গত সংখ্যার পর
ইউহাওয়া গল্প বলতে শুরু করলো। এই গল্প কয়েক মাস আগে মক্কা থেকে শুরু হয়েছিল। ইউহাওয়া তার রূপ ও যৌবন দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিল আবু সুফিয়ান, খালিদ ও আকরামাকে। ইচ্ছে ছিল তাদের একজনকে দিয়ে আরেকজনকে ঘায়েল করা। কিন্তু যখন সে শুনলো এই তিনজনই মুসলমানের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন সে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিলো।
ইউহাওয়া গল্প বলছে। বললো, ‘একদিন মক্কা থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরের এক গ্রামে গিয়েছিলাম বিশেষ একটি কাজে। দিন শেষে সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার সাথে আরও দু’টি মেয়ে ছিল। আমাদের তিনজনের সাথে ছিল তিন পুরুষ। আমরা সবাই ছিলাম ইহুদি। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পথ চলছিলাম আমরা। আমরা যখন অর্ধেক পথ পেরিয়েছি তখন হঠাৎ করেই আমরা মরু ঝড়ের কবলে পড়লাম। সেই ঝড়ের বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। চারদিক নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল। তীরবেগে বালুর কণা এসে বিঁধছিল গায়ে। মনে হচ্ছিল শরীরে সুই ফোটাচ্ছে কেউ। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বালুর পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে সমতল হয়ে যাচ্ছিল। সমতল জায়গায় মুহূর্তেই সৃষ্টি হচ্ছিল পাহাড়ের অবয়ব। এমন ভয়ঙ্কর মরু সাইমুম আমি আর জীবনে কোনদিন দেখিনি। আগেই সঙ্গীদের হারিয়ে ছিলাম। সামনে পেছনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। প্রাণ বাঁচানোর আশায় চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পিঠের সাথে লেপ্টে ছিলাম। ঘোড়ার ওপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঘোড়া ছুটছিল পাগলের মতো। তার দুরন্ত ছুটেচলা আর উল্টাপাল্টা ডিগবাজির ফলে এক সময় ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়লাম আমি। ঘোড়ার ওপর বালু জমে দেখতে দেখতে একটি টিলা তৈরি হয়ে গেল সেখানে। বালু চাপা পড়ে মারা গেল ঘোড়া। আমার বেঁচে যাওয়াটা এক অলৌকিক ব্যাপার। ঝড় আমাকে উড়িয়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না। কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। একসময় টের পেলাম ঝড় আমাকে কোন দেয়ালের গায়ে আছড়ে ফেলেছে। অবাক হলাম আমি। এই মরুভূমিতে এমন নিরেট দেয়াল এলো কোত্থেকে? আমি দেয়াল হাতড়ে একটু একটু করে এগোচ্ছিলাম। আমার চোখ মুখ পুরোটাই কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এ ছাড়া বালুর ঝাপটা থেকে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। কখনো এক পা, দুই পা এগোতাম, ঝড়ের ঝাপটা এলে দেয়াল আঁকড়ে স্থির হয়ে থাকতাম। ঝড়ের তান্ডবে কান স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মাঝেই আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কোন উটের ডাক। পাহাড়ের গায়ে ঝড়ের দাপট আছড়ে পড়ার কারণে বিচিত্র রকমের শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোন অসুর দানব হুঙ্কার দিচ্ছে। কখনো মনে হতো একদল ভূত তারস্বরে চিৎকার করছে।’
ইউহাওয়া বলছে, ‘আমি নিজেকে খুব সাহসী মনে করতাম। কিন্তু ঝড় আমার সব সাহস যেন কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। এক সময় ঝড় থামলো, কিন্তু আমি আমার হারিয়ে যাওয়া সাহস আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। ভয় এসে যেন আমাকে জাপটে ধরেছে। রাত হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে নেমে এসেছে কৃষ্ণকালো আঁধার। ভয়ের ¯্রােত যেন বয়ে চলেছে আমার ওপর দিয়ে।’ ইউহাওয়া বলে চলেছে, ‘প্রথমে মনে জাগলো মরু শিয়ালের ভয়। এরা অসম্ভব রকমের হিং¯্র প্রাণী। একবার ওদের পাল্লায় পড়লে আর বাঁচার আশা নেই। দ্বিতীয় ভয় ছিল নিঃসঙ্গতা। সঙ্গীরা কে কোথায় জানা নেই আমার। বেঁচে আছে না সবাই মারা গেছে তা-ও জানি না। আশপাশে কোন জনমানবের চিহ্নও কোথাও নেই। তখনি আমার মনে পড়লো, মানুষ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। এখন কোন মরুবেদুইন আমাকে পেলে সে কিছুতেই আমাকে আমার ঘরে ফিরতে দেবে না। সে আমাকে নিয়ে যাবে তার ডেরায়। সেখানে সে আমাকে ভোগ করবে যতক্ষণ তার মন চায়। লোকটি ভালো হলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভোগের স্বার্থে, নইলে মেরে ফেলবে। সবচেয়ে বড় ভয়, ঝড় মরুভূমির রাস্তাঘাটের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে। কোন দিকে মক্কা বোঝারও উপায় নেই। এখন পথ চলা মানে অনিশ্চিত বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া। যদি দিক ভুল করে হাঁটতে থাকি তবে দেখা যাবে, মক্কা না গিয়ে মরুভূমির আরো গভীরে চলে গেছি। এমন চক্করে পড়ে গেছি যে, লোকালয়ে আর কোনদিন যাওয়া হবে না।’
ইউহাওয়া বলল, ‘দেয়াল ধরে একটু একটু করে এগোচ্ছি আমি। অন্ধকারের জন্য দেখতে পাচ্ছি না কিছু। মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল ধরে এভাবে পথ চলছি আমি। একসময় আমার মনে হলো, দেয়াল বেঁকে গেছে। বাঁক ঘুরে আরো একটু এগিয়ে গেলাম। এ সময় আমার কানে এলো উটের ডাক। আমি এটাকে ভাবলাম স্মৃতির বিভ্রম। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি দাঁড়িয়ে কান খাড়া করলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, আবারও ডেকে উঠলো উট। আমি বুঝলাম, এটা কোন বিভ্রম নয়, সত্যি সত্যি এটা উটের ডাক। আমি আবারও চলতে শুরু করলাম।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ খুব কাছেই আবারও উটের ডাক শুনলাম। ভয়ে জমে গেলাম আমি।’
ইহুদি কন্যা ইউহাওয়া এক ভয়ঙ্কর ও অবিশ্বাস্য গল্প বলে চলেছে। সে বলল, তার রাগ হলো নিজের সঙ্গীর ওপর। লোকটা মরার আর সময় পেলো না। উট নিশ্চয়ই একা নেই। এক বা একাধিক আরোহী আছে তার সঙ্গে। এখন যদি তারা তার সন্ধান পায় তবে কী ঘটতে পারে তা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলো ইউহাওয়া। সে লোকগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওখান থেকে পালাতে চাইল। কিন্তু তার পা যেন আটকে আছে মাটির সাথে। পালাতে চাইলেও পালাতে পারছে না সে। আর যাবেই বা কোন দিকে? উট কোনদিকে, কোনদিকে তার আরোহী অন্ধকারের কারণে কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। পালাতে গিয়েও আবার ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো ইউহাওয়া। আবার সব সুনসান। উটের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার সে দেয়াল হাতড়ে চলতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তার মনে হলো সামনে একটি উট দাঁড়িয়ে আছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ইউহাওয়া। উটটি দেয়ালের সাথেই বাঁধা। এরপর আর দেয়াল নেই। সামনে একটি গুহামুখ। একবার ভাবলো ভেতরে ঢোকে, কিন্তু গুহার ভেতর জমাট অন্ধকার দেখে সেখানে ঢোকার সাহস করলো না। গুহামুখের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছিল এখন কী করবে। এ সময় গুহার ভেতর থেকে কেউ তাকে ডাক দিল, ‘কে ওখানে, ভেতরে এসো।’
এ ডাক আবারও তার শরীরে ভয়ের শিহরণ বইয়ে দিল। লোকটি আবার ডাকলো, ‘কই, ভেতরে এসো।’ ইউহাওয়ার কী মনে হলো, সে ধীরপায়ে গুহার মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকটি ভেতর থেকে বললো, ‘আরে, এ যে দেখছি মেয়ে মানুষ।’
ইউহাওয়ার মনে হলো, সে এখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু তার পা জমে যাওয়ায় পালানোর চেষ্টা ত্যাগ করতে হলো তাকে। লোকটি ভেতর থেকে বাইরে এসে হাত ধরলো ইউহাওয়ার।
‘তুমি একা?’
‘না, আমার সাথে আরো চারজন আছে। তাদের সাথে ঘোড়া আছে, তলোয়ার আছে।’
‘কোথায় তারা? কাউকে দেখছি না যে!’
‘ঝড়ের কারণে তাদের আমি হারিয়ে ফেলেছি।’ সত্যি কথাই বললো ইউহাওয়া।
ইউহাওয়া বলে চলেছে, ‘লোকটি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘চলো।’ এটুকু বলেই সে গুহার ভেতর ঢুকে গেল। আমি তার পেছনে চলতে লাগলাম। অল্প একটু গিয়েই গুহাটি বাম দিকে মোড় নিয়েছে। সেখানে জ্বলছে আলোর শিখা। জায়গাটা বড়সড় কামরার মতো। লোকটির পিছে পিছে আমিও সে কামরায় ঢুকে গেলাম।
এখানে ঝড়ের কোন আলামত নেই। সব কেমন পরিপাটি, গোছানো। কামরায় ঢুকে লোকটি ফিরলো আমার দিকে। বললো, ‘বসো। আমার নাম জারিদ। তোমাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি?’
