Home নিয়মিত রহস্যভেদ পুড়োবাড়ির রহস্যবুড়ো -জিয়াউল আহ্সান

পুড়োবাড়ির রহস্যবুড়ো -জিয়াউল আহ্সান

বিকেল গড়িয়ে গেছে। দূরে বৃত্তাকার প্রান্তে অন্ধকার নেমে এসেছে। বড় রাস্তা থেকে একটা পথ বেঁকে গেছে ডান দিকে। সমস্তটাই পিচঢালা, পরিষ্কার। সামনে ডাহুক নদী। নদীর ওপর স্টিলের লম্বা সেতু। গাড়ির ভেতর গরমের তীব্রতা নেই। সেতুর ওপর উঠে আসতেই শরীর জুড়িয়ে গেলো। নদীর বাতাসের গুণই আলাদা। সেতু আর সংযোগ সড়ক পেরিয়ে সঙ্কীর্ণ রাস্তায় নেমে আসতে গতি কমে গেলো। ছোটখাটো খানাখন্দ ঝাঁকুনি বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ির গ্লাস নামানো। গতি কমে যাওয়ায় ভেতরটা আবার গরম হয়ে উঠছে।
এক জায়গায় রাস্তার পাশে যতোখানি দেখা যায় বেশ কিছু ছোটবড় ঢিবি। খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। বাবা বললেন, পালযুগের পুরাকীর্তি। মাটির ঢিবিতে চাপা পড়েছিল। সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ খোঁড়াখুঁড়ি করছে। খোঁড়াখুঁড়িতে দুই-তিন ফুট গভীর চারকোনা কয়েকটি ছোট-বড়ো গর্ত বেরিয়ে এসেছে। জায়গাটা কিছুক্ষণের ভেতর আড়ালে চলে গেলো।
সবুজ গাছপালায় ঢাকা গ্রাম সুমনের কাছে ভালো লাগে। এখানে সবাই কতো সহজ-সরল। কারো কোনো তাড়া নেই। ঘর ছেড়ে বেরোলেই সবাই সবার পরিচিত। শহরের মতো না। কয়েকদিন মজা করে গ্রামে থাকা যাবে। সুমন মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে।
হিমতলীর বাজার যেতে মাঝে বলেশ্বর নদী। নদীর ওপর বেইলি ব্রিজ। গ্রামে ঢোকার ঘন্টাখানেক আগে পড়ে হিমতলী বাজার। তারপর কিছুটা পথ পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে কিছু পাকা-আধাপাকা বাড়ি। একসময় বিশাল হাট বসতো। তখন নাম ছিলো হিমতলীর হাট। দু’দিন ধরে চলতো কেনা-বেচা। এখন হিমতলীতে প্রতিদিন বাজার বসে। বাবার কাছে শোনা। আশপাশ গ্রাম তো বটেই দূর-দূরান্ত থেকেও একদিন দু’দিন আগে ব্যবসায়ীরা হাটে আসতো নৌকা, গরুরগাড়ি চড়ে। সুমন গরুরগাড়ি দেখেছে। বাজার থেকে ইট বিছানো রাস্তা বাড়ির পথে গিয়েছে।
হিমতলী বাজারের পর থেকে সবটা রাস্তাই খালের পাশ দিয়ে গেছে। খাল বেশ গভীর। নদীর সাথে সংযোগ তাই শুকায় না, তবে কচুরিপানায় কোথাও কোথাও একদম ঢেকে গেছে। কোথাও নৌকা বাঁধা কিংবা ডোবানো। বাবা বলেছেন, গাব গাছের কষের সাথে আরো কি সব মিশিয়ে রঙ বানিয়ে নৌকায় লাগানো হয়। এতে পানিতে ডুবিয়ে রাখলেও নৌকার ক্ষতি হয় না। বরং ডুবিয়ে রাখলে নৌকা অনেকদিন টেকে। ব্যবহার না করে ফেলে রাখলে রোদের তাপে একসময় ফেটে যায়।
আরেকটা বাঁক ঘুরতেই যেনো রাত নেমে এলো। রাস্তায় গাছের সারি। অন্ধকারে চেনা যায় না। কিছু কিছু গাছ এতো বিশাল যে, বোঝা যায় খুব পুরানো। গাছের ফাঁকে ফাঁকে যথেষ্ট ঝোপঝাড়। অন্ধকারে ঝোপঝাড়-গাছপালা একাকার হয়ে গেছে। কিছুদূর পরপর রাস্তা থেকে বাড়ির পথ নেমে গেছে। অন্ধকারের ফাঁক গলে আড়ালে পড়া বাড়িগুলো অস্পষ্ট চোখে পড়ে। গ্রামে ইলেকট্রিসিটি এসেছে অনেকদিন। তবে লোডশেডিং এতো বেশি যে, অধিকাংশ বাড়িতে এখনো কুপি জ্বলে। খোলা জানালা কিংবা দরজা দিয়ে সে কুপির আলোয় মানুষের চলাফেরা হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে।
গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পথ চলতে হচ্ছে। যেখানে আলো পড়ে সে অংশটুকু পরিষ্কার। আধাপাকা রাস্তা কোথাও কোথাও খালের পাশ থেকে সরে গিয়ে বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে এগিয়েছে। গ্রামের রাস্তা-ঘাটে বৈদ্যুতিক বাতি থাকে না। তাই এইসব ঝোপঝাড়ের তলায় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। এই অন্ধকারের সাথে শহরের অন্ধকারের মিল নেই। গ্রামের অন্ধকার এতো কালো, এতো ঘন যে, গা ছম্ছম্ করে। গ্রামের অন্ধকারের সাথে এই পরিচয়টা প্রায় প্রতিবছরেই নতুন করে হয়। এই অন্ধকার সবসময়ই তাকে কেমন একটা হিম ধরানো অনুভূতি দেয়।
গত গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়েছিল কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি। এবার গ্রামের বাড়ি। আগ্রহটা বাবার। মা গ্রামে আসতে চান না। তাঁর হাজারো অভিযোগ। গ্রামে রাস্তা-ঘাট ভালো না, চাপকলের পানিতে আয়রন। খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা, গ্রামে গেলেই ছেলেমেয়ের পেট খারাপ করে ইত্যাদি। এখন মা’র অভিযোগের তালিকায় যুক্ত হয়েছে, টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক।
বাড়ির জমিজমা আত্মীয়স্বজনকে বর্গা দেয়া। এখন তাদের গ্রামের বাড়িতে মেজোফুপা থাকেন। আশপাশের জমি তিনিই বর্গা নিয়েছেন। আট-দশদিন বেড়ানোর পর বিদায় নেয়ার সময় মন খুব খারাপ লাগে।
গ্রামে রাস্তা-ঘাট চেনা সহজ। মূল রাস্তা একটাই। বিষয়টা মজার। রাস্তা থেকে সরুপথ প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে মিশেছে। কমবেশি সব বাড়িতেই বেড়া দেয়া। পাটখড়ি কিংবা আড়াআড়ি বাঁধা বাঁশের ওপর শুকনো কলাপাতা ঝুলিয়ে বেড়া বানানো হয়েছে। দু’একটা বাড়িতে বাঁশের বেড়া দেখেছে। কোথাও কোথাও খেজুর গাছের শুকনো ডাল বাঁশের ফালিতে বেঁধে আড়াল তৈরি হয়েছে। কিন্তু শহরে যেমন গেটে তালা দেয়া থাকে, সারা গ্রামে তেমন কোথাও নেই। গ্রামে নিজেকে অনেক স্বাধীন মনে হয়। বাবাকেও শহুরে মনে হয় না। সবসময় হাসি খুশি, কতো সহজে কতো কিছু মেনে নেন।
গ্রামের অন্ধকার চোখে সয় না। রাস্তায় বাতি না থাকলেও পথ চলতে গ্রামের কারো অসুবিধা হয় না। প্রথম প্রথম বেশ অবাক হতো। বাবা বলেছেন, ওরা অভ্যস্ত। গ্রামে থাকলে তুমিও পারবে। চোখ সয়ে যায়। তবে অনেকেই টর্চ ব্যবহার করে। কিন্তু একবার বিদ্যুৎ গেলে আর আসতে চায় না। এই সমস্যা ঢাকায়ও। শহরেই যখন এ অবস্থা, গ্রামের অবস্থা ভালো হবে না, সেটাইতো স্বাভাবিক। এটাও মা’র একটা অভিযোগ।
মিতুটা হয়েছে মা’র মতো, একটু বেশি চুপচাপ। আজ সারা পথ কথা বলেনি। সারাক্ষণ বাইরের দৃশ্য দেখেছে। বাবা ঠাট্টা করেন, আমার মেয়েটা ভাবুক হবে। মিতুটা লজ্জা পায়।
শহর ছাড়িয়ে যাওয়ার পর দু’বার থামতে হয়েছিল। তখন আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। পড়ন্তবেলা। সূর্যরশ্মির ছটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করছে দেখে বাবা সবাইকে দেখানোর জন্য একবার থামলেন। দ্বিতীয়বার মা চা খেতে চেয়েছিলেন। মা সাধারণত বাইরের কিছু খান না। কিন্তু গ্রামে মায়েরও দুয়েকটা ব্যতিক্রম ঘটে। সুমন বেশ মজা পায়। সবাইকে অনেক বেশি কাছের মনে হয়। বাড়ির সামনে থামতেই ছোট-বড়ো কয়েকজন অন্ধকারে ছুটে এলো। কেউ কেউ তার সমবয়সী। গাড়ির আলোয় দুয়েকজনকে পরিচিত মনে হলো। বাবা নেমে দাঁড়াতে একজন এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন, ভাইজান কেমন আছেন? এইবার ম্যালাদিন পর আসলেন।
বাবা বললেন, ভালো। কেমন আছো ফজর আলি?
জি, আল্লাহপাক ভালো রাখছেন। তারপর ঘুরে মা’র পা ছুঁয়ে সালাম করলেন, ভাবীজান আস্তি কষ্ট হয় নাই তো।
মা মৃদুস্বরে কী যেন বললেন, সুমন ওপাশে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো না। মিতু তখনো ভেতরে বসা। সুমন এখন চিনতে পেরেছে, দাড়িওয়ালা লোকটা ফুপা। ইতোমধ্যে কুপি হাতে একজন মহিলা ঘোমটা টেনে মা’র পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ম্যাবাই ভালো আছো? মহিলার গলা খন্খনে। গাড়ির জানালায় উবু হয়ে মিতুকে ডাকলেন, মা বাড়ির ভেতরে আসো। ফুপা এসে সুমনের হাত ধরলেন, ক্যামোন আছো বা’জান।
জি ভালো। আপনি ভালো আছেন?
আল্লাহপাক যেমন রাখছে। খুউব ভালো লাগ্তিছে, তোমরা বাড়ি আইছো। এট্টু ঘোনো ঘোনো না আস্লি বাড়ির দিগ্ টান থায়ে না। তাছাড়া নিজিগি বাড়ি, দেইহা-শুন্যা না রাখ্লি মান্ষি মোন্দো ক’য়।
বাবা বললেন, সুমন তোমার মেজো ফুপা। চিনতে পারছো?
সুমন মাথা নাড়লো।

কিছুক্ষণের ভেতর সবাই বৈঠকখানায় গিয়ে উঠলো। দুটো স্যুটকেস এবং বাড়ির লোকদের জন্য আনা কাপড়চোপড়ের বড়ো ব্যাগগুলো ঘরে আনা হয়েছে। বৈঠকখানা ঘরের সাথে লাগানো, বারান্দার মতো লম্বা একটা ঘর। প্রথম দরজার দু’পাশে দু’টি করে জানালা। শেষের জানালায় কাঠের কঞ্চির একটা আধাআধি ভাঙা। একদিকের প্রান্তে একটা খাট পাতা। সম্ভবত কেউ থাকে। বিছানাপত্র গোটানো। একসারিতে কাঠের দুটো চেয়ার। অন্যপাশে একটা বসার বেঞ্চ। কোনায় একটা বেতের মোড়া। কয়েকজায়গায় বেত ছড়ে গিয়ে কাঠি বেরিয়ে এসেছে। ফুপা মোড়ায় বসলেন, বাবা চেয়ারে। মা আর মিতুকে মেজো ফুপু হাত ধরে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন।
বাবা অন্য ফুপু-ফুপাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন। ফুপাতো ভাইবোনরা দরজার আশপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে চেনে না। যদিও আগে কয়েকবার দেখেছে। এদের ভেতর ফারুক উঠানেই দাঁড়িয়ে আছে। রেহানা সবার ছোট, সবসময় ডান হাতের দুটো আঙুল চোষে। চেহারাটাও বোকা বোকা। কথাও বলে তেমন। সুমন ভাবে, ওর বোধ হয় আয়োডিনের অভাব আছে।
পাড়া-প্রতিবেশীদের দু’একজন টর্চ কিংবা হারিকেন হাতে আসতে শুরু করেছেন। এটা সমসময়ই দেখে এসেছে। বাড়ি এলে বাবা যেমন সবার খোঁজ-খবর নেন। তেমনি আত্মীয়-প্রতিবেশীরাও বাবা এলে দেখা করেন। যে ক’দিন গ্রামে থাকা হবে, এই আসা-যাওয়া চলতে থাকবে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর বৈঠকখানা জমজমাট হয়ে ওঠে। গ্রামে এলে খাওয়াদাওয়া সন্ধ্যায় সারতে হয়। যারা আড্ডায় আসেন, তারাও খাওয়া-দাওয়া সেরে আসেন। এদের কেউ কেউ বিভিন্ন উপলক্ষ করে সাহায্য, পরামর্শ চান। বাবা সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
বৈঠকখানায় বিদ্যুৎ বাতি জ্বলছে। বিস্তৃত উঠান ঘন অন্ধকারে ঢাকা। চলমান মানুষগুলোকে ছায়ার মতো মনে হয়। খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারলো না। ফুপু দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সুমনকে বললেন, আসো বাবা হাত-মুখ ধুইয়্যা ন্যাও। কতোদূর দ্য আইছো!
বাইরের অন্ধকারে কে একজন জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ফুপু কুপিটা মাটিতে রেখে বললেন, ফারুক সুমনের হাত-মুখ ধোয়া হইয়্যা গেলি ঘরে নিয়্যাসবি। খাবার দিছি, সেই কহোন খাইছে!
কুপির আলো পরিষ্কার মাজা পেতলের জগে প্রতিফলন ঘটায়। এসব দাদার আমলের জিনিস। গ্রামের অন্যান্য বাড়িতেও পেতলের থালা-বাসন, বদনা ইত্যাদি দেখেছে। কিছু কিছু আকারেও বেশ বড়ো। উঠানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ফারুক পানি ঢালে। সুমন উবু হয়ে যতোটা সম্ভব হাত-মুখ ভিজিয়ে নেয়। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ফারুক গামছা এগিয়ে দেয়। কুপিটা দপ্ দপ্ করে জ্বলছে, কিন্তু আলো বেশিদূর ছড়ায় না। আলোর বাইরে অন্ধকার আরো বেশি ঘন মনে হয়। নিজেকে সাহসী মনে করলেও এই অন্ধকারে সুমনের ভয় করে। ফারুক কথা বলে না, তা সত্ত্বেও ফারুকের উপস্থিতিই সুমনকে সাহসী করে তোলে।
ফারুক চার-পাঁচ বছরের বড়ো, কিন্তু এখনো স্কুলের গন্ডি ছাড়াতে পারেনি। ও অবশ্য ফারুককে সবসময় লেখা-পড়া করতেই দেখেছে। গ্রামে বড়ো বড়ো ছেলেমেয়েগুলো কতো ছোট ছোট ক্লাসে পড়ে! সুমনের স্কুলে এটা ভাবাই যায় না।
হাতমুখ ধোঁয়া হয়ে গেলে ফারুক তাড়া দেয়, বাড়ির ভিত্যারে চলো, খাবানা? মা ভাত দেছে।
এট্টু দাঁড়াও না। সুমন নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে।
