Home তোমাদের গল্প একটি কলমের জন্য

একটি কলমের জন্য

নাবিউল হাসান#

‘পাঁচটা টাকা দেনতো আব্বু কলম কিনতে হবে’ জসিম তার বাবার কাছে আবদার করে।’
‘যখন তখন টাকা চাস কেন? কলম তোর স্কুল থেকে দিতে পারে না? টাকা খরচ কইরা এত লেখাপড়া শিখনের দরকার নাই।’ সোজা সাপটা জবাব দেন জসিমের বাবা ফালু মিয়া। ফালু মিয়া একজন রিকশাচালক, লেখাপড়ার মূল্যায়ন তিনি বুঝেন না। ফাহিমা, জসিম ও শাকিল তার তিন সন্তান। ফাহিমা সবার বড়। সে মিন্টু সর্দারের বাড়িতে কাজ করে। একমাত্র জসিমই স্কুলে যায়। আর শাকিলের বয়স মাত্র ৪ বছর। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা নেই ফালু মিয়ার। তাই তাদের পেছনে দু-চার টাকাও খরচ করেন না ফালু মিয়া। তিনি মনে করেন লেখাপড়া শিখে গরিব মানুষের কোন কাজ নেই। কারণ ঘুষ ছাড়া আজকাল চাকরি-বাকরি একদম অসম্ভব। অতএব তাদের মত লোকের এসব করার কী দরকার?
বাবার ধমক খেয়ে জসিমের মন ভারি হয়ে যায়। রাগ আর অভিমানে মুখটা লাল করে স্কুলের পথে হাঁটা ধরে সে। এলোমেলো অনেক কথা তার মাথায় চলে আসে। আচ্ছা সিগারেট খেলে কী লাভ হয়? বাবা যখন দিনে এক প্যাকেট করে সিগারেট কিনে তখন টাকা নষ্ট হয় না? আমার একটা কলমের টাকা দিতে তার এত আপত্তি কেন? আমি তো বাজে কাজ করার জন্য টাকা চাইনি। আব্বু আমার সাথে এমন ব্যবহার করেন কেন? লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হয়ে সবার মুখ উজ্জ্বল করাই তো আমার ইচ্ছা। আমার বন্ধুরা আইসক্রিম চকোলেট খেয়ে কত টাকা-পয়সা নষ্ট করে, আমি তো তা-ও করি না। নানা চিন্তা করতে করতে পথ চলতে থাকে। এক সময় স্কুলে পৌঁছে যায় সে। ক্লাস থ্রিয়ে পড়ে জসিম। বন্ধুরা দুষ্টুমি শুরু করে কিন্তু তার কিছু ভালো লাগে না। হঠাৎ ক্লাসে ঢুকলেন হানিফ স্যার। রোল হাজিরা করে স্যার নির্দেশ দিলেন ৩ নাম্বার প্রশ্নের উত্তর লিখতে। সবাই লেখা শুরু করলো কিন্তু জসিমের শুরু করা হলো না। কারণ ওর কলম নেই। গত দুই দিন অন্য জনের কলম দিয়ে লিখেছে। আর কত অন্যের কাছে হাত পাতা যায়। স্যারের দৃষ্টি গেল সেদিকে। কিরে জসিম লিখছিস্ না কেন?
‘স্যার আমার কলম নেই।’ উত্তর আসে জসিমের মুখ থেকে।
‘কয়েকদিন ধরে একই কথা বলছিস তাই না?’- রাগত স্বরে উঠে দাঁড়ান স্যার। ডাস্টার হাতে নিয়ে পাঁচ থেকে সাতটা আঘাত বসিয়ে দিলেন জসিমের দুই হাতে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না জসিম। হানিফ স্যার খুব ধনী মানুষ। তাই জসিমের মতো ছাত্রের সমস্যার কথা তার ভাবার সময় নেই।
সব ছাত্রছাত্রী উত্তর লিখে খাতা জমা দিলো। কিন্তু জসিমকে কান ধরিয়ে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। খাতা কেটে চলছেন স্যার। চুপে চুপে কাঁদছে জসিম। খাতা দেখা শেষ করে নতুন পড়া দিলেন স্যার। সবার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন-
জসিমের বাড়ির কাছে কার বাড়ি?
‘স্যার আমার বাড়ি’- উত্তর দিলো হাবলু।
‘তার বাসায় গিয়ে বলবে, লেখাপড়া করা জসিমের কাজ নয়, অন্য কোন কাজ করে খাবে সে’- বললেন স্যার।
ধক্ করে উঠলো জসিমের ছোট্ট বুকটা। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে তার।
হাবলু গিয়ে স্যারের কথাটা বলে দিল জসিমের মাকে। জসিমের মা ভাবলেন স্যার হয়তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সব কথাই যে একইভাবে মূল্যায়ন করা ঠিক নয় এটা  বোঝার সাধ্য নেই সহজ-সরল জোৎস্না খাতুনের। পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন মিন্টু সর্দার। লোকটা মোটামুটি জনদরদি কিন্তু অশিক্ষিত। বাজারে তার বড় ঝালাই মেশিনের দোকান। যেখানে লোহা দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করা হয়।
‘কী ব্যাপার ফাহিমার মা কী ভাবছো?’- জিজ্ঞেস করলেন মিন্টু সর্দার। জোৎস্না খাতুন জসিমের ব্যাপারে আলোচনা করলেন তার সাথে। ঝালাই মেশিনে কাজ শিখতে পারলে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানালেন সর্দার। এতেই খুশি হয়ে গেলেন জোৎস্না খাতুন। মিন্টু সর্দারের কথা রাতে ফালু মিয়াকে জানালেন তিনি। ফালু মিয়া ভাবলেন ছেলে এখন থেকে কাজ শিখতে পারলে তো ভালোই হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ছেলেকে মিন্টু সর্দারের কাছেই দেবেন।
জসিমকে নিয়ে যেতে তাদের বাসায় এলেন মিন্টু সর্দার। জসিম কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। জোৎস্না খাতুন তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন ছেলে জসিমকে। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে দিল সে। লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হতে চেয়েছিল জসিম। কেউ তার মনের ইচ্ছা ও প্রবল উচ্ছ্বাসের কথা বুঝলো না। বাবা-মায়ের কথার অমত করতে নেই বলে উপদেশবাণী ঝাড়তে লাগলেন মিন্টু সর্দার। জসিমের সঙ্গে তার মা জোৎস্না খাতুনও কাঁদতে লাগলেন আর জসিমের চোখের পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিলেন। ছেলেকে সাজিয়ে গুজিয়ে অনেক সান্ত্বনাবাণী শুনিয়ে সর্দারের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
ঝালাই মেশিনের দোকানে কাজ করে যাচ্ছে ছোট্ট জসিম। মিন্টু সর্দার তাকে কাজের বেশি চাপ দেন না। ছোটখাটো কাজ তার। এই যেমন দু-একটা লোহার পাত এখান থেকে ওখানে আনা-নেয়া করা এই আর কি। মেশিনের কাছে একটা রড আনতে যায় জসিম। রডের অন্য প্রান্ত বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে লেগে যায়। জসিম কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই চলে যায় সে না-ফেরার দেশে। পৃথিবীর কেউ হয়তো জানে না সামান্য একটি কলমের জন্য জসিমকে আর এ ধরায় থাকা হলো না।

SHARE

Leave a Reply