কামরার চারদিকে তাকালাম আমি। এমন ভয়ঙ্কর জায়গা জীবনে দেখিনি আমি। কামরায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কটি নরকঙ্কাল। কঙ্কালের দাঁতগুলো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেন তারা বলতে চাইছে, দেখো হে রূপের গরবিনী, আয়ুর বয়স গেলে এই হয় জীবনের পরিণতি। কামরায় ঢুকে ভয় ও আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠলাম। লোকটি এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলো। বললো, ‘ভয় পাচ্ছো? ভয়ের কিছু নেই। এটাই মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি। জীবনের লেনদেন শেষ করে এই বেশই পরতে হয় সবাইকে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের এই পরিণতি হয়েছে, এখন যারা জীবিত আছে এবং যারা আগামীতে দুনিয়ায় আসবে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে তাদেরও। মানুষের সব দম্ভ অহমিকা এভাবেই একদিন কঙ্কাল হয়ে যায়। কঙ্কাল হয়ে যায় ক্ষমতার দাপট, যৌবনের উন্মাদনা।’
আমি ছুটে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। লোকটি আমাকে ধরে ফেললো আর বললো, ‘কোথায় পালাবে নারী, এই অন্ধকারে পালিয়ে তুমি যাবে কোথায়?’
আমি থেমে গেলাম। জারিদকে খুলে বললাম সব কথা। বললাম, ‘আমি মক্কা যেতে চাই। এই কামরায় থাকলে আমি মরে যাবো। তুমি আমাকে মক্কা পৌঁছে দাও, বিনিময়ে যা চাও তাই পাবে।’
জারিদ খানিক ভেবে নিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে মক্কা পৌঁছে দেবো।’
খানিক পর। উটের পিঠে চড়ে বসলো জারিদ। আমাকে তার পেছনে বসালো। আমি জারিদের কোমর জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভয় একটু একটু করে কমতে লাগলো। সেখানে এসে আসন নিলো সাহস।
অনেক দূর চলে এসেছি আমরা। তারার আলোয় মরুভূমির অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছিল। জারিদ এখন আমার রক্ষক। আমার দিক থেকে তার ভয়ের কিছু ছিল না। সে হয়তো ভাবছিল, আমি এক অবলা নারী। শুধু অবলা নয়, এক পথহারা অসহায় মুসাফির। জারিদ যখন এসব ভাবছিল আমার মনে তখন খেলা করছিল এক অশুভ চিন্তা। আমি ভাবছিলাম, জারিদের এই ভালমানুষির পেছনে লুকিয়ে আছে তার লালসা। আমি তার লালসা চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্য তাকে খুন করার শপথ নিলাম।
এক সময় দূরদিগন্তে ভেসে উঠলো আলোর রেখা। বুঝলাম, আমরা মক্কার সন্নিকটে চলে এসেছি। আমি কোমর থেকে খঞ্জর বের করলাম। জারিদ পথ চলছিল আর গুনগুন করে গান গাইছিল। সে ভাবতেও পারেনি পৃথিবীর রূপরস উপভোগের যখন সুবর্ণ সময় তখন তাকে ছেড়ে যেতে হবে পৃথিবীর সব বন্ধন। মক্কার কাছে চলে এসেছিল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে আমার হাতের খঞ্জর জারিদের পিঠে বসিয়ে দিলাম। এরপর সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে তাকে উট থেকে ফেলে দিলাম।’
ইউহাওয়া বললো, ‘এই স্বপ্নবৃত্তান্ত যখন আমি জাদুস¤্রাট লায়েস বিন মোশানকে বললাম, তিনি বললেন, ‘তুমি এক যুগান্তকারী স্বপ্ন দেখেছো ইউহাওয়া। তুমি জাতির খুব বড় খেদমত করবে। স্বপ্নে তুমি যে ঝড়ের কথা বলেছো, সেটা হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের এই ঝড় আরব ভূখন্ডকে তছনছ করে ফেলবে। তুমি বাধ্য হবে তাদের আশ্রয়ে যেতে। তারপর তুমি ইসলামের প্রবর্তককে হত্যা করবে, এই হচ্ছে এ স্বপ্নের তাবির।’
এবার কথা বললেন লায়েস বিন মোশান, ‘ইউহাওয়ার স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে আমি চমৎকৃত না হয়ে পারলাম না। ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধে মুহাম্মদের নেতৃত্বে যে প্রবল শক্তি মাথা তুলছিল, সেটা নিয়ে আমরা গভীর দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ইউহাওয়ার কথা শুনে বুঝলাম, মহান প্রভু এবার আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। যে সমস্যা আমাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল তার সমাধানের জন্য খোদা বেছে নিয়েছেন এক নারীকে। ইউহাওয়া সেই নারী।
আমি তার বাপের সাথে দেখা করলাম। তার পিতা একজন কট্টর ইহুদি। তাকে বললাম, ‘ধর্মের সেবার জন্য আপনার কন্যাকে আমাদের দরকার।’ তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিলেন।
৫.
