Home গল্প তবুও প্রত্যাশা -চঞ্চল শাহরিয়ার

তবুও প্রত্যাশা -চঞ্চল শাহরিয়ার

মল্লিক বাড়ির অতি আদরের ছোট ছেলে তবিয়াল। পড়াশুনা ছাড়া সে সকল কাজের কাজী। টিভি দেখা, খেলা করা, কারো আমবাগানে হানা দেয়া, পুকুরে ঘণ্টাব্যাপী সাঁতার কাটা, সর্র্দি-কাশি বাঁধিয়ে মানুষের ঘুম হারাম করায় তার জুড়ি নেই। তবিয়ালের দস্যিপনার চিরসাথী রয়েল, জুয়েল, অন্তু আর তাপস।
ভাগ্যগুণে আজ শুক্রবার। স্কুল ছুটি। বাঁচা গেল। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না। পড়াশুনার ঝামেলাও নেই। আগামীকালের বিষয়
আগামীকাল ভাবা যাবে।
ক্লাস সিক্সে পড়া তবিয়ালের পড়াশুনায় এতো অমনোযোগী ভাব দেখে মা-বাবা চিন্তিত। ভাইবোনেরা চিন্তিত। ছোট চাচা, ফুফুরাও রাতদিন বকাঝকা করে।
তবিয়ালের এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। সবার কথা এ-কান দিয়ে শুনে ও-কান দিয়ে বের করে দেয়। সারাদিনে বিস্তর কর্ম সেরে সন্ধ্যায় ছটাকখানিক পড়ে ঘুমানোর পাঁয়তারা করে। বাড়িতে ভাইবোনের সাথে মারামারি, খুনসুটি করে বলে ওকে তার মেজ চাচার বাসায় রাতে ঘুমাতে পাঠানো হয়। তবিয়াল এতে খুশি। রাতভর টিভি দেখা যায়। তখন আর চোখে ঘুম আসে না। তবিয়াল মনে মনে ভাবে আহা! যদি এ রকম একটা রুম থাকতো আমার। টিভি থাকতো। জীবনটা ধন্য হয়ে যেতো।
চাচা ফুফুরা অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর চা নাস্তা খায়। টিভি দেখে। গল্প করে। তবিয়াল ভাবে, সন্ধ্যো বেলা না পড়ে যদি এ রকম চাচা-ফুফুদের মতো টিভি দেখতে পারতাম, গান শুনতে পারতাম।
তবিয়ালকে কে বোঝাবে চাচা ফুফুরাও একদিন ওর মতো ছোট ছিল। পড়াশুনা করে চাকরি বাকরি করে এখন প্রতিষ্ঠিত।
মুড়ি পকেটে পুড়ে গুলতি হাতে নিয়ে তবিয়াল বন্ধুদের খোঁজে বের হয়। ছোট চাচাদের রাইস মিলের ওখানে জুয়েলদের সাথে দেখা। সবাই মিলে আমবাগনের ছায়ায় গিয়ে বসে। রয়েল খবর দেয় আজ বিকেলে মুন্সী পাড়া আর সরদার পাড়ার মধ্যে ফুটবল খেলা হবে। দক্ষিণ পাড়ার বড় মাঠে।
খানিক বাদে রবু এসে হাজির। বলে, তবিয়াল তুই আজ আমাদের দলের হয়ে খেলবি। আমরা তোকে হায়ার করলাম।
তবিয়াল ঠোঁট উল্টে বলে, উহু আমি হায়ার টায়ারে যাবো না। আমি মুন্সী পাড়ার হয়ে এতো দিন খেলেছি। ওদের হয়েই খেলবো।
রবু বলে, তাহলে আজ আমরা আবার গোল খাবো। তবিয়াল রবুকে মুড়ি খেতে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়।
রবু চলে গেলে তবিয়ালরা গল্পে মশগুল হয়। পচা মিয়ার পুকুরের কী করে মাছ মারা যায়, আগামী শুক্রবার বনভোজনের জন্য মোরগ কোথায় পাওয়া যায়, এখন কে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়বেÑ এই সব।
তবিয়ালদের সকল পরিকল্পনার আখড়া এই আমবাগানে বসেই হয়। আমবাগানের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বড় রাস্তা। উত্তরে মল্লিকদের জমি। পশ্চিমে পচা মিয়ার আমবাগান, পুকুর, নারকেল গাছের সারি। তারও ও-পাশে প্রাসাদতুল্য পচা মিয়ার বাড়ি।
