দোতলা বাড়িটার সামনের অংশজুড়ে দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগানটা সহজেই যে কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাগান আলো করে টকটকে লাল গোলাপ ফুটে আছে বেশ কিছু। একটা বোগেনভেলিয়া ও মাধবীলতার ঝাড় বাড়িটার সৌন্দর্যকে যেন বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে। সাজানো-গোছানো বাগানটা বাড়ির মালিকের সৌন্দর্যবোধ আর শিল্পমনের স্বাক্ষর বহন করছে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে বাগানটা দেখে নিয়ে ডোরবেলের সুইচে হাত রাখলেন লায়লা চৌধুরী। ভেতরটা রীতিমতো কাঁপছে। ভেতরের পরিবেশ কেমন হতে পারে ভাবতে ভাবতে আবার চাপ দিলেন ডোরবেলে। নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালালেন আবারও।
মাহি বাবা, দেখতো কে এলো? কলিংবেলের টিউন শুনে কিচেন থেকে ছেলের উদ্দেশে বলেন শামা। মর্নিং স্কুল হওয়ায় দুই ভাইবোন ক্লাস শেষে দ্রুত বাসায় চলে এসেছে আজ। পড়ার টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক আর বাবার দেয়া পড়াগুলো রেডি করছিল ওরা। বাবা আব্দুস সালাম সাহেব অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন দুই ছেলেমেয়ের পড়া রেডি করে দেন। মায়ের কথায় পড়ার টেবিল ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় মাহি। আইহোলে উঁকি দিয়ে লায়লা চৌধুরীকে দেখে দরজা খুলে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে-
‘আরে খালামণি যে! আসসালামু আলাইকুম।’ মাহির কণ্ঠস্বর কানে যেতেই চমকে ওঠেন তিনি।
আসুন, ভেতরে আসুন- বলতে বলতে লাজুক হেসে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল ও।
ওর হাসিভরা মুখটা যেন তার বুকে টর্পেডো হয়ে বিঁধল। ভেতরে ঢুকতেই রান্নার সুঘ্রাণ এসে ধাক্কা দিল নাকে। সারা ফ্ল্যাটে মৌ মৌ করছে সেই ঘ্রাণ। শামার রান্নার হাত অসম্ভব ভালো, ভাবতে ভাবতে একটা সোফায় বসেন তিনি। ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দিয়ে মাকে খবর দিতে ভেতরে চলে গেল ছেলেটা। উৎকণ্ঠা কমাতে চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলেন লায়লা চৌধুরী। হঠাৎ দেয়ালে ঝুলানো হাতে আঁকা একটা ক্যালিগ্রাফি দৃষ্টি কাড়ল তার। সদ্য ঝোলানো ক্যালিগ্রাফির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন অপরূপ কারুকার্যে খচিত কালো জমিনে সোনালি কালিতে ফুটিয়ে তোলা অক্ষরগুলোকে। ক্যালিগ্রাফিটির নিচে লেখা তারিখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আজ সকালেই শেষ করা হয়েছে এটা। হঠাৎ কারো কথায় তিনি সচকিত হয়ে ওঠেন। খালামণি কী দেখছেন অমন করে? পেছন ফিরে দেখেন ক্লাস সিক্সে পড়–য়া নিশাত টি-টেবিলে নাশতার ট্রে রাখতে রাখতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলে উঠল, ক্যালিগ্রাফি দেখছেন? কি লেখা জানেন? হু বলে একটু মাথা নাড়ালেন তিনি। ‘ইন্নাল্লাহা মা’আস সাবিরিন। থেমে থেমে আরবি লেখাগুলো উচ্চারণ করলো ও। সাথে অর্থও- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। ‘খুব সুন্দর তাই না খালামণি! আব্বু আজ সকালেই শেষ করেছেন। আব্বু না খুউব সুন্দর ক্যালিগ্রাফি আঁকতে পারেন। আদুরে গলায় কথাগুলো বলতে বলতে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল মেয়েটা। ওর টোল পড়া মুখের দিকে চেয়ে মনটা আবার কেমন করে উঠল। হাত ধরে টানতে টানতে মেয়েটা ওকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললো- খালামণি পুডিংটা আমি আব্বুর জন্য নিজ হাতে করেছি। একটু খেয়ে দেখেন না কেমন হয়েছে? আব্বু… আবারো খচ করে একটা কাঁটা যেন বিঁধে গেল লায়লা চৌধুরীর বুকের মাঝে। মেয়েটির জোরাজুরিতে কোনো মতে এক চামচ পুডিং মুখে দিলেন তিনি। বাষ্পকুল স্বরে বললেন,
– ‘খুব মজা হয়েছে মামণি। চল তোমার আম্মুর কাছে যাই।’
