আসাদ বিন হাফিজ #গত সংখ্যার পর
হাসসান রাদিয়াল্লাহ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন লাশের দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘লোকটাকে আপনি সত্যি মেরে ফেলেছেন? একজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে এক নিরীহ ও নিরস্ত্র নারী কী করে কুপোকাত করতে পারে!’
‘পারে, যখন তার সাথে আল্লাহর মদদ থাকে। শোননি, আবরাহার হস্তিবাহিনীকে আল্লাহ নিকেশ করেছিলেন আবাবিল পাখি দিয়ে। আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। শর্ত হলো, মুমিন হৃদয় আল্লাহ নির্ভরতায় পরিপূর্ণ থাকা চাই। যাও, কথা না বাড়িয়ে লাশটা সরাও।’
এ দিকে যুদ্ধের অবস্থা তখন বড়ই নাজুক ও সঙ্কটপূর্ণ। অনন্তকাল বসে থাকার মত খাদ্য সামান নিয়ে কেউ ময়দানে আসে না। মাসের প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল খালিদরা মদীনা অবরোধ করে বসে আছে। তাদের খাবার ও পানি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। অথচ মদীনা আক্রমণের মত কোনো পথই পাচ্ছে না কুরাইশরা। সীমাহীন অস্থিরতা ও উদ্বেগ খালিদকে কুরে কুরে খাচ্ছে। খালিদ একজন জাত সৈনিক। যুদ্ধে এসে লড়াই না করে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা তার জন্য যেমন কষ্টকর, তারচেয়েও কষ্টকর বিজয় অর্জন না করে ফিরে যাওয়া। খালিদের সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে। সকাল হলেই সে ঘোড়া নিয়ে খন্দকের এক প্রান্ত থেকে ছুটে যেতো অপর প্রান্তে। কিন্তু মদীনায় প্রবেশের সুবিধাজনক কোন জায়গাই তার নজরে পড়তো না। ওপারে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা যদিও কম, কিন্তু খন্দক পেরিয়ে ওপারে গেলে মুসলিম সৈন্যদের তীরের নিশানা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। না খন্দকে সাঁকো বানিয়ে পার হওয়ার উপায় আছে, না খন্দকে নেমে কেউ ওপারে উঠতে পারবে। রাতের আঁধারে খন্দক পার হওয়া যায় কি না সে চেষ্টা করেও দেখেছে। রাতে মুসলমান পাহারাদারদের সংখ্যা দিনের দু’তিন গুণ হয়ে যায়। আর সৈন্যরা এমন দূরত্বে মশাল জ্বালিয়ে রাখে যে, মুসলিম সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে কারো পক্ষেই মদীনায় প্রবেশ করা অসম্ভব ব্যাপার। একরাশ হতাশা নিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ তার সৈন্যদের মাঝে ফিরে আসে।
অন্য দিকে মহানবী সা:-এর পেরেশানিরও কোনো কমতি ছিল না। তাঁর সবচে বড় দুশ্চিন্তা ছিল খাদ্যসঙ্কট নিয়ে। কুরাইশরা এভাবে যদি অবরোধ অব্যাহত রাখে তবে একদিন মদীনাবাসীকে না খেয়েই মরতে হবে। অবশ্য এই ভেবে তিনি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলেন যে, মুসলমানদের চেয়ে কাফেরদের খাদ্যঘাটতিও কম হওয়ার কথা নয়। তারা এত অধিক খাদ্য নিয়ে যুদ্ধে আসেনি যে, মাসের পর মাস তারা এভাবে অবরোধ চালিয়ে যাবে। মহানবীর এই দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিল বনু কোরাইজার ষড়যন্ত্র। তিনি খবর পেলেন বনু কোরাইজার লোকজন মুসলমানদের সাথে শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে গোপনে কুরাইশদের সাথে হাত মিলিয়েছে। যেকোনো সময় তারা শহরে গোলযোগ পাকিয়ে তুলতে পারে।
যুদ্ধ হচ্ছে এক ধরনের কৌশলের খেলা। শক্তির চাইতেও কৌশল যুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করে। যাদের কৌশল যুদ্ধে অধিক কার্যকর হয় তারাই শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করে। মহানবী সা: ভাবছিলেন বনু কোরাইজার ষড়যন্ত্র নিয়ে। বনু কোরাইজাকে শায়েস্তা করার চাইতে কুরাইশদের চালের জবাব দেয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি গোপনে খবর নিয়ে জানতে পারলেন কুরাইশদের সাথে বনু গাতফান গোত্র প্রায় দুই হাজার সৈন্য নিয়ে শামিল হয়েছে। বনু গাতফান গোত্রের সৈন্যরা আরবে বীর ও লড়াকু বলে পরিচিত। মহানবী সা: গোপনে গাতফান গোত্রের সেনাপতি আয়নালের কাছে দূত পাঠালেন। আয়নাল যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধবিহীন বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত। তার সে বিরক্তি এক সময় হতাশায় রূপ নেয়। তার হতাশার বড় কারণ, সৈন্যদের খাবারের মজুদ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। সে যখন অবরোধ তুলে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করছিল সে সময় মহানবী সা:-এর দূত গিয়ে গোপনে দেখা করলো তার সাথে। বলল, ‘আমরা খবর পেয়েছি, আপনার সৈন্যদের মাঝে ক্রমেই অসন্তোষ বাড়ছে। আপনাদের খাবারেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ময়দানের সব খবরই নিয়মিত রাখছেন। এ যাত্রা মদীনায় প্রবেশের কোনো সুযোগ আপনারা পাবেন না। আপনাদের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। কুরাইশদের শত্রুতার বোঝা আপনারা কেন নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। কুরাইশদের রসদ ফুরিয়ে গেলে তারা যখন বাড়ি ফেরার কথা ভাববে তখন মুসলিম বাহিনীর একটা অংশ পেছন থেকে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করলে এই হামলার শিকার হবেন আপনারাও। আপনারা যদি আগেই ময়দান থেকে সরে যান তবে আপনাদের পিছু ধাওয়া করা হবে না। আপনারা আগ্রহী হলে মহানবী সা: আপনাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না।’
‘কিন্তু আমাদের পথ খরচ? আবু সুফিয়ান বলেছে, যুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে এ বাবদ যত খরচ হবে সব কুরাইশরা বহন করবে। কিন্তু আমরা আগে চলে গেলে কুরাইশরা তা বহন করতে অস্বীকার করে বসতে পারে। জানি যুদ্ধ হবে না এবং আমাদের একজন সৈন্যকেও জীবন দিতে হবে না। তাহলে শুধু শুধু আমরা এই ঝুঁকি নিতে যাবো কেন?’
হাসলেন মুসলিম দূত। বললেন, ‘এ ব্যাপারে মহানবী সা:-এর সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আপনারা যদি তাঁর প্রস্তাব মেনে নেন, তবে এ বছর মদীনায় যত খেজুর উৎপন্ন হবে তার তিন ভাগের এক ভাগ আপনারা পাবেন। ফসল তোলার আগেই আপনারা এখানে চলে আসবেন এবং নিজেদের অংশ নিজেরা বুঝে নেবেন।’
গাতফান গোত্রের কাছে মহানবী সা:-এর দূত পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল, যদি তাদের ফিরে যেতে রাজি করানো যায় তবে কুরাইশদের দল থেকে দু’হাজার সৈন্য কমে যাবে। তারচেয়েও বড় লাভ যেটি হবে তা হলো, কুরাইশ ছাড়া অন্যান্য যেসব গোত্র এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের মনোবল ভেঙে যাবে এবং তারাও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবে বা যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে যাবে। যুদ্ধের ময়দান থেকে মন উঠে গেলে সে সৈন্য আর যুদ্ধ করতে পারে না। সংখ্যায় যত বেশিই থাকুক না কেন, পরাজয়ই হয় তাদের কপালের লিখন।
দূতের উদ্দেশ্য সফল হলো। বনু গাতফান গোত্র ময়দান ছেড়ে চলে যাবে এই ওয়াদা নিয়ে দূত ফিরে এলো মহানবী সা:-এর দরবারে।
এটা ছিল বনু কোরাইজার ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ। এই এক চালেই যুদ্ধ একটি ফয়সালার দিকে এগিয়ে গেল। বনু গাতফানের সরদার আবু সুফিয়ানকে বললো, ‘আবু সুফিয়ান, আমাদের খোরাকি শেষ হয়ে আসছে। যেটুকু খোরাকি আছে তা আমাদের ফিরে যাওয়ার চলার পথেই লাগবে। এখানে শুধু শুধু বসে থাকার কোনো মানে হয় না। এটি এক নিষ্ফল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলমানদের নিকেশ করার আশা দুরাশাই থেকে যাবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চলে যাবো আমরা। তুমি আমাদের যুদ্ধের খরচ মিটিয়ে দাও।’
‘কী বলছো আয়নাল!’ বিস্মিত কণ্ঠে আবু সুফিয়ান বললো, ‘পরাজয়ের তিলক নিয়ে তুমি ফিরে যেতে চাও?’
