Home নিয়মিত রহস্যভেদ পুড়োবাড়ির রহস্যবুড়ো -জিয়াউল আহ্সান

পুড়োবাড়ির রহস্যবুড়ো -জিয়াউল আহ্সান

গত সংখ্যার পর

ইতোমধ্যে রাস্তার দু’পাশেই ছোট-বড়ো দালানের ভগ্নাবশেষ। দালানগুলো যেনো পেছনে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেছে।
ডানদিকে মোড় নিতেই বরাবর সামনে অদূরে বিশাল-উঁচু একটা বাড়ি চোখে পড়ে। রাস্তাটা ক্রমে উঁচু হয়ে গেছে এবং এতোটাই সোজা, যেনো সরাসরি বাড়িতে গিয়ে ওঠার জন্যই তৈরি হয়েছিল। ক্রমশ উঁচু হয়ে ওঠা রাস্তায় ভ্যান চালাতে চালকের বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। ভ্যান যতো কাছে যাচ্ছিলো গাছপালার ফাঁক- ফোকর দিয়ে এর ছড়িয়ে থাকা বিশালত্ব ততোই স্পষ্ট হচ্ছিলো। বাড়ির সামনে দিয়ে বেঁকে সরুপথটা বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে।
ভ্যান সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামলো। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাঙা-আধভাঙা পোড়াইটের স্তূপ। মানুষজনের সাড়া নেই। অদ্ভুত এক নীরবতা ঢেকে আছে সর্বত্র। বাড়িটা এতো ভেতরে যে, রাস্তা থেকে কোনো শব্দ এ পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। সম্ভবত এই নীরবতার কারণেই ভ্যানচালক অকারণেই বেল বাজালো। টিং টিং শব্দ এই নিস্তব্ধতায় বেমানান কানে এসে বাজে। কোথাও ইট গড়িয়ে পড়ার হালকা শব্দ পাওয়া গেলো। একটা কাঠবেড়াল ইটের পাঁজা থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় উঠে এসে হঠাৎ থমকে তাকালো, তারপর লেজ উঁচিয়ে বাকি পথটুকু প্রায় চোখের নিমিষে পেরিয়ে গেলো। বেড়ালটার মাথা থেকে লেজ অবধি কয়েক সারি লম্বা ছাই রঙের মোটা দাগ। চিড়িয়াখানায় কাঠবেড়াল দেখেছে। কিন্তু এই মুক্ত পরিবেশে দেখার আনন্দ অন্যরকম। সে অবাক-বিস্ময়ে সবকিছু দেখে যাচ্ছে। জমিদারবাড়ির বিশালত্ব সম্পর্কে তার ধারণা ছিলো না। বাড়ির সামনে বড়ো একটা মন্দির। জমিদারবাড়ির প্রথম ও প্রধান মন্দির। বলেশ্বরের কূলে পরে আরো বড়ো একটা মন্দির তৈরি করা হয়।
ভ্যানচালক ভাঙা রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে বাঁকের আড়ালে হারিয়ে গেলো। দু’একবার বেলের ক্ষীণ শব্দ পাওয়ার পর নেমে এলো আগের নিস্তব্ধতা। কালাম ওর পিঠে আলতো ঠেলা দিয়ে বললো, হাঁটো।
মন্দিরটা এখন পরিত্যক্ত। সামনের প্রশস্ত ও খোলা আঙিনায় ওরা উঠে আসে। আঙিনা পাকা এবং প্রায় চার-পাঁচ ফুট উঁচু। একপ্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মন্দির। চূড়া ভেঙে গেছে। মন্দিরের কক্ষ একটা। দেয়ালের এখানে ওখানে ভাঙা। ইটগুলো ক্ষয়ে গিয়ে ধসে পড়ার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। মেঝেতে ধুলা-ময়লা, বিভিন্ন প্রাণীর বিষ্ঠা ও আবর্জনার পুরু স্তর। জানালা না থাকায় প্রকট গন্ধে ভেতরে দাঁড়ানো কষ্ট। ওরা বেরিয়ে আসে।
এইট্যাই রাজমন্দির। মন্দিরের পিছোনে অ্যাকসোমায় মোটা অ্যাট্টা শিমুল গাছ ছিলো। জমিদারের কতা না শুনলি শিমুল গাছে ঝুলয় রাখতো। তারপর পিটাতি পিটাতি মার‌্যা ফ্যালাতো। শেখোদ্দিরে ধর‌্যা নিয়্যা আস্যা শিমুল গাছের গোড়ায় কল্লা নামায় দেছোলো। বাম হাতে চুল ধইর‌্যা ভুট্ কর‌্যা ডানহাতে এক্কোপে ধড় ফ্যালায় দেতো। পরে কাটা মাতা মন্দিরের ছাদে ফিক্যা দেতো। গাছ কাটতি বাজান অনেকবার জমিদারের হালোটে গেইছে। বাজানও মন্দিরের ছাদে মানুষির খুলি দ্যাখ্ছে।
জমিদারবাড়ি তিনতলা। প্রথমতলা কর্মচারীদের। চওড়া সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। মাঝামাঝি উঠে খানিকটা জায়গা সমতল। সিঁড়ির দু’পাশে রেলিংয়ের ধ্বংসাবশেষ। এই বিশাল স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে সমস্ত মন ছেয়ে আছে। সুমন কালামকে অনুসরণ করে।
সিঁড়ি ভেঙে একটা প্রশস্ত আঙিনায় উঠে এলো ওরা। আঙিনাটা গোলাকার। মাথার ওপরে গম্বুজের ছাদ। আঙিনা পেরিয়ে প্রশস্ত বারান্দা। সারি সারি কক্ষ। কক্ষগুলো বিভিন্ন আকারের। বিভিন্ন আকারের বড় কক্ষের পাশাপাশি ছোট কক্ষ। কক্ষগুলোর ভেতর যাওয়া-আসার ব্যবস্থা আছে। কক্ষের ওপাশেও বারান্দা। একটা কক্ষ থেকে নিচে সিঁড়ি নেমে গেছে। গোলক ধাঁধার মতো। কালাম নিজের মতো বলে যাচ্ছে, কোন ঘরে কী হতো, এগুলোতে কারা থাকতো? আরো কতো কী বিষয়! ও যেন সবজান্তা।
দু’পাশে বিভিন্ন কক্ষ রেখে ভেতরের দিকে একটা লম্বা বারান্দা ঢুকে গেছে। বেশ কিছুটা পথ অন্ধকার। দেয়ালগুলোর চুনসুড়কির মসৃণতা উঠে গেছে। কেমন একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। কিছুটা এগিয়ে একপাশে কক্ষের সারি, অন্য দিকটা খোলা। ভেতরের দিকে এরকম উন্মুক্ত থাকতে পারে, বাইরে থেকে অনুমান করা যায় না। বাড়ির মাঝে এই উন্মুক্ত স্থানটা বর্গাকৃতির। এরকম বর্গাকৃতির উন্মুক্ত স্থান নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপরই। কয়েকটি কক্ষের পরপর এই বর্গাকৃতি স্থানটুকু লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। সম্ভবত লোহার বলেই কালের থাবায় এখনো টিকে আছে। লোহার পাতের ওপরে কাঠের প্যানেলের অস্তিত্ব নেই। রোদ-বৃষ্টির থাবা আর অযতœ নিশ্চিহ্ন করে ফেললেও প্যানেলের জোড়ালাগানোর স্থানগুলো কালের সাক্ষী হিসাবে রয়ে গেছে। মাঝের এই ফাঁকা জায়গার মাটিতে একসময় হয়তো সাজানো-গোছানো বাগান ছিলো। কিন্তু এখন এর অস্তিত্ব নেই। মাঝে গোলাকার পানিশূন্য ফোয়ারা। ঘন ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে। ভবনের মেঝে প্রায় একতলা সমান উঁচু। দুটো মোটাগাছ পরস্পরের সাথে পাল্লা দিয়ে তিনতলার মাথা ছাড়িয়ে দালানের ছাদে শাখা বিস্তার করে আলো আসার পথ প্রায় ঢেকে দিয়েছে। অশত্থপাকুড়ের বয়স এক শ’ বছরেরও বেশি হবে। গাছটা কতো মোটা আন্দাজ করা কষ্ট। তবে কয়েকটা ঝুরি নারিকেল গাছের চেয়েও মোটা।
ফোয়ারার দেয়াল বেশ উঁচু। দেয়ালের উপরের অংশ ঢেউয়ের মতো। দেয়ালের কয়েকস্থানে অশত্থপাকুড়ের শেকড় ঢুকে ক্রমে মোটা হয়ে ভালোরকম ভাঙন ধরিয়েছে। ভেতর দিকে দেয়ালের গায়ে চক্রাকারে নারী-মূর্তি বসানো। পানির ধারা বেরিয়ে আসতো পাথরের তৈরি ছোট ছোট এই নারী-মূর্তিগুলোর মুখ থেকে। সেগুলোর কোনো কোনোটির মুখের আদল ভেঙে যাওয়ায় ধাতব নল বেরিয়ে এসেছে। সবগুলো মূর্তিই বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দু’একটার অস্তিত্বই নেই, গোড়া থেকেই ভেঙে গেছে। ফোয়ারার মাঝেতে পাথর কেটে বানানো একটা পদ্মফুল দাঁড়িয়ে আছে। পাপড়িগুলোর কয়েকটি ভাঙা। এর শীর্ষে কিছু একটা হয়তো ছিলো, কিন্তু এখন ভাঙা একটি প্রস্তরদন্ড ঠায় ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ানো।
এইটা যে দেখতিছো ফেরান্সের কারিগর বানায় গেইছে, কালাম ফোয়ারার দিকে আঙুল তুলে বলে।
এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তিনতলা ভবনটির ধ্বংসাবশেষ বেশ ভালোভাবে নজরে পড়ে। তিনতলার ছাদের কড়িকাঠের বর্গা কয়েক জায়গায় ভেঙে গিয়ে আলো চলাচলের পথ করে দিয়েছে। রেলিংগুলো স্থানে স্থানে ভেঙে পড়েছে কিংবা ঝুলে আছে। রেলিংয়ের কারুকার্য এখনো বোঝা যায়। আসলে কারুকার্য সারা ভবনেই ছড়িয়ে আছে। দরজা-জানালার ওপরে গম্বুজাকৃতির ফাঁকা জায়গায় কাঠের প্যানেলে রঙবেরঙের কাচ বসিয়ে সম্ভবত আলো চলাচলের ব্যবস্থা; যদিও কাচগুলো ভাঙা কিংবা স্থানটা ফাঁকা হয়ে আছে। কয়েকটি কক্ষে গন্ধে নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায়।