ঘামে ভেজা কপালটা শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে দরজার পর্দা টেনে ভেতরে প্রবেশ করলেন শামা। ওর পাশে বসতে বসতে বললেন- একটু দেরি করে ফেললাম, আপা। ওর বাবা আবার চিংড়ির কাটলেন খুব পছন্দ করে। গতকাল রাতে একগাদা চিংড়ি এনে বললো, কাটলেন বানাতে। রাতে কুটতে বাছতে সময় কাভার। তাই এখন বানাচ্ছিলাম। এই হরতালে দিনেও কাজ শেষ হয় না মাহির বাবার।’ হাসতে হাসতে একনাগাড়ে বলে গেলেন শামা। লায়লা চৌধুরী হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকলেন শামার চেহারার দিকে। মনে মনে আওড়ালেন,
– ‘এরা কি তাহলে কিছুই জানে না। ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠেছেন তিনি। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। অসম্ভব অস্থির আর অসহায় লাগছে নিজেকে। ছোটবেলা থেকে দুই ফ্যামিলিকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দেখেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পরও যে আন্তরিকতায় একটু ঘাটতি আসেনি। তাইতো খবরটা শুনে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। ছুটে এসেছেন। কিন্তু… কৌতূহল চাপতে না পেরে অনেক কষ্টে বললেন,
– ভাবী! আপনি কিছু শুনেননি? শামা বিস্মিত গলায় বললেন,
– কী শুনব আপা? লায়লা অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির রেখে বললেন,
– ‘এখনি একটু হাসপিটালে যেতে হবে ভাবী! আপনি সব গুছিয়ে নিন।’
হসপিটাল! হসপিটাল কেন? কেমন যেন আর্তনাত করে উঠলেন শামা। এ সময় বেজে উঠল শামার মোবাইলটা। খুব দ্রুত ছেলেমেয়ে দুটোকে বাসায় রেখে লায়লার সাথে বেরিয়ে পড়েন শামা। বের হওয়ার সময় আবারো লায়লা চৌধুরীর চোখ ছুঁয়ে যায় দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফিটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন তিনি,
– ‘হে আল্লাহ। আমাদের ধৈর্য দান করো! তুমি’। চমকে ওর দিকে তাকালেন শামা। শামার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলেন লায়লা চৌধুরী।
সারাটা পথ কোনো কথা বলেননি দু’জন। শামার ব্রেনের সার্কিটে সার্কিটে হাজার মাইল গতিতে বয়ে চলছে যেন টর্নেডো। মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে অজানা আশঙ্কায়। বারবার মন চাইছে লায়লা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে ওকে? কিন্তু কথা বুক ফুলে মুখে উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছেন না। পাছে কোন চরম সংবাদ শুনতে হয়। মাহির বাবার ফোন বন্ধ। বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে। আল্লাহকে ডাকতে থাকেন ও ট্যাক্সিতে একবার লায়লা চৌধুরী তার হাত দুটো চেপে ধরেছিলেন গভীরভাবে। কিছু যেন বুঝাতে চাইলেন ওকে। কিন্তু শামা কিছুই বুঝতে পারেন না। বোবা দৃষ্টিতে লায়লা চৌধুরীর দিকে চেয়ে থাকেন। রাস্তার জ্যাম ঠেলে যখন তারা হসপিটালের বারান্দায় পা রাখলেন তখন ঘড়ির কাঁটা চারটা ছুঁই ছুঁই। প্রচন্ড ভিড় উপছে পড়ছে। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই ওদের দেখে সরে জায়গা করে দিল লোকগুলো। সামনে তাকিয়ে যা দেখলেন তার চেয়ে সমস্ত পৃথিবীটা ভেঙে একাকার হয়ে গেলেও এতটা আবাক হতেন কি না তিনি জানেন না। ওর সব আশঙ্কাকে বাস্তবে পরিণত করে চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। লায়লা চৌধুরীর মুষ্টিবদ্ধ হাতের মধ্যে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ না!… না! … বলতে বলতে ঢলে পড়লেন শামা।
