Home উপন্যাস জোসনা রাতের গল্প -সোলায়মান আহসান

জোসনা রাতের গল্প -সোলায়মান আহসান

[শেষ পর্ব]

আষাঢ় মাস হলেও বৃষ্টির দেখা নেই। বিকেলে মেঘ করেছিল। আকাশ মুখ গোমড়া করে জানান দিয়েছিল বুঝি ‘ভ্যা’ করে কেঁদে দেবে। না ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছিল ঠিকই, বৃষ্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি। অন্যান্য দিনের মতো একে একে সন্ধ্যার একটু পর সবাই ছাদে এসে আশ্রয় নেয়।
ছাদে এসে দীনা ও রহমান সাহেব শখের বাগানটায় একটা চক্কর লাগান। গাছের যতœ-আত্তি লেদু চাচাই করেন। বলা হয় সন্তানকে বাবা-মা যেভাবে যতœ করেন, লেদু চাচা ছাদের টবের গাছগাছালির প্রতি তেমনই মহব্বত করেন। ছাদে বাগান পরিদর্শনে এসে দীনার চোখ জুড়িয়ে গেল। টগর, হাসনাহেনা, লিলি ফুলের সমাহার দেখে। আম্মু, দেখে যাও কী সুন্দর টগর ফুল ফুটেছে। প্রেমার উচ্ছ্বাস প্রকাশের সূত্র ধরেই দীনা এগিয়ে দেখে যান আরও ফুলের ফুটে ওঠার সৌন্দর্য। শুধু কি সৌন্দর্য, মাতাল করা প্রাণ।
তোমার ছাদে এলে বলে দেওয়া যায় কোন ঋতুতে আছি আমরা। রহমান সাহেব ও দীনা প্রেমা জিসানদের ভিড়ে যোগ দিলেন।
‘আচ্ছা প্রেমার আব্বু, এক কাজ করলে হয় না, বর্ষাকালের এমন সুন্দর ফুল কদমগাছ লাগালে হয় না।’
দীনা একটু হাসি হাসি মুখে তাকান রহমান সাহেবের দিকে।
‘খুব ভালো হয়। তাহলে তো কদম ফুলের অনেক গানও গাওয়া যাবে।’
রহমান সাহেব গলা ছেড়ে একটা গান গাইতে শুরু করলে প্রেমা জিসান হাসতে লাগে।
দীনাও ওদের হাসিতে যোগ দেন। শোন জিসানের আব্বু, রবীন্দ্রনাথ কদমগাছের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে কী বলেছেন জানো?
এসো নীপ বনে ছায়াবীথি তলে
এসো কারো ম্লান নব ধারা জলে
দীনার আবৃত্তির অভ্যাস স্কুলজীবন থেকে। এখনও সুযোগ পেলে স্কুলের ফাংশনে আবৃত্তি করে থাকেন।
তাই বেশ আবেগ ঢেলে আবৃত্তি করছিলেন। এতো কদমচর্চার পর এবার একটা কদমফুলের গাছ আমাকে ছাদে স্থান দিতেই হবে।
রহমান সাহেব হাসি মুখে বললেন। কিšুÍ কদমগাছ তো অনেক বড় গাছ আব্বু। আমাদের ছাদে কিভাবে স্থান দেবে? প্রেমা বলল। যেভাবে হাসনাহেনা, শেফালি, কামিনী, ফুল গাছগুলোকে টবে স্থান দিয়েছি।
মানে এসব গাছকে বামুন গ্রহের মত স্থান দেবে? জিসান বলল হাসতে হাসতে।
বামুন গ্রহ সম্পর্কে যেদিন বলেছিলাম আজ কাজে লাগালে না। ঠিক সে রকম না। যেকোনো গাছ কলম করে লাগালে গাছটি ফল বা ফুল যেভাবে দ্রুত দেয় তেমনি গাছটি সাইজে ছোট থাকে। টবে লাগানো যায়।
ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। আকাশের দিকে রহমান সাহেবের চোখ যায়। আর আকাশের দিকে চোখ যাওয়া মানে তাকে টানতে থাকে টেলিস্কোপঘর। তেমন মেঘ নেই আকাশে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ এগিয়ে চলেছে। হয়তো আষাঢ়ের সেই চিরচেনা নক্ষত্র দেখা যেতে পারে। রণে ভঙ্গ দেন রহমান সাহেব। নীরবে কেটে পড়েন।
রহমান সাহেব চলে এলেন তার শখের টেলিস্কোপঘরে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে দরজাটা আস্তে আস্তে টেনে দেন বাম পাশে। স্লাইডিং সিস্টেমের দরজা। পকেট থেকে রুমাল বের করে মোছামুছিতে সময় দেন কয়েক মিনিট। টেলিস্কোপের ওপর মোটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে। তা সরিয়ে দেন। এরপর টেলিস্কোপের মাথায় প্লাস্টিকের ক্যাপটি খুলে দেন। মাথাটা নিচু করে চেয়ারে বসেছেন। ধীরে ধীরে মাথাটা এগিয়ে টেলিস্কোপের গোড়ায় আইপয়েন্টে চোখ লাগান। বিস্ময়ের এক অপার জগতে ডুব দেন রহমান সাহেব। মনে মনে খুঁজতে থাকেন পূর্ব দিকের ছায়াপথ। পেয়ে যান। এরপর আরও পূর্বদিকে দৃষ্টি রাখেন ছায়াপথটির আরও নিচের দিকে। একটু একটু করে। অসংখ্য নক্ষত্রের মাঝে খোঁজেন এ মাসের নক্ষত্র ধনুকে। খোঁজেন আরও দু’টি নক্ষত্র- উত্তর আষাঢ়া ও পূর্ব আষাঢ়া। এমন সময় জিসান-প্রেমা হাজির। ওদের সঙ্গে কথা ছিল এ মাসের নক্ষত্র চেনায় আব্বু সাহায্য করবেন।
