গত সংখ্যার পর
মদিনাবাসী যখন উল্লাস করছিল, মদিনার বাইরে বনু কোরায়জার সরদারের ঘরে তখন চলছিল ভিন্ন এক তৎপরতা, অন্য এক আয়োজন। বনু কোরায়জার প্রভাবশালী নেতারা বসা ছিল কাব বিন আসাদের বৈঠকখানায়। কাব বিন আসাদ বলছিল, ‘নঈম যদিও কোরাইশ বংশের কিন্তু তার পরামর্শের কারণেই আমরা বেঁচে গেলাম এক অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে। কোরাইশদের সাথে সন্ধি ছিন্ন না করলে আজ মহাবিপদে পড়ে যেতাম। ভাগ্য ভালো যে, আমরা কোরাইশদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিইনি।’
‘কে বলল নঈম কোরাইশ?’ বললো এক ইহুদি, ‘নঈম এখন মুহাম্মদের শিষ্য হয়ে গেছে। কোরাইশরা চলে যাওয়ার পর তাকে মদিনায় দেখে এক মুসলমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নঈমের ঘটনাটা কী? সে বলল, ‘নঈম আগেই মুসলমান হয়েছিল, কিন্তু মহানবী এ কথা তাকে প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। সে কারণেই ঘটনাটা এত দিন জানাজানি হয়নি। এখন কোরাইশরা মক্কার পথ ধরায় তার পরিচয় গোপন করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, তাই সে মক্কায় না গিয়ে এখানেই রয়ে গেছে।’
‘তার মানে সে যুদ্ধের সময় মুসলমানদের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছিল?’ কাব বিন আসাদের কণ্ঠে বিস্ময়!
‘তবে আর বলছি কী? মুহাম্মদের চর কোরাইশ, গাতফান এমনকি আমাদের মাঝেও থাকা অসম্ভব নয়। আর সে জন্যই মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে যখন যেখানে যা-ই ঘটুক, সঙ্গে সঙ্গে সব খবর পেয়ে যায়।’
এক বৃদ্ধ ইহুদি বললো, ‘কাব, মুসলমানদের সংখ্যা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। এ সয়লাব এখনি ঠেকাতে না পারলে আরবের সব ধর্মমত তাদের মতবাদের কাছে ভেসে যাবে। প্রভু সহায় হোন, একটা কিছু করো।’
‘কী করবো, কী করতে পারি আমরা?’ আক্ষেপের সুরে বললো কাব বিন আসাদ।
‘মুহাম্মদকে হত্যা করতে হবে।’ সেই বুড়ো ইহুদি রায় ঘোষণার মত করে বললো, ‘এ ছাড়া পরিত্রাণের আর কোন পথ নেই। বিষবৃক্ষের শিকড় উপড়ে না ফেললে নতুন করে আবার চারা গজাবে।’
কাব আরো বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কী বললে তুমি! মুহাম্মদকে হত্যা করতে হবে! কিন্তু কে করবে এ কাজ? কার এত বড় বুকের পাটা যে, উদীয়মান সূর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়?’
‘সে জন্য তোমার ভাবতে হবে না। এ জন্য লোক তৈরি হয়েই আছে।’
এবার কাবের বিস্ময়ের মাত্রা আরো বাড়লো, ‘আমি তোমাদের গোত্রপ্রধান। অথচ এমন একটি বিস্ময়কর ঘটনার খবর আমার জানা নেই?’
