Home স্মরণ স্বরণে ও মননে কবি মতিউর রহমান মল্লিক -হাশিম হায়দার

স্বরণে ও মননে কবি মতিউর রহমান মল্লিক -হাশিম হায়দার

বহুমুখী প্রতিভার এক বিরল কবি ছিলেন মতিউর রহমান মল্লিক।
তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, কন্ঠশিল্পী প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন তিনি সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।
কে চেনেনা তাঁকে!
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন আমাদের এই প্রাণের কবি ও গীতিকার।
তাঁকে কেন চিনবে না!
তিনি তো ছিলেন মানুষ হিসাবে সরল, সহজ, প্রাণবন্ত। হৃদয়টা ছিল তাঁর সাগরের মতো বিশাল।
তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার কোনো তুলনা হয়না।
তিনি ফুল, পাখি, নদী, আকাশ, বাংলা প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসতেন।
ভালোবাসতেন ছোটদেরকেও।
কবি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ছোটদের জন্যও গান, কবিতা আরও কত কী!
তাঁর মনটা কী হতে চায় সেটা বুঝা যায় নিচের ‘মন হতে চায়’ কবিতাটিতে। যেমন-
“মন হতে চায় গানের কলি
মন হতে চায় পদ্য,
মন হতে চায় শাপলা শালুক
মন হতে চায় পদ্ম।
রঙিন মেঘের পালকি চড়ে,
চায় হারাতে হাওয়ায় জোরে,
ভোরের আলোর সরোবরে
এক নিমিষেই অদ্য।

মন হতে চায় বকের পালক
বাবুই পাখীর বাসা,
উধাও আকাশ সাতসাগরের
গভীর ভালোবাসা।

জোসনা মাখা চাঁদ দেখে সে
ঢেউয়ের মত উঠবে হেসে;
সবুজ নরম পাতার দেশে
নীড় বাঁধিতে সদ্য।”

কবির চোখ থেকে মন থেকে কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না। ভোলেন না তাঁর চেনা-জানা চারপাশকে। এমনকি চড়ুই পাখিও কবির হৃদয়ে আসন করে নেয়। যেমন “স্বাধীন চড়ুই” কবিতাটি-
“কিচির মিচির ডাকছে চড়–ই
ছাদের খোপে খোপে;
আবার কখন যাচ্ছে উড়ে
ধারের কাছের ঝোপে,

ব্যস্ত বড় সকাল সাঁঝে,
সময় কাটায় কাজের মাঝে
রাত্রি হলে ঘাপটি মারে
দালান কোঠার খোপে।

উঠোন ভরা ধানের গাদায়
চড়–ই পাখির ঝাঁক
তাড়িয়ে দিতে মা-মনি ঐ
দিচ্ছে কেবল হাঁক।
হাত বাড়িয়ে দুষ্টু ছেলে
হঠাৎ করে ধরতে গেলে
ফুড়–ত ফুড়–ত যায় উড়ে সব
তল্লাবাঁশের ঝোপে।”
a-mo1
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন একজন স্বপ্নচারি কবি। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখতেন। অন্যদেরকেও স্বপ্নের জগতে টেনে নিতে ভালোবাসতেন। আর ছোটদের ব্যাপারেতো কথাই নেই। তাদের নিয়ে তিনি কত যে স্বপ্নের জাল বুনতেন তার কোনো হিসাব নেই। ছোটদেরকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। তাদেরকে নিয়ে সকল সময় স্বপ্ন দেখতেন। তাদেরকে সাহসের ফুলকিতে জাগিয়ে তুলতেন। যেমন কবির ‘আলো আশা’ কবিতাটি আমরা পাঠ করে দেখতে পারি। কবি কী সুন্দর ভাবেই না লিখেছেন-
“নামবে আঁধার তাই বলে কি
আলোর আশা করবো না?
বিপদ-বাধায় পড়বো বলে
ন্যায়ের পথে লড়বো না?

মেঘ দেখে চাঁদ
যায়কি দূরে হারিয়ে?
যায়কি নদী
পাহাড় দেখে পালিয়ে?
হায়-হতাশায় মরবো শুধু
আশায় হৃদয় ভরবো না?

দু:খ আছে তাই বলে কি
স্বপ্ন সুখের দেখতে নেই?
রণাঙ্গনে হার আছে তাই
জেতার কানুন শিখতে নেই?

বজ্রপাতের ভয় আছে তাই বিহঙ্গ
পাখার ভেতর গুটিয়ে রাখে সব অঙ্গ?
ঝড়-তুফানে মরবো বলে
সাগর পাড়ি ধরবো না?”

এভাবেই কবি তাঁর ছড়া-কবিতায় সাহসের কথা বলেছেন, স্বপ্নের কথা বলেছেন, আশার কথা বলেছেন, যোগ্য মানুষ হবার জন্য যোগ্য হয়ে গড়ে ওঠার কথা বলেছেন।
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন একেবারেই সোঁদাগন্ধ মাটি ও মানুষের কবি। আগেই বলেছি কবি ফুল, পাখি, নদী প্রভৃতির সাথে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছিলেন। খুব কাছ থেকে তিনি এসব দেখেছেন। ফুলের গন্ধ নিয়েছেন। কখনওবা সেই ফুলকে বানিয়েছেন তিনি আশা ও স্বপ্নের চারণভূমি। যেমন তার ‘ফুলের মতো’ কবিতাটি-
“শিউলি যেমন খুব সকালে
সাজায় বনোতল,
তেমনি আমি সকাল হলেই
বাড়িয়ে মনোবল-

নিজেই নিজের ঘুম তাড়াবো
করবো যা দরকারী,
মন লাগিয়ে মনের মতই
সাজাবো ঘরবাড়ী।

ফুটেফুটে ফুল গন্ধরাজের মত
ফুটফুটে ঠিক রইবো অবিরত।

আমার স্বভাব করবো আমি
গোলাপ ফুলের ন্যায়;
আমার সুবাস ছড়িয়ে যাবে
সকল আঙিনায়।

সন্ধ্যাবেলায় উঠলো ফুটে
যেমন সন্ধ্যামণি,
ঐ সময়ে পড়ার ঘরে
ফুটবো আমি তেমন করে
গভীর মনোযোগের সাথে
তুলবো পাঠের ধ্বনি।

যে রজনীগন্ধা সারারাত ধরে,
গন্ধ বিলায় নির্জনতার হাত ধরে;
আমিও যেন সেই রজনীগন্ধ হই
রাত্রি জুড়ে আর সাধনায় মগ্ন রই।

এভাবেই কবি তাঁর সুন্দর শব্দ-ছন্দে কতকিছু এঁকে গেছেন আমাদের জন্য।
এমন একজন প্রকৃত দরদি ও দূরদৃষ্টিসমপন্ন স্বপ্নচারি কবিকে কী কখনো ভোলা যায়।
না।-
তিনি এইতো বেঁচে আছেন, জেগে আছেন আমাদের হৃদয়ে ও মননে। প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের উচ্চারণে।
আশা করি এভাবেই কবি মতিউর রহমান মল্লিক বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তর, কাল থেকে কালান্তর পর্যন্ত।

SHARE

Leave a Reply