“আব্বু, এ মাসের নক্ষত্র পেয়েছো?” জিসান এসে আস্তে বলল।
“না এখনও পাইনি। ছায়াপথ পেয়েছি যখন, পেয়ে যাবো ওদের খুব শিগগিরই। রহমান সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে আকাশরাজ্যে দৃষ্টি রেখে বললেন।
তার মানে প্রেমা জিসানকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এসব ব্যাপারে ওরা ধৈর্যশীল। ওরা জানে একটা নক্ষত্র খুঁজে পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টাও চলে যায়। আবার কয়েকদিন পর্যন্ত। আকাশের মতিগতি সব দিন এক থাকে না। মেঘের লুকোচুরি তো আছেই। আছে তারাদের হারিয়ে থাকার খেলা। ওরা মানুষের দৃষ্টির অনেক দূরে থেকে লুকোচুরি খেলতে বুঝি ভালোবাসে!
“পেয়েছি-পেয়েছি, ইউরেকা-ইউরেকা” রহমান সাহেব শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে চিৎকার করে ওঠেন। এটা প্রায় সময় দেখা যায়। টেলিস্কোপে চোখ রেখে রেখে ঘর্মাক্ত হয়ে একটা নক্ষত্রকে শনাক্ত করতে পারলে খুশিতে চিৎকার করে ওঠেন তিনি।
‘আমরাও দেখবো আব্বু’ প্রেমার আবদার।
রহমান সাহেব চিহ্নিত করেন তারাদের। তারপর চেয়ার থেকে নেমে আসেন।
‘প্রথমে প্রেমাকে চান্স দাও জিসান, কারণ বেশি সময় উজ্জ্বল থাকবে না নক্ষত্রগুলো।’ রহমান সাহেব বলে প্রেমাকে চেয়ারে উঠতে সাহায্য করলেন।
প্রেমা চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে মাথা ঝুঁকিয়ে আনে টেলিস্কোপের আইপয়েন্টে। এসব ওদের জানা।
‘প্রেমা নীল ক্রস দেখতে পাচ্ছো?’
‘জি আব্বু দেখতে পাচ্ছি’ প্রেমা বলল।
‘ঠিক তার নিচের উজ্জ্বল তারাটি হচ্ছে ধনু, দেখতে পাচ্ছো?’
‘পাচ্ছি’ প্রেমা বলল।
এর কাছাকাছি আরও দুটো নক্ষত্র দেখতে পাচ্ছো?
পাচ্ছি। ও দু’টি উত্তর এবং পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্র। রহমান সাহেব বলেন।
এবার জিসানের পালা। প্রেমা চেয়ার থেকে নেমে পড়ল। যথারীতি নামতে রহমান সাহেব সাহায্য করলেন। জিসান নিজে নিজেই চেয়ারে উঠে বসে। মাথাটা ঝঁুঁকিয়ে টেলিস্কোপের আইপয়েন্টে চোখ রাখে। এক মায়াময় জগৎ। ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি তারার মেলা।
‘কী সুন্দর আব্বু’ জিসানের আনন্দ চিৎকার!
‘কিন্তু যে নক্ষটি ক্রস করা তা দেখতে পাচ্ছো তো?’ রহমান সাহেব জানতে চান।
‘দেখতে পাচ্ছি, তবে নিভু নিভু’ তার মানে ও এখন গা ঢাকা দিচ্ছে। আরও রাতে আসবে। কিছুই করার নেই। জিসান কয়েক মিনিট চোখ রাখে আইপয়েন্টে। অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করে। কতো কিছু চোখে পড়ে। এমন একটা নতুন জিনিস তার চোখে পড়ে।
‘আব্বু, ঝাঁটার মতো একটা কী যেনো দেখছি। ওটা কী?’ জিসান প্রশ্ন করে।
‘ঝাঁটার মতো- তাহলে ধূমকেতু হবে হয়তো’ রহমান সাহেব বলেন।
আকাশরাজ্যে শুধুতো তারা নয়, আরও যাদের বসবাস রয়েছে- গ্রহ, উল্কা, নীহারিকা এবং ধূমকেতুর।
‘ওর ব্যাপারটা অন্যরকম।’
‘কী রকম?’
‘নেমে এসো, পরে বলছি।’