‘তোমার যখন জানার সময় হবে তখন অবশ্যই জানবে, এই যেমন এখন জানতে পারছো। কাজ সেই করবে, তোমার শুধু ইশারা দরকার।’
‘কিন্তু তুমি বললেই আমি ইশারা করবো এমনটি কেন মনে হলো তোমার? কে সেই লোক, এ কাজে কতটা দক্ষ আর আন্তরিক, অভিযান সফল করার কতটুকু নিশ্চয়তা আছে, এসব না জেনেই এমন সিদ্ধান্তে সায় দেবো আমি? কক্ষণো না। বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা সরদার হওয়ার জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এই যে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবেলা না করতাম, তবে আমরা এতক্ষণে মুসলমানদের শত্রু বলে গণ্য হয়ে যেতাম। মুসলমানরা আমাদের সাথে সেই ব্যবহারই করতো, যেমনটি করেছিল বনু নজির গোত্রের সাথে। এতক্ষণে তারা আমাদের মেরে কেটে সাফ করে ফেলতো। আর না হয় আমাদের পালিয়ে যেতে হতো অজানা গন্তব্যে। এমন কিছুর অনুমতি আমি দেবো না, যাতে আমাদেরকে তাদের বিরাগভাজন হতে হয়। বন্ধুত্বের বিনিময়ে শত্রুতা কেউ বরদাশত করবে না। মুসলমানরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দিচ্ছে, রুটিরুজির নিরাপত্তা দিচ্ছে, ধর্মকর্মের নিশ্চয়তা দিচ্ছে, সব ধরনের স্বাধীনতা দিচ্ছে, এর বিনিময়ে বলতে গেলে আমাদের কিছুই দিতে হচ্ছে না। কথায় বলে না, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, তোমাদের হয়েছে সেই অবস্থা। খবরদার, এমন কিছু করবে না, যা মুসলমানদের ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে। অন্যান্য ইহুদি গোত্রের মত আমাদের যে পালিয়ে যেতে হয়নি তার অন্যতম কারণ বিশ্বস্ততা। নিশ্চিত না হয়ে এই বিশ্বস্ততার দেয়াল আমি ভাঙতে চাই না।’
বুড়ো ইহুদি বললো, ‘তোমাকে আমাদের সরদার করেছি কি মুসলমানদের গুণগান করার জন্য? কোরাইশদের সাথে সন্ধি ছিন্ন করে তুমি যে ভুল করেছো তার জন্যই মুসলমানরা ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেছে। এখন আবার তাদের পক্ষে সাফাই গাইছো?’
‘যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলতে যেয়ো না। আমাদের কয়েকজন সৈন্য কোরাইশদের সাথে শরিক হলেই কোরাইশরা জিতে যেতো এমনটা কেবল কোনো আহাম্মকই বলতে পারে। আরবের দশ হাজার সৈন্য যাদের কিছুই করতে পারেনি, আমার কয়েকজন সৈন্য শামিল হলে তারা জিতে যেতো এমনটা তুমি ভাবলে কী করে? শোন, আমি তাদের কপালের পরাজয় লেখা পড়তে পেরেছিলাম, তাই উপযুক্ত সময়ে তাদের সাথে চুক্তি ছিন্ন করে তোমাদের রক্ষা করতে পেরেছি। নইলে এতক্ষণে এখানে তোমাদের লাশ জমে যেতো। এসব বড় বড় কথা বলার মওকা পেতে না।’
বুড়ো কিছুটা কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললো, ‘সরদার, মুসলমানরা এত বড় বিপদ কাটিয়ে উঠছে দেখে আমার বুদ্ধি বিগড়ে গেছে। কিন্তু এটাতো ঠিক, মুসলমানদের এই অব্যাহত অগ্রযাত্রা থামাতে না পারলে আমাদের ধর্ম মহাসঙ্কটে পড়ে যাবে? আর এই আপদ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ মুহাম্মদকে হত্যা করা। সে জন্যই আমার এ পেরেশানি।’
বৈঠকখানায় বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ইহুদি ছাড়াও উপস্থিত ছিল এক ইহুদি যুবতী, নাম ইউহাওয়া। যেমন রূপসী, তেমনি বুদ্ধিমতী। পুরুষ মানুষ তার কাছে তৃষ্ণার্ত ভেড়ার পাল। সারা জীবন তাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানো যায়। মেয়েটির চোখের তারায় জড়িয়ে ছিল সম্মোহনী জাদু। মেয়েটি সেই জাদুমাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো বুড়োর দিকে। বুড়ো ইউহাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হাওয়া, সব কথা সরদারকে খুলে বলো।’
‘আমি এ কথা জাদুস¤্রাট লায়েস বিন মোশানের সামনে বলতে চাই। আমার কথার গুরুত্ব সে বুঝতে পারবে, আর আপনারাও তার কথায় গুরুত্ব দেবেন।’ ইউহাওয়া বললো।
