হেলাল আনওয়ার#
পাখা হাতে রিতু দাদুকে বাতাস করতে থাকে। বেশ গরম পড়ছে। ভ্যাপসা গরমে সবাই অতিষ্ঠ। বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং শিশুদের জন্য দুর্ভোগ বেড়ে যায়। পরনির্ভরশীল হলেই এমন অবস্থা হয়ে থাকে। তবু শিশুদের জন্য তো থাকে অভিভাবক। আর বৃদ্ধদের জন্য থাকে কেবলই অবহেলা।
এইমাত্র রিতু স্কুল থেকে বাড়ি এলো। নিত্যদিনের মতো উঠোনে পা দিতেই দাদুকে ডাকতে থাকে। কিন্তু দাদু তার ডাকের উত্তর নিতেও বেশ কষ্টবোধ করছেন। তিনি গরমে হাঁপাতে থাকেন। রিতু দাদুর কষ্ট বুঝতে পারে। তাই দৌড়ে এসে দাদুকে বাতাস করতে থাকে। কপালের ঘাম গায়ের ওড়না দিয়ে মুছে দেয়। পরম আদরে মুখে হাত দিয়ে বলে, এখন ভালো লাগছে দাদু?
হ্যাঁ আপু। এখন বেশ ভালো লাগছে। তুমি যাও। একটু বিশ্রাম করে গোসল সেরে নাও। তারপর খাওয়া দাওয়া করে নামাজ আদায় করো। কিন্তু রিতু দাদুর কথায় কান দিতে চায় না। আসলে দাদুর কোনো কষ্টই যেন রিতু সহ্য করতে পারে না।
সখিনা বেগম দুপুরের রান্না নিয়ে বেশ ব্যস্ত। মন চাইলেও এই মুহূর্তে শ্বশুরকে সেবা দিতে পারছে না। তবু তার নজর শ্বশুরের দিকে। রান্না ঘরের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন রিতু দাদুকে বাতাস করছে। খুব ভালো লাগলো তার। এ যেন শ্বশুরের পাওনা। এমন ভালো মানুষের জন্য।
শ্বশুরকে কখনো শ্বশুর বলে মনে করে না সে। তার ভালোবাসা আদর আর সোহাগ সব যেন বাবার মতো। এমনকি তার চেয়েও বেশি। বাবা বেঁচে না থাকলেও কখনো সে বাবার অভাববোধ করেনি। শ্বশুরকে তিনি আব্বাজান বলে ডাকেন। সেই প্রিয় মানুষকে রিতু সেবা যতœ করছে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
রিতু মাকে ডাকতে থাকে-আম্মু, আম্মু!
– কি মা-! কিছু বলবে?
– দেখো তো মা দাদু ভায়ের কী অবস্থা!
– আমি তো রান্না করছি মা! কী করবো বলো!
– তাতে কী? দাদু ভাইকে তো আগে-নাকি-?
– তাতো-।
– শিগগির এদিকে আস। আগে দাদু ভাইয়ের গোসলের ব্যবস্থা করো। তারপর রান্নাবান্না করো।
– হাত মুছতে মুছতে সখিনা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রিতুকে বললো, কল চেপে বালতি ভরে দাও। তোমার দাদুকে এখনই গোসল করিয়ে দিচ্ছি।
শুনতে পেয়ে তিনি সখিনাকে ডাক দেন। বলেন, বউমা তোমার রান্নার কাজ আগে শেষ করে নাও। আমি আপুকে নিয়ে গোসল সেরে নিচ্ছি। রিতু সাথে সাথে বলে ওঠে, সেকি দাদু, আপনি যদি মাথা টলে পড়ে যান তাহলে-।
দাদু হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমতে আমার আপু ধরবে।
– আস দাদু আমরা দু’জনে গোসল করে নিই।
রিতু মার পাশে শুয়ে আছে। সখিনা বেগম রিতুর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। রিতু বলে, মা আজ এক কান্ড ঘটে গেছে।
– কী সে কান্ড। মা বলেন-
আমার ক্লাসের এক মেয়ের সাথে গল্প করছি। হঠাৎ করে সে বললো, জানিস আমার দাদু রাতে হাউ মাউ করে কেবল কান্দে। তার সেবা যত করার তেমন কেউ নেই। আমার আব্বু আম্মু দাদুকে বকাঝকা করে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া হয় না তার। এমনকি ঔষুধও।
জান মা, ওর দাদুর খুব কষ্ট।
আসলে বয়স্ক মানুষকে সবাই ঝামেলা মনে করে। মনে করে বাড়তি বোঝা তারা।
ঠিক বলেছ মা-। কিন্তু আসলে কি এটা সত্যি? রিতু কোনো কথা বলে না।
সখিনা বেগম আবার বলেন, যদি আমরা বয়স্ক মানুষদের রহমত বলে ভাবি তাহলে তাদের প্রতি অবজ্ঞা বা অবহেলা করার সুযোগ থাকে না।
– আসলে আমরা এমনটি ভাবি না কেন?