ওর খুব ভালো লাগছে। বাড়ির পূর্বদিকে বেশ খানিকটা জমি। তারপরে বাঁশ ঝাড়। মাঝের এই খোলা জায়গার অন্ধকারে প্রচুর জোনাকি পোকা আলোর লেজ বানিয়ে ছুটছে। চেষ্টা করলেই ধরা যায়। কি নিরুত্তাপ আলো! ধরতে গেলে প্রায়ই হাতের তালুতে লেগে নিচে পড়ে যায়। লম্বাটে আকৃতির পোকার পেছনে আলো জ্বলে আর নেভে। হাতে তুলে নিলে কী চমৎকার হেঁটে বেড়ায়! যেনো বলতে চায়, দেখো আমি কতো সুন্দর। তোমাকে ভয় কী, তুমিতো আর আমাকে মারছো না।
জোনাকির পেছনে ছুটতে খুব মজা। প্রতিবার গ্রামে এলেই এসবের দেখা মেলে। আজ আসার সময় গাড়িতে বসেও দু’একবার চোখে পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারেই সুমন নতুন করে দেখে। এখন এমন হয়েছে, গ্রামের কথা উঠলেই এসব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর কেবলি হাতছানি দিয়ে ডাকে। কেমন যেনো রহস্যঘেরা পরিবেশ। বৈঠকখানায় বাবার গলা শোনা যাচ্ছে, ভেতর ঘরে মা-ফুপুর।
ফারুক তাড়া দেয়, খাওয়া হইয়্যা গেলি তোমারে নিয়্যা হাঁট্বানি। অ্যাহোন্ চলো।
ফারুক কথা বলতে গিয়ে তোতলায়। একসময় ওরা দু’ভাইবোন এ নিয়ে হাসাহাসিও করেছে। একবার মা ওদের কথা শুনে ফেলায় ধমক দিয়েছিলেন। এখন সে কথা মনে পড়লে লজ্জা পায়। কয়েকবার গ্রামে বেড়ানোর পর ফারুক আর ওর বড়ো ভাই কালামের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা জন্মে গেছে। গ্রামে এলেই কালাম-ফারুক যে যখন পারে সবসময় সাথে থাকে। কতো সময় কতো জায়গায় নিয়ে যায়।
মেজোফুপুর বাড়ি বলেশ্বর নদীর পাড়ে বইবুনিয়া গ্রামে। কয়েক বছর আগে বিশাল এলাকা ভাঙনে বিলীন হয়ে গেলে বাবার পরামর্শে সুমনদের বাড়ি এসে ওঠে। ওরা নয় ভাইবোন। ফুপার ব্যবসা ছিলো গ্রামে গ্রামে ঘুরে গাছ কিনে কেটে নিয়ে এসে বিক্রি করা। সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। অত্যন্ত কষ্টের কাজ। বাবার চেয়ে কম বয়স। অথচ পেশার কারণে শরীরে বাতের ব্যথা শুরু হওয়ায় এখন বর্গা নেয়া জমিতে কাজ করেন। ফুপা খুব ভালো মানুষ। সহজ-সরল। এতো সুন্দরভাবে গল্প করেন! কাজ করতে গিয়ে তাঁর যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিশেষ করে রাতবিরেতে চলা-ফেরা করতে গিয়ে যা দেখেছেন, সেসব গল্পের মতো শোনান। আবদারটা অবশ্য মিতুই করে। ভূতের গল্প শুনতে ভালো লাগে। ফুপার বলার ভঙ্গিটাও ভালো। মনোযোগ দিয়ে শোনে। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটায় মিতু। গল্পের মাঝে বারবার প্রশ্ন করবে। আর ফুপারও সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া চাই। গল্প বলতে গিয়ে ফুপা এমন হয়ে ওঠেন, যেনো তিনি সব জানেন।
রাত বেড়েছে। প্রতিবেশীরা যার যার মতো চলে যাচ্ছে। সুমন ঘরে গিয়ে ওঠে। মা-মিতু হাত-মুখ ধুয়ে খাটের ওপর বসা। ঘরের পেছন দিকে চাপকল আছে। বেশ খানিকটা জায়গা ঘিরে বাঁশের বেড়া দেয়া। ফুপু কাজ করতে করতে মা’র সাথে গল্প করছেন। কাজ বলতে মেঝেয় মাদুর বিছিয়ে খাবার সাজানো। ফুপুর দুই মেয়ে খাবার আনানেয়ার কাজ করছে। ছোট ছেলে লুৎফর পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
খেতে বসে সুমন অবাক হয়ে দেখলো, ফুপুর করিতকর্মায় এই অল্পসময়ে বিরাট আয়োজন। বরাবরই এটা দেখে এসেছে। সবসময়ই সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, কোনো ধরনের ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই গ্রামের বাড়িতে কতো সহজে, কতো তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যায়। অথচ ঢাকায় কাজের বুয়াকে এ জন্যে মা কতো বকাবকি করেন!
বাবা আর ফুপার সাথে সুমন খেতে বসে। ফুপু চাপাচাপি করায় মিতুও বসলো। এ সময় বাইরের ঘরে কার শব্দ পেয়ে ফুপু বলে উঠলো, কালাম আইছিস্। দেইখ্যা যা তোর মামা আইছে।
দরজার কাছে একটা কালো মুখ দেখা গেলো। বোঝা যাচ্ছে ঢুকতে লজ্জা পাচ্ছে কিংবা হাত-পা না ধুয়ে এ অবস্থায় ঢুকতে ভরসা পাচ্ছে না। কালাম ফুপার মেজো ছেলে। লম্বাটে মুখে আকর্ণ হাসি দিতে সাদা ঝক্ঝকে বড়ো বড়ো দাঁতগুলো অল্প আলোতেও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মামা ক্যামোন আছেন?