কালাম এগিয়ে যেতে যেতে বলে, এই সামনে একটা ঘর দেখতিছো, এইখানে জমিদার বসতো খাজনা আদায় করার জুন্নি।
কক্ষটা বিশাল। ঘরটার অবস্থা খুব খারাপ। জানালায় চৌকাঠের চিহ্ন আছে কপাটের অস্তিত্ব নেই। আলো-আঁধারির বালাই নেই। সব ফক্ফকা। মানুষের বর্জ্যরে স্তূপ অন্যসব গন্ধের সাথে মিশে গিয়ে ব্যাখ্যার অতীত আবহ তৈরি করেছে। ছাদে কড়িকাঠের জ্বরাজীর্ণ অবস্থার কারণে আড়াআড়ি বসানো ইট দাঁত বের করে আছে। উপরন্তু মাকড়সার জাল যেভাবে ঝুলছে তাতে সাম্রাজ্যটা তাদেরই মনে হয়। দেয়ালে কিসব আঁকাআঁকি। এসব কি, কে জানে। কেমন ভয় ধরানো অনুভূতি।
বুঝ্তি পারো, এইখানে জমিদারের পেয়াদারা কতো মানুষ পিট্যাতি পিট্যাতি মার‌্যা ফ্যালাইছে! বোঝ্লা, এইট্যা হলো আল্লাহর গজব। আল্লাহ বাড়াবাড়ি সহ্য করেন না।
সুমন শুনে যায়। এ ধরনের পরিবেশে বলার চেয়ে শুনতেই ভালো লাগে। ও পাশে আরো কয়েকটা ঘর আছে। কালাম বলে, দেইখ্যা লাভ নাই। সবগুলর একই অবস্থা।
এই বড়ো কক্ষের সাথেই একটা সিঁড়ি উপরতলায় গিয়ে মিশেছে। কালাম সেদিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ির ধাপগুলো ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এতোটাই স্যাঁতস্যাঁতে যে কোথাও কোথাও রীতিমতো পিচ্ছিল হয়ে গেছে। সিঁড়ি অপ্রশস্ত। প্লাস্টার খসা অপরিচ্ছন্ন দেয়ালে হাত রেখে উঠতে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। সুমন কোনো রকমে কালামকে অনুসরণ করে।
সিঁড়ি শেষ হতেই একেবারে মুখোমুখি বিশাল একটা হলঘর। ব্যালকনিটা যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন। ভেতরে ঢুকতে ছেঁড়া স্যান্ডেল, পরিত্যক্ত কাপড়, কাপড়ের টুকরা, দলানো- মোচড়ানো বিভিন্ন কাগজ চোখে পড়ে। বোধ হয় সম্প্রতি কেউ থেকে থাকবে।
এহ্যান দ্য চাইরজন ডাকাতরে ধর‌্যা নিয়্যা গেইছেলো পুলিশ।
এখানে কী হতো?
এইটা নাচঘর। বাইজিরা নাচতো। শুন্ছি ভারত থিক্যা বাইজি আসতো। তারপর ম্যাল্যা টাকা নিয়্যা চোইল্যা যাতো। কেউ কেউ অবশ্য থাক্যাও গেইছে।
কেন?
যাওয়ার চেয়ে থাক্লি লাভ, তাই। দুই-একজন আত্মহত্যাও ক’রছে শুনছি।
সুমন ওর মুখের দিকে তাকায়। গা বেয়ে শীতল অনুভূতি নেমে যায়। পরিবেশটা হঠাৎই মনে হয় অতিনির্জন। একটা ঠান্ডা বাতাস যেনো ছুঁয়ে গেলো। কালাম সুমনের পরিবর্তন লক্ষ্য করে না।
ঐযে ভাঙা কড়িকাঠ্টা দেখতিছো। মুজ্রা কোরতি আস্যা ঐখানে রামা বাইজ ফাঁস নেছোলো।
ভয়টা সুমনের ওপর চেপে বসে। সে কালামের ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে।
কেন?
কতোজোন্ কতো কথা কয়। কার্’টা বিশ্বাস ক’রবো। কালাম ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলে যায়, দুই ছাওয়ালের বড়ো জোন গঙ্গারাম, রামার সাথে খারাপ ব্যবহার র্কছেলো। রামা জমিদাররে জানালি নারান হাসি দিয়া কইছেলো, এতো ভালো কতা, আমার ছাওয়াল আমার মোতোন হোইছে। ওই পারবে জামদারি রাখ্তি। এই কথায় গঙ্গার আরো বাড় বাড়ে। রামা তার বুড়া সঙ্গীরি সব টাকা পয়সা দিয়্যা পলায় যাতি ক’য়। বুড়া চল্যা গেলি গঙ্গার গেলাসে বিষ মিশ্যায় দিয়া রামা ফাঁস নেয়। নারানের ছোট ছাওয়াল গিরি হাবাগোবা। কতা কো’তি পারতো না, চলতি-ফিরতি পারতো না। হাত-পাও ব্যাহা, চিকুন। দেখতিও কদাকার।…
সুমনের দিকে হঠাৎ খেয়াল করে কালাম বলে ওঠে, কী ভয় কোরতিছে?
সুমন কোনো কথা বলে না।
দূর পাগল। এইগু’ল কতো আগের কতা! অ্যাহোন এইসব আছে নিকি। আমি তো একা একাও আইছি। আমার তো ভয় করে না।
সুমন অপার বিস্ময় নিয়ে এইসব সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। অট্টালিকা কতো সুন্দর হতে পারে! সে ঘুরে ঘুরে অস্পষ্ট হয়ে ওঠা দেয়ালচিত্র এবং কারিগরদের তৈরি কারুকাজ দেখতে থাকে। দেয়ালের খোপে বাতি রাখার ব্যবস্থা। খড়িকাঠের বগায় ঝুলছে এক খন্ড সরু শিকল। সম্ভবত ঝাড়বাতি ঝোলানো হতো। সুমন এসব জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়। অযতœ, অপব্যবহারের ছাপ সর্বত্র। কালাম হাঁটতে হাঁটতে বলে, নারান জমিদার বাড়ি বানানির জুন্নি দিল্লি থিকাও কারিগর আনায়ছেলো।
হলঘরটা বিশাল। কোনো জানালা নেই। তিন দিকের দেয়ালে দুটো দরজা। দু’পাশের দরজার একদিক দিয়ে টানা বারান্দায় যাওয়া যায়। অন্যপাশের দরজা দিয়ে পাশের কক্ষে। সে কক্ষের দুটো দরজা। একটা দরজা ঝুল বারান্দায় যাওয়ার জন্য। ঝুল বারান্দার রেলিংয়ের ভগ্নদশা। কক্ষের অন্য দরজা একটা সরু করিডোরের প্রবেশপথ। পাল্লা বন্ধ থাকলে মনে হবে ওপাশেও বোধ হয় কোনো কক্ষ আছে।
তুমি এতোসব জানো কী করে?
শুনছি। বাবা সব জানে।
নারানের পাঁচ মাইয়্যা। কিন্তু বয়স বারো-ত্যারো বছর হ’তি কি অ্যাক্ রোগে একজোনের পর একজোন মইর‌্যা গ্যালো। ক্যাবোল ছোটজোন সরস্বতী থাকলো। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে কালাম থেমে যায়। একটু থেমে বলে, ঐদিক্ চলো, তোমারে নতুন এট্টা জিনিস দ্যাহাবো।
ওরা দু’জন বেরিয়ে আসে। বারান্দা ধরে এগিয়ে যায়। হাতের বাঁ পাশে সারি সারি কক্ষ। অধিকাংশ কক্ষের দরজাতে চৌকাঠের অস্তিত্ব থাকলেও পাল্লা আছে মাত্র কয়েকটার। আর যা আছে, তাও না থাকার মতো। কিন্তু যতটুকু আছে সেগুলোর কাঠে যে নকশা, তা দেখার মতো। একসময় কতোশত লোকের পদচারণায় এই পুরী গম্ গম্ করতো। জমিদারের পাপ তার বংশকেও নিপাত করে ছেড়েছে। এখন মৃতপুরীর মতো বিশাল বাড়িটায় হাঁটার শব্দ ছাড়া আর কোনো প্রাণ নেই। লম্বা প্যাসেজ, স্থানে স্থানে দু’দিকের কক্ষের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে। অদ্ভুত নীরবতা রহস্যকে শতগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
আগে খুব আসতাম। অ্যাহোন আর ভাল্লাগে না। কালাম রাজনীতিবিদদের মতো বলে, তুমিতো জানো না, এই জমিদার বাড়ি মানে নির্যাতনের অ্যাক্-অ্যাক্টা ইতিহাস।
সুমন যতোটা শোনে তারচেয়ে বেশি দেখে। এই নিঝুম সৌন্দর্যে তার কথা বলতে ভালো লাগে না। বইতে জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের কাহিনী সেও পড়েছে। নায়েব আলি স্যারও ইতিহাস পড়ানোর সময় অনেক কাহিনী বলেছেন। বাবার কাছেও শুনেছে।
হঠাৎ কি যেনো চোখে পড়ায় কালামের হাত টেনে ধরে, কালাম একটু দাঁড়াও, ঐ রুমটায় কাকে যেনো দেখলাম।
কালাম কান দেয় না। বোধ হয় শুনতে পায়নি। প্যাসেজের এপথ-সেপথ ধরে বেশকিছুটা যাওয়ার পর একটা খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।
দ্যাহো?
নিচে ঘন ঝোপে ঢাকা একটা বাগান। বাগান কিনা কালাম বলে না দিলে বুঝতে পারতো না। সুমন প্রশ্ন করে, কী?
নাহ্। পষ্ট দ্যাখা যাতিছে না। চলো তিনতালা যাই।
আবার এপথ-সেপথ। ওরা তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ায়। এ সিঁড়ির অবস্থা আরো কাহিল। ধাপগুলো কেবল ক্ষয়েই যায়নি, শ্যাওলা জমে গেছে। সুমন ভাবে, সম্ভবত বৃষ্টির পানি এপথ বেয়ে নিচে পড়ে, তাই এ অŸস্থা।
এট্টু সাবধানে আসো, কালাম সতর্ক করে।
একবার পিছলে পড়লে নির্ঘাত হাত-পা ভাঙবে। সঙ্কীর্ণ সিঁড়ির দু’পাশের দেয়ালে ভর দিয়ে অবশেষে ওঠা গেলো। তিনতলার মেঝে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কালাম যেভাবে হাঁটছে তাতে সুমন বেশ নির্ভয়ে অনুসরণ করে। ব্যালকনির ধারগুলোর যা অবস্থা তাতে মনে হয় এগুলোর আর বেশি আয়ু নেই। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে ওপর থেকে কয়েকটি কক্ষে নজর পড়ে, ছাদ বলতে কোনো কিছুর অবশিষ্ট নেই, পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়।
বেশ খানিকটা হাঁটিয়ে কালাম মোটামুটি ভালোভাবে নিচের দৃশ্য দেখা যায় এবং নিরাপদে দাঁড়ানো যায় এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেলো। এটা অন্যপাশ। নিচে ছোটোবড়ো গাছের জঙ্গল। কালামের কথায় বাগান। বড়ো গাছগুলো তিনতলা ভবন ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। বেমক্কা বেড়ে ওঠা গাছগুলো একসময় যেভাবে লাগানো হয়েছিলো, তাতে পরিকল্পনা থাকলেও এখন বোঝার উপায় নেই। কালাম আঙুল দিয়ে বাগানের একটা অংশের দিকে দেখালো। কবরের মতো একটা স্থাপনা দেখা যাচ্ছে।
জলিল ব্যাপারীর কবর।
বলে না দিলে কবর বলা মুশকিল। কবরের দেয়াল বলে এককালে কিছু থাকলেও এখন আলাদা করে বোঝা কষ্টকর। আশপাশে উইপোকার ঢিবিগুলো দুই-আড়াই ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে আছে। কবরটা আকারে বেশ বড়ো। উপর থেকে দেখায় আশপাশে কয়েকটা গভীর গর্তও নজরে পড়ছে।
এখানে কবর কেন?
সেইট্যাইতো কথা। কালাম একটু থেমে বলে, জলিল ব্যাপারী আট-দশ গেরামের মুসলমানগে মধ্যি সবচাইতি ধনী ছেলো। তার একটা মাত্র ছাওয়াল মকবুল সরস্বতীর সাথে এক স্কুলি পড়তো। এভাবেই পরিচয় ও সম্পর্ক। সরস্বতী তার বাপরে চেনতো। নারান গোড়া হিন্দু। তার জমিদারিতে গরু জবাই নিষিদ্ধ। আমাবস্যার রাতি পলায় যাতি গিয়্যা সরস্বতী ধরা পড়লো। সরস্বতীর ঘরে তালা পড়লো।
কালাম থেমে বলে, চলো ওদিক্ যাই।
সুমন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। এক প্যাসেজ থেকে আরেক প্যাসেজ। সমস্তটাই গোলকধাঁধা। কালাম আরেক প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। এই অংশের রেলিংয়ে লোহার কাঠামো এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। কালাম হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। সুমন এতোটা ভরসা পায় না। ওর হাতের তালুতে রেলিংয়ের ধাতব কঙ্কাল কেমন শীতল অনুভূতি দেয়। যা ধীরে ধীরে শরীরের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে। পাশেই আরেকটা দালান, দোতলা। সমস্ত ছাদটাই চোখে পড়ে। গোটা ছাদ জুড়ে দু’তিন হাত উঁচু ঘাসের রাজ্য এতোটাই বিস্তৃত যে, চুন-সুড়কির ছাদ মনে হয় না। প্রকৃতির এই অকৃপণ আনুকূল্যে এই দালানের আরেক রহস্য ছাদের সিঁড়িঘর। সিঁড়িঘরের দরজার কাঠামো বিলীন। কিম্বা হয়তো ছিলোও না। দু’পাশে ইট খসে যাওয়ায় চারকোনা দরজা প্রায় গোলাকার ধারণ করেছে। ঘাসের উচ্চতা দরজার অর্ধেকটা ঢেকে দেয়ায় প্রবেশপথ অন্ধকার গুহার মতো মনে হচ্ছে। দিনের আলোতেও ভেতরে দৃষ্টি যায় না। গুহার অন্ধকার সবকিছু গ্রাস করতে ডাকছে।
দোতলার ঝুল বারান্দার কার্নিশে বটের একটা চারা হয়তো কোনো একসময় জন্ম নিয়েছিল। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসে এখন মহীরূহ হয়ে উঠেছে। ঝুরিগুলো মাটি ছুঁয়েছে, স্বাস্থ্য পেয়েছে, কান্ড দেয়াল ভেদ করে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে। কোথাও কোথাও অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। দেয়ালের কয়েক জায়গার ফাটল বেশ গভীর। ইটগুলো জীর্ণ-শীর্ণ আলগা হয়ে গেছে।
কালাম বলে যায়। নারায়ণের তখন প্রচন্ড দাপট। একমাত্র উত্তরসূরি গিরিন্দ্র কুমার প্রতিবন্ধী। একদিকে উত্তরসূরির শোক, অন্যদিকে সরস্বতীর বিশ্বাসঘাতকতা। নারায়ণ আরো হিংস্র ও ক্ষমতাদর্পী হয়ে উঠলো। খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরায় শৃঙ্খলা থাকলো না। পান থেকে চুন খসলেই কর্মচারী, প্রজা সবার সাথে নির্মম-নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করলো। কাচারি থেকে বেরিয়ে বাকিসময় রঙমহলেই কেটে যায়। জমিদারির উন্নতির দিকে মন নেই। লোকজন খাজনা আদায় করতে গিয়ে অত্যাচারের সীমা-পরিসীমা মানে না। আর্দালি, গোমস্তা, লাঠিয়াল সর্দার একেকজন ছোটখাটো জমিদার। অন্যায়-অত্যাচারে একজন আরেকজনকে টেক্কা দেয়। মকবুলকে ধরে নিয়ে আসার হুকুম হলো। জলিল ব্যাপারী তহন ব্যবসার কাজে বিদেশে। মকবুলকে পাওয়া গেলো না। নারায়ণের নির্দেশে মকবুলের মা-বোনকে ঘরে আটকে রেখে জলিল ব্যাপারীর সবক’টি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। মকবুলকে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলে, নারায়ণের গোয়ালা মকবুলকে ধরায় দেছোলো। কিন্তু কেউ কখনো মকবুলরে আর দ্যাখে নাই।
দুই বছর পর জলিল ব্যাপারী গ্রামে ফিরে দেখে তার ঘর-সংসার সব শেষ। এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা ব্যাপারীর ছিলো না। সে নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলো। বাড়ি-ঘরের অবশিষ্ট ছিলো না। প্রতিবেশীরা ঘুঘুচরা ভিটায় কোনোরকমে একটা ছাপরাঘর তুলে দিলো। ব্যাপারী সেখানেই থাকে। সারাদিন চুপচাপ কিসব ভাবে। স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে আত্মীয়-প্রতিবেশীরা চেষ্টার ত্রুটি করলো না। কিন্তু সে আর স্বাভাবিক হলো না।
মাঘী পূর্ণিমায় উৎসব করা জমিদার বংশের অনেকদিনের রেওয়াজ। সূর্যোদয়ের সময় স¥ানান্তে পূজা হয়। জমিদারের বজরায় নাচ-গানের আসর বসে। সাত গ্রামের লোক জমিদার বাড়ি আসে ভরপেট একবেলা খেতে।
মাঝরাতে অপ্রকৃতিস্থ জমিদার বাইজিসহ বজরার ছাদে ওঠে জোস্না দেখার জন্যে। তারপর কিভাবে দুইজনই বলেশ্বরে পড়ে যায়। কেউ কেউ বলে, বাইজি জমিদারকে নিয়ে বলেশ্বরে ঝাঁপ দেয়। আরেকটা গল্পও আছে, মুসলমানের সাথে সম্পর্ক করায় জমিদার সরস্বতীকে গলায় ভরা কলস বেঁধে বলেশ্বরে ডুবিয়ে দিয়েছিলো। মাঝরাতে জমিদার বজরার ছাদে উঠে দেখে, সরস্বতী পানিতে একটা পদ্মফুলের উপর বসে আছে। বাপকে দেখে, সরস্বতী দু’হাত বাড়িয়ে বলে, বা’জান বড়ো কষ্ট, তোমারে কতোদিন দেহি না। তুমি আমার কাছে চোল্যা আসো। জমিদার কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে নদীতে পড়ে যায়। জমিদারের সাথে বাইজিও ছাদে উঠে এসেছিলো। এই দৃশ্য দেখে সে অজ্ঞান হইয়া বজরার ছাদ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। বলেশ্বর দু’জনকেই কোলে টেনে নেয়।
নদীতে তখন ভরা জোয়ার। লোকজন কতো খুঁজলো। লগির খোঁচায় নদীর তল মেলে না। জোয়ারে নদীর পানি ফুলে উঠেছে, যেনো ফুসছে। ভাটির টানে লাশ কোথায় ভেসে গেলো কে জানে।
কথায় কথায় সময় গড়াচ্ছে অথচ ঘুরে দেখা হচ্ছে না। আবার গল্পের শেষটা জানতেও খুব ইচ্ছা করছে। যদিও বাড়ি গিয়ে শোনা যেতো, কিন্তু যা নিয়ে গল্প তার কাছাকাছি থেকে শোনার মজা আলাদা।
কালাম, ছাদে যাওয়া যাবে না? চলো ছাদে গিয়ে বসি।
ছাদে ওঠা নিরাপদ না। তাছাড়া ছাদটাও ভালো না। একটা মাত্র লোহার সিঁড়ি, সুবিধার না। তারচে’ চলো তোমারে আরেক জা’গা নিয়্যা যাই।
কোথায়?
নারান যেহানে সরস্বতীরে তালা দিয়্যা রাখছেলো। এইতো কয়টা ঘর পরই।

বাড়িটা বিশাল। রুমগুলোও ছোট না। প্যাসেজটা ডানদিকে বাঁক নিয়ে একটা দরজার মুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। সুমন অবাক হয়, দরজা-চৌকাঠ এখনো অক্ষুন্ন। কালাম বলে, সরস্বতীরে অনেকেই ভালো জানতো। গেরামের বুড়া-বুড়িরা এখোনো ক’য় সরস্বতী দেখতি ছেলো চাঁদের মোতো সুন্দর। নৌক’য় বস্যা থাকলি মোনে হতো আকাশের চাঁদ নাম্যা আইছে। সরস্বতী মারা গেলি অনেক বছর কেউ এই ঘরে ঢোক্তো না।
সুমন লক্ষ্য করে, কালামের মুখে চাঁদ শব্দটা বেশ মানিয়ে গেছে।
চমৎকার একটা কক্ষ। বোঝাই যায় বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষভাবে বানানো। বিশাল কক্ষটায় বিলাসিতার ছাপ স্পষ্ট। দরজা একটাই। তিনদিকে জানালা। রোদ-বৃষ্টিতে জানালার কাঠ ক্ষয়ে গেছে। একটা কক্ষ হলেও পূজা করার জন্য দেয়ালের গায়ে ছোট ঘরের মতো ব্যবস্থা। পূজার উপকরণ নেই, সমস্ত ঘরটাই ফাঁকা। তবে অন্যান্য কক্ষে যেমন আছে, ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই কোথাও। গরাদের বেশ ক’টি এখনো অবশিষ্ট। মনে হয় প্রকৃতি নিজেই ঘরটি রক্ষা করে চলেছে। জমিদার নিজির মার জুন্নি বানাইছেলো এইটা, কালাম জানায়।
সিলিং অর্ধগোলাকার, মসজিদের গম্বুজের মতো। তিন তলার এই কক্ষের ছাদে আড়াআড়ি কোনো বর্গাকাঠ নেই। মাঝে একটা আংটা, সম্ভবত ঝাড়বাতির ব্যবস্থা ছিলো।
বাবার সাথে সুমন লালবাগ কেল্লা, আহ্সান মঞ্জিল, বড় কাটরা দেখেছে। তাই প্রাচীন আমলের বাড়িগুলোর নির্মাণশৈলী সে কিছু কিছু জানে। বাবাই তাকে এসব বলেছেন।
কালাম একদিকের জানালার কাছে দাঁড়ায়। ঐ যে নিচি দেখতিছো একটা পুকুর। জমিদারবাড়ির সব ধোয়াপাল্লার কাজ এই পুকুরি হতো। যারা কাজ করতো, তারা দ্যাখছে, যে কয়দিন সরস্বতী এইহানে বন্দী ছেলো, সবসময় এই জানালার কাছে চুপ কইর‌্যা বস্যা থাকতো। কিন্তু কেউ কতা ক’তি সাহস পাতো না, পাছে আবার জমিদার জান্যা যায়। জমিদার পরে বুঝতি পারছেলো, সরস্বতী তার বংশের নাম ডুব’বে।
মকবুলকে কোথায় বন্দী করে রেখেছিলো?
এই দালানে মাটির তলে আরো দুইতালা আছে। এখোনো সিঁড়ি আছে কিন্তু যাওয়া যায় না। সবচাইতি নিচির তালায় ছেলো জেলখানা। ঐ রকম এট্টা ঘরে আছে কু’য় (কূপ)। নির্যাতন করে লাশ ওহানে ফ্যালায় দেতো।
ঐ ঘরগুলো তুমি দেখ্ছো?
না, ঐহানে কী যাওয়া যায়? আলো নাই, বাতাস নাই। শুনছি আগে যারা গেইছে, তারা কেউ ফিরা আসে নাই। জায়গার এট্টা অভিশাপ আছে না?
এই সুনসান নিস্তব্ধ পরিবেশে একমাত্র বক্তা কালামকে মনে হতে থাকে অনেক অভিজ্ঞ। সে যেনো এই অট্টালিকার এতোদিনের না বলা কথা, এতোকালের নিষিদ্ধ অনেক কাহিনী জানে।
কারা যেনো যাচ্ছে। কথাবার্তার শব্দ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের ভেতরে জঙ্গল থেকে দু’জন লোক বেরিয়ে এলো। কালো কুচকুচে, খালি গা খালি পা। দেখে মনে হয়, লোক দু’টো ঠিক মতো গোসল করে কি না সন্দেহ। মাথার চুল কটা হয়ে গেছে। দু’জনেরই বাঁ কাঁধে দুটো করে পাটের বস্তা; বোঝা যায় ভেতরে কিছু আছে, ডান হাতে সড়কি। কালাম বললো, ওরা কাছিম ধরে।
সুমনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে কালাম ব্যাখ্যা করে, কাছিম মানে তোমরা যারে কচ্ছপ কও।
ওদের সম্বিত ফেরে। বেলা বেড়ে যাচ্ছে। কয়টা বাজে, সুমন আন্দাজ করতে পারে না।
ব্যালা পড়্যা যাতিছে। আইজ থাক্, আরেকদিন আসবো, কালাম বলে।
তোমার গল্পটা শেষ করো, সুমন বাধা দেয়।
জমিদার মারা গেলে তার সম্পত্তি নিয়ে নানান শরিকের ভেতর গন্ডগোল বেধে গেলো। নতুন নতুন শরিক গজিয়ে উঠলো। রানী দেখলেন, এতো মহাফ্যাসাদ। এই সমস্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। রানী ধর্ম-কর্ম করতেন। জমিদারের কর্মকান্ড তার কাছেও ভালো লাগতো না। তাই তিনি সোনাদানা-টাকাপয়সা যতোটুকু পেলেন, নিয়ে গিরিসহ কাশী চলে গেলেন। ততোদিনে মামলা চালাতে চালাতে শরিক্দের অবস্থা পড়ে গেছে। জমিদারি নিলামে উঠলো। কিন্তু নারান জমিদারের অভিশাপ কেউ মাথায় নিতে রাজি না। যে যেভাবে পারলো লুটেপুটে নিতে লাগলো। রানী জীবদ্দশায় ফিরলেন না। ফেরার উদ্দেশ্যে তিনি যাননি।
জমিদার নেই, সেই জমিদারিও নেই। গেরামের লোকজন জমিদারকে যমের মতো ভয় করতো। জমিদার মারা গেলে সেই ভয় আর থাকলো না। শরিকদের কেউ পাত্তা দিতো না। নারান ডুবে মরার অনেকদিন পরও জলিল ব্যাপারী বেঁচে ছিলো। একদিন সকালে দেখা গেলো বলেশ্বরে জলিল ব্যাপারীর লাশ ভাসছে। কেউ জানলো না, বুঝলো না, কয়েক মাইল দূরে বলেশ্বরে জলিল ব্যাপারী কখন গেলো। আর যদি গেলোই কারো চোখে কেন পড়লো না। আসলে শেষের দিকে এমন হয়েছিলো ব্যাপারীকে দেখেশুনে রাখবে তেমন কেউ ছিলোও না।
নারান জমিদারকে গ্রামের মানুষ পছন্দ করতো না। তাই গ্রামের লোকজন জমিদারের দক্ষিণ বাগান যেটা ছিলো সবচেয়ে সুন্দর, সেখানে জলিল ব্যাপারীকে কবর দিলো। এই বাগানে রামা বাইজি বেঁচে থাকতে সকাল-সন্ধ্যা কবুতর ওড়াতো। বিভিন্ন জায়গায় থেকে আনা অনেক ধরনের ফুলগাছ ছিলো এই বাগানে। বলেশ্বরে একসময় আরবের জাহাজ ভিড়তো। সেই জাহাজের নাবিকরা, যারা নিয়মিত ব্যবসা করতো, নারান জমিদারের জন্য দেশ-বিদেশের নানারকম ফুলগাছের বিচি নিয়ে আসতো। জমিদার অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছ এই বাগানে লাগিয়েছিলো। রামা বাইজি মারা গেলে বাগানটার নাম হয়ে যায় রামাজির বাগান। গ্রামের লোকরাই উদ্যোগ নিয়ে জলিল ব্যাপারীর কবর পাকা করে দেয়।
কালাম একটু থেমে বলে, নারান জমিদাররে নিয়্যা এরোম কতো গল্প যে আছে তার শ্যাষ্ নাই।
ওরা তখন বাড়ির সামনের সরু পথটায় নেমে এসেছে। সুমন বললো, বাড়িতে বোধ হয় এখনো মানুষ থাকে। একটা ঘরে দেখলাম, বেশ লম্বা একজন শুয়ে আছে।
ওইয়্যা আরো কতোজোন দ্যাখ্ছে! ঐগু’লন অলো ভয়।
ভয় মানে, ওগুলো সত্যি না?
কালাম উত্তর না দিয়ে দাঁত বের করে হাসে। কালামের দাঁতগুলো বড়ো বড়ো। সুমনের অস্বস্তি লাগে।
আরো কিছুটা হেঁটে মূল রাস্তায় উঠে এলো। কালাম বলেছে, কাছাকাছি ভ্যান না-ও পাওয়া যেতে পারে। সুমনের হাঁটতে আপত্তি নেই। কিন্তু ভাগ্য ভালো, রাস্তায় উঠে আসতেই ভ্যান পেয়ে গেলো। সুমন আরো অবাক হলো, সেই একই ভ্যানওয়ালা। ওদের দেখে হেসে বললো, আফ্নারা অ্যাহোনো বাড়ি যান নাই! চাচাজান আমারে আবার পাঠাইছে।
বোঝা যাচ্ছে ভ্যানওয়ালা পরিচিত। দ্বিতীয় কালভার্টের পর ভোটস্কুল পর্যন্ত রাস্তাটা একটু দীর্ঘ। তারপরের পথটুকু কেবল কথা বলা দূরত্বের। ভ্যানওয়ালা বললো, ভাইজান ধলাবুরু নাকি আবার আইছে!
কালাম ত্বরিত উত্তর দেয়, কোই আইজ তো দ্যাখলাম না!
সবাই তো কতিছে। আফনাগে হালটে নামায় দিয়্যা রাস্তায় উঠ্যা আসতি পাচুমেয়া কলো ধলাবুরুরি দ্যাখ্ছো নাকি। আমিও তো জানতাম না। পাচুমেয়া কলো ধলাবুরু দুইদিন হলো হালটে গিয়্যা উঠছে।
ভ্যান বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। আর কোনো কথা হলো না।
উঠানে ফুপু কিছু একটা করছিলো। কালামকে দেখে ধম্কে উঠলেন, ছাওয়ালডারে নিয়্যা অ্যাক্দুফুর কাটায় দিলি? মরা মান্ষির ভিট্যায় এতোক্ষুণ কেউ থায়ে?
কালাম কোনো কথা না বলে বৈঠকখানায় গিয়ে ওঠে। বাবা ঘরে দূর সম্পর্কের এক ফুপুর সাথে গল্প করছেন। সুমনকে দেখে বললেন, এতো দেরি করলে কেন?
দেরি হয়ে গেলো বাবা, একটু ঘুরে দেখছিলাম।
বিকাল হয়ে গেছে, খেয়ে নাও। তোমার ফুপা বাবুগঞ্জের হাটে তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তোমার জন্য অপেক্ষা করে চলে গেছে।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতে নয়টা বাজলো। উঠানে হোগলার বড়ো মাদুর বেছানো হয়েছে। ভাইবোনদের কয়েকজন গিয়ে সেখানে বসলো। বাবার জন্য একটা চেয়ার আগেই আনা হয়েছিলো। কিন্তু বাবা বেশিক্ষণ বসলেন না। পাশে শিকদার বাড়ির কে একজন গুরুতর অসুস্থ, বাবাকে দেখতে চেয়েছেন। ফুপু পান নিয়ে এসে বাবাকে একটা দিলেন, তারপর ফুপাকে। বাড়ি এলে বাবা পান খান। ঢাকায় কালেভদ্রে বাবাকে পান খেতে দেখেছে। পান চাবানোর সময় সেই রাশভারি চেহারাটা একেবারেই থাকে না। বাবার রাশভারি চেহারা সুমনের ভালো লাগে না। ফুপার সাথে বৈষয়িক কয়েকটা বিষয় নিয়ে কথা বলে বাবা উঠে গেলেন।
কালাম সবেমাত্র খেয়ে এসে বসেছে। আজ সন্ধ্যায় ফারুক পড়তে বসেনি, সুমনকে সময় দিয়েছে। সেও এসেছে। ফুপা সুমনকে বললেন, আইজ কী কী দ্যাখ্লা বা’জান।
ফুপার কাছ থেকে জমিদারবাড়ির আরো গল্প শোনার প্লান দুপুরের পর থেকেই সুমনের মাথায় ঘুরছে। খুব ভালো হতো যদি ফুপা নিজেই সঙ্গে করে ঘুরিয়ে দেখাতেন। বললে হয়তো তিনি রাজিও হবেন। কিন্তু সংসারের বিভিন্ন কাজে তিনি এতোটা ব্যস্ত থাকেন যে তাকে বলতে ইচ্ছে করে না।
(চলবে)

SHARE

Leave a Reply