‘কিন্তু সেই জবরদস্ত জাদুকরকে আমি কোথায় পাবো? তার মত গুণী ব্যক্তি তো আর পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায় না যে, যখন তখন যাকে তাকে ধরে আনলেই সে লায়েস বিন মোশান হয়ে যাবে।’ বললো কাব বিন আসাদ, ‘তুমি বলো। তোমার কথা আমার মনে ধরলেই চলবে।’
বুড়ো ইহুদি বললো, ‘এটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি সে ব্যবস্থা করেই এসেছি। লায়েস বিন মোশান এখন ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে। আপনার অনুমতি পেলেই সে আপনার সামনে হাজির হয়ে যাবে।’
এ কথা শুনে কাব বিন আসাদ বিস্ময় ও অস্বস্তির কারণে কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না। বুঝতে পারলো, এই বুড়ো সবদিক আঁটঘাট বেঁধেই এখানে এসেছে। নইলে এই আসরে ইউহাওয়ারও থাকার কথা নয়। ইউহাওয়ার উপস্থিতির কারণে এমনিতেই তার মনে খটকা লেগেছিল, এবার লায়েস বিন মোশানের বিষয় জানতে পেরে সেই খটকা আশঙ্কায় পরিণত হলো।
কাব বিন আসাদ বিস্মিত কণ্ঠে বললো, ‘কী বলছো তুমি! লায়েস বিন মোশান এখানে? ভেতরে না এনে তাকে তোমরা ঘরের বাইরে বসিয়ে রেখে এসেছো? জলদি যাও, তাকে সসম্মানে এখানে নিয়ে এসো।’
বুড়ো ইহুদি তার এক সঙ্গীকে ইশারা করলে সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। বুড়ো বললো, ‘তার সাথে আরো এক লোক আছে, তাকেও নিয়ে আসবে।’ তারপর কাব বিন আসাদের দিকে ফিরে বললো, ‘যে লোক মুহাম্মদকে হত্যা করবে তাকেও আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আপনি তাদের দেখুন, তাদের সাথে আলাপ করুন, তাদের পরিকল্পনা শুনুন। যদি মনে করেন পরিকল্পনায় কোন পরিবর্তন আনা দরকার তবে তাও তাদের খুলে বলুন। মোটকথা, মুহাম্মদকে হত্যার পরিকল্পনা আজই চূড়ান্ত করুন।’
বুড়োর কথা শেষ হওয়ার আগেই সঙ্গীকে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করলো লায়েস বিন মোশান। লোকটির বয়স আশির বেশি। থাকে মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী এক গ্রামে। মাথার চুল ও দাড়ি ফকফকে সাদা। চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ছে ব্যক্তিত্বের আভা। বয়সের তুলনায় শরীর যথেষ্ট মজবুত। চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। হাতে তার জাদুর লাঠি। লাঠিটিতে তেল দিয়ে এমন চকচকে করা হয়েছে যে, লাঠিতে চোখ দিলে নিজের চেহারা দেখা যায়। লাঠিটি কোমরের একটু উপরে উঠে সাপের মতই বেঁকে গেছে। একটি নয়, দু’টি নয়, সেই লাঠির মাথায় ফণা তোলা সাপের তিন তিনটি মাথা। সেই সাপের মাথার ফাঁক দিয়ে সে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার ডান হাতের পাঁচটি আঙুল। তিন সাপের ছোট্ট লেজের ওপর তার হাতের তালু।
লাঠিতে ভর দিয়ে কামরায় ঢুকলো সে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো কাব বিন আসাদ ও কামরার অন্যান্যরা। সহাস্যে কাব বললো, ‘সম্মানিত জাদুস¤্রাট লায়েস। আপনাকে এখানে ডেকে আনার অধিকার এখানকার কারো নেই। এটা শুধু দুঃসাহস নয়, বেয়াদবিও। এরা আপনাকে এখানে ডেকে এনে যে বেয়াদবি করেছে সে জন্য সত্যি আমি লজ্জিত। আসুন, বসুন।’
মিষ্টি করে হাসলো লায়েস বিন মোশান। বললো, ‘না না, এতে বেয়াদবিরও কিছু নেই, আপনার লজ্জিত হওয়ারও কিছু নেই। আপনি, আমি, আমরা সবাই একই ধর্মের অনুসারী। আপনি ইহুদি সম্প্রদায়ের অত্যন্ত সম্মানিত গোত্র বনু নজিরের গোত্রপ্রধান। প্রভুর সন্তানদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আপনার। আমিও ধর্মের এক নগণ্য খাদেম। ধর্মের জন্য আমি যা খুশি তা করতে পারি, যেখানে দরকার সেখানেই যেতে পারি। আমি এখানে এসেছি ধর্মের পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে।’
‘কিন্তু সম্মানিত জাদু স¤্রাট!’ বললো কাব বিন আসাদ, ‘এক বিপজ্জনক মিশন নিয়ে আপনি এখানে এসেছেন। মুহাম্মদকে হত্যা করা মুখের কথা নয়। এতে বিফল হলে কী পরিণতি হবে ভেবে দেখেছেন?’