পচা মিয়ার প্রাসাদতুল্য এই পুরনো বাড়িতে তবিয়ালে খুব ঢোকার ইচ্ছা। কিন্তু ওর দস্যিপনার কথা পাড়ার সবাই জানে বলেই ও বাড়ির আঙিনা কখনো মাড়ানো হয়নি।
অন্তু অবশ্য পচা মিয়ার প্রাসাদতুল্য বাড়িটার অনেক খোঁজখবর রাখে। পচা মিয়াকে ও দাদা বলে ডাকে। পুতা ছেলে হিসেবে শুর গ্রহণযোগ্যতা অনেক। ও বাড়ির ওপর নিচে সব কয়টা ঘর, বারান্দা, ছাদ, চিলেকোঠা অন্তু ঘুরেছে। প্যাঁচানো সিঁড়ি, ভূতের ঘর সব দেখার সুযোগ হয়েছে।
বাড়িটায় মানুষের সংখ্যা কম বলে সর্বদাই নির্জন থাকে। দিনের বেলাতেও কেমন গা ছমছম ভাব। অন্তু শুনেছে, এক যুগ আগে বাড়িটা খুব কোলাহলময় ছিল। গৃহকর্ত্রী মারা যাবার পর বাড়িটাতে প্রায় ঘুঘু চরবার উপক্রম।
অন্তুর মুখে গল্প শুনে তবিয়ালের কৌতূহল বাড়ে। বিশেষ করে বাড়িটার চিলে কোঠায় ওঠার খুব শখ। ওখান থেকে কেমন দেখা যায় তবিয়ালের প্রিয় গ্রাম সলেমানপুর? আর শখ ভূতের ঘরটা ঘুরে দেখার।
ভূতের ঘর বিষয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা অন্তু দিতে পারে না। শুধু শুনেছে ঘরটা খুব ঠাণ্ডা, আর অন্ধকার। সাপের উৎপাত দারুণ। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে জাত সাপ আর কানন সাপের মতো বিষধর সাপ ঘুরে বেড়ালেও কাউকেই আজ পর্যন্ত ক্ষতি করেনি ওরা।
তাপস এ মুহূর্তে একটা নতুন খবর দেয়, অলক ভাইয়ের ছোট চাচা এসেছেন ঢাকা থেকে। বাড়ি থেকে খুব একটা বের হয় না। দিনরাত পড়াশোনা করে। অলক ভাই, পলক ভাই, রথী আপুদের সাথে গল্প গুজব করে। ঢাকায় একটা কলেজে অধ্যাপনা করেন অলক ভাইয়ের ছোট চাচা।
অধ্যাপনার কথা শুনে ঢোক গেলে তবিয়াল। আবার পড়াশুনা….।
তাপস বলে, তুই এতো পড়াশোনার ভয় পাস কেন? বড় কিছু হতে হলে তো পড়াশোনা করতেই হবে।
তবিয়াল গুলতি ছুড়তে ছুড়তে বলে, জ্ঞান দিসনে।
-জ্ঞান দেবার কী হলো? অন্তুর মতো আমিও তো ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি। এইটেও বৃত্তি দেবো। আমি তো চাই তুইও আমাদের মতো পড়াশুনায় সমান এগিয়ে যাবি।
– আমার দ্বারা পড়াশুনা হবে না।
– কেন?
– ইংরেজি আর অঙ্ক খুব ঝামেলা করে।
– ঝামেলা ভাবলেই ঝামেলা, ইংরেজি ঠিকমতো পড়লেই সহজ হয়ে যাবে। অঙ্ক মনোযোগ দিয়ে করলেই পানির মতো সহজ…।
পড়াশুনার কথা শুনলে তবিয়ালের গায়ে জ্বর আসে। বেশি পীড়াপীড়ি করলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। সকল কাজের কাজী হয়েও তবিয়াল কিন্তু রয়েল, জুয়েল, অন্তু বা তাপসের থেকে পড়াশুনায় পিছিয়ে।
অন্যদিন হলে তাপসকে এক ধমক দিয়ে তবিয়াল প্রসঙ্গ চেঞ্জ করতো। আজ কেন জানি তাপসের কথাগুলো ওকে ভাবালো। তাপসরা তো তবিয়ালদের চেয়ে কতো গরিব। তিনবেলা ভাতও ঠিকমতো খেতে পায় না।
জুয়েল বলে, অলক ভাইয়ের চাচার কিন্তু প্রাইভেট কার আছে। উনি সেটা নিজেই ড্রাইভ করেন।
এ কথা শোনার পর তবিয়াল চুপসে যায়। তাপস বড় হয়ে ডাক্তার হবে। অন্তু হবে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। জুয়েল নামকরা ক্রিকেটার, রয়েল ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার। তবিয়ালের কোন টার্গেট নেই। টার্গেট ছাড়া মানুষ কিভাবে চলে?

SHARE

Leave a Reply