– মূলত আমাদের জ্ঞানের অভাব। ভাবি না যে তারাও একদিন আমাদের মতো এই সংসারের কর্তা ছিলেন। আমাদের শেকড় কিন্তু তারাই। তাদের আদর স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়ে আমরা আজ এত বড় হতে পেরেছি।
– আম্মু তুমি সত্যি বলেছ। তাঁরা না থাকলে আমরা এই রঙিন পৃথিবীর মুখ হয়তো কোনো দিন দেখতে পেতাম না। আজ তোমরা যেমন জীবন দিয়ে আমাকে ভালো বাস, তেমনি দাদু কিংবা নানুও একদিন তোমাদের জীবন দিয়ে ভালবাসতেন। একদিন তোমরাও বৃদ্ধ হবে। তারপর আমরাও ঠিক তাই। এসব মনে রেখেইতো-।
আমার দাদুভাই আব্বুকে খুব ভালবাসতেন। তাই আব্বুও দাদু ভাইকে খুব ভালবাসেন। আবার আমাকে তোমরা যে ভালোবাসা দিচ্ছ আমিও তোমাদের সে ভালোবাসা দেবো ইনশাআল্লাহ।
সখিনা বেগম রিতুর কথা শুনে অবাক হয়। মনে মনে হাসতে থাকে। আদর করে মাথায় হাত বুলায়। কপালে চুমু দিয়ে বলে, লক্ষ্মী মা আমার। এবার ঘুমিয়ে পড়ো। ভোরে উঠে আবার কুরআন শিখতে যেতে হবে না!
রিতু ঘুমিয়ে আছে। আহসান সাহেব শুয়ে আছেন রিতুর পাশেই। সব সময় ও বাবার পাশে ঘুমুতে পছন্দ করে। তা ছাড়া আহসান সাহেব সারাক্ষণ নিজ ব্যবসার কাছে ব্যস্ত থাকেন। মেয়েকে পাশে রেখে আদর করার সময়ও পান না। তাই রাতটুকু মেয়েকে আদর আর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন।
মাঝরাত। ঘুমের ভেতর রিতু চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কানতে কানতে ওর চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। সখিনা বেগম এবং আহসান সাহেব কিছুই বুঝতে পারেন না। শুধু ওকে কান্না থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই রিতুর কান্না থামে না।
আহসান সাহেব ভারী দুশ্চিন্তায় পড়েন মেয়েকে নিয়ে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন কী হলো মা? কানছো কেন?
– রিতু নিরুত্তর।
– বাবা আবারও যত করে জিজ্ঞেস করেন কী হলো মা-কিছু বলছো না যে।
রিতু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আবারও কানতে থাকে। তারপর একটু শান্ত হয়ে বলে, আমি দাদুর কাছে যাবো। আমাকে দাদুর কাছে নিয়ে চলো।
– দাদুতো এখন ঘুমুচ্ছে মা। উনি অসুস্থ। এ রাতে উনাকে ডাকলে তো কষ্ট হবে তাঁর।
– তা হোক। আমি দাদুর কাছে যাবো।
– দাদু তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে তখন মুনাজাত করছেন। কেঁদে কেঁদে নিজের গোনাহর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, আপন প্রতিবেশী-এমনকি দেশের কল্যাণ কামনা করে তিনি মুনাজাত করেন।
সখিনা বেগম রিতুকে কোলে নিয়ে শ্বশুরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মেলে বউমা আর রিতুকে দেখে তিনি অবাক হন। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন- কী ব্যাপার দাদু এত রাতে-!
দাদু দু’হাত এগিয়ে দিলেন। রিতু মার কোল থেকে নেমে দাদুর পাশে বসলো। সখিনা বেগম দাঁড়িয়ে আছে রিতুকে নেয়ার জন্য। দাদু রিতুর মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।
রিতু দাদুকে জড়িয়ে ধরে পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে। দাদু খুব খুশি হন। তার এই ভালোবাসার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোয়া করেন।