জিসান চেয়ার থেকে নেমে এলো। রহমান সাহেব চেয়ারে উঠে বসলেন। ধীরে ধীরে চোখ রাখলেন টেলিস্কোপে। সত্যি তো, জিসান ঠিক বলেছে, এই কমেটটি কিভাবে ধরা দিলো? রহমান সাহেব গভীর দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন আর ভাবতে থাকেন এই ধূমকেতু কোথা থেকে এলো? ভাবতে ভাবতে বিন্দুর মত হয়ে হারিয়ে যেতে থাকে।
‘আব্বু, এখনো আছে?’ জিসান প্রশ্ন করে।
‘বিন্দুর মত হারিয়ে যাচ্ছে।’
‘আব্বু ধূমকেতু কী?’ প্রেমার প্রশ্ন।
ধূমকেতু নিয়ে মানুষের আদি ধারণা ছিল- দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস হচ্ছে ধূমকেতুর আবির্ভাব। প্রাচীনকালে ধূমকেতুর গঠন সম্পর্কে নানা রকম মতবাদ প্রচলিত ছিল। যেমন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ধারণা ছিল পৃথিবীর মাটি থেকে বাষ্পীয়ভবনের ফলে ধূমকেতুর উৎপত্তি। এমনকি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও পর্যন্ত মনে করতেন পৃথিবী থেকে বাষ্প আকাশে ওঠে। সূর্যের আলোর প্রতিসরণের ফলে ধূমকেতুর উৎপত্তি হয়। ধূমকেতু সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি ২০ বছর মানমন্দীর পর্যবেক্ষণ করেন। নাম- টাইকো ব্রাহে। তিনি বলেন, ধূমকেতু সৌরজগতের এক আদি বাসিন্দা। অন্য গ্রহ উপগ্রহের মতোই।
‘আব্বু ধূমকেতু আসলে কী? আর আমরা হ্যারির ধূমকেতু শুনেছি ওটা কী? জিসান বলল।
‘ধূমকেতু আসলে একটি বড় বরফ এবং ধুলার দলা, যার কারণে এটিকে মাঝে মধ্যে বলা হয় ‘ময়লার তুষার গোলক’। কোন কোন ধূমকেতুর ব্যাস খুব ছোট। যেখানে কোনটার ব্যাস হলো দশ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি। একটি ধূমকেতু যখন সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে। পেছনের ধোঁয়ার একটি লম্বা লেজ বেয়ে বরফটা গলে যায়। আর হ্যালির ধূমকেতু হচ্ছে- এডমন্ড হ্যালি নামে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আকাশে চোখ রেখে দীর্ঘদিন গবেষণা করে ১৬৮২ সালে একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। হ্যালির আগেও এই ধূমকেতুটি অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নজরে আসে কিন্তু হ্যালি দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও এর গতি নিরূপণ করে হিসাব নিকাশ করে বলেন ৭৬ বছর পর পর পৃথিবীর মানুষ এই ধূমকেতুটি দেখতে পাবে। সেভাবে আমরা বাংলাদেশের মানুষ ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসের ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এবং ১০ তারিখে দেখতে পাই। আমি নিজে হ্যালির ধূমকেতু দেখেছি। হ্যালি ঐ সম্পর্কে এমন নির্ভুল পর্যবেক্ষণ দেয়ায় ভদ্রলোকের নামের সঙ্গে ধূমকেতু নামটি জুড়ে গেছে।
‘চলো আব্বু, এবার যাওয়া যাক’ প্রেমা বলল।
‘চলো, আকাশেও বেশ মেঘ জমেছে। রাতে বৃষ্টি হতে পারে। ওদিকে তোমার আম্মু নিশ্চয়ই টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন, রহমান সাহেব বললেন। লেদু চাচা চিলেকোঠায় তক্তপোশে বসে নামাজ পড়ছেন।
‘দাদাজান আজ মসজিদে যেতে পারেননি। শরীর খারাপ’ প্রেমা বলল।
‘তাই নাকি? তাহলে লেদু চাচার শরীরের খোঁজ নিতে হয়’ রহমান সাহেব বললেন।
এমন সময় সালাম ফিরিয়ে লেদু চাচা দাঁড়ানো রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কিতা বাবাজি, কিছু কইতায়নি?’
‘চাচা, আপনার শরীর খারাপ?’
‘আল্লায় রাখছুইন। খারাপ নায়।’
রহমান সাহেব, জিসান ও প্রেমা নিচে এলেন।
(সমাপ্ত)

SHARE

Leave a Reply