমন্তের হাওয়া-
সে যে আমার বোনের নোলক
নতুন চালের ভাতের বোলক
আপন করে পাওয়া।”
হেমন্তের সোনালি ধানের গন্ধ চারিদিকে থাকতে থাকতেই শীত এসে যায়। শীত ঋতুকে যেন হেমন্ত তার দু’হাতে ধানের ডালা নিয়ে সুস্বাগতম জানায়। শীত ঋতুও হেমন্তের ধানের ডালা গ্রহণ করে ধন্য হয়ে যায়। সত্যি, ঋতুতে ঋতুতে কতো সম্পর্ক! মানুষে মানুষেও যদি এমনটি হতো! বর্ষায় বীজতলা থেকে চাষিরা চারা উঠিয়ে রোপণ করেন জমিতে। তারপর সেবা যত্ন করতে থাকেন। শরতে ক্ষেতে ধানের চারা পরিপুষ্ট হয়। বেড়ে ওঠে। একসময় ধানের শিষ বের হয়। সেই ধানশিষ থাকে সবুজে ঘেরা। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় পরিপুষ্ট ধানে। এরপর ধানক্ষেতে ধানের শিষ অল্প অল্প করে হেলতে দুলতে থাকে। আহ! কী মনোরম সেই দৃশ্য! হেমন্তের রোদেলা দুপুরে ধীরে ধীরে ধানের শিষে সোনা রঙ ধরে। সোনালি রঙে মাখামাখি হয়ে যায় তখন চতুর্দিক। গ্রাম বাংলার দৃশ্যপট সত্যি অন্যরকম হয়ে যায়। মাঠে মাঠে দোল খায় ধানের শিষ! কবির ভাষায়-
“ধানের শিষে দোল খেয়ে যায়
এই তো মাঠের ছবি
মিষ্টি রোদও দেয় ছড়িয়ে
হেমন্তের ওই রবি।”
আসলে হেমন্তের কোন তুলনাই নেই। হেমন্তের তুলনা সে নিজেই। হেমন্তের কোন এক সকালে মাঠের দিকে তাকালেই দেখতে পাবে আমি সত্যি বলছি কি না! চারদিক সাদা কুয়াশায় ঘেরা। কিছুই যেন দেখা যায় না। কথা বলার সময় কারো কারো মুখ দিয়েও সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বের হয়, তাই না? রাতের বেলা থাকে শীতের আমেজ। ভোরে আবার দেখা যায় পুকুরপাড়ে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু। সত্যিই হেমন্ত এক চমৎকার ঋতু। কবি তাই হেমন্তকে অন্য চোখে দেখেন-
“গ্রীষ্মকালে গরম জ্বালায়
বর্ষাকালে বৃষ্টি
শরৎ এবং হেমন্তকাল
নেয় কেড়ে নেয় দৃষ্টি!”

হেমন্তকাল মানেই ফসলের ছড়াছড়ি। মাঠে ধান পাকে, বাড়ির আঙিনায় বা উঠোনের মাচানে লাউ কুমড়াগুলো লক লক করে বেড়ে ওঠে। মিষ্টি রোদের মায়াময় দিনে নানা রঙের পাখিদের ডানা ঝাপটানো দেখা যায় গাছে গাছে। হেমন্তের নরম রোদের ছোঁয়া সবাই পেতে চায়। একসময় দিন গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সকালে বের হওয়া পাখিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করে দলবেঁধে। তাদের কিচিরমিচির ধ্বনির সঙ্গে যোগ হয় বাঁশ ঝাড় থেকে আসা এক ধরনের শির শির শব্দ। তৈরি হয় অন্যরকম এক সুরের আবেশ।
রাতের আকাশে দেখা যায় অগণিত তারার মেলা। বিস্তৃত দিগন্তের কোথাও এক বিন্দু জমাটবাঁধা মেঘেরও দেখা মেলে না। মিটিমিটি তারা জ্বলে সারা রাত। সেই সঙ্গে চাঁদের শরীর থেকেও জোসনা ঝরে পড়ে পৃথিবী জুড়ে। ঝিরিঝিরি বাতাস আর মৃদু আলোর ঝলকানিতে তৈরি হয় মায়াময় এক রাত। এমন দৃশ্য দেখে হৃদয় থেকে আনমনেই বের হয়ে আসে আমাদের পরিচিত সেই গানের সুর-

“তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
কত সুন্দর!”

SHARE

Leave a Reply