বনু কোরায়জার সরদার কাব বিন আসাদের দরবারকক্ষে গোত্রের প্রভাবশালী নেতাদের সামনে কথা বলছিল লায়েস বিন মোশান। মোশান বলল, ‘আমি ইউহাওয়াকে আমার কাছে নিয়ে এলাম। তার দেহটাই একটা জাদু। এমন অঙ্গসুষমা প্রভু খুব কম মেয়েকেই দিয়েছেন। তার দেহ খাপখোলা তলোয়ারের চাইতে ধারালো। তাকে আমি এমন সব জাদুবিদ্যা শিক্ষা দিলাম যা তার কাজে লাগবে। আমাকে আপনারা জাদুস¤্রাট বলেন। আমি আমার জাদুর ঝাঁপি উজাড় করে খুলে দিয়েছি তার জন্য। একজন পুরুষকে ঘায়েল করার জন্য তার দেহের জাদুই যথেষ্ট। আমার জাদু তার মধ্যে এনে দিয়েছে এক অতিমানবিক শক্তি। এই শক্তির বলে হাজার হাজার মুগ্ধ চোখের সামনে থেকে সে এমনভাবে উধাও হয়ে যেতে পারবে যে, কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। তাকে আপনারা বলতে পারেন মদিনার টসটসে তাজা খেজুর। যে খেজুরে মেখে রাখা হয়েছে সৌরভমাখা মিষ্টি বিষ। এই বিষ এরই মধ্যে যে অসাধ্য সাধন করেছে তা আপনারা জানেন না, আমি জানি। মুসলমানদের বিনাশ করার সাথে সাথে যেন কোরাইশদের শক্তিও খর্ব হয়ে যায়, যাতে ইহুদিরাই হয়ে ওঠে আরব ভূখন্ডের প্রধান শক্তি এই লক্ষ্যে তাকে কাজে নামিয়েছিলাম। এই অভিপ্রায়েই সে কোরাইশদের ছোট দু’টি গোত্রকে টার্গেট করে। তাদের সরদারকে সে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। গোত্রের যুবকদের মধ্যে সৃষ্টি করে মুসলিমবিরোধী উন্মাদনা। তাদের দিয়ে গড়ে তোলে ক্ষুদ্র এক বাহিনী। এই বাহিনীর প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছিল কোরাইশদের সেই বিশাল বাহিনী, যারা লড়াই করতে এসেও যুদ্ধ না করেই ফিরে গেছে। তারা সফল হলে মুসলমানদের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো পৃথিবীর বুক থেকে। লড়াইয়ের ঘা শুকোনোর আগেই আমরা কোরাইশদের মধ্যে এমন বিভেদ সৃষ্টি করতাম, যাতে তারাও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। তখন আমাদের আধিপত্য মেনে নেয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকতো না। কিন্তু এ পরিকল্পনা সফল না হওয়ায় আমাদেরকে নতুন করে ছক তৈরি করতে হচ্ছে।’
‘বুঝলাম’, কাব বিন আসাদ বলল, ‘অনেকদিন ধরেই আপনারা জাতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন কিভাবে কী করতে চান একটু খুলে বলুন।’
‘ইউহাওয়ার গল্প শেষ হয়নি। তার গল্পের বাকি অংশ শুনুন, তারপর বলছি কিভাবে কী করতে হবে।’ বলল জাদুস¤্রাট লায়েস বিন মোশান।
ইউহাওয়া আবার ফিরে গেল তার গল্পে। বলল, ‘ওস্তাদজি আমাকে ধর্মের শিক্ষা দিয়েছেন। তার কাছ থেকেই আমি জেনেছি, আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম। এই ধর্মের সেবকদের সাথে থাকেন স্বয়ং খোদা। আমি তার অনেক প্রমাণও পেয়েছি। ভেবে দেখুন, যে মরুঝড়ে আমার ঘোড়া ও সঙ্গীসাথী সবাই মারা পড়লো সে ঝড় আমার কোনোই ক্ষতি করলো না। যে যুবক আমাকে তার লালসা চরিতার্থ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল তার হাত থেকেও খোদা আমাকে রক্ষা করলেন। আমি তার পিঠে খঞ্জর বসিয়ে ধাক্কা মেরে যখন ফেলে দিয়েছিলাম, তখন আমার ধারণা ছিল তাকে আমি কাবু করতে পেরেছি। কিন্তু ঘটনা ঘটল ভিন্ন। যুবক আপন মনে পথ চললেও সে ছিল যথেষ্ট হুঁশিয়ার। আলখেল্লা ভেদ করে আমার খঞ্জর তার কোমরের বেল্টে লেগে পিছলে যায়। আহত হওয়ার আগেই সে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়ে। নিচে নেমেই সে দাঁড়িয়ে যায় এবং উটের লাগাম টেনে ধরে। সে উটটিকে সেখানেই বসিয়ে দেয়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এটা কি হলো ইউহাওয়া?’ আমি তখন নিরস্ত্র। আমার সাথের একমাত্র অস্ত্র খঞ্জরটি তখন তার পিঠের আলখেল্লায় ঝুলছে। আমার চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, মৃত্যু অতি নিকটে চলে এসেছে। তার প্রশ্নের জবাবে আমি কিছুই বলতে পারলাম না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো। আমি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তোমাকে মারতে চেয়েছিলাম। আমার মন বলছিল, তোমার ভালমানুষির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কুমতলব লুকিয়ে আছে। তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে তারপর তোমার লালসা মেটাবে। আমার কাছে জীবনের চাইতে ইজ্জত বড়। তোমাকে হত্যা করে আমি আমার ইজ্জত বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি ব্যর্থ হয়েছি, এখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো।’ কি করে এতগুলো কথা বলতে পারলাম তা ভেবে আমি নিজেই চমৎকৃত হলাম। গুরুজি বলেছেন, কথা নাকি আমি বলিনি, আমাকে দিয়ে পরম প্রভু এ কথাগুলো বলিয়েছেন। এখন আমার মনে হয় গুরুজি সত্যি কথাই বলেছেন।
জারিদ আমার কথা শুনে গভীরভাবে আমার দিকে তাকালো। বললো, ‘তোমার এমনটি মনে হলো কেন? সাক্ষাতের পর থেকে এ পর্যন্ত আমার কথায় বা আচরণে কি এমন কোন ইঙ্গিত আমি দিয়েছি? আমার নিয়ত খারাপ থাকলে এই বিজন মরুতে তোমাকে ভোগ করা থেকে কেউ কি আমাকে বিরত রাখতে পারতো? শোন, আমার বিবি আছে, ছোট একটি কন্যাও আছে। নিজের বিবি ছাড়া অন্য মেয়েদের দিকে লালসার নয়নে তাকানোকে আমি পাপ মনে করি। আর সে জন্যই তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করিনি। এক পবিত্র মন নিয়ে তোমাকে আমি তোমার বাড়ি পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি, আর বিনিময়ে তুমি আমার পিঠে খঞ্জর চালিয়ে দিলে!’ বিবেকের দংশনে তখন আমি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম। সত্যি, এ যুবক এ দীর্ঘ পথে কখনো আমার দিকে কুনজরে তাকায়নি। জারিদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। জারিদ বললো, ‘কি হলো, কথা বলো?’ আমি আমার চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তোললাম, যেন আমি অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি। সে বললো, ‘কি হলো ইউহাওয়া, কথা বলো?’ আমি কাতর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘না জারিদ, তুমি নিষ্পাপ। পাপ ছিল আমার মনে, নইলে অমন কথা কেন আমি চিন্তা করতে গেলাম? কেন তোমাকে হত্যা করার বাসনা আমার মনে এলো? জারিদ, তোমার যা ইচ্ছা আমাকে শাস্তি দাও।’
জারিদ আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল, ‘তুমি যে জঘন্য অন্যায় করেছো তার শাস্তি বড় ভয়াবহ হতে পারতো। কিন্তু তুমি যে উদ্দেশ্যের কথা বললে তা শুনে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে। আমাদের মেয়েরা এখনো ইজ্জতকে এতটা মূল্যবান মনে করে এ কথা শোনার পর তোমাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। যাও, তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। এবার উটে চড়ো, তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দেই।’ আমরা আবার উটে চড়লাম এবং এক সময় সে উট আমাদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। আমি ফিরে এসেছি দেখে আব্বা এসে দৌড়ে গেট খুলে দিল। আব্বা ধারণা করেছিলেন, ঝড়ের কবলে পড়ে আমি মারা গেছি। তিনি আমাকে দেখে এতটাই বিস্মিত হলেন যা বর্ণনা করা কঠিন। তিনি জারিদকে কিছুতেই যেতে দিলেন না, ঘরে এনে নাস্তাপানি দিলেন। আমি সব খুলে বললাম আব্বাকে। এ ঘটনার পর আমার মনে হলো জারিদ এক ফেরেশতা। কুদরতই আমাকে রক্ষা করার জন্য তাকে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এ কথা আমি জারিদকেও খুলে বললাম। তাকে অনুরোধ করলাম, সে যেন মাঝেমধ্যেই আমাকে এসে দেখে যায়।
এ ঘটনার পর কয়েকদিন কেটে গেল, জারিদ আর এদিকে আসেনি। জারিদের অমায়িক ব্যবহার, ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ, উন্নত নৈতিক চরিত্র ইউহাওয়ার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। জারিদের অনুপস্থিতিতে তার মন শূন্যতায় খাঁখাঁ করতে লাগল। ইউহাওয়া অনুভব করলো, সে জারিদকে ভালোবেসে ফেলেছে। একদিন সে তার চাকরকে দিয়ে জারিদের কাছে এক চিঠি পাঠালো। তাতে লিখলো, জারিদ, তুমি আমার দেবতা। তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না। শুধু একনজর দেখতে চাই। তুমি কি আসবে? জারিদ এলো। এভাবে আসা-যাওয়া করতে করতে জারিদের মনেও ভালোবাসা জন্ম নিল। ইউহাওয়া এ ভালোবাসাকে বলে পবিত্র ভালোবাসা, কারণ এ ভালোবাসায় কামনা বা লালসার কোন স্পর্শ ছিল না। এভাবেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলো।