‘আপনাকে আমি বীরপুরুষ বলেই জানতাম। কিন্তু এখন কথা বলছেন না-মরদের মতো। মুহাম্মদ খোদা নয় যে, তাকে হত্যা করা যাবে না। যদি কোরাইশরা মুসলমানদের পরাজিত ও তাকে হত্যা করতে পারতো তবে আমাদেরকে আর জটিল পথে পা বাড়াতে হতো না। কিন্তু তারা বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে কাপুরুষের মতো বসে রইলো, কোন আক্রমণই করলো না। আফসোস! তারা মাথা নিচু করে আবার মক্কায় ফিরে গেছে। এখন যা কিছু করার আমাদেরই করতে হবে।’
লায়েস বিন মোশান সম্পর্কে আরব ভূখন্ডে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল। জাদুবিদ্যায় সে ছিলো অসম্ভব পারদর্শী। সে জীবিত মানুষকে সবার সামনে দুই টুকরা করে আবার তাদের জোড়া লাগিয়ে দিতে পারতো। মৃত মানুষকে কিছু সময়ের জন্য হলেও জীবিত করতে পারতো। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য হলে মন্ত্রবলে তাদের বিবাদ মিটিয়ে দিতে পারতো। হাতের লাঠিকে সাপ বানিয়ে ফেলতে পারতো। এরকম আরো নানা চমকপ্রদ কাহিনীর নায়ক সে।
‘সম্মানিত জাদুস¤্রাট! জানি, আপনি জাদুবলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারেন। কিন্তু মুহাম্মদের নিজেরও কিছু জাদু আছে। যদি আপনার জাদু তার কাছে হেরে যায়? যদি তিনি বেঁচে যান? যদি জানতে পারেন তাকে আমরা হত্যার চেষ্টা করেছিলাম? তার পরিণাম কত ভয়াবহ হবে আপনি কি তা আন্দাজ করতে পারছেন?’ বলল কাব বিন আসাদ।
‘সরদার কাব! আপনি অযথাই এত ভয় পাচ্ছেন। আমার জাদু কখনো ব্যর্থ হয় না। আর এবারের জাদুর জন্য আমি বেছে নিয়েছি আসেম ও ইউহাওয়াকে। ইউহাওয়া নিজেই একটি মারাত্মক মারণাস্ত্র। আপনি যদি একশো ঘোড়া আর একশো উট একপাশে রাখেন আর অন্যপাশে রাখেন ইউহাওয়াকে, শতকরা একজন লোকও পাবেন না, যে ইউহাওয়াকে রেখে উট ও ঘোড়ার দিকে হাত বাড়াবে। তা ছাড়া আমি তাকে জাদুবিদ্যার ট্রেনিং দিয়েছি। হাজার হাজার লোকের মাঝখান থেকে সে বেমালুম গায়েব হয়ে যাবে, কেউ তাকে খুঁজেও পাবে না।’
‘কিন্তু মুহাম্মদকে কিভাবে তোমরা হত্যা করতে চাও?’ বুড়ো ইহুদির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কাব।
‘সেটা আপনাকে বলবেন জাদুস¤্রাট লায়েস। তবে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আছে, অভয় দিলে বলতে পারি।’
‘বলো।’ অভয় দিয়ে বললেন কাব।
‘ইউহাওয়া কোন মশহুর মুসলিম যোদ্ধাকে বিয়ে করবে। কিছুদিন খাঁটি মুসলমানের মতো জীবনযাপন করবে। একদিন মুহাম্মদকে দাওয়াত দেবে তাদের বাসায়। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে সেই খানা খাওয়াবে মুহাম্মদকে। তারপর পালিয়ে আসবে সেখান থেকে।’
এবার ইউহাওয়ার দিকে তাকালেন বনু নজির গোত্রের প্রধান কাব বিন আসাদ। বললেন, ‘তুমি কী বলো?’
