Home প্রবন্ধ ঈদের খুশি ছড়িয়ে যাক সবখানে

ঈদের খুশি ছড়িয়ে যাক সবখানে

হারুন ইবনে শাহাদাত#

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশীর ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানি তাকিদ।’
আমাদের জাতীয়  কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গান ঈদের দিনে মনে আনন্দ দোলা জাগাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বিবেককে কতটা জাগাতে পেরেছে? বন্ধুরা, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে এসো সময়ের চাকা একটু ঘুরিয়ে নিই। গত বছর রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মলে একটি লেহেঙ্গা বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং শাড়ি ১ লাখ ২৫ হাজার পর্যন্ত  দামে। এটা ঐ বছরের ঈদের পোশাকের দেশের বাজারের সর্বোচ্চ দাম। সাধারণত লেহেঙ্গা ও পার্টি শাড়ি ১০ হাজার থেকে ৬০ হাজার, বিয়ের শাড়ি ১৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয় রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মলে।

বন্ধু তোমরা হয়তো ভাবছো, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? যার যার সামর্থ্যানুসারে শপিং করবে, খরচ করবে? এতে দোষের কী আছে। অবশ্যই সামর্থ্যানুসারে খরচ করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু এই সমাজের একজন মানুষ হিসেবে আমাদের যেমন অধিকার আছে, ঠিক তেমনি অধিকারের প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে আছে দায়িত্বের বিষয়টিও। ৩ লাখ টাকার লেহেঙ্গা পরার আগে অবশ্যই তোমাকে আমাকে ভাবতে হবে, আমাদের চার পাশের মানুষ কেমন আছে। বিশেষ করে নিকট আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বাসার কাজের লোকদের কথা। নিজের বড়ত্ব ও অহঙ্কার প্রকাশের জন্য বেশি দামি পোশাক পরলে মনের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। ঈদ ও সিয়ামের শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ ঘটে।

তোমরা কি জান, জাতিসংঘের হিসাবে আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪২ শতাংশ দরিদ্র। যদিও গত ২০১৪ সালের  জুনের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার এখন ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এদিকে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১ হাজার ১৯০ ডলার, অর্থাৎ দিনে তিন ডলারের বেশি। তারা প্রতিদিন দু’বেলা পেটভরে খেতে পায় না। আমাদের ঈদ আনন্দ সেই দিনই সার্থক হবে যেদিন এইসব বঞ্চিত মানুষদের আমরা আনন্দে শামিল করতে পারবো। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার এই তাগিদের কথাই গানে গানে আমাদের জাতীয় কবি তুলে ধরেছেন।
ঈদ শব্দের অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব। এই খুশির তুলনা অন্য কোনো খুশির সাথে করা যায় না। কারণ কী বল তো বন্ধুরা? হ্যাঁ ঠিক বলেছো, এই খুশি হলো অপার্থিব। এক জান্নাতি খুশি। মহান আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যমে ঈদুল ফিতরের খুশির উৎসব পরিপূর্ণতা পায়। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় সৃষ্টি জগতের অন্যান্য প্রাণীর এবং মানুষের খুশি, আনন্দ প্রকাশের পার্থক্যের মধ্য দিয়ে। সাধারণত সৃষ্টি জগতের অন্য প্রাণীরা সবার আগে চায় নিজের উদরপূর্তি করতে। কিন্তু একজন মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে না। একজন প্রকৃত মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো, মহান আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ। এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহর নির্দেশিত এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর দেখানো পথে সাধনা করা। প্রতি বছর ঈদুল ফিতর আসে মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি স্তম্ভ হলো সিয়াম বা রোজা। একজন মুমিন বান্দা সুবেহ সাদিক থেকে নিয়ে সূর্য অস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পানাহার ত্যাগ করেন। এর মাধ্যমে তার আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়, তিনি বুঝতে পারেন প্রকৃত সুখ ভোগে নয় ত্যাগে।
এক মাস সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে ত্যাগের যে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করি ঈদুল ফিতরের দিন আমাদের সকল কাজে কর্মে তার প্রতিফলন ঘটবে। বছরের বাকি ১১ মাস এই শিক্ষার আলোকে চলবো, এমনটাই হওয়া উচিত।

কুড়িগ্রামের সমশের আলী আর ঢাকার আকিব চৌধুরী দু’জনই এ দেশেরই মানুষ। সমশেরের বাবা অন্যের জমি চাষ করে অতি কষ্টে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে আছেন। ঈদের দিন নতুন জামা কাপড় তার কাছে দুঃস্বপ্ন। সেমাই চিনিও চোখে দেখে না। তাদের এই সামান্য প্রয়োজন মেটাতে লাখ টাকার প্রয়োজন নেই। দেড় থেকে দু’হাজার টাকা হলেই ঈদের খুশির ঝিলিক খেলবে তাদের কুঁড়েঘরে। অথচ আকিব চৌধুরীর বাবার ঈদের বাজেট কোটি টাকার ওপরে। কবে দূর হবে এই বৈষম্য। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অর্জন করেছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু আজও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের মুসলমানরা সিয়াম সাধনা করছে, উদযাপন করছে ঈদুল ফিতর, অথচ সিয়াম ও ঈদের শিক্ষার আলোয় ভরে উঠছে না আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। তাই তো আজও মনের অজান্তে সমান তালেই কণ্ঠে বেজে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই সত্যে-উচ্চারণ :
জীবনে যাদের হররোজ রোজা
ক্ষুধায় আসেনা নিদ,
মুমূর্ষ সেই কৃষকের ঘরে
এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে
যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে
কি সে শিশু-পুঁজরের হাড়?”
(কৃষকের ঈদ)

জাতীয় কবির এই আকুতি উপলব্ধি করে সবাইকে জানাতে হবে, দামি পোশাকের অহঙ্কারে গর্বে মাটি কাঁপিয়ে হাঁটার আনন্দের সাথে ঈদের খুশির পবিত্রতার কোনো সম্পর্ক নেই। সিয়াম ও ঈদের ত্যাগের শিক্ষার আলোকে নিজেদের গঠন করার মধ্যেই প্রকৃত আনন্দ। বন্ধুরা এসো, ঈদের সত্যিকারে এই খুশি আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার শপথ নিই। তবেই অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ খুশি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হবে। আমরা বিশ্বের দরবারে উন্নত জাতি হিসেবে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো।

SHARE

Leave a Reply