সোনার খোঁজে বেরিয়েছিল রস মার্টিন। সে জানত, তার মত আরো শত মত লোক একই উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছে। সবার গন্তব্য ডস ক্যাবেজাস। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে বয়ে যাওয়া নদী লিটল ক্রিকের মৃদু ¯্রােতে নাকি বালুর সাথে সোনার কণা দেখা গেছে। তা সোনার কণা যখন দেখা গেছে আশপাশেই কোথাও তার খনি নিশ্চয়ই আছে। এক ভবঘুরে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হয়েছিল ডস ক্যাবেজাস পর্বতে। এক সময় ছোট নদীটায় নামে সে। তখনি ব্যাপারটা ধরা পড়ে তার চোখে। তড়িঘড়ি করে নিজের শহরে ফিরে আসে সে। আর সোনার খবরটাও বেশ রঙচঙে হয়ে বেরিয়ে আসে তার পেট থেকে। তারপর যা হবার তাই হয়েছে। মার্টিনের শহর সান্তা ফে থেকেও সোনা খুঁজতে বহু লোক ছুটে গেছে ডস ক্যাবেজাসে। সে আজ মাসখানেক হয়ে গেছে। তবে কথা হচ্ছে, এত দিনেও থলে ভরা সোনা নিয়ে কেউ ফিরে আসেনি। ফলে গত এক সপ্তাহ থেকে নতুন করে ওমুখো হয়নি আর কেউ।
অনেকের মত তরুণ মার্টিনও এই সোনা পাওয়ার খবর শুনেছিল। মা তখনি তাকে রওনা হতে বলেছিল অন্যদের সাথে। দলের সাথে গেলে অনেক সুবিধা। কিন্তু মার্টিন যায়নি। এই বিশ বছর বয়সেও বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে সে। লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরই হতে চায় না এ কারণে। শুধু প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তাদের ছোট শহরের পাবটায় একবার ঢুঁ মারে। তার বয়সী অন্যরা যখন আড্ডাবাজি, তাস খেলায় মেতে থাকে তখন সে পাবের এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার যে মার্টিনের কোনো বাজে অভ্যাস নেই। তাকে কোনো খারাপ কাজেও কেউ দেখেনি কখনো। ছোটবেলা থেকেই ছেলে হিসেবে সে অত্যন্ত ভালো। কারো সাথে খুব একটা মেশে না। বিরোধেও জড়ায় না কারো সাথে। দিনের বেলা ঘর-সংসারের নানা কাজে বিধবা মাকে সাহায্য করে। রাতে অনেকক্ষণ ধরে আলো জ্বালিয়ে বই পড়ে। এ রকম একটি ভালো ছেলের জন্য তার মা খুবই গর্ব অনুভব করেন।
হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয় মার্টিন- সোনার সন্ধানে ডস ক্যাবেজাসে যাবে সে। সেখানে যে সোনা মিলবে এ কথা সে নিজেও বিশ্বাস করে না। তবে সোনা মিলুক আর না মিলুক, একটা নতুন অভিজ্ঞতা তো হবে। বেশ কয়েকদিন চলার মত খাবার ও পানি নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে সে।
ডস ক্যাবেজাস পর্বতের নামই শুনেছে, কোনদিন ওদিকে যায়নি মার্টিন। শুনেছে, ঘোড়ায় চেপে তিনদিনের পথ মাত্র। কিন্তু তৃতীয় দিনে ড্রাগুন পর্বত পাড়ি দিয়ে আরো উত্তরে এগিয়ে বুঝতে পারল যে, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখন তার সামনে পেছনে শুধু সীমাহীন বালুর প্রান্তর। প্রচন্ড রোদ তাকে ঝলসে দিচ্ছিল। বুক ফেটে যাচ্ছিল পিপাসায়। সাথে যে পানি এনেছিল বেহিসেবি ভাবে খাওয়ার ফলে তা দু’দিনেই শেষ হয়ে গেছে। এখন এক ফোঁটা পানিও নেই যে মুখে দেবে। মার্টিন বুঝতে পারে খুব শিগগিরই সে যদি কোনো আশ্রয় ও পানি খুঁজে না পায় তাহলে মৃত্যুই হবে তার শেষ পরিণতি।
টলোমলো পায়ে বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে নিঃসঙ্গ মার্টিন। কিছুক্ষণ আগে একমাত্র সাথী ঘোড়াটাকে হারিয়েছে সে। পানিবিহীন অবস্থায় প্রচন্ড রোদের তাপ সহ্য করতে পারেনি এতদিন আরাম-আয়েশে থাকা অবলা প্রাণিটা। তার মৃত্যু মার্টিনের ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। না, এভাবে মরতে চায় না সে। কিন্তু কতক্ষণ! তার মনে হয়, সূর্যের নগ্ন নির্মম তপ্ত ঝাঁজ তার জামা-কাপড় ভেদ করে গায়ের চামড়ায় যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মায়ের ¯েœহভরা মুখ এ সময় তার মনে ভেসে ওঠে। সে যদি না ফেরে, শোকে দুঃখে মারা যাবে মা। আর সহ্য করতে পারে না মার্টিন। তার চোখের সামনে সব আঁধার হয়ে আসে। জ্ঞান হারায় সে।
ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক। একটানা শব্দে জেগে ওঠে মার্টিন। বালুর বিছানা থেকে অনেক কষ্টে মাথাটা উঁচু করে। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কোথাও কিছু চোখে পড়ে না। কিন্তু শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, একটি ট্রেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা চলন্ত ট্রেনেরই শব্দ। কিন্তু তা কি করে হয়! এই বিরান মরু প্রান্তরে ট্রেন আসবে কোথা থেকে? তা ছাড়া এ জায়গার কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো শহরও নেই।
ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক। এখন শব্দ আগের চেয়ে জোরালো শোনা যাচ্ছে। হিস হিস হিস হিস। কয়লার ইঞ্জিন থেকে বাষ্প নির্গত হওয়ার শব্দও শুনতে পায় সে। মার্টিন পরিষ্কার বুঝতে পারে- এ বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়।
দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে বিছিয়ে তার ওপর মাথা রেখে আসন্ন মৃত্যুর জন্য তৈরি হয় মার্টিন। গোটা শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। এ রকম অনুভূতির মধ্যে হঠাৎ তার মনে পড়ে- বেশ কয়েকদিন আগে এক বুড়োর সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে-ই তাকে জানিয়েছিল ডস ক্যাবেজাস পর্বতে সোনা পাওয়ার খবর। এ সময় সে একটি ভৌতিক ট্রেনের গল্পও করেছিল। তার আরো মনে পড়ে, বুড়ো লোকটি ঠিক এ জায়গার কথাই উল্লেখ করে বলেছিল- ট্রেনটি কোথা থেকে আসে কেউ জানে না। আর এ সমভূমির ওপর দিয়েই সেটা চলে যায় যদিও সেখানে কোন রেললাইন নেই। সে বলেছিল মরুভূমির বালুর ওপর দিয়ে ট্রেনটা ছুটে আসে এবং দুপুরের চোখ ঝলসানো আলোর মধ্যে একটি কালো পর্দার মত তা মিলিয়ে যায়। বুড়ো লোকটি নাকি স্বচক্ষে ট্রেনটিকে দেখেছে যাকে আসলে মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
মার্টিনের মনে হয় বুড়ো লোকটি নিঃসন্দেহে এক মহামিথ্যুক। প্রচন্ড তাপদাহের শিকার হয়েছিল লোকটা। আর এ অবস্থায় সে স্বচক্ষে দেখেছে বলে যে গল্প শুনিয়েছে তা তার বিভ্রম ছাড়া কিছু নয়। এ সময় ঝিক ঝিক শব্দটি আরো জোরালো হয়ে তার কানে প্রবেশ করে। ব্যাপারটা কী? মার্টিন আবার মাথা উঁচু করে। তখনি তার চোখে পড়ে একটি দীর্ঘ কালো ছায়া প্রচন্ড বেগে তার দিকে ছুটে আসছে। একবার কি দু’বার ট্রেনের হুইসেল বাজার শব্দও শুনতে পায় সে। কালো ছায়াটি ক্রমেই বড় হতে থাকে। সে দেখতে পায়, একটি কয়লার ইঞ্জিন দু’টি বগিকে টেনে আনছে। উজ্জ্বল রোদের মধ্যে নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে ইঞ্জিনের হেড লাইটের হলুদ আলো।
ট্রেনের হুইসেল খুব জোরে বেজে ওঠে। মার্টিনের দিকে ছুটে আসছে ট্রেনটি। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ট্রেনের পথ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু তার শরীর একচুলও নড়ে না। সমস্ত শক্তি যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে। নিরুপায় মার্টিন আসন্ন নির্মম মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকে। ঠিক তখনি হঠাৎ করেই ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে আসে। তার মাথা থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে তা থেমে যায়। হাসি খুশি চেহারার এক কন্ডাক্টর ট্রেন থেকে নেমে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। কোমর ঝুঁকিয়ে বালুর ওপর শুয়ে থাকা মার্টিনের হাত ধরে টেনে তোলে। অন্য একজন এসে ধরে তার দু’পা। সে লোকটিকে মার্টিন দেখতে পায় না। দু’জনে তাকে বয়ে নিয়ে এসে ট্রেনের একটি বগিতে তোলে। মার্টিন অনুভব করে- তাকে একটি লম্বা সিটের ওপর শুইয়ে দেয়া হলো। পাশে কয়েকজন লোককে দেখতে পায়। তাদের চেহারায় সহানুভূতির ছাপ। পানি, একটু পানি- অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করেই জ্ঞান হারায় সে।
মুখে ঠান্ডা পানির স্পর্শে জ্ঞান ফিরে পায় মার্টিন। চোখ খুলে শেরিফের ব্যাজ আঁটা দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তিকে দেখতে পায় সে। তিনি একটি পাত্র থেকে খুব সাবধানে অল্প অল্প করে পানি মার্টিনের মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন। তার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে পানির পাত্রটি পাশে সরিয়ে রাখেন তিনি। তারপর একটি কাপে পানি ঢেলে নিয়ে মার্টিনের ঠোঁটের কাছে তুলে ধরেন। সে যাতে একবারে বেশি পানি না খেয়ে ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন তিনি। প্রচন্ড তৃষ্ণায় মুখের ভেতরে জিভ ফুলে ওঠে। তাই, ফোঁটা ফোঁটা পানিতে প্রথমে শুকনো জিভ ভিজিয়ে দিতে হয়। একটু পরই এক ঢোক পানি গিলে ফেলে মার্টিন। এভাবে আরো কয়েক ঢোক পানি খেয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে সে।
: আচ্ছা, কী ঘটেছিল বলুন তো! শেরিফের কাছে জানতে চায় মার্টিন।
: আমার এক সহযোগী শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে মরুভূমির মধ্যে মরার মতো অবস্থায় দেখতে পায় তোমাকে। তারপর সে ব্যাপারটা আমাকে জানায়।
: কোন শহর? খুব সাবধানে জানতে চায় মার্টিন। তার মাথায় ভৌতিক ট্রেন দেখা, কন্ডাক্টর ও কয়েকটি সহানুভূতি মাখা মুখের মানুষ এসে ভিড় জমায়।
শেরিফ অবাক হয়ে মার্টিনের দিকে চেয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে বয়স্ক মানুষটির মুখের কঠিন রেখাগুলো একটু নরম হয়ে আসে। তিনি বলেন-
: বুঝতে পারছি প্রচন্ড সূর্যতাপ ও পিপাসায় তোমার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। আর সে কারণেই তুমি কোথায় যাচ্ছিলে তাও ভুলে গেছ। যাহোক, এটি হচ্ছে উইলকক্স শহর। তুমি এখন এখানেই আছ।
: এখানে কি ট্রেন থামে? দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে মার্টিন।
: ট্রেন! এ শহরের কয়েক মাইলের মধ্যেও তো কোনো ট্রেন চলাচল করে না। যাক গে, আমার মনে হয় তোমার সুস্থ হয়ে উঠতে আরো সময় লাগবে। নাও, আরেকটু পানি খাও। তারপর আরো কিছুটা সময় বিশ্রাম নাও। দেখবে, সব ঠিক হয়ে গেছে।
মার্টিন শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে গোটা বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে। ভৌতিক ট্রেনটি কি তাকে উদ্ধার করার জন্যই এসেছিল? ঠিক বুঝতে পারে না সে। তবে সে নিশ্চিত যে ঐ ট্রেনটি তার জন্যই সেখানে থেমেছিল।
এর বেশ কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন প্যাসিফিক রেলওয়ে অ্যারিজোনার উইলকক্স শহরের ওপর দিয়ে রেললাইন স্থাপন করে। তারপর থেকে ঐ লাইনে নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। কেউ কেউ বলে- মরুভূমির ওপর দিয়ে ভৌতিক ট্রেনটি ঠিক দুপুর বেলায় এখনো প্রতিদিন আগের মতই হুইসেল বাজিয়ে ছুটে যায়। তবে কথা হলো- সেখানে কোনো রেললাইন নেই।
* আরতি আগরওয়াল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখিকা। তিনি ইন্টারনেটে গল্প লেখেন।