ইউহাওয়া তার পটোলচেরা চোখ তুলে তাকালো সরদারের দিকে। বললো, ‘পরিকল্পনা আপনারা নেবেন। আমাকে যে দায়িত্ব দেবেন নিষ্ঠার সাথে পালন করবো। তবে পুরুষ ঘায়েল করার বিদ্যা আমার ভালোই জানা আছে। আমার বিদ্যা কতটা কার্যকর তা পরখ করার জন্য একবার আমি আবু সুফিয়ানকে টার্গেট করেছিলাম। প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী হয়ে যায় আবু সুফিয়ান। আমার সামান্য চোখের বাণও সে সহ্য করতে পারেনি। আরেকবার খালিদ বিন ওয়ালিদকে টার্গেট করেছিলাম। খালিদ একটা ভিতুর ডিম। আমার বাণে আহত হওয়ার ভয়ে সে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি বলতে চাচ্ছি, কাউকে টার্গেট করলে বিফল হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই আমার।’
‘কিন্তু এ তো অনৈতিক কাজ। পাপের পথ। জেনেশুনে জাতির এক কন্যাকে কি করে আমি এই পথে ঠেলে দেই?’ বললেন কাব।
এবার মুখ খুললো লায়েস বিন মোশান। বললো, ‘আমি কেবল জাদুকর নই, একজন ধর্মগুরুও বটে। আমি আপনাকে বলছি, পাপ আর পুণ্য নির্ধারিত হয় কাজের উদ্দেশ্য দেখে। একটা খারাপ কাজও পুণ্যের হতে পারে যদি তার উদ্দেশ্য হয় মহৎ। আবার একটা ভালো কাজও পাপের হতে পারে যদি তার উদ্দেশ্য থাকে খারাপ। ইউহাওয়া যা করছে তা জাতির এক মহান স্বার্থের জন্যই করছে। অতএব, এখানে পাপের কোনো প্রশ্নই আসে না, বরং এ এক মহা পুণ্যের কাজ। এমন পুণ্যময় কাজ থেকে আপনি তাকে বিরত রাখতে পারেন না।’
কাব নিজে জানে তার চরিত্রে অনেক দোষ আছে। কিন্তু এমন প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কথা তিনি ভাবতে পারেন না। তিনি নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘গুরুজি, আপনি আসলে কাজটি কিভাবে করার কথা ভাবছেন জানি না। আপনি কি আমাকে বলবেন আপনার পরিকল্পনাটা কী?’
‘অবশ্যই বলবো। তবে তার আগে আপনাকে একটি গল্প শোনাতে চাই। এই যে ইউহাওয়াকে দেখছেন তার জীবনের ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। আমার মনে হয় গল্পটা আমি না বলে ইউহাওয়া বললেই বেশি ভালো হবে। কী বলো ইউহাওয়া?’
ইউহাওয়া মুচকি হাসলো। বললো, ‘আপনার যেমন মর্জি।’
‘তাহলে শুরু করো।’ (চলবে)
ইউহাওয়া গল্প বলতে শুরু করলো। এই গল্প কয়েক মাস আগে মক্কা থেকে শুরু হয়েছিল। ইউহাওয়া তার রূপ ও যৌবন দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিল আবু সুফিয়ান, খালিদ ও আকরামাকে। ইচ্ছে ছিল তাদের একজনকে দিয়ে আরেকজনকে ঘায়েল করা। কিন্তু যখন সে শুনলো এই তিনজনই মুসলমানের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন সে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিল।
ইউহাওয়া গল্প বলছে। বললো, ‘একদিন মক্কা থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরের এক গ্রামে গিয়েছিলাম বিশেষ একটি কাজে। দিন শেষে সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার সাথে আরও দু’টি মেয়ে ছিল। আমাদের তিনজনের সাথে ছিল তিন পুরুষ। আমরা সবাই ছিলাম ইহুদি। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পথ চলছিলাম আমরা। আমরা যখন অর্ধেক পথ পেরিয়েছি তখন হঠাৎ করেই আমরা মরু ঝড়ের কবলে পড়লাম। সেই ঝড়ের বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। চারদিক নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল। তীরবেগে বালুর কণা এসে বিঁধছিল গায়ে। মনে হচ্ছিল শরীরে সুই ফোটাচ্ছে কেউ। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বালুর পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে সমতল হয়ে যাচ্ছিল। সমতল জায়গায় মুহূর্তেই সৃষ্টি হচ্ছিল পাহাড়ের অবয়ব। এমন ভয়ঙ্কর মরু সাইমুম আমি আর জীবনে কোনদিন দেখিনি। আগেই সঙ্গীদের হারিয়ে ছিলাম। সামনে পেছনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। প্রাণ বাঁচানোর আশায় চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পিঠের সাথে লেপ্টে ছিলাম। ঘোড়ার ওপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঘোড়া ছুটছিল পাগলের মতো। তার দুরন্ত ছুটেচলা আর উল্টাপাল্টা ডিগবাজির ফলে এক সময় ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়লাম আমি। ঘোড়ার ওপর বালু জমে দেখতে দেখতে একটি টিলা তৈরি হয়ে গেল সেখানে। বালু চাপা পড়ে মারা গেল ঘোড়া। আমার বেঁচে যাওয়াটা এক অলৌকিক ব্যাপার। ঝড় আমাকে উড়িয়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না। কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। একসময় টের পেলাম ঝড় আমাকে কোন দেয়ালের গায়ে আছড়ে ফেলেছে। অবাক হলাম আমি। এই মরুভূমিতে এমন নিরেট দেয়াল এলো কোত্থেকে? আমি দেয়াল হাতড়ে একটু একটু করে এগোচ্ছিলাম। আমার চোখ মুখ পুরোটাই কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এ ছাড়া বালুর ঝাপটা থেকে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। কখনো এক পা, দুই পা এগোতাম, ঝড়ের ঝাপটা এলে দেয়াল আঁকড়ে স্থির হয়ে থাকতাম। ঝড়ের তান্ডবে কান স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মাঝেই আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কোন উটের ডাক। পাহাড়ের গায়ে ঝড়ের দাপট আছড়ে পড়ার কারণে বিচিত্র রকমের শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোন অসুর দানব হুঙ্কার দিচ্ছে। কখনো মনে হতো একদল ভূত তারস্বরে চিৎকার করছে।’
ইউহাওয়া বলছে, ‘আমি নিজেকে খুব সাহসী মনে করতাম। কিন্তু ঝড় আমার সব সাহস যেন কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। এক সময় ঝড় থামলো, কিন্তু আমি আমার হারিয়ে যাওয়া সাহস আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। ভয় এসে যেন আমাকে জাপটে ধরেছে। রাত হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে নেমে এসেছে কৃষ্ণকালো আঁধার। ভয়ের ¯্রােত যেন বয়ে চলেছে আমার ওপর দিয়ে।’ ইউহাওয়া বলে চলেছে, ‘প্রথমে মনে জাগলো মরু শিয়ালের ভয়। এরা অসম্ভব রকমের হিং¯্র প্রাণী। একবার ওদের পাল্লায় পড়লে আর বাঁচার আশা নেই। দ্বিতীয় ভয় ছিল নিঃসঙ্গতা। সঙ্গীরা কে কোথায় জানা নেই আমার। বেঁচে আছে না সবাই মারা গেছে তাও সে জানি না। আশপাশে কোন জনমানবের চিহ্নও কোথাও নেই। তখনি আমার মনে পড়লো, মানুষ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। এখন কোন মরুবেদুইন আমাকে পেলে সে কিছুতেই আমাকে আমার ঘরে ফিরতে দেবে না। সে আমাকে নিয়ে যাবে তার ডেরায়। সেখানে সে আমাকে ভোগ করবে যতক্ষণ তার মন চায়। লোকটি ভালো হলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভোগের স্বার্থে, নইলে মেরে ফেলবে। সবচেয়ে বড় ভয়, ঝড় মরুভূমির রাস্তাঘাটের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে। কোন দিকে মক্কা বোঝারও উপায় নেই। এখন পথ চলা মানে অনিশ্চিত বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া। যদি দিক ভুল করে হাঁটতে থাকি তবে দেখা যাবে, মক্কা না গিয়ে মরুভূমির আরো গভীরে চলে গেছি। এমন চক্করে পড়ে গেছি যে, লোকালয়ে আর কোনদিন যাওয়া হবে না।’