কালাম সুমনের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে হাসলো।
বাবা তখনো খেতে শুরু করেননি। মৃদু মাথা নাড়িয়ে বললেন, ভালো। তুমি কোত্থেকে আস্লা।
সুমন খেয়াল করে বাবা যেনো ফুপাদের মতো কথা বলছেন।
কুটি মেয়ার বাড়ি গেইছালাম সালিশ দেখ্তি।
বাবা ফুপার দিকে তাকায়। কিসের সালিশ?
ফুপা ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, ছত্তার চেয়ারম্যান রাস্তার গম চুরি কইর‌্যা জমিদারের হালটে লু’কয় রাখছেলো। রেজাউল মাস্টার দেখ্যা ফ্যাল্যায় নালিশ করছে। এইগুলন্ আসলে কিছু না, রেষারেষি। আসল কথা অলো ভোটে হাইর‌্যা চেয়ারম্যানের পাছ্ লাগছে।
বাবা খেতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে কালাম হাওয়া। এমনিতেও বাবার সামনে ও খুব একটা স্বস্তি পায় না। সম্ভবত এ কারণেই বাবা বলা সত্ত্বেও ফারুকও খেতে বসেনি। ফুপুও জোর করেনি।
খাবার সময় বাবা প্রয়োজন না পড়লে কথা বলেন না। সবাই নীরবেই খেয়ে যাচ্ছে। বাবা বললেন, এ জন্যই রাস্তাঘাটের এই হাল্। অ্যামোন থাক্লি সামনের বন্যায় রাস্তা থাকবে না। তখন সবাইরে নিয়া গ্রামে আসাই মুশকিল হইয়া যাবে।
বাবার কথায় সুমনের বুক কেমন করে ওঠে।
ফুপা মুখের চাবানো ভাত ঢোক গিলে নামিয়ে দিয়ে বলেন, রাস্তাঘাট থায়ে কি কর‌্যা? যা গম আসে সব তো চেয়ারম্যান মেম্বাররা নিজিরাই খাইয়্যা ফ্যালে।

খাওয়ার পাট শেষ হতে মাঝরাত অবধি গড়ালো। সবাই কম-বেশি ক্লান্ত। গ্রামের মানুষ একটু আগেই ঘুমায়। ফুপুর ছোট মেয়ে রেহানা আর ছোট ছেলে লুৎফর সেই কখন থেকে ঝিমাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভেতর শোয়ার আয়োজন হতে লাগলো। সুমন বৈঠকখানায় কালাম-ফারুকের সাথে ঘুমাবে। ঢাকায় রাত বারোটার আগে ঘুমাতে পারে না। কখনো কখনো আরো দেরি হয়। আজ ক্লান্ত লাগছে; কিন্তু এখনি শুয়ে পড়তে মন চাইছে না। ফারুক খেয়েদেয়ে পড়তে বসেছে। ও পড়ালেখায় কালামের চেয়ে ভালো।
কালামের সাথে বাইরে এসে দাঁড়ালো। উঠানের এক কোণে কুটার পালা। জায়গাটা অন্ধকার। কালামের ভ্রুক্ষেপ নেই। পালার গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে সুমনকেও বসতে বললো। আকাশে বিক্ষিপ্ত মেঘ। কিছুক্ষণ পর পর চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে। বাতাস বইছে না। গুমোট গরম। সেই খেতে বসা থেকে সুমনের মন আকুল হয়ে ছিলো একটা কথা শোনার জন্য। এতোক্ষণে বোধ হয় সুযোগ এলো।
কালাম ভাই, সালিশিতে শেষ পর্যন্ত কী হলো?
কী আর হবে? যা হবে তাতো আগেই জানতাম। কুটি মেয়া কলো ছত্তার চেয়ারম্যান্রে একঘরে কোরতি হবে। কিন্তু ওই কথা শুনলি আমাগে চলবে ক্যান্। গম আনে চেয়ারম্যান, কাজও দেয় চেয়ারম্যান। চুরি করুক আর যাই করুক। কিছু কাজতো হয়। শরিকির গন্ডগোল, আমাগে ওপর দিয়্যা চালাতি চায় কুটি মেয়া। আমরা তো জানি, যহন খাতির ছেলো তহন তো কুটি মেয়া কোনো কথা কয় নাই। ছত্তারমেয়া চেয়ারম্যান তো এই প্রত্থম না। এর আগেও তিন তিনবার হোইছে। জমিদারের ভাঙা ডোয়ায় মনসুর সোনার কলস পাইছেলো। কুটিমেয়া, ছত্তারমেয়ার লোভে পইড়্যা বেচারা শ্যাষ্ পর্যন্ত কি ভোগটাই না ভোগ্লো। এইগু‘ল হলো গেরামের পলিটিকস্। তুমি শহরের মানুষ বোঝ্বা না।
শহরের মানুষ বলায় সুমনের কষ্ট লাগে। কালাম বোধ হয় তাকে পর ভাবছে। কালামের সাথে বয়সের ব্যবধান সাত-আট বছরের; কিন্তু ঘনিষ্ঠতার কারণে তুমি বলে। ফারুক কালামের ছোট। ওদের বড়ো দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। কালাম উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে নাই। ফি বছর পরীক্ষা দেয়; কিন্তু পাস করে না। ওর অভিযোগ মাস্টাররা তাকে নাম্বার দেয় না। কেন দেয় না, এ উত্তর কালামও জানে না। কিন্তু ওর অভিযোগ একটাই। ফুপার কাছে শুনেছিল, কালাম এখন রাজনীতি করে।
সুমনের মনে এখন অন্য চিন্তা। জমিদারবাড়ির কথা সে আগেই জানে। কিন্তু কখনো দেখার আগ্রহ হয়নি। এবার গ্রামে এসে কালামের কথা শুনে দেখার আগ্রহ দানা বেঁধেছে। সেও বুঝতে পারে আগ্রহটা বাড়ছে।
কালাম জমিদারের বাড়িটা কি খুব বেশি দূরে? মানুষ থাকে?
দূরে না, দুই গেরাম পরে।
সুমনের জবাবের অপেক্ষা না করে কালাম বলে, জমিদার বাড়িতে দ্যাহার কিছু নাই। মানুষ থায়ে না, চোর-ডাকাত থায়ে। এহোন অবশ্য কেউ থায়েটায়ে না। কয়বার পুলিশ আস্যা কতোগুলরে ধর‌্যা নিয়্যা গেইছেলো। তারপর দ্য আর কেউ যায়-টায় না। মাহামুদকান্দা গেরামে গেইছো কখনো? হাঁট্যা গেলি অ্যাক ঘন্টা লাগে। ভ্যানেও যাওয়া যায়। তয় ম্যালা ঘুরতি অয়।
না, যাই নাই।
যাবা নিকি দেখ্তি? কতোগু’লন খালি ঘর পইড়্যা রইছে। জঙ্গলে ভইর‌্যা গেইছে সবজাগা, সাপখোপের আস্তানা। বিরাট দালান। সব ভাঙ্যা পড়তিছে অ্যাহোন। যার যহন দরকার ইট খসায় নিয়্যা যায়। আটানব্বইর মোতো আর‌্যাট্টা বইন্যা হোলি আর কিছু থাকবে না। তয় দালান দেইখ্যাই বোঝা যায় একসোমা ম্যালা দাপট ছেলো। কতো যে অত্যাচার করছে শুনছি! মানুষ মার‌্যা গাছে ঝু’লয় রাখ্তো। কুয়র মদ্দি ফ্যাল্তো। গেরামের মানুষ নারান জমিদাররে যোমের মোতো ভয় পাতো। নারান জমিদার ডুব্যা মরছেলো। তুমি বাবারটেন (বাবার কাছে) শুইনো, নারান জমিদারের হিস্টিরি। এই গেরামে বাবার চে’ ভালো আর কেউ জানে না।
কাল তোমার কোনো কাজ আছে?
ক্যান্ যাবা?
তুমি যাবে?
কালাম এক গাল হেসে বলে, কাইল আমার কোনো কাজ নাই। তাছাড়া তোমারে নিয়্যা ঘোরাওতো এট্টা কাজ।
রাত বেশ গভীর হয়েছে বোঝা যায়। সন্ধ্যার জোনাকিগুলো এখন নেই। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কোথাও একটা ঝিঁ ঝিঁ বিরতিহীন ডেকে যাচ্ছিলো, সে শব্দও থেমে গেছে। মৃদু বাতাস বইছে। কুটার পালার গায়ে এক ধরনের র্স র্স শব্দ। কালাম টর্চ জালিয়ে দু’পাশ একবার দেখে নিয়ে নিরুত্তাপ গলায় বললো, এই গরমে মাঝে-মধ্যি সাপ-টাপ বারোই (বের হয়ে) আসে।
সাপের কথায় শরীর র্শি র্শি করে। হয়তো ভয় পেয়েই সুমন বলে ওঠে, চলো ঘরে যাই।
কালামের নড়ার কোনো লক্ষণ নেই। সুমনের উৎকণ্ঠা হয়তো খেয়াল করেনি। একই গলায় বলে, ভয়ের কিছু নাই, সাপ মান্ষির কাছে আসে না।
এতে ভয় দূর হয় না। সুমন আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে। আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। দু’জন আবার চুপচাপ। কালাম আপনমনে কি একটা সুর ভাঁজে। সুমন ধরতে পারে না। পল্লীগীতি-টিতি হবে।
অকস্মাৎ কালাম বলে ওঠে, নারান জমিদারের শরিকরাও খুব অত্যাচার করতো।
রাজবাড়ীর মন্দিরের পিছোনে অ্যাকসোমায় মোটা অ্যাট্টা শিমুল গাছ ছেলো। তোমারে দ্যাহাবো। গাছটা অ্যাহোন্ নাই। জমিদার বাড়ির পাশদ্য যাওয়ার সোময় জ’ত হাতে নিয়্যা ছাতি (ছাতা) নামায় যাওয়া লাগতো। জমিদারের এট্টা প্রজা ছেলো শ্যাখোদ্দি। খুব চ্যাতা। বাপ ছেলো জমিদারের লাঠ্যাল সরদার। চরের অ্যাক্ গন্ডগোলে সড়কির ঘায়ে মর‌্যা যায়। ভাদ্রো মাসের অ্যাক্দিন শ্যাখোদ্দি জমিদার বাড়ির পাশদ্য যাতিছেলো। জ’ত হাতে নিতি মোনে ছেলো না। নেতাই ঘোষ দেইখ্খা নালিশ কর‌্যা দেয়। নেতাইর সাথে শ্যাখোদ্দির বাদাবাদি ছেলো। জমিদারের লাঠ্যাল শ্যাখোদ্দিরি ধইর‌্যা নিয়্যা অ্যাক্কোপে মাথা নামায় দেয়।
চলো যাই। আইজ আর ব’সবো না। তুমি কেলান্তো।

পরদিন ঘুম ভাঙে ডাকাডাকিতে। সেই বুড়ি মহিলাটা এসেছে। বাবার নাম ধরে ডাকছে। চোখ মেলে দেখে সকালের স্নিগ্ধ আলোয় চারদিক ভরপুর। গোয়ালঘর থেকে গরুগুলো বের করা হয়েছে। শুয়ে থেকেই জানালা দিয়ে দেখতে পায় ফুপা গরুর দুধ দোয়াচ্ছেন। ছোট বালতিতে দুধের সরুধারা তীক্ষèভাবে পড়ে প্রতিবারেই শব্দ উঠছে, চিন্ন্, চিন্ন্। উঠানে মিতু রেহানার সাথে বসে গল্প করছে। গ্রামের সকাল সত্যিই মন ভালো করে দেয়। গাড়ির শব্দ নেই। রাস্তা দিয়ে যাওয়া দু’একটা সাইকেলের টিং টিং শব্দ বৈঠকখানা থেকে শোনা যায়। সে শব্দও যেনো ঢাকার সাইকেলের মতো কর্কশ না।
