মোবারক হোসাইন#
রূপ রস গন্ধ আর সবুজের সমারোহে ভরপুর যেন সব কিছু। সত্যিই! অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত আমাদের এই পৃথিবী। সুন্দর সাজানো গোছানো এ যেন মানুষের জন্য মহান রবের পক্ষ থেকে এক বিরাট উপহার। পৃথিবীর এমন একটি জায়গাও নেই যেখানে চোখ ফেললে মনে হবে এসবের কোন কিছুই প্রয়োজন ছিল না। চলো, পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় সুন্দর ও বিশাল দেশ ভারতের কিছু ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জেনে নিই। জনসংখ্যার দিক থেকেও বিশাল, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। মানুষের চামড়ার রঙ ও বাহ্যিক ভেদাভেদের রকমফেরও বিরাট। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের সংখ্যা ৩২। ১৯৭২ সালের ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য সনদের বর্ণনা অনুযায়ী এ স্থানগুলো সাংস্কৃতিক অথবা প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন। চল, ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জায়গা সম্পর্কে পরিচিত হই।
তাজমহল
তাজমহল পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম। এটি একটি সমাধিসৌধ। ১৬৩১ সালে সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পতœী বেগম মমতাজ মহলের মৃত্যু হলে তাঁর স্মৃতিতে এই সৌধটি নির্মিত হয়। শ্বেতপাথরের এই সমাধিসৌধটি মুঘল স্থাপত্যকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এতে মিলিত হয়েছে পারসিক, ইসলামি ও ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী। সৌন্দর্যের খবর কম-বেশি অনেকেই জানি। কিন্তু এর নির্মাণের পেছনে আরও অনেক বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় ২৪০ ফুট উচ্চতা নিয়ে প্রায় ৪০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র তাজমহল। কথিত আছে, এ ভবনের স্থাপত্য নকশা নির্মাণ করেছিলেন যারা-তাদের প্রত্যেকের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল, যেন তারা এ রকম আরেকটি ভবনের নকশা তৈরি করতে না পারেন। ১৬৩২ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৬৫৩ সালে। এ ভবনের প্রধান স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহৌরি। তার সঙ্গে ছিলেন আরও দু’জন। ২০ হাজার শ্রমিকের ঘাম ঝরেছিল এর নির্মাণে। এক হাজার হাতি মালামাল বহনে ব্যবহার করা হয়েছিল। দামি সব পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল এর সৌন্দর্য বর্ধনে- আকিক, ইয়েমেনি, ফিরোজা, কোরাল, সোলায়মানি, ক্যাটস আই, ব্লাড স্টোন ইত্যাদি। অন্যান্য পাথর তো ছিলই। নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছিল বলে এর ভিত্তিতে ব্যবহার করা হয়েছিল ১৬০ ফুটলম্বা কয়েক হাজার পাইল। নদীর কিনারায় ইট, পাথরসহ অন্য মালামাল আনার জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার পাথরের রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। পাইলিংয়ের আশপাশ এলাকা ভরাট করা হয়েছিল পাথর পিটিয়ে। এরপর বসানো হয়েছিল ইট। সেই সময়ে এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৩২ মিলিয়ন রুপি। সাদা মার্বেল আনা হয়েছিল মাক্রানা আর রাজস্থান থেকে, লাল-হলুদ-বাদামি পাথর পাঞ্জাব থেকে, সবুজ ও স্বচ্ছ পাথর আনা হয় চীন থেকে। ব্যবহৃত ২৮ রকমের অন্য পাথরগুলো আনা হয় তিব্বত, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আরব থেকে। তাজমহলের ভেতরের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য শিল্পী আনা হয়েছিল বুখারা অঞ্চল থেকে এবং ক্যালিগ্রাফারদের সিরিয়া ও পারস্য থেকে। উল্লেখ্য, এর বিভিন্ন অংশে পবিত্র কুরআনের ১৫টি সূরার ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছিল। ক্যালিগ্রাফার আব্দুল হক নানা রঙের পাথরে এসব ক্যালিগ্রাফি নির্মাণ করেছিলেন। প্রতিদিন হাজার হাজার লোকজনের সমাবেশ হয় এই স্বপ্নের তাজমহল দেখার জন্য। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের লোকজনের এবং অসংখ্য বিদেশী পর্যটকরা আসেন তাজমহল দেখতে।
জয়পুরের যন্তর মন্তর
জয়পুরের যন্তর মন্তর ঘর আসলে ঐতিহাসিক নিদর্শন। কি চমৎকার তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। প্রতিদিন অনেক পর্যটক সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন। জয়পুরের যন্তর মন্তর কয়েকটি জ্যোতির্বিজ্ঞান যন্ত্র স্থাপত্যের সমষ্টি। ১৭২৭ থেকে ১৭৩৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মহারাজা দ্বিতীয় জয়সিংহ তাঁর নতুন রাজধানী জয়পুরে মুঘল রাজধানী দিল্লিতে তাঁরই নির্মিত যন্তর মন্তরের আদলে এটি নির্মাণ করেন। তিনি এ রকম পাঁচটি স্থাপনা পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নির্মাণ করিয়েছিলেন। তার মধ্যে দু’টি দিল্লি ও জয়পুরে অবস্থিত। জয়পুর মানমন্দিরটি ছিল বৃহত্তম এবং এখানে তিনি ২০টি স্থায়ী যন্ত্র বসিয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ পর্বে এক জ্ঞানী সামন্তরাজার রাজদরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞান দক্ষতা ও বিশ্বচেতনার অভিপ্রকাশ রূপে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় সাংস্কৃতিক সম্পত্তি রূপে অন্তর্ভুক্ত হয়।
আগ্রা ফোর্ট বা আগ্রার লালকেল্লা
মুঘল স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন। এটি ১৯৮২ সালে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে (ররর) ক্যাটেগরিতে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত হয়। দুর্গটি যমুনা নদীর ডান তীরে অবস্থিত। এটি লাল বেলে পাথরের তৈরি। দুর্গচত্বরের মোট আয়তন ২.৫ কিলোমিটার (১.৬ মা)। পরিখাবেষ্টিত দুর্গটির অভ্যন্তরে অনেক প্রাসাদ, মিনার ও মসজিদ রয়েছে। এগুলি ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীতে আকবরের রাজত্বকালে, শেষ হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বকালেও দুর্গের বেশ কয়েকটি স্মারক নির্মিত হয়েছিল। দুর্গ-অভ্যন্তরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলি হলো খাস মহল, শিশ মহল, মুহাম্মান বুর্জ (একটি অষ্টভুজাকৃতি মিনার), দিওয়ান-ই-খাস (১৬৩৭), দিওয়ান-ই-আম, মোতি মসজিদ (নির্মাণকাল ১৬৪৬-৫৩) ও নাগিনা মসজিদ (১৬৫৮-১৭০৭)। এই স্মারকগুলিতে তিমুরিদের পারসিক শিল্পকলা ও ভারতীয় শিল্পকলার এক আশ্চর্য মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। এটি তাজমহলের নিকটেই অবস্থিত। একটি বাফার জোন উভয় স্মারকে মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে। আগ্রা ফোর্ট আসলে চমৎকার ও মজার স্থান।
রাজস্থানের পাহাড়ি দুর্গসমূহ
আরাবল্লি পর্বতমালার পাথুরে এলাকায় অবস্থিত দুর্গের শ্রেণী। এগুলি রাজস্থানী পাহাড়ি গঠনশৈলীর অন্যতম সামরিক ও প্রতিরক্ষামূলক নিদর্শন। এই দুর্গগুলির অভ্যন্তরে বিশাল এলাকা এমনকি গোটা গ্রাম অবস্থিত থাকতে পারে। চিতোরগড় দুর্গ, কুম্ভলগড় দুর্গ, রণথম্বোর দুর্গ, গগ্রোন দুর্গ, অম্বর দুর্গ, জয়সলমীর দুর্গ রাজস্থানের পাহাড়ি দুর্গসমূহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
হুমায়ুনের সমাধিস্থল
দিল্লিতে অবস্থিত হুমায়ুুনের সমাধিস্থল প্রথম সমাধিক্ষেত্র যেটি কৃত্রিম জলধারা সংবলিত কোনো বিলাসবহুল উদ্যানের মধ্যস্থলে নির্মিত হয়। এই সমাধি প্রায় শতাব্দীকাল পরে নির্মিত তাজমহলের উত্তরসূরি। ১৫৭০ সালে নির্মিত এই সমাধিস্থলের নাম ১৯৯৩ সালে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্মারক তালিকায় অধিভুক্ত হয়। ১৫৬৯-৭০ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের বিধবা পত্নী বিগা বেগম (হাজি বেগম) এটি নির্মাণ করান। কথিত আছে, মির্জা গিয়াথ এটি নির্মাণ করেছিলেন। ছত্রীসহ এই সমাধির দুই-গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপত্যশৈলীটি মুঘল স্থাপত্যের একটি অনন্য নিদর্শন। এই সমাধিস্থলটি ‘মুঘল রাজবংশের সমাধিক্ষেত্র’ নামেও পরিচিত। কারণ, হুমায়ুনের সমাধি ছাড়াও এই সমাধি চত্বরে রাজপরিবারের প্রায় ১৫০ সদস্যের সমাধি অবস্থিত। সমাধিক্ষেত্রটি চার-ভাগ বা চতুষ্কোণ। এখানে দু’টি সিংহদরজা রয়েছে, একটি দক্ষিণে ও অপরটি পশ্চিমে। সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে বেশ কয়েকটি কৃত্রিম জলধারা, একটি প্যাভিলিয়ন ও একটি স্নানাগার আছে। সমাধিটি অসম অষ্টভুজ প্ল্যাটফর্মের ওপর অবস্থিত। ডোমটির উচ্চতা ৪২.৫ মিটার। পুরো সমাধিটি শ্বেতপাথরে আবৃত ও ছত্রী শোভিত।
কুতুব মিনার ও সংলগ্ন স্মারকসমূহ
দিল্লির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। এই চত্বরের কেন্দ্রে রয়েছে কুতুব মিনার। লাল বেলেপাথরে নির্মিত এ মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফু)। মিনারটির ব্যাস পাদদেশে ১৪.৩২ মিটার (৪৭.০ ফু) ও শীর্ষদেশে ২.৭৫ মিটার (৯.০ ফু)। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই মিনারের নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়। মিনার চত্বরে কয়েকটি পথ, আলাই দরওয়াজা (১৩১১), আলাই মিনার (একটি অসমাপ্ত মিনারের স্তূপ, এটি নির্মাণের কথা থাকলেও, নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়নি), কুব্বত-উল-ইসলাম মসজিদ (ভারতের সেই প্রাচীনতম মসজিদগুলির অন্যতম, যেগুলি অদ্যাবধি বর্তমান), ইলতুৎমিশের সমাধি এবং একটি লৌহস্তম্ভ রয়েছে। একাধিক হিন্দু ও জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে এই মিনার নির্মিত হয়। চত্বরের কেন্দ্রস্থলে ৭.০২ মিটার (২৩.০ ফু) উচ্চতাবিশিষ্ট যে চকচকে লৌহস্তম্ভটি রয়েছে, তাতে একটুও মরচে ধরেনি। এই লৌহস্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের একটি লেখা রয়েছে। ১১৯২ সালে কুতুবউদ্দিন আইবক এই মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের কাজ শেষ হয়। পরে আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) এই চত্বরে আরও কতকগুলো নির্মাণকার্য হয়। পরবর্তীকালেও বজ্রপাতে মিনারটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শাসকেরা সেটির সংস্কার করেছিলেন। ইসলামি স্থাপত্য ও শিল্পসৌকর্যের এক অনবদ্য প্রতিফলন হিসেবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার ক্যাটেগরির অধীনে এই চত্বর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করে।
লালকেল্লা চত্বর
পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-৫৮) কর্তৃক সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি প্রাসাদ দুর্গ। এটি তার নতুন রাজধানী শাহজাহানাবাদের একটি অংশ ছিল। লালকেল্লা দিল্লির উত্তর অংশে অবস্থিত। মুঘল শাসনের গৌরবের প্রতিনিধি এই কেল্লা মুঘল স্থাপত্য, শিল্পসৌকর্য ও সৃষ্টিশীলতার স্বর্ণযুগের একটি নিদর্শন। পারসিক, তৈমুরি ও ভারতীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণে এ দুর্গ নির্মিত হয়। কথিত আছে, পারসিক রাজধানী ইসফাহান লালকেল্লা চত্বর নির্মাণের পশ্চাতে অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করে। দুর্গের নকশাটি জটিল। প্যাভিলিয়ন গঠনশৈলীর জাল-আকার জ্যামিতিক নকশায় এই দুর্গ নির্মিত। পরবর্তীকালে রাজস্থান, দিল্লি, আগ্রা ও অন্যান্য অঞ্চলের বহু স্থাপত্য নির্মিত হয় এই জাতীয় নকশায়। দুর্গটি লাল বেলে পাথরের প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত। এই কারণে এটি লালকেল্লা নামে পরিচিত।
১৫৪৬ সালে ইসলাম শাহ সুরি যে সেলিমগড় দুর্গ নির্মাণ করেন, তা এই দুর্গের ঠিক গায়েই ছিল। বর্তমানে উক্ত দুর্গটি লালকেল্লারই একটি অংশ। সমগ্র দুর্গ চত্বরের আয়তন ১২০ একর।
এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ক্যাটেগরির অন্তর্গত। ১৬৩৯ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত ৬৫৬ মিটার (২,১৫২ ফু)´ ৩২৮ মিটার (১,০৭৬ ফু) আয়তনের এই কেল্লার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৩ মিটার (৭৫ ফু)। এটি যমুনা নদীর ডান তীরে অবস্থিত। নদীর পুরাতন খাতের ওপর একটি সেতুর মাধ্যমে এই কেল্লা সেলিমপুর দুর্গের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বর্তমানে সেতুটি শহরের একটি রাস্তার রূপ নিয়েছে। দুর্গ চত্বরের প্রাসাদটি দেওয়ান-ই-আমের (গণদরবার কক্ষ) পেছনে অবস্থিত। এই প্রাসাদে অনেক উচ্চমানের কারুকার্যখচিত শ্বেতপাথরের প্রাসাদ প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এগুলি ‘নহর-ই-বেহেস্ত’ নামে কৃত্রিম জলধারার দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকত। এই অংশেই ছিল দেওয়ান-ই-খাস (ব্যক্তিগত দরবার কক্ষ), কয়েকটি অন্যান্য দরকারি ব্যক্তিগত ভবন ও স্থাপনা এবং সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত মোতি মসজিদ।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতের উত্তর প্রদেশ অঙ্গরাজ্যের আলীগড় শহরে অবস্থিত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ রাজত্বের সময় ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিগণিত হয়। তৎকালীন অনেক সনামধন্য মুসলিম চিন্তাবিদ ও উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি ও লেখক এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। আলীগড় কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়; অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের একটি আন্দোলনও ছিল বটে। যে আন্দোলন ব্রিটিশ-ভারতে মুসলমানদের রাজনীতিতে ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যে আন্দোলন দুই হাত ভরে ব্রিটিশ-ভারতকে দিয়ে গেছে জাঁদরেল রাজনীতিবিদ, পন্ডিত, সমাজ সংস্কারকসহ অসংখ্য গুণীজন। দেশ ভাগের পর ভারত, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের অনেকেই ছিলেন আলীগড়ের ছাত্র। ভারতের প্রথম মুসলমান রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন (১৯৬৭-১৯৬৯), বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান (১৯৪৭-১৯৫১), পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জেনারেল ও পরে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন, স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান (যদিও ডিগ্রি সমাপ্ত করেননি), বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মনসুর আলীসহ (জানুয়ারি ১৯৭৫ থকে আগস্ট ১৯৭৫) উপমহাদেশের বহু বরেণ্য ও বিখ্যাত ব্যক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আলীগড়ে রয়েছ ভারতের প্রথম ও এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটির নাম মাওলানা আজাদ গ্রন্থাগার। শিক্ষার্থীদের উন্নত সুযোগ-সুবিধা এনে দিতে এই গ্রন্থাগারের পেছনে প্রায় চার কোটি রুপি খরচ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এই গ্রন্থাগারটির উদ্বোধন করেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম অনুসারে তিনি এ গ্রন্থাগারের নামকরণ করেন। এ গ্রন্থাগারটিতে সাড়ে ১১ লাখের বেশি বই, তথ্য-উপাত্ত, দলিল সংরক্ষিত রয়েছে। পাশাপাশি দুর্লভ কিছু সংগ্রহে ভরপুর এ গ্রন্থাগার। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের পান্ডুলিপি আছে এখানে, যা চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা)-এর সময়কার। এ গ্রন্থাগারের আরেকটি দুর্লভ সংগ্রহ বায়েজিদ আনসারির একটি হলনামা। মুঘল আমলের নামকরা অনেক শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম আছে এখানে। এঁদের মধ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীর আমলের প্রসিদ্ধ একজন চিত্রকর মানসুর নাকাশের আঁকা ‘লাল ফুল’ নামের চিত্রকর্মটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আছে স¤্রাট বাবর, আকবর ও শাহজাহানের আমলের রাজকীয় আইন-কানুন আর রায়ের কপি।
এভাবে বিখ্যাত সব স্থান আর নিদর্শনে ভরপুর সমস্ত ভারত। যা ইতিহাসের নানা বাঁক ও পথের সাথে মিশে আছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা আর প্রাচীন নিদর্শনাবলিই প্রমাণ করে ভারতের ঐতিহাসিকতা।