ইউহাওয়া বলল, ‘দেয়াল ধরে একটু একটু করে এগোচ্ছি আমি। অন্ধকারের জন্য দেখতে পাচ্ছি না কিছু। মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল ধরে এভাবে পথ চলছি আমি। একসময় আমার মনে হলো, দেয়াল বেঁকে গেছে। বাঁক ঘুরে আরো একটু এগিয়ে গেলাম। এ সময় আমার কানে এলো উটের ডাক। আমি এটাকে ভাবলাম স্মৃতির বিভ্রম। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি দাঁড়িয়ে কান খাড়া করলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, আবারও ডেকে উঠলো উট। আমি বুঝলাম, এটা কোন বিভ্রম নয়, সত্যি সত্যি এটা উটের ডাক। আমি আবারও চলতে শুরু করলাম।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ খুব কাছেই আবারও উটের ডাক শুনলাম। ভয়ে জমে গেলাম আমি।’
ইহুদি কন্যা ইউহাওয়া এক ভয়ঙ্কর ও অবিশ্বাস্য গল্প বলে চলেছে। সে বলল, তার রাগ হলো নিজের সঙ্গীর ওপর। লোকটা মরার আর সময় পেলো না। উট নিশ্চয়ই একা নেই। এক বা একাধিক আরোহী আছে তার সঙ্গে। এখন যদি তারা তার সন্ধান পায় তবে কী ঘটতে পারে তা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলো ইউহাওয়া। সে লোকগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওখান থেকে পালাতে চাইল। কিন্তু তার পা যেন আটকে আছে মাটির সাথে। পালাতে চাইলেও পালাতে পারছে না সে। আর যাবেই বা কোন দিকে? উট কোনদিকে, কোনদিকে তার আরোহী অন্ধকারের কারণে কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। পালাতে গিয়েও আবার ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো ইউহাওয়া। আবার সব সুনসান। উটের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার সে দেয়াল হাতড়ে চলতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তার মনে হলো সামনে একটি উট দাঁড়িয়ে আছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ইউহাওয়া। উটটি দেয়ালের সাথেই বাঁধা। এরপর আর দেয়াল নেই। সামনে একটি গুহামুখ। একবার ভাবলো ভেতরে ঢোকে, কিন্তু গুহার ভেতর জমাট অন্ধকার দেখে সেখানে ঢোকার সাহস করলো না। গুহামুখের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছিল এখন কী করবে। এ সময় গুহার ভেতর থেকে কেউ তাকে ডাক দিল, ‘কে ওখানে, ভেতরে এসো।’
এ ডাক আবারও তার শরীরে ভয়ের শিহরণ বইয়ে দিল। লোকটি আবার ডাকলো, ‘কই, ভেতরে এসো।’ ইউহাওয়ার কী মনে হলো, সে ধীরপায়ে গুহার মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকটি ভেতর থেকে বললো, ‘আরে, এ যে দেখছি মেয়ে মানুষ।’
ইউহাওয়ার মনে হলো, সে এখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু তার পা জমে যাওয়ায় পালানোর চেষ্টা ত্যাগ করতে হলো তাকে। লোকটি ভেতর থেকে বাইরে এসে হাত ধরলো ইউহাওয়ার।
‘তুমি একা?’
‘না, আমার সাথে আরো চারজন আছে। তাদের সাথে ঘোড়া আছে, তলোয়ার আছে।’
‘কোথায় তারা? কাউকে দেখছি না যে!’
‘ঝড়ের কারণে তাদের আমি হারিয়ে ফেলেছি।’ সত্যি কথাই বললো ইউহাওয়া।
ইউহাওয়া বলে চলেছে, ‘লোকটি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘চলো।’ এটুকু বলেই সে গুহার ভেতর ঢুকে গেল। আমি তার পেছনে চলতে লাগলাম। অল্প একটু গিয়েই গুহাটি বাম দিকে মোড় নিয়েছে। সেখানে জ্বলছে আলোর শিখা। জায়গাটা বড়সড় কামরার মতো। লোকটির পিছে পিছে আমিও সে কামরায় ঢুকে গেলাম।
এখানে ঝড়ের কোন আলামত নেই। সব কেমন পরিপাটি, গোছানো। কামরায় ঢুকে লোকটি ফিরলো আমার দিকে। বললো, ‘বসো। আমার নাম জারিদ। তোমাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি?’
