আসাদ বিন হাফিজ
গত সংখ্যার পর
[dropcaps round=”no”]প[/dropcaps]দাতিক বাহিনীর জওয়ানরা আবু সুফিয়ানের চিৎকার শুনে ময়দানের দিকে তাকাল এবং দেখতে পেল ময়দানে তাদেরই পতাকা উড়ছে। ওরা তখন হোবল জিন্দাবাদ! উজ্জা জিন্দাবাদ!! ধ্বনি দিয়ে ময়দানে ফিরে এলো এবং মুসলমানদের ঘিরে ফেললো।
খালিদের সে সময়ের কথা স্মরণ হল, যখন সে ময়দানে রাসূল (সা)-কে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে ঘটনার চার বছর পর আজ আবার সে মদিনায় রাসূলের কাছে ছুটে যাচ্ছে। তার হৃদয় সাগরে ভাসছে রাসূলের অনিন্দ্য সুন্দর প্রশান্ত মুখাবয়ব।
খালিদ এখন দিগন্তের পাড়ে ওহোদ পাহাড়টি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে খালিদের ঘোড়া আপন গতিতে আপন তালে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পাহাড়ের দিকে। সে তার হৃদয় কাবায় এমন এক প্রশান্তি অনুভব করল যা সে ভাষায় ব্যক্ত করতে অক্ষম। তার মনে হচ্ছিল এখন আর তার কোন তাড়া নেই। অন্য সময় গন্তব্যে পৌঁছে যেমন ঘোড়ার লাগামে ঝটকা মেরে জলদি পৌঁছার জন্য গতি বাড়াতো, আজ তেমন কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যদিও যে গন্তