ডা: মনিরুল ইসলাম#
ঈদ মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার পক্ষ থেকে দুনিয়াবাসীর জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। খুশির এক বিরাট উপলক্ষ। সুদীর্ঘ টানা এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দ আর খুশির বারতা নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয় ঈদ। এ আনন্দ হিল্লোল সাড়া দিয়ে যায় ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো নির্বিশেষে সবার হৃদয়ে। ঈদের দিনের অন্যতম আকর্ষণ হলো বাহারি রঙবেরঙের সব জামা-কাপড় আর মজার মজার সব খাবার দাবার। কিন্তু মজার মজার এসব খাবার-দাবার নিয়ম না মেনে ইচ্ছেমতো গ্রহণ করার ফলে যেকোনো সময়, যে কেউ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। সব আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে, নিজের এমনকি পরিবারের সবার। তাই খাবার গ্রহণে সর্বোচ্চ মনোযোগ ও সাবধানতা অবলম্বনের কোন বিকল্প নেই। তাই এসো এবার এক এক করে জেনে নিই ঈদের এই মহোৎসবের খাবার দাবার কী রকম হওয়া চাই।
ঈদের দিনে আমাদের দেশে সাধারণ যেসব খাবার খুবই জনপ্রিয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মিষ্টি জাতীয় নানা ধরনের সেমাই, জর্দা, পোলাও, মজাদার পায়েস, ফালুদা, লাচ্ছি, জিলাপি, দধি, সুজি, হালুয়া আর হরেক পদের কোমল পানীয় আর জুস। আমিষ জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন গোশতের কোরমা, কাবাব, রেজালা, কালিয়া, কোপতা, রোস্ট ও ফ্রাই প্রভৃতি। শর্করাজাতীয় খাবার যেমন ভুনা খিচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, ম্যাকারনি, নুডুলস, বিভিন্ন ধরনের ভাজিভুজা আর পিঠা-মাঠা।
চলো এবার জেনে নিই যে সমস্ত বিষয়কে সামনে রেখে খাবার নির্বাচন করা প্রয়োজন-
ক্যালরি
ক্যালরি বলতে বুঝায় কোন খাবারে কী পরিমাণ শক্তি আছে। বেশি ক্যালরি যুক্ত খাবার গ্রহণ করলে, বেশি শক্তিশালী হওয়া যায় এমন ধারণা ঠিক নয়। বরং অতিরিক্ত ক্যালরি চর্বি আকারে শরীরে জমা হতে থাকে এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার জন্ম দেয়। এ জন্য সব সময় কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়ার দরকার- মিষ্টি জাতীয় খাবার যেগুলো সরাসরি চিনি থেকে প্রস্তুত সেগুলো যত কম গ্রহণ করা যায় ততোই ভালো। অন্য দিকে টমেটো, শসা, গাজর, বিভিন্ন ধরনের সবজি থেকে তৈরি খাবার ইচ্ছামত খেলেও কোনো প্রবলেম নেই।
স্বাস্থ্যসম্মত
খাবার নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া দরকার। অনেকে মনে করে থাকতে পারেন একদিনের জন্য তো অনিয়ম করা যেতেই পারে। কিন্তু না, একদিনের অনিয়মও অনেক বড় সমস্যার কারণ হতে পারে। তেলে ডুবিয়ে ভাজা খাবার, অতিরিক্ত তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার, কলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার, রাস্তার ধারে বা খোলা জায়গায় রাখা চকটকদার খাবার- যেমন চাটনি, ফুসকা, অতিরক্ত ঝাল দেয়া খাবার, লবণযুক্ত খাবার, কৃত্রিম এবং রঙ মেশানো বাজারের জুস সবই অস্বাস্থ্যকর খাবার। এগুলো পরিহার করা শ্রেয়।
পাকস্থলী ও অন্যান্য পরিপাক অঙ্গের
সহনশীল ও উপযোগী
আমাদের পাকস্থলী দীর্ঘ এক মাস রোজায় অভ্যস্ত ছিল। একদিনে হঠাৎ করে ভারি আর বিভিন্ন ধরনের খাবারে বিশেষ লোড চাপিয়ে দিলে সেটা নিতে এসব অঙ্গ বিশেষ করে খাদ্যান্ত্র, লিভার, কিডনি অগ্নাশয় দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এ জন্য খাবার হতে হবে সহজপাচ্য, সহজে হজমের উপযোগী। সে ক্ষেত্রে আঁশযুক্ত খাবার, মৌসুমি ফলমূল এগুলো অনেক বেশি উপযোগী। ভাজি-ভুজা, পোড়া খাবার তীব্র এসিডিটি পেট ফাঁপার কারণ হতে পারে।
খাবারের পরিমাণ
ঈদে সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাতের মাহেন্দ্রক্ষণ। নিজের বাড়িতে তো আছেই, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেখানেই যাওয়া হোক না কেন কিছু না কিছু খেতেই হয়। এ জন্য সকাল থেকে পরিকল্পনা থাকা দরকার। যত ক্ষুধাই লাগুক একবারে বেশি খাবার গ্রহণ তোমাকে একেবারেই ক্লান্ত বানিয়ে দিতে পারে। মাটি হয়ে যেতে পারে সারা দিনের যতসব আনন্দ পরিকল্পনা। এ জন্য সবখানে অল্প অল্প করে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