কামরার চারদিকে তাকালাম আমি। এমন ভয়ঙ্কর জায়গা জীবনে দেখিনি আমি। কামরায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কটি নরকঙ্কাল। কঙ্কালের দাঁতগুলো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেন তারা বলতে চাইছে, দেখো হে রূপের গরবিনী, আয়ুর বয়স গেলে এই হয় জীবনের পরিণতি। কামরায় ঢুকে ভয় ও আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠলাম। লোকটি এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলো। বললো, ‘ভয় পাচ্ছো? ভয়ের কিছু নেই। এটাই মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি। জীবনের লেনদেন শেষ করে এই বেশই পরতে হয় সবাইকে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের এই পরিণতি হয়েছে, এখন যারা জীবিত আছে এবং যারা আগামীতে দুনিয়ায় আসবে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে তাদেরও। মানুষের সব দম্ভ অহমিকা এভাবেই একদিন কঙ্কাল হয়ে যায়। কঙ্কাল হয়ে যায় ক্ষমতার দাপট, যৌবনের উন্মাদনা।’
আমি ছুটে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। লোকটি আমাকে ধরে ফেললো আর বললো, ‘কোথায় পালাবে নারী, এই অন্ধকারে পালিয়ে তুমি যাবে কোথায়?’
আমি থেমে গেলাম। জারিদকে খুলে বললাম সব কথা। বললাম, ‘আমি মক্কা যেতে চাই। এই কামরায় থাকলে আমি মরে যাবো। তুমি আমাকে মক্কা পৌঁছে দাও, বিনিময়ে যা চাও তাই পাবে।’
জারিদ খানিক ভেবে নিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে মক্কা পৌঁছে দেবো।’
খানিক পর। উটের পিঠে চড়ে বসলো জারিদ। আমাকে তার পেছনে বসালো। আমি জারিদের কোমর জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভয় একটু একটু করে কমতে লাগলো। সেখানে এসে আসন নিলো সাহস।
অনেক দূর চলে এসেছি আমরা। তারার আলোয় মরুভূমির অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছিল। জারিদ এখন আমার রক্ষক। আমার দিক থেকে তার ভয়ের কিছু ছিল না। সে হয়তো ভাবছিল, আমি এক অবলা নারী। শুধু অবলা নয়, এক পথহারা অসহায় মুসাফির। জারিদ যখন এসব ভাবছিল আমার মনে তখন খেলা করছিল এক অশুভ চিন্তা। আমি ভাবছিলাম, জারিদের এই ভালমানুষির পেছনে লুকিয়ে আছে তার লালসা। আমি তার লালসা চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্য তাকে খুন করার শপথ নিলাম।
এক সময় দূরদিগন্তে ভেসে উঠলো আলোর রেখা। বুঝলাম, আমরা মক্কার সন্নিকটে চলে এসেছি। আমি কোমর থেকে খঞ্জর বের করলাম। জারিদ পথ চলছিল আর গুনগুন করে গান গাইছিল। সে ভাবতেও পারেনি পৃথিবীর রূপরস উপভোগের যখন সুবর্ণ সময় তখন তাকে ছেড়ে যেতে পৃথিবীর সব বন্ধন। মক্কার কাছে চলে এসেছিল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে আমার হাতের খঞ্জর জারিদের পিঠে বসিয়ে দিলাম। এরপর সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে তাকে উট থেকে ফেলে দিলাম।’
ইউহাওয়া বললো, ‘এই স্বপ্নবৃত্তান্ত যখন আমি জাদুস¤্রাট লায়েস বিন মোশানকে বললাম, তিনি বললেন, ‘তুমি এক যুগান্তকারী স্বপ্ন দেখেছো ইউহাওয়া। তুমি জাতির খুব বড় খেদমত করবে। স্বপ্নে তুমি যে ঝড়ের কথা বলেছো, সেটা হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের এই ঝড় আরব ভূখন্ডকে তছনছ করে ফেলবে। তুমি বাধ্য হবে তাদের আশ্রয়ে যেতে। তারপর তুমি ইসলামের প্রবর্তককে হত্যা করবে, এই হচ্ছে এ স্বপ্নের তাবির।’
এবার কথা বললেন লায়েস বিন মোশান, ‘ইউহাওয়ার স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে আমি চমৎকৃত না হয়ে পারলাম না। ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধে মুহাম্মদের নেতৃত্বে যে প্রবল শক্তি মাথা তুলছিল, সেটা নিয়ে আমরা গভীর দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ইউহাওয়ার কথা শুনে বুঝলাম, মহান প্রভু এবার আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। যে সমস্যা আমাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল তার সমাধানের জন্য খোদা বেছে নিয়েছেন এক নারীকে। ইউহাওয়া সেই নারী।
আমি তার বাপের সাথে দেখা করলাম। তার পিতা একজন কট্টর ইহুদি। তাকে বললাম, ‘ধর্মের সেবার জন্য আপনার কন্যাকে আমাদের দরকার।’ তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিলেন।