আমরা তিন বন্ধু একটা জরুরি কাজে গিয়েছিলাম উত্তরায়। কাজ শেষ করে রওনা হলাম নোয়াখালীর উদ্দেশে। সূর্যটা তখন ঠিক মাথা বরাবর ওপর। রোদের তাপে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। এমন সময় সামনের গলিতে একটা মসজিদ দেখতে পেলাম। ব্যাস, এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। নামাজও পড়া হলো, বিশ্রামও করা হলো।
নামাজ পড়ে মাত্র মসজিদ থেকে বের হলাম। শরীফ বলে উঠল দোস্ত, খুব খিদে পেয়েছে এখনি কিছু খেতে হবে। না হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। সৌরভও দেখলাম কাচুমাচু করছে। আমি বললাম, কিছু যখন খেতে হবে ভাতই খেয়ে নিই। দুপুরবেলা ভাত ছাড়া অন্য কিছু আমার পেটে সয় না। অবশেষে হোটেলে ঢুকে পেটপুরে ভাত খেয়ে নিলাম। হোটেল থেকে বের হয়ে একটা মিনি বাসে উঠলাম। গন্তব্য এয়ারপোর্ট। প্রচন্ড গরম, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এতটুকু পথ। বাসে না গিয়ে ট্রেনেই যাবো। যেহেতু ট্রেন ছাড়বে ৪টায়। আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা থাকবে। তা ছাড়া সৌরভও পীড়াপীড়ি করতে লাগল সে নাকি ট্রেন ভ্রমণ করেছে, চার বছর হয়ে গেছে। আমি কিছুটা খুশি হলাম অন্তত অর্ধেক ভাড়া বাঁচবে। বাসে ওঠার পর মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা।
আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়তাম। আব্বু জানতে চাইলেন ট্রেনে যাবো, নাকি বাসে যাবো? ভাবলাম ট্রেন শুধু বইয়েই দেখেছি। বাস্তবে দেখিনি। ট্রেনেই যাবো। আব্বুকে জানালাম নিজের মতটা। আব্বুও দেখলাম খুশি হলেন।
আব্বু একটা রিকশাওয়ালাকে ডাকলেন। এয়ারপোর্ট যাবে কি না জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল পাঁচ টাকা ভাড়া। আব্বু রাজি হয়ে গেলেন। আমি বললাম চার টাকা হলে যাবো। জিজ্ঞেস করলো এক টাকা দিয়ে আইসক্রিম খাইবি? আমি মাথা নাড়ালাম। তিনি বললেন আচ্ছা, তোরে দুটো দুধের আইসক্রিম কিইন্যা দিমুনে।
এয়ারপোর্ট পৌঁছার পর সত্যিই তিনি (রিকশাওয়ালা) আমাকে দুটো দুধের আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলেন। আব্বু সাত টাকা দিয়ে বললেন, তোমার লস করে লাভ কী এই নাও! তিনি পাঁচ টাকা নিয়ে বাকি দুই টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, আমার পোলাটা বাঁইচ্যা থাইকলে ওরেতো আইসক্রিম খাওয়ান লাগতো। হেই টাকা দিয়া ওরে খাওয়াইলাম। কিছু মনে করবেন না।
আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ছেলে কি মারা গেছে? সে কান্না সংযত করে বলল- মরে নাই, হারাইয়া গেছে। যেই দিন থাইকা পোলা হারাইছি হেই দিন থেইকা রিকশার প্যাডেলে পাও দিছি পুরো শহর খুঁজছি। পাই নাই তারে, তারে আমি পাই নাই। ছোড পোলাপান দেখলে আমার নাফিসের কথা মনে পইড়া যায়। এ কথা বলে কাঁদতে থাকে। আর রিকশার প্যাডেলে পা চালাইতে থাকে।
আমরাও স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাই। ৪টার ট্রেন ঠিক সাড়ে ৪টায় এলো। বইয়ে যেমনটি দেখেছি ঠিক তার বিপরীত। কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে। তবুও তো ট্রেন। জীবনের প্রথমে ট্রেন ভ্রমণ। অনুভূতিটা অন্য রকম। ট্রেন চলছে তো চলছেই। মাঝে মাঝে দু-একটা স্টেশনে থামে। চলতে চলতে চোখে ঘুম এসে গেছে। এক সময় আব্বুর ডাকে ঘুম ভাঙে। আব্বু বললেন সামনেই মাইজদী স্টেশন। এখানে নামতে হবে। অবশেষে স্টেশনে ট্রেন থামলো। আমি খুশি হয়ে বলে উঠলাম। ওহো এয়ারপোর্ট এসে গেছে। দেখলাম আশপাশের লোকজন হো, হো করে হেসে উঠলো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্বু আমাকে টেনে নামিয়ে নিলেন ট্রেন থেকে।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাস এয়ারপোর্টে এসে গেছে টেরই পেলাম না। রোডের যে উন্নতি, সাত মিনিটের জায়গায় জ্যামে পড়ে সাতাশ মিনিট লেগে গেল। আজকাল গাড়ি বেড়ে গেছে বোধ হয়। এমন সময় শরীফের কণ্ঠ শুনতে পেলাম এই হাবিব, বসে আছিস কেন? শাহবাগ যাবি নাকি? তাড়াতাড়ি নাম। চারটার কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দেবে। আমি বাস থেকে নামতে নামতে বললাম চারটার ট্রেন চারটায় ছাড়ে, এটা আবার কবে থেকে রে? তাহলে বুঝি বাংলাদেশের রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সচেতন হতে পেরেছে, ওরা এখন জনগণের কষ্ট বোঝে। তাই না? শরীফ বলল, পন্ডিতগিরি করিস না। তাড়াতাড়ি চল। অবশেষে রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলাম। সৌরভ বলল, খেয়ে দেয়ে কাজ নেই ট্রেনের জন্য আমাকে এনেছ এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে কি ট্রেন পাওয়া যায়? আমি তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির ছাপ দেখতে পেলাম। আমি বললাম, ফার্মগেটে গেলে একটা ফার্মও পাবি না। এখানে দেখবি কোচিং বাণিজ্যের আখড়া। গুলিস্তানে গুল পাবি না। উত্তরাতে সব প্রশ্নের উত্তরও পাবি না, চুপ করে বসে থাক। দেখবি ট্রেন ঠিক সময়েই আসবে। হয়তো পনের-বিশ মিনিট লেট আর কি? এমন সময় মনে পড়ল ছোটবেলার সেই ট্রেন ভ্রমণের কথা। রেলওয়ে স্টেশনকে এয়ারপোর্ট বলাতে ওই নির্বোধ মানুষগুলো কেন হো হো করে হাসলো?
কথা বলতে বলতে দেখলাম ট্রেন এসে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম বারবার চারটা, অবাক হলাম। জয় রেলমন্ত্রী। চারটার ট্রেন চারটায় এলো কবেরে? কবেরে? প্রতি-উত্তরে অন্যরা বলছে সবেরে? সবেরে? এমন সময় ট্রেনের ভেতর থেকে কয়েকজন বলে উঠলো, এত খুশি হওয়ার কী দেখছেন? এটা গতকালের ট্রেন আজ এসেছে।
এ কথা শুনে আমরা তিন বন্ধু হাসতে হাসতে ট্রেনের দিকে পা বাড়ালাম।