চোখ খুললেন তিনি। হঠাৎ সব মনে পড়ে যেতে তাড়াক করে লাফিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলেন শামা। মাথার কাছে বসে আছে মাহি আর নিশাত। কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে দুই চোখের কোল। মাকে চোখ খুলতে দেখে জড়িয়ে ধরল দুই ভাইবোন। ওদের হাত ছাড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়ালেন শামা। আস্তে আস্তে সামনে গিয়ে বসলেন। ঘোর লাগা চোখে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলেন সব। লোবান আর আতরের গন্ধে ভরে আছে চার পাশ। কারা যেন সুর করে কুরআন পড়ছে। চারদিকে অনেক লোক ফিস ফিস করে কথা বলছে কেউ কেউ। বুঝিবা একটু আওয়াজ হলেই ঘুম ভেঙে যাবে কারো। কে যেন বলে উঠল- আহারে সালামের মতো মানুষটাকে পুলিশ এভাবে গুলি করল? চমকে মহিলার দিকে তাকালেন শামা। সমাজের কোনো অন্যায়ই মানতে পারতেন না সালাম। সবসময় অবস্থান করেছেন ন্যায়ের পক্ষে। তাই এভাবে? আর ভাবতে পারেন না শামা। বড় ভাইয়া এসে শেষবারের মতো চেহারাটা দেখালেন তাকে। তারপর নিয়ে চললো কফিনটা। ও বাধা দিত চাইল…. কিন্তু সব শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। সারা দুনিয়া ফাঁকা হয়ে গেল তার সামনে। মলিন হয়ে গেল পৃথিবীর সব সৌন্দর্য। সালাম ওকে রেখে এভাবে চলে গেল! বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। যেন পাথর হয়ে গেছেন। তার সমস্ত শক্তি বিকল হয়ে গেছে। কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরল। চারিদিকে কান্নার অস্পষ্ট আওয়াজ। নানীর কোলে অনবরত ফোঁপাচ্ছে নিশাত। থেকে থেকে বলছে- ‘আমার আব্বু এমন কী করেছে যার জন্য এভাবে তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো। এখন কে আমার পড়া তৈরি করে দেবে? আমাকে গল্প শোনাবে? বেড়াতে নিয়ে যাবে?’ ওর কান্নায় পরিবেশ আরো ভারী হয়ে ওঠে। আর মাহি মায়ের পাশে বসে ফুলে ফুলে কাঁদছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন শামা। আহ! ও যদি একটু কাঁদতে পারত। ওর বুকে জমানো বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ যদি পারতো এ পৃথিবীটাকে দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে দিতে। তাহলে বুঝি বুকের জ্বালা একটু কমতো। তার আদরের মাহি নিশাত- কী হবে ওদের? হঠাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল সবকিছু।
পাঁচটা মাস কেটে গেছে। শামার মনে হয় ওর অনুভূতিতে একেকটি দিন যেন হাজার বছরের সমান। পনের বছর একত্রে বসবাসের মজবুত রশিটা যে এভাবে দুই টুকরো হয়ে যাবে তা কি তিনি কখনো কল্পনা করতে পেরেছিলেন? প্রতিটি রাত কাটে তার অসহ্য যন্ত্রণায়। বাচ্চা দুটোর দিকে চেয়ে কাটে নির্ঘুম রাত। কান্নায় ভিজে ওঠে মখমলের জায়নামাজের সবুজ জমিন। ছেলেমেয়ে দুটো যেন এ ক’দিনে অনেক বড় আর বুঝদার হয়ে উঠেছে। মায়ের পাশে ছায়ার মতো লেগে থাকে। যা বলে চুপ করে তাই শোনে। খাবার টেবিলে বসলে নিশাতটার ঝামেলার অন্ত ছিল না। অথচ এখন যা সামনে পায় চোখ বুজে সব খেয়ে উঠে পড়ে। কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেছে বাচ্চা দুটো। আগের মত খুনসুটিও করে না। স্কুলের সময় স্কুলে যায়। আর যতটা সময় বাসায় থাকে পড়ার টেবিলেই থাকে। ওদের মলিন মুখ দুটো দেখে তার বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। একাকিত্ব যেন আরো নিবিড় করে আঁকড়ে ধরে তাকে।
তন্ময় হয়ে কুরআন পড়ছিলেন শামা। ছেলেটা পাশে বসে বসে শুনছে। তার পড়া শেষ হলেই মায়ের হাত দুটো সজোরে চেপে ধরে বলে ওঠে মা কুরআন কে নাজিল করেছেন?
শামা অবাক হয়ে ছেলের চিবুক নাড়া দিয়ে বলেন- কেন বেটা তুমি জান না! মুরুব্বিদের মত চোখ-মুখে গাম্ভীর্য টানে ছেলে বলে,
– জানি তো, তাও তুমি বল না! মুচকি হেসে শামা বলেন,
– তোমাকে, আমাকে যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তিনিই কুরআন নাজিল করেছেন।
মাহি বলে, মা যিনি কুরআন নাজিল করেছেন তিনিই আমাদের সবচেয়ে বড় অভিভাবক তাই না?
-হ্যাঁ তাই তো, বাবা।
আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন। তাহলে তুমি এত কষ্ট পাও কেন? ক্লাস এইটের ছেলের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে শামা ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন।