Home নাটিকা একটি পিন

একটি পিন

 হুসনে মোবারক#

(১৫ বছরের এক বালক পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে মঞ্চে ওঠে। উন্মুক্ত ডান পায়ের হাঁটুর নিচে পচে পচে পুঁজ বেরুচ্ছে। অসুস্থ, রোগা-পাতলা ধরনের চেহারা।)

বালক : কী, আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছ না! পচা দুর্গন্ধের উটকো গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসছে! না-না, যেও না, এই যে আমি আমার পা ঢেকে দিচ্ছি। আমি আসলে তোমাদের কিছু কথা বলতে চাই। আমার নাম রাসেল। ক্লাস সেভেনে পড়তাম। আমার বাবা গাড়ির মেকানিক, সতীনপুর চৌরাস্তার মোড়ে গ্যারেজ আছে। তোমাদের বাবা কেমন জানি না, তবে আমার বাবা খুবই চালাক। অনেক টাকা তার। গ্যারেজে আমার মত, তোমাদের মত, অনেক ছেলে কাজ করে। তয় সবার কাজ কিন্তু এক না, মানে সবাই গাড়ির মেকার না।
…ও আচ্ছা, আমি তো বাবার গল্প বলতে আসিনি। এই যে আমার পা দেখতে পাচ্ছ.., ঠিক ঠিক আছে…, সরিয়ে নিচ্ছি…। আমি মূলত আমার এই অবস্থা কী করে হলো তা-ই বলতে চাই। যা দেখে বারবার তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ, যার কারণে উটকো গন্ধে তোমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে তার কথা বলতে চাচ্ছি। আসলে আমার পা এ রকম ছিল না। আমি তোমাদের মত একজন সুস্থ, সুন্দর মানুষ ছিলাম। একদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। হঠাৎ সামনের চাকা পিছলে পড়ে গেলাম রাস্তার পাশে। না-না, পড়ে গিয়ে খুব বেশি ব্যথা পাইনি, কিন্তু সমস্যাটা হলো পরে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা পিন ঢুকে গেলো ডান পায়ে। পুরনো মরিচা ধরা এই পিনটিই যে আমার জন্য এতটা দুঃখ বয়ে আনবে তা ভাবতে পারিনি। ডাক্তার বলেছেন, আমার পা না-কি আর ভালো হবে না। হয়তো কেটে ফেলতেও হতে পারে। এখন আমি আর ওসব নিয়ে ভাবি না। কারণ, এখন তো আমার আর কেউ নেই, যে আমার চিকিৎসার খরচ দেবে…।
এখন আমি আমার বাবা-মা থেকে অনেক দূরে। মা মারা গেছেন বহু আগে। আর বাবাকে ছেড়ে আমিই চলে এসেছি। কেন? কারণ, আমার এই অবস্থার জন্য বাবাই দায়ী। তার গ্যারেজের পাশেই সেদিন আমি সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। আর ঐ যে পিন, যেটা আমার পায়ে ঢুকেছিলো সেটা বাবার গ্যারেজের আমার বয়সী ছেলেরা রাস্তায় ছিটিয়েছিলো। বাবাই তাদের নিয়োগ করেছেন পিন ছিটানোর কাজে। যাতে করে রাস্তায় চলাচল করা গাড়ির চাকা ফুটো হয়। চাকা ফুটো হলেই বাবার লাভ। কাছাকাছি এই গ্যারেজ ছাড়া আর কোনো গ্যারেজ নেই। সুতরাং দিনে বিশ-পঞ্চাশটা গাড়ির চাকা পাংচার হওয়া ছিলো স্ব^াভাবিক ব্যাপার। আরো বেশিও হয়। পিন ফেলানোর কাজে নিয়োজিত ছেলেরা কমিশনও পেত। প্রতি চাকা ২০ টাকা করে। সেই পিনেই আজ আমার পায়ের এই অবস্থা। পরের জন্য গর্ত করলে সে গর্তে নিজেই পড়তে হয়। বাবার লোভের কারণে তারই আদরের সন্তান আজ পঙ্গু প্রায়।
আমি যখন জানতে পারলাম এটা আমার বাবার কাজ তখন যতটা না কষ্ট পেয়েছি পায়ের আঘাতে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই কাজ আমার বাবা করেছেন জানতে পেরে। আর তাই ঘৃণা আর দুঃখে বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছি এই দূরের শহরে, যেখানে আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না। আমি ভাবতেই পারিনি; আমার বাবা এমন একটি ঘৃণ্য কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছেন।
খবরদার, তোমরা কেউ বাবাকে খবর দেবে না। আমি আর কখনো ফিরে যাবো না, এমন একজন খারাপ মানুষের সাথে থাকার চেয়ে একা একা থাকা অনেক ভালো। না থাকুক কেউ। তাতে কী। আমি একাই থাকবো। তবে বাবা যদি নিজেকে শোধরাতে পারেন, মানুষের অনিষ্ট থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন, তাহলে হয়তো ফিরে যেতে পারি। আমি জানি না, আমার এ স্বপ্ন পূরণ হবে কি-না!

SHARE

Leave a Reply