সুমন হাতমুখ ধুয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসে। সে জানে, এই বৃদ্ধা মহিলার দুই ছেলেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একই সাথে যুদ্ধ করেছেন। সে জন্য বাবাকে তিনি নিজের সন্তানের মতো মনে করেন। বাবা বাড়ি এলে দেখা করবেনই। যতোদিন বাবা থাকবেন, নিয়মিত তিনি আসবেন। এবং প্রায়ই বিভিন্ন পিঠা বানিয়ে হাতে করে নিয়ে আসবেন। বাবাও গ্রামে এলে বৃদ্ধার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। আবার ঢাকা ফেরার আগে জোর করে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দেন। আত্মসম্মানজ্ঞান বুড়ির খুব প্রখর। প্রতিবারই বাবাকে বুড়ির ভাষায় বলতে হয়, আমি তো তোমার ছাওয়াল। তোমার জুন্যি কতো কিছু কোরতি ইচ্ছা করে। সবসময় তো আসতি পারি না। তুমি যদি এইটুক্ও আমারে কোরতি না দ্যাও, তা’লি খুব কষ্ট পাবো।
বাবার কথায় বুড়ির চোখ জলে ভরে ওঠে। আর কোনো কথা না বলে বাবার দেয়া টাকা কোমরে গুঁজে নেয়।
বুড়ি চোখে খুব একটা দেখেন না। কিন্তু চশমাও পরেন না। বাবা অনেকবার বলেছেন। বাবার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, আমি আর কয়দিন। মা’বুদ খুউব ভালো রাখছে। কোন্দিন আস্যা শুন্তি পাবা, এই বুড়ি আর নাই। এই বলে বুড়ি নিঃশব্দে খানিকটা হেসে নেয়। খুব পান খায়। ঠোঁট লাল। সামনের দাঁতগুলো এখনো আছে। দাঁতগুলো বড়ো বড়ো। ফাঁকে ফাঁকে পানের ঘন দাগ। হাসলে রেখাবহুল মুখ এতো সুন্দর হয়ে ওঠে যে, বুড়িকে না দেখলে জানা হতো না।
সুমনকে দেখে বুড়ি কাছে ডাকে। বুড়ির এতো আন্তরিকতাই সুমনকে লজ্জায় ফেলে দেয়। বাবা ওর হাত ধরে এগিয়ে দেন। মাথায় মুখে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, আমার সোনাচান দাদা। বিদ্যা-বুদ্ধিতি অনে-ক বড়ো অ’বা।
বুড়ি নিজের মতো করে আরো নানাকথা বলে যায়। সুমন লক্ষ্য করেছে বুড়ি সবসময় একই কথা বলে। যে ক’দিন গ্রামে থাকবে; সুমনকে দেখলে কাছে ডেকে এ কথাগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলবে। এইসব অতিপ্রশংসার জবাব সুমন জানে না। বাবা কিংবা মা কখনো এভাবে প্রশংসা করেন না। তাই খুব লজ্জা পায়।
কিছুক্ষণ পর ফুপু এসে দরজায় দাঁড়ান। নাশতা খেতে ডাকেন। খাওয়া-দাওয়ার পর্বটা সবসময় পুবপাশের বারান্দায় সারা হয়। বারান্দার একপাশ সম্পূর্ণ খোলা থাকায় দিনের বেলা আলোর অভাব ঘটে না। রাতে রয়েছে বিদ্যুৎবাতি। সুমন বাবার সাথে মাদুরে গিয়ে বসে। রান্নাঘরটা আলাদা। কিন্তু সেখানে রান্নাবান্নার কোনো কাজ হয় না। ঘরটায় রয়েছে একটা ঢেকি। সে কখনো এই ঢেঁকির ব্যবহার দেখেনি। কিন্তু দেখেছে কিভাবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামে এখন ঢেঁকির ব্যবহার নেই। সবাই রাইস মিলে ধান ভানায়। কিছুদূরে রয়েছে ভোট স্কুল নামে পরিচিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই স্কুলের মাঠের অপরপ্রান্তে কেউ একজন রাইস মিল বসিয়েছে। সবাই সেখানে ধান নিয়ে যায়।
তাদের রান্নাঘরের বেড়া পাটখড়ির এবং চালা খড়ের। খড়কে এখানে কুটা বলে। ঘরটা মূলত ব্যবহৃত হয় পাটখড়ি এবং জ্বালানি কাঠ রাখতে। রান্নার কাজ সারা হয় এই বারান্দা সংলগ্ন নিচের জায়গায়। পাটখড়ির বেড়া দিয়ে জায়গাটুকু উঠান থেকে আলাদা করা হয়েছে।