একদিন জারিদ বলল, ‘ইউহাওয়া, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’
ইউহাওয়া বলল, ‘জারিদ, আমি তোমাকে আমার দেবতা বানিয়েছি। বিয়ে করে আমি তোমাকে আমার সমপর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাই না। চিরকাল আমি তোমাকে দেবতার আসনেই রাখতে চাই।’
‘তুমি জানো আমার একটি কন্যা সন্তান আছে, কিন্তু কোন ছেলে নাই। আমার বিবি আমাকে আর সন্তান দিতে পারবে না। তাই আমি চাই, তুমি আমাকে বিয়ে করে আমাকে অন্তত একটি পুত্রসন্তান দাও।’
এ কথায় ইউহাওয়াও বিচলিত হয়ে উঠলো। বলল, ‘জারিদ, জানি তোমার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে আছে একটি পুত্রসন্তানের জন্য। এই পুত্র তোমাকে তোমার বিবিও দিতে পারে।’
‘না ইউহাওয়া, চিকিৎসক না করে দিয়েছে।’
‘নিরাশ হয়ো না। আমার একজন গুরুজি আছেন। জাদুস¤্রাট লায়েস বিন মোশান আমার সেই গুরু। তার চিকিৎসায় অনেক বন্ধ্যা মেয়েও মা হয়েছে। আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাবো, দেখবে তিনি তোমার মনের আশা পূরণ করবেন।’
এরপর জারিদ সত্যি সত্যি ইউহাওয়ার সাথে জাদুস¤্রাট লায়েস বিন মোশানের কাছে গেল।
লায়েস বিন মোশান সবকিছু শুনে বলল, ‘ইউহাওয়া, এই যুবকের মনের ইচ্ছা পূরণ হবে কিনা তা এখনি বলা যাচ্ছে না। আমি পরীক্ষা করে দেখবো তার আর সন্তান জন্ম দেয়ার আদৌ কোন সম্ভাবনা আছে কিনা? কেন তার এই অবস্থা? পরীক্ষার পরই আমি এ ব্যাপারে প্রকৃত কথা বলতে পারবো।’
জারিদ বলল, ‘আমি রাজি। আপনি পরীক্ষা করুন এবং আমার মনের আশা পূরণ করুন।’
‘এখনই পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। তুমি ভালো করে ভেবে দেখো আসলেই তুমি চিকিৎসা করাবে কিনা? যদি করাতে চাও তবে এ মাসের পূর্ণিমা রাত এখানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকালবেলা চলে আসবে। ইউহাওয়া, তোমাকেও আসতে হবে তার সাথে।’
লায়েস বিন মোশান তাদের সাথে আরো অনেকক্ষণ কথা বললেন। রাত ঘনিয়ে এলে বাড়ির পথ ধরলো তারা।
আকাশে ফকফকা পূর্ণিমা। জারিদ ও ইউহাওয়া বিকালেই মোশানের বাড়িতে চলে এসেছে। রাতে জাদুস¤্রাট মোশান জারিদকে নিয়ে এক অন্ধকার কামরায় প্রবেশ করলো। বলল, ‘যাই ঘটুক ভয় পাবে না। আমি তোমার পাশেই থাকবো।’ একটু পর কামরাটি ভরে গেল মিষ্টি সৌরভে। ক্ষীণ একটু আলোও যেন জ্বলছে কামরায়, তবে এ আলো হালকা নীলাভ। এরপর সেখানে ডেকে আনা হলো ইউহাওয়াকে। তার পরনে ফিনফিনে কাপড়ের আবরণ। মোশানের ইশারায় ইউহাওয়া শরবতের পেয়ালা তুলে ধরলো জারিদের ঠোঁটে। জারিদ অপূর্ব স্বাদের সে শরবত পান করলো তৃপ্তির সাথে। নীল আলো মিলিয়ে গেল। জ্বলে উঠলো লালচে আলোর আভা। মোশান বিড়বিড় করে অনবরত মন্ত্র পড়ে চলেছে। একসময় জারিদ দেখলো তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিকটদর্শন এক লোক। মোশান মন্ত্র থামিয়ে তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করলো। বলল, ‘হে জিনের বাদশাহ। আপনার সামনে যে লোকটি বসে আছে তার একটি আশা আছে। তার সে আশা কি পূরণ হবে?’
জিনের বাদশাহ, এগিয়ে গেল জারিদের দিকে। তার চারদিকে চক্কর দিল। তার মাথা, হাত, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ঘ্রাণ নিল। বলল, ‘যুবক, তুমি তোমার পরনের কাপড় খুলে ফেলো।’ জারিদ মন্ত্রমুগ্ধের মত তাই করলো। জিনের বাদশাহ আবারো তার চারপাশে চক্কর দিল। বলল, ‘বড় কঠিন প্রশ্ন। তার ওপর জাদুর প্রভাব কাজ করছে। এ জাদু বড় কঠিন জাদু। এর প্রভাব মুক্ত হতে হলে তাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। এ যুবক কি সেই কঠিন পরীক্ষা দিতে রাজি আছে?’
মোশান বলল, ‘জারিদ, প্রশ্নের জবাব দাও।’
জারিদ বলল, ‘একটি পুত্রের জন্য আমি যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। আপনি বলুন আমাকে কী করতে হবে?’
‘যে তোমাকে জাদু করেছে তাকে খুন করতে হবে। তুমি কি তাকে খুন করে হলেও পুত্র চাও?’
‘চাই, চাই। আপনি বলুন সে কে? আমি তাকে খুন করবো।’
‘খুন করবো বললেই সে খুন হয়ে যাবে না। তাকে খুন করতে হলে মোশানের মত জাদুস¤্রাটের কথা মত এগোতে হবে। নইলে তুমি খুন করতে গিয়ে নিজেই ধরা পড়ে যাবে এবং প্রাণ হারাবে।’
‘আমি মোশানের ইশারা মতই সব করবো। আপনি বলুন সে কে? কোথায় থাকে?’