খাবারে মসলা
ঈদে মেহমানদের উপলক্ষে অনেক রান্নাবান্না হয় বলে সবাই খাবারকে মজাদার আর অধিক স্বাদের করতে অতিরিক্ত তেল মসলার ব্যবহার করে থাকেন। খাবার ঠিকই খুব আকর্ষণীয় স্বাদের হয়। একটু মুখে দিলেই আর একটু খেতে মন চায়; কিন্তু এ ধরনের অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক মাস অভুক্ত পাকস্থলীর জন্য কাল হতে পারে। বদহজম হয়ে যেতে পারে। এ জন্য আগে থেকেই এ ধরনের মসলাযুক্ত মজাদার খাবার গ্রহণে সাবধানতা জরুরি।
এলার্জি
অনেক ধরনের খাবারেই অনেকের এলার্জি বা ইনটোলারেন্স থাকতে পারে। মজাদার খাবার, চিংড়িযুক্ত খাবার, ইলিশ, গরুর গোশত এগুলো অনেকেরই যন্ত্রণাকর এলার্জির কারণ হতে পারে। যাদের আগে থেকেই এ ধরনের খাবারে সমস্যা আছে তাদের খাবার গ্রহণে একটু বাড়তি সতর্কতা জরুরি। আর সাথে এন্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধও সাথে রাখা দরকার। না হলে ঈদের দিন জরুরি ওষুধের জন্য অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হতে পারে।
অন্যান্য অসুখ যদি থাকে
যাদের হাই ব্লাডপ্রেসার বা ডায়বেটিস আছে, অগ্নাশয়ের অসুখ আছে, কিডনির সমস্যা আছে, লিভারে অসুখ আছে কিংবা খাদ্যনালীর বড় অপারেশন হয়েছে, তাদেরকে চিকিৎসকের পূর্বের পরামর্শগুলো মাথায় রেখেই খাবার গ্রহণ করতে হবে।
শরিয়াসম্মত
যদিও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অতিরিক্ত আনন্দ উল্লাস করতে গিয়ে কিংবা কখনো বা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমরা ভুলে বসি আল্লাহপ্রদত্ত বিধিনিষেধ। মনে হতে পারে একবারের জন্য খেলে কিছু হবে না। কিন্তু যেটা হারাম সেটা এক চুমুকও হারাম। অ্যালকোহল মেশানো কোমলপানীয় ধূমপান কিংবা যেগুলো নেশার উপকরণ সেটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বর্জন করা আবশ্যক। খাবার গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে নাও। এক ভাগ খাবার দিয়ে, এক ভাগ পানি দিয়ে পূর্ণ করো। আরেক ভাগ সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইবাদতের জন্য রেখে দাও।”
কখন কী খাবেন
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঈদের নামাজের আগে হালকা মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন- সেমাই, পায়েস এগুলো সীমিত খাবে। ঈদের নামাজ শেষে এবং দুপুরে একটু ভারী খাবার খাওয়া যেতে পারে। বিকালে বা সন্ধ্যায় যদি আবারো খাওয়া হয়- তবে রাতের খাবার আলাদা করে না খাওয়াই ভালো। না হলে রাত ৮-৯টার মধ্যে বা ঘুমাতে যাবার কমপক্ষে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার গ্রহণ করা উচিত।
বিভিন্ন খাবারের কমন কিছু সমস্যা ও প্রতিকার
যে সমস্যাগুলো অনেকেই ঈদের দিন ফেস করতে পারে, যেমন- অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, বদহজম, বমি বমি লাগা, এমনকি বমি হওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া বা আমাশয় হওয়া। যাদের প্রায়ই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় তাদের সকালে কিছু খাওয়ার আধ ঘণ্টা আগেই ভালো মানসম্মত কোন গ্যাসের ওষুধ এবং রাতে খাওয়ার আগে আরো একটু ওষুধও খেয়ে নিতে পারে। পেটও ফাঁপা বা বমি বমি ভাবের জন্য এন্টাসিড সিরাপ বা ট্যাবলেট সাথে ডমপেরিডন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। পাতলা পায়খানা হলে অবশ্যই সবার আগে খাবার স্যালাইন খেতে হবে।
বন্ধুরা, পানি খেতে কিন্তু ভুলে যেও না। যে কোন খাবারই খাও না কেন অবশ্যই সারাদিনে প্রচুর পরিমাণ ঠান্ডা পানি, লেবুর শরবত এবং বোরহানি জাতীয় তরল খাবার খেতে হবে। যদি সমস্যা বেশি হয়ে যায় অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। জরুরি সমস্যা হলে কোথায় যাবে, কাকে ফোন করবে আগে থেকে যেন সেটা ভেবে রাখতে ভুল না হয়।