ফুপুর হাতে দুধের বালতি দিয়ে ফুপাও খেতে বসেন। ফুপু দুধটুকু মাটির হাঁড়িতে ঢেলে চুলায় বসিয়ে দেন। মা ফুপুকে পরিবেশনে সাহায্য করছেন, ফুপাকে ভাতের থালা এগিয়ে দেন। সেই বৃদ্ধাও খেয়ে যাবে, চুলার পাশে একটা পিঁড়িতে বসে আছে। মিতু তখনো রেহানার সাথে গল্প করে যাচ্ছে। বোধ হয় মা’র সাথে বসবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে কালামকে দেখেনি। ফুপুকে জিজ্ঞেস করতে জানালেন, তাকেও বলে যায়নি। এই কথার মাঝেই কালাম এসে হাজির। ফারুককে বই পড়তে দেখেছিলো; এখন জমিতে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে, চলে আসবে তাড়াতাড়ি। কালাম পরে এলেও তাদের সাথেই খাওয়া শেষ করলো।
বেরোবার সময় সুমন বাবাকে জানালো, সে কালামের সাথে জমিদার বাড়ি দেখতে যাচ্ছে। বাবা বললেন, জমিদার বাড়িতে এখন কিছু নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। যতোটুকু আছে, ঝোপ-জঙ্গলে তাও ঢেকে গেছে। যাওয়াটা নিরাপদ না।
কিন্তু বারণ করলেন না। একটু থেমে বললেন, বেশি ভেতরে যেয়ো না। আশপাশ দেখে ঘুরে চলে এসো। কালামের হাতে কিছু টাকা দিলেন।

রাস্তায় উঠে কালাম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটা ভ্যান ডাক দিলো। সুমন বললো, তুমি তো বললে খুব বেশি দূরে না, তা হলে চলো হেঁটে যাই।
কালাম বললো, বেশি দূর না, কিন্তু তোমার কষ্ট হবে। আমরা মাইলির পর মাইল হাঁটতি পারি। তুমি পারবা না।
সুমন ভ্যানে উঠে বসে।
গতবছর যখন এসেছিল, তখন রাস্তা এতো চওড়া ছিলো না। কালাম বলে, খালের মাটি কেটে রাস্তা বড়ো করা হয়েছে। কোথাও কোথাও নতুন করে ইট বিছানো হয়েছে। ওদের ভ্যান ভোটস্কুল পেরোচ্ছে। নির্বাচনের সময় এখানে ভোট নেয়া হয়। তাই স্কুলের নাম ভোটস্কুল। দশ-পনের মিনিট পর ওরা একটা কালভার্টে উঠে পড়ে। দু’পাশের রেলিং ভেঙে রড বেরিয়ে আছে। রাস্তাটা এবার ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। ভ্যান ডানপথ ধরলো। আবার কালভার্ট। তবে এটার অবস্থা আগেরটার চেয়ে ভালো। এ পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাটাই খালের পাশ দিয়ে। আরো কিছুদূর এগোলে রাস্তার বামপাশে একটা কবর, বেশ পুরনো। প্লাস্টার খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। দেয়ালের গায়ে বসানো পাথরের টাইল্সে বাংলা সন-তারিখ খোদাই করা। পড়া যায় না। এতোক্ষণে খেয়াল করে গাছপালা বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। ডানপাশে খাল, বাঁ পাশে জঙ্গল। ভ্যান এবার বাঁ দিকের একটা সরুপথে নেমে পড়লো। রাস্তার এই শাখা ঘন হয়ে ওঠা গাছপালার ভেতরে ঢুকে গেছে। পথটা জঙ্গলাকীর্ণ। কোথাও বাঁশের ঝাড় উপুড় হয়ে সমস্ত রাস্তাটাই ঢেকে দিয়েছে। ভ্যানে বসে মাথা নিচু করতে হয়। পুরনো আমলের ইটের পাঁজা আশপাশে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। ইটগুলো বেশ সরু ও চ্যাপ্টা, আয়তনে ছোট। বড়ো বড়ো গাছের ফাঁকে ঝোপঝাড়গুলো বেশ ঘন। একটা জায়গা কিছুটা ফাঁকা, বড়ো গাছপালা কম কিন্তু নাম না জানা বিভিন্ন লতাজাতীয় গাছ ঝোপের আকৃতি নিয়ে জায়গাটা দুর্গম করে তুলেছে। একটা দালান, খুব একটা বড়ো না। দেয়ালগুলো দুই-তিন হাত পুরু। ছয়-সাতটা কক্ষ। ছাদ নেই। দেয়ালগুলোও প্রায় ভেঙে পড়েছে। দালানের পেছন দিক এপাশ থেকে বোঝা যায় না।
কালাম, আমরা কী চলে এসেছি?
না, আরো সামনে এগিয়ে ডানদিক্। জমিদার বাড়ির পাশে একসোমা নদী ছিলো। এহন শু‘গয় গেইছে। তয় বুজ্তি পারবা, নদীর জাগাডা খুব নিচ্যা।    (চলবে)

SHARE

Leave a Reply