Home তোমাদের গল্প সেই ছেলেটি -রাকিব উদ্দীন

সেই ছেলেটি -রাকিব উদ্দীন

গ্রামের নাম করুনা নগর। খবুই সুন্দর গ্রাম। দেখতে ছবির মতো। এই গ্রামেরই পূর্ব কোণে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। ভালোই জমিজমা আছে তাদের। উত্তরাধিকার সূত্রেই তারা এখানে বসবাস করে। অন্য আট-দশটি পরিবার থেকে ভিন্ন তাদের জীবনযাপন। বাবা এবং মা দু’জনই পেশায় শিক্ষকতা করেন।
১৫ নভেম্বর ১৯৯৫ সাল। রাত ১০টা। আকাশে এক ফালি চাঁদ হেসে আছে। এই শুভক্ষণেই জন্ম নেয় একটি ছেলে। চাঁদের মতো সুন্দর দেখতে। পরিবারের সবার ছোট সে। বাবা-মায়ের অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্তগুলো তাকেই ঘিরে। সবার ভালোবাসায় আবৃত সে। মা যতœ করে ছেলের সুন্দর একটি নাম রাখেন।
গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে ছেলেটি। ভদ্র হিসেবে পাড়া-পড়শির কাছে বেশ সুনাম অর্জন করে সে। সাত বছর বয়সে গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। প্রথম দিকেই শিক্ষকদের নজর কাড়ে। ক্লাসে নিয়মিত ভালো ফলাফল করে সে।
স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে এবং বৃত্তি পরীক্ষায়ও ভালো ফলাফল অর্জন করে। নিজের গ্রামে হ্ইাস্কুল না থাকায় পাশের গ্রামে একটি হ্ইাস্কুলে ভর্তি হয়। প্রতিদিন তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। কমলনগর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে একবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিল। সাঁতারু হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিল তার স্কুলে। নিয়মিত ফুটবল খেলতো এবং বলতে গেলে সব ধরনের প্রতিভা ছিল ছেলেটির।
দেখতে দেখতে এসএসসি পরীক্ষা চলে এলো। ২০১১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সে জিপিএ ৫ পায়। তার বাবা-মা খুব খুশি হন।
বাবা-মা তাদের ছেলেকে শহরের ভালো কলেজে ভর্তি করাতে চান। কিন্তু সে যেতে রাজি হয় না। কারণ বাবা-মাকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। ওর বাবা-মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা রয়েছে। অবশেষে বেশ অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে ঢাকায় ভর্তি হতে রাজি হয় সে।
ঢাকার একটি কলেজে ভর্তি হয় সে। আজিমপুরে বড় বোনের বাসায় ওঠে। মাঝে মাঝে জহুরুল হক হলের মাঠে খেলা করতো।
২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায় সে। এবার তার যুদ্ধক্ষেত্রে নামার কঠোর প্রস্তুতি। ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লড়াইয়ে নামতে হবে তাকে। কারণ বাবা-মাকে যে খুশি করতেই হবে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে বাবা-মাকে খুশি করার প্রত্যয় নেয় সে।
উচ্চশিক্ষার কথা চিন্তা করে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অবশেষে এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমিতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। সব ধাপ অতিক্রম করে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতও হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল, সকাল ১০টা। বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমিতে যোগদান করে। আর তার সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে মেরিন অ্যাকাডেমিকে কেন্দ্র করে। অ্যাকাডেমি বিধায় এখানে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর মতো বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা আছে যা খুবই কষ্টকর।
ছেলেটি যোগদান করে জুনিয়র ক্যাডেট হিসেবে। অ্যাকাডেমিতে দুই বছরের পড়াশুনা ও প্রশিক্ষণ। তাই দু’টি ব্যাচ থাকে সব সময়। সে হিসেবে আমি ছিলাম সিনিয়র ক্যাডেট।
যা হোক অ্যাকাডেমির বিভিন্ন ট্র্যাডিশন মোতাবেক সবাইকে বরণ করে নেয়া হলো।
অ্যাকাডেমিতে ২৪ ঘন্টার কঠোর রুটিন থাকে। পিটি প্যারেড আরো কত কী!
আমার ইঞ্জিনিয়ারিং নলেজ পরীক্ষা থাকার কারণে একটু ব্যস্ত ছিলাম।
একদিন রাতের খাবারের পর ডাকলাম ওকে। ওই দিনই ওর সাথে প্রথম কথা বলা। খুব দ্রুত ওকে নিয়ে ক্লাস রুমে গেলাম।
তত্ত্বীয় লেখার কাজ দিলাম, ওর হাতের লেখা এতটাই খারাপ ছিল যে আমি বকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই ওর জন্য খারাপ লাগলো।
ও থাকতো ২০৪ নম্বর রুমে। আমি থাকতাম নিচতলায় ১০৫ নম্বর রুমে। জুনিয়রদের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতাম না। শুধু ওর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। প্রতিদিন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ওর খোঁজ নিতাম।
এক শুক্রবার ওকে ডাকলাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম ওর পরিবার সম্বন্ধে এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য জানলাম।
ওকে তখন থেকেই খুব ভালো লাগতো। ওর কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম ও অনেক সুন্দর মনের একটি ছেলে।
সারাদিনের শারীরিক পরিশ্রমে ওর খুব কষ্ট হতো। তা দেখলে আমার খুব খারাপ লাগতো। ওর দিকে তাকালে আমি খুঁজে পেতাম নিষ্পাপ প্রতিচ্ছবি।
তাই ও কখনো শাস্তি পেলে যেকোনোভাবে সহায়তা করতাম।
জুনিয়রদের প্যারেড গ্রাউন্ডে দৌড়ানো বাধ্যতামূলক ছিল। তাই আমি ওকে প্রতিদিন বিকেলবেলা আমার সাথে নিয়ে যেতাম এবং গল্প করতাম দীর্ঘ সময় ধরে।
সকালবেলা এবং দুপুরবেলা সবার আগে ওকে ক্লাসে পাঠিয়ে দিতাম পড়াশুনার জন্য। অ্যাকাডেমিতে কোন কাজ থাকলে ওকে সাথে নিয়ে যেতাম। অল্প পরিশ্রমের কাজে অথবা আমার সাথে আমার রুমে নিয়ে যেতাম।
ডাইনিং হলে আমি অনেক সময় ওর জন্য খাবার রেখে দিতাম অথবা আমার সাথে বসতে বলতাম।
শুক্রবার ছুটিতে চট্টগ্রাম শহরে বেড়াতে যেতাম।
ওকে পরীক্ষা করার জন্য একদিন সিগারেট খাওয়ার প্রস্তাব দিলে ও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তখন বুঝলাম ও আসলে অনেক ভালো ছেলে।
অ্যাকাডেমিতে মোবাইল ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও গোপনে ব্যবহার করতাম। তাই ওকে প্রায়ই ডেকে ওর বাড়িতে কথা বলার সুযোগ করে দিতাম। মাঝে মাঝে ওর আম্মাকে ফোন করে জানাতাম।
ঈদের ছুটিতে যতদিন বাড়ি থাকতাম ওর সাথে নিয়মিত কথা বলতাম। ছোট ভাইয়ের মতো এবং বন্ধুর মতো আচরণ করতাম ওর সাথে। কখনই ওকে কষ্ট দেওয়ার মতো কাজ করতাম না।
ওকে সব সময় পড়াশুনার জন্য উৎসাহ দিতাম। প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষায় ও খুব ভালো ফলাফল করে। দ্বিতীয় সেমিস্টারে সে ১৩তম হয়।
আমি এখন অ্যাকাডেমিতে নেই। ওর কাছ থেকে অনেক দূরে আছি কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ওর কাছেই।
মহাসাগরের বুক চিরে চলার পথে আমি হয়তো তাকে দেখতে পাবো সফল তরঙ্গ রূপে।
কে সেই ছেলেটি? কী তার নাম?
হ্যাঁ, সেই ছেলেটির নাম শরীফ। আমি ডাকতাম শারীফ নামে। আসলেই সে একজন শারীফ ছেলে।
শরীফ এখন বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমির একজন সিনিয়র ক্যাডেট। সে একজন ক্যাডেট ক্যাপ্টেনও।
শরীফ এখন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট আছে। ক্যাডেট নম্বর : ৪০৯৮।
হ্যালো শরীফ কেমন আছো? নিশ্চয়ই ভালো?
তোমাকে খুব মনে পড়ে। তোমার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা এবং অসীম ভালোবাসা। ভালো থেকো দেবা।

SHARE

Leave a Reply