‘সে এই মক্কাতেই ছিল, এখন মদিনায় থাকে। তার নাম মুহাম্মদ।’
‘আমি মুহাম্মদকেই হত্যা করবো। তাহলে কি আমি পুত্রসন্তানের জনক হতে পারবো?’
‘না, তারপর ইউহাওয়াকে বিয়ে করতে হবে। তার গর্ভেই জন্ম নেবে তোমার পুত্রসন্তান। তবে শর্ত হচ্ছে, ওই লোককে হত্যা করার আগে তুমি ইউহাওয়াকে বিয়ে করতে পারবে না। এখন তোমরা বাগানে যাবে। চাঁদ হেলে পড়ার আগে বিছানায় যাবে না।’
এভাবেই নেশা ও নারী দিয়ে আচ্ছন্ন করা হলো জারিদকে। জারিদ ফিরে গেল বাড়িতে। নেশার ঘোরে ওখানে মুহাম্মদকে হত্যা করার কথা বলে এলেও বাড়িতে এসে সে কিছুতেই তার মনকে রাজি করাতে পারছিল না। ইউহাওয়া তাকে উত্তেজিত করলে একবার সে রাজি হয়, কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার আগেই তার সে সঙ্কল্প শিথিল হয়ে পড়ে। ইউহাওয়ার ক্রমাগত প্ররোচনায় অবশেষে একদিন মুহাম্মদকে হত্যা করার সঙ্কল্প নিয়ে ইউহাওয়ার সাথে সে মক্কা থেকে মদিনা পাড়ি জমায়। তাদের পরিকল্পনা, নও মুসলিম হিসেবে তারা মদিনায় আশ্রয় চাইবে এবং সুযোগ বুঝে একদিন মুহাম্মদকে দাওয়াত দেবে তাদের ঘরে। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে মুহাম্মদকে হত্যা করে পালিয়ে যাবে ওখান থেকে।
বনু কোরায়জার এ ষড়যন্ত্রের খবর বৈঠক শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলেন মহানবী। মুসলমানরা তখন মদিনার অলিতে গলিতে আনন্দ উল্লাস করছিল। যে লোক বৈঠকে জানিয়েছিল নঈমের মুসলমান হওয়ার কথা, তাকেই বৈঠক থেকে বলা হলো নঈমের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে এবং তার কাছ থেকে কৌশলে তথ্য আদায় করতে। এ লোক ছিল নঈমেরই গুপ্তচর। বৈঠক থেকে বেরিয়েই সে বৈঠকের পুরো বিবরণ নঈমকে জানিয়ে দিল এবং নঈমের মাধ্যমে মহানবীও পেয়ে গেলেন এ খবর। নঈম যখন এ খবর মহানবীকে দেয় সে সময় সেখানে ছিলেন কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী। তারা বলাবলি করতে লাগলেন, ‘ইহুদিদের বিশ্বাস করা আর নিজের খঞ্জর নিজের বুকে বসিয়ে দেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’
খালিদ বিন ওয়ালিদ। মক্কা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। মাথার ওপর কড়া রোদ। গন্তব্য মদিনা। ঘোড়াটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পথ চলছে ধীরগতিতে। খালিদের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে পথ চলছে ঘোড়া। ঘোড়ার ওপর বসে খালিদ হাতড়ে ফিরছে অতীত দিনের স্মৃতি। সে স্মৃতি বেদনার। সে স্মৃতি অপমান ও লজ্জার। ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের সে বৈঠকের কিছুদিন পরের কথা। মক্কার অদূরে এক মরুদ্যানে বসে বিশ্রাম করছিল খালিদ। দেখলো মদিনার দিক থেকে এক লোক মক্কার দিকে এগিয়ে আসছে। মরুদ্যানের কাছে এসে ঘোড়া থামাল সেই লোক। খালিদ চিনলো তাকে, জারিদ। খুবই শরিফ আদমি। এখনকার যুবক বলতেই দাঙ্গাবাজ। জারিদ এদের মধ্যে পড়ে না। হাসিখুশি প্রাণবন্ত এক যুবক। খালিদ ওকে দেখেই বললো, ‘আরে! জারিদ যে, কোত্থেকে এলে?’
জারিদ তার ঘোড়াটিকে পানি পান করিয়ে এক গাছে বেঁধে বসতে বসতে বলল, ‘একটু মদিনা গিয়েছিলাম।’
‘মদিনা! এতদূর! ব্যবসার কাজে বুঝি?’
‘আরে না।’
‘তাহলে?’
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে জারিদ এক দৃষ্টিতে ওয়েসিসের পানির দিকে তাকিয়ে রইল। খালিদ বলল, ‘তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে, ব্যাপার কী জারিদ?’
জারিদ এবার খালিদের দিকে ফিরে বলল, ‘তোমাকে বলা যায়। জাদুস¤্রাট মোশান মদিনায় গিয়েছিলেন। তিনিই আমাকে তার সঙ্গে নিয়েছিলেন।’
‘ইহুদিরা তো ইহুদি ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করে না। তা ইহুদি যুবকদের রেখে হঠাৎ তিনি তোমাকে মদিনায় নিয়ে গেলেন কেন?’
‘খালিদ, এ কথা এখন কাউকে বলা যাবে না। তবে গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিলে তোমাকে বলতে পারি।’
‘আরে! বলো, বলো। তুমি জানো, লোক দেখলেই পেটের কথা কারো গায়ে ঢেলে দেয়ার মত লোক আমি নই। তুমি নির্ভয়ে সব বলতে পারো।’
‘তোমরা যা পারোনি ইহুদিরা তাই করতে যাচ্ছে।’
‘আমরা কি পারিনি অথচ ইহুদিরা তাই করবে!’
‘মুহাম্মদকে হত্যা।’
খালিদের চেহারা লজ্জা ও অপমানে লাল হয়ে গেল। কথা তো জারিদ মিথ্যা বলেনি। আমরা তো মুহাম্মদকে হত্যা করার জন্য বারবার তাকে যুদ্ধে জড়িয়েছি। কিন্তু বিশাল বাহিনী নিয়েও তাকে আমরা কাবু করতে পারিনি, হত্যা তো পরের কথা। বললো, ‘যেদিন আমার সম্প্রদায় বদরের ময়দানে পরাজয় বরণ করলো সেদিন থেকে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি তাকে হত্যা করার। পর পর তিনটি যুদ্ধ করলাম, কিন্তু তাকে পরাজিত ও হত্যা করতে পারলাম না।’
‘তোমরা কি রণে ভঙ্গ দিয়েছো, নাকি এখনো হত্যা করার আশা পোষণ করো?’
‘না, আমরা রণে ভঙ্গ দিইনি, আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
‘যুদ্ধ করে তোমরা তার কিছুই করতে পারবে না। ইহুদিদের চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে।’
‘ইহুদিরা কী করতে চাচ্ছে?’
‘গোপনে আততায়ীর মাধ্যমে বা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে সেই খাবার খাইয়ে তাকে হত্যা করবে তারা। তুমি জানো না, লায়েস বিন মোশান কত বড় জাদুকর। তার মত জ্ঞানী লোক আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি বলেন, একদিন বিশ্ব হবে ইহুদিদের করতলগত। আজ হোক, কাল হোক, শত বা হাজার বছর পরে হোক, এটা ঘটবেই। পৃথিবীতে বিজয়ী হবে ধোঁকা বা প্রতারণা। যুদ্ধজয়ের সর্বোত্তম অস্ত্র হচ্ছে কূটকৌশল। কূটকৌশলে যে পারদর্শী তার বিজয় কেউ রোধ করতে পারবে না। যেদিন প্রতারকরা পৃথিবীর দায়িত্ব নেবে সেদিন ইহুদিরাই হবে প্রকৃত ক্ষমতাবান। মুহাম্মদের কাছে জাদু আছে বলেই সে এখনো টিকে আছে। খোদার কসম, মোশানের জাদুর কাছে মুহাম্মদের জাদু কিছুতেই টিকবে না।’
জারিদের কথায় মন ভারাক্রান্ত হলো খালিদের। ষড়যন্ত্র কোনো বীরের অস্ত্র হতে পারে না, অথচ সেই অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভেবে পুলকিত হচ্ছে ইহুদিরা। জারিদের সাথে সেই কথোপকথনের দৃশ্য ভেসে উঠলো খালিদের অন্তরে। মনে মনে বলল, জারিদ, মুহাম্মদের জাদু কী এটা দেখার জন্যই আজ আমি একাকী মদিনার পথ ধরেছি। আমি দেখতে চাই, কেন তার চেয়ে বেশি সৈন্য নিয়েও আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, কেন ইহুদিদের কোন ষড়যন্ত্রই ফলপ্রসূ হচ্ছে না, কেন বারবার ব্যর্থ হয় জাদুস¤্রাট মোশানের জাদু।
খালিদের মন তখন অশান্ত ও বিপর্যস্ত। তার মনে হলো জারিদ তাকে ডেকে বলছে, ‘খালিদ, মোহাম্মদের কাছে ভয়ঙ্কর জাদু আছে। তার কাছে যেয়ো না তুমি। তুমি তার কাছে গেলে তোমাকেও গ্রাস করে ফেলবে তার জাদু।’
খালিদ আপন মনে বলল, ‘না না, জাদু বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। মানুষ যে জিনিস বুঝতে পারে না তাকেই জাদু বলে, আর যাকে প্রতিরোধ করতে পারে না তাকে বলে জাদুকর।’ কিন্তু এই সিদ্ধান্তে অটল থাকে না তার মন। মনের সাথে মন কথা বলে। বলে, ‘কিছু না কিছু রহস্য তো অবশ্যই আছে, নইলে তার কথা তুমি বুঝতে পারবে না কেন? কেন ভক্তিবিগলিত চিত্তে মানুষ মেনে নেয় তার আধিপত্য!’
এ সময় তার মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা। আবু সুফিয়ান একদিন তাকে, আকরামা ও সাফওয়ানকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘মুহাম্মদ মক্কা আক্রমণ করতে আসছে?’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
(চলবে)