‘কিসের পরাজয়, যেখানে যুদ্ধই হয়নি সেখানে পরাজয়ের প্রশ্ন উঠে কী করে?’
‘যে জন্য এসেছো তা সমাধা না করে ফিরে যাওয়া কি পরাজয় নয়?’ আবু সুফিয়ান তাকে উত্তেজিত করতে চাইল।
আয়নাল বললো, ‘এখন মুসলমানদের ধ্বংস করা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। এতদিন হয়ে গেলো আমরা কোন হামলাই করতে পারলাম না। এখন সৈন্যদের মনে হতাশা ছেয়ে বসেছে। খাদ্যঘাটতির আশঙ্কায় কমে এসেছে তাদের বাহুর শক্তি। দেখছো না, সৈন্যদের তীর আর আগের মত দূরে যায় না। এখানে বসে থাকলে না খেয়েই মরতে হবে আমাদের। আমি আমার সৈন্যদের না খাইয়ে মারতে চাই না। অবরোধ উঠিয়ে সময় থাকতে চলো সবাই চলে যাই। আর না হয় তুমি বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গোন, আমি যাই।’
কুরাইশের সম্মিলিত বাহিনীর মাঝে এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো যে, গাতফানরা ময়দান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সাথে সাথে অন্যান্য গোত্র প্রধানরাও উপলব্ধি করলো, আয়নালের সিদ্ধান্তই সঠিক। এ অবরোধ অর্থহীন। তাদেরও উচিত এখনি ময়দান ছেড়ে দেয়া।
গাতফানরা ময়দান ছেড়ে চলে যেতে চায় এটা ছিল আবু সুফিয়ানের জন্য বড়ই পেরেশানি ও মর্মপীড়ার কারণ। কিন্তু এখানেই থামলো না ঘটনা। বিভিন্ন গোত্রের সেনাপতিরাও আবু সুফিয়ানের সাথে দেখা করে একই রকম আবেদন জানাতে থাকলো। আবু সুফিয়ান অভিজ্ঞ সেনাপতি। বাস্তব অবস্থা তাকে বলছিল, এইসব সেনাপতির মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে অবিলম্বে অবরোধ উঠিয়ে নাও, আর তার প্রাণের আকুতি তাকে বলছিল, মক্কায় ফিরে আপন নারীদের কাছে কী জবাব দেবে আবু সুফিয়ান? এত প্রস্তুতি, এত অস্ত্র, এত সেনা মোতায়েন করে কী নিয়ে তুমি মক্কায় ফিরবে?
ওহোদ পাহাড়ের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে খালিদ। ঘোড়া তার ওহোদ পাহাড় অতিক্রম করলেও তার মন পড়েছিল খন্দকের ময়দানে। যুদ্ধে কখন কী ঘটবে আগে থেকে কিছু বলা যায় না। একজন অভিজ্ঞ সেনানায়ক হিসাবে সেও জানে, যুদ্ধ হচ্ছে কৌশলের খেলা। মুহাম্মদের কুশলী চালের মোকাবেলায় আরো দূরদর্শী ও কুশলী চাল দেয়া ছাড়া বিজয়ের স্বপ্ন দেখা অবান্তর। একটা কুশলী চাল তারাও দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কোনো কাজে আসেনি। যুদ্ধে ছোট ছোট ঘটনাই যে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয় তা খালিদ প্রত্যক্ষ করেছে খন্দকের যুদ্ধে। গাতফান গোত্র যে মহানবী সা:-এর সাথে নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে তা আর গোপন থাকেনি। গোয়েন্দা মারফত এ খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান বিচলিত হলেও খালিদের মনে নতুন চিন্তার উদয় হয়েছিল। সে গোয়েন্দা মারফত এ খবর মদীনার ইহুদিদের জানিয়ে বললো, ‘তোমরা মদীনাবাসীকে উত্তেজিত করে তোল। এখানে কোনো যুদ্ধই হয়নি, অথচ মুহাম্মদ তোমাদের এবং মদীনাবাসীর ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ গাতফান গোত্রকে দেয়ার ওয়াদা করেছে। এটা তোমাদের পেটে লাথি মারার শামিল। এভাবে সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাও তোমরা। মদীনাবাসীকেও জানাও কী ঘটতে যাচ্ছে। এ নিয়ে মদীনায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোল।’
খালিদের এ পরিকল্পনা কাজে লাগলো। মদীনার ইহুদি এবং সাধারণ জনগণ এতে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তারা বললো, ‘এখানে কোনো যুদ্ধ হয়নি যে, যুদ্ধ ফান্ডে আমাদের শস্যের এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে দিতে হবে। আমরা এ সিদ্ধান্ত মানি না।’ মানুষ মাত্রই স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন। নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগায় এ খবরে মদীনার জনগণ বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। তারা বললো, ‘গাতফানকে আমরা আমাদের শস্যের এক দানাও দেবো না।’
মহানবী সা: এতে বিচলিত হলেন। সারা শহরেই এ নিয়ে কানাঘুষা চলতে লাগলো। অবস্থা জটিল আকার ধারণ করলে এক সাহাবী জটলারত লোকজনকে উদ্দেশ করে বললো, ‘তোমাদের এ আলোচনা শুনে অবাক হচ্ছি আমি। তোমরা কি জানো না মহানবী সা: এ যুদ্ধের সেনাপতি এবং মদীনার রাষ্ট্রপ্রধান? এ বিশাল কাফের বাহিনীর হাত থেকে মদীনাকে রক্ষা করার জন্য তিনি এমন চুক্তি করতেই পারেন। খোদার কসম, যুদ্ধের ফায়সালার ব্যাপারে নবীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলা কোনো মুজাহিদ বরদাশত করতে পারে না। কেউ এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাকে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। আমি সবাইকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি।’
তার এ বক্তব্যের পর পথেঘাটে এ নিয়ে আলোচনা বন্ধ হলেও ঘরের চারদেয়ালের ভেতর এ আলোচনা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করলো। গোয়েন্দা মারফত সব খবরই পাচ্ছিলেন মহানবী সা:। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি। যখন মদীনাবাসীর ঐক্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি তখন এ ধরনের আলোচনা নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। অবস্থা জটিল আকার ধারণ করলে তিনি সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। বললেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি তোমার বান্দাদের গায়েবি মদদ দিয়ে হেফাজত করো। আমাদের ওপর তোমার রহম নাজিল করো।’
মহানবী সা:-এর এ প্রার্থনা যে বিফল যায়নি তার সাক্ষী তো স্বয়ং খালিদ বিন ওয়ালিদ। আজো তার মনে পড়ছে নঈমের কথা। নঈম বিন মাসউদ। গাতফান গোত্রের এক চৌকস যুবক। বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে সে ছিল সবার পরিচিত। যুদ্ধের সময় তিনটি গোত্রের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করা ছিল তার অন্যতম গুরু দায়িত্ব। এ তিনটি গোত্র হচ্ছে কুরাইশ, গাতফান ও বনু কোরাইজা। গাতফান গোয়েন্দা বাহিনীর সে ছিল অন্যতম সদস্য।
যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগের কথা। কুরাইশদের পয়গাম নিয়ে তাকে আসতে হয়েছিল বনু কোরাইজার কাছে। সে সময় মদীনার একদল মুসলমানের সাথে তার কথা হয়। তারা নঈমকে ইসলামের দাওয়াত দেয়। নঈম গোপনে তাদের সামনে ইসলাম কবুল করে। তার পরিচয় পেয়ে মুসলমানরা তাকে বলে, ‘এখনি তোমার মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করার দরকার নেই। এখন যে দায়িত্ব পালন করছো, করে যাও। যুদ্ধের ময়দানে একজন গোয়েন্দা হাজার যোদ্ধার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সময়ই বলে দেবে কখন নিজেকে প্রকাশ করবে।’
নঈম মাসউদ মদীনার অসন্তোষের খবরে বিচলিত হয়ে পড়লো। যুদ্ধের ময়দানে তার কাজ ছিল ঘুরে ফিরে খবর সংগ্রহ করা এবং তা সেনাপতি আবু সুফিয়ানকে জানানো। মদীনার অসন্তোষের খবর পেয়ে সে পাহাড়ের উল্টোদিকে চলে গেল এবং রাতের আঁধারে পাহাড় অতিক্রম করে মদীনায় প্রবেশ করলো। সে তার পরিচিত এক মুসলমানের বাড়িতে গিয়ে উঠলো এবং বললো, ‘আমাকে মহানবী সা:-এর কাছে নিয়ে চলো।’
রাতেই তাকে নিয়ে আসা হলো মহানবী সা:-এর দরবারে। মহানবী সা: তাকে দেখেই বললেন, ‘তুমি? তুমি তো আমাদের দলের কেউ নও। তাহলে আমার সাথে দেখা করতে চাও কেন?’
‘হুজুর, কিছুদিন আগে আমি গোপনে মুসলমান হয়েছি। এরা জানে সে খবর। তারাই আমাকে এ কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন।’ এরপর সে তার পরিচয় দিয়ে বললো, ‘মদীনায় যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে তা দূর করার ব্যাপারে আমি সামান্য চেষ্টা করতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি আমার মত করে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে আপনার অনুমতি নেয়ার জন্যই আজ আপনার দরবারে ছুটে এসেছি।’
‘আল্লাহ তোমার ওপর রহম নাজিল করুক।’ মহানবী সা: বললেন, ‘ইসলামের খেদমতের জন্যই হয়তো আল্লাহ তোমাকে এ জটিল সময়ে এখানে পাঠিয়েছেন। তোমার প্রতি আমার দোয়া রইলো।’
নঈম বললো, ‘আমি যে মুসলমান হয়েছি এটা যেন এখনই জানাজানি না হয়। আমি ফিরে যাচ্ছি, দোয়া করবেন আমি যেন সফল হই।’
রাতের আঁধারে আবার সেই পাহাড় ডিঙিয়ে নঈম ফিরে এলো মক্কার বাহিনীর কাছে। ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে। সূর্য উঠে এসেছে পূর্বাকাশে। বিভিন্ন বাহিনীর সেনাপতিরা নিজেদের তাঁবু ছেড়ে প্রাতভ্রমণে বের হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকেই চলে এসেছে আবু সুফিয়ানের তাঁবুর কাছে। আবু সুফিয়ানের তাঁবুর পাশেই ছিল বিশাল এক তাঁবু। সেনাপতিদের নিয়ে ওখানেই বৈঠক করতেন তিনি। আবু সুফিয়ান তাদের নিয়ে সেই তাঁবুর ভেতর ঢুকলেন। নানা গল্পগুজবে মেতে উঠলেন সেনাপতিরা। নঈম মাসউদ সোজা সেই তাঁবুতে গিয়ে হাজির হলো।
নঈমকে দেখেই আবু সুফিয়ান বললো, ‘আরে নঈম যে, বলো কী খবর নিয়ে এসেছো? রাতে কোথায় ছিলে? মনে হয় সারারাত ঘুমাওনি?’
নঈম বললো, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন। পাহাড় ডিঙিয়ে আমি মদীনায় গিয়েছিলাম। আপনার জন্য কোনো ভালো খবর আনতে পারিনি।’
‘সে তো কেউ আনতে পারছে না। বলো কী খবর নিয়ে এসেছো তুমি?’ আবু সুফিয়ান আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো।
‘বনু কোরাইজা আপনার বন্ধুত্ব গ্রহণ করেনি। হাইয়া বিন আফতাবের কথার জালে বন্দী হয়ে বন্ধুত্বের ওয়াদা দিলেও তারা এখনো মুসলমানদের বন্ধুই রয়ে গেছে।’
‘নঈম’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘তুমি যা বলছো বুঝে বলছো তো? তোমার তথ্যে যদি ভুল থাকে তাহলে আমি তোমায় ছাড়বো না।’
‘মদীনায় আমার কয়েকজন বন্ধু আছে বনু কোরাইজা গোত্রের। তারা কবে ময়দানে আসতে পারবে সেটা জানার জন্য ওদের সাথে আমি দেখা করি। ওদের মধ্যে যুদ্ধের কোনো আলামতই দেখতে না পেয়ে আমি কিছুটা বিস্মিত হই। আমি ওদের বলি, ‘কী ব্যাপার, তোমরা কবে ময়দানে নামছো? তোমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির কোন আলামত তো দেখতে পাচ্ছি না।’
আমার কথার জবাব না দিয়ে ওরা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। আমি বলি, ‘কী ব্যাপার, কথার জবাব দিচ্ছো না কেন?’
আমার এক বন্ধু বলে, ‘নঈম, তুমি এতো বোকা কেন? তুমি জানো না আমরা মুসলমানদের পেটের ভেতর বসবাস করি। জলে বাস করে কুমিরের সাথে কি লড়াই করা যায়?’
‘কিন্তু তোমরা তো আবু সুফিয়ানকে কথা দিয়েছো। আবু সুফিয়ানের উপঢৌকন গ্রহণ করেছো।’
‘আমাদের সরদার মদ আর মেয়ে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। তা ছাড়া হাইয়া বিন আফতাবের কথার মারপ্যাঁচে পড়ে আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু ওটা তার মনের কথা ছিল না। তিনি জানেন, এ যাত্রা আবু সুফিয়ানকে ব্যর্থতার বোঝা নিয়েই ফিরে যেতে হবে। মদীনায় আক্রমণ করার সাধ তার পূরণ হবে না।’
তাদের কথা সত্য না মিথ্যা এটা যাচাই করার জন্য রাতেই আমি কাব বিন আসাদের বাড়িতে যাই। তার চাকর প্রথমে আমাকে ঢুকতেই দিতে চায়নি। তাকে বললাম, ‘তুমি জানো না, তোমার মনিব আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব কবুল করেছে? তার জন্য গোপন বার্তা আছে, এখনি দেখা না করলে তার মহা ক্ষতি হয়ে যাবে।’ আমার এ কথার পর চাকর ফটক খুলে দিল। ভেতরে গিয়ে আমি তো অবাক। কাব বিন আসাদ আপনার দেয়া মদ পান করছে, তার দুই পাশে আপনার পাঠানো দুই মেয়ে। আমি তাকে বললাম, ‘কাব, এসব কী শুনছি?’
‘কী শুনছো বন্ধু?’
‘আপনি নাকি আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব ফিরিয়ে দিচ্ছেন?’
তিনি মদের গ্লাস টেবিলে রেখে আমার দিকে গভীর চেখে তাকালেন। বললেন, ‘কে বললো তোমাকে এ কথা? আমি তার বন্ধুত্ব কবুল না করলে সে আমাকে এই নারী ও মদ পাঠাবে কেন? আর আমিই বা তা গ্রহণ করবো কেন?’
‘তাহলে ওয়াদা মতো আপনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন না কেন?’ আমি জানতে চাইলাম।
হাসলো কাব বিন আসাদ। বললো, ‘অ, এই কথা? দেখো, মুসলমানদের সাথে আমাদের চুক্তি হচ্ছে, ওরা আক্রান্ত হলে আমরা ওদের সাহায্যে এগিয়ে যাবো এবং আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবো। এই চুক্তির দাবি হচ্ছে, আমরা এখন মুসলমানদের সাথে মিলে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরি। কিন্তু আমি কি তাই করছি? আমি কি আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্বের খাতিরে আমার তলোয়ার কোষবদ্ধ রাখিনি? তাহলে আবু সুফিয়ানের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন?’
বুঝলাম কাব বিন আসাদ চোখ উল্টে ফেলেছে। সে আমাদের পক্ষে অস্ত্র ধরবে না।
ভেসে এলো আবু সুফিয়ানের হুঙ্কার, ‘নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। আমার সাথে চালাকি করবি আর আমার পাঠানো মদ খেয়ে আমারই দেয়া মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করবি? তোকে যদি হত্যা করে আমার ঘোড়ার পেছনে বেঁধে মদীনা থেকে মক্কা পর্যন্ত টেনে নিয়ে না যাচ্ছি তবে আমার নাম আবু সুফিয়ান না।’ প্রচন্ড রাগে দাঁতে দাঁত পিষছিল আবু সুফিয়ান। বললো, ‘আমি মদীনার অবরোধ উঠিয়ে নেবো। মক্কা ফেরার আগে বনু কোরাইজার বস্তি আমি বালুর সাথে মিশিয়ে দেবো।’
খালিদ তখন ওখানেই ছিল। যা বোঝার বুঝে নিলো সে। বুঝলো, অর্থহীন এক অভিযানের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে সে। আবু সুফিয়ানের পক্ষে মদীনা আক্রমণ করা আর সম্ভব হচ্ছে না। মুসলমানদের অস্তিত্ব দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে সে মক্কা ছেড়েছিল, সে স্বপ্ন আর পূরণ হবার নয়। অপারগতার দুঃসহ ভারে নুয়ে এসেছিল তার মস্তক। মাথা নত করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছিল খালিদ। আজো সে স্মৃতি তার অন্তরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। তবে সেদিন ছিল অন্তর জুড়ে ব্যর্থতার হাহাকার, আজ সে ব্যর্থতার কথা স্মরণ করে অন্তরে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করছিল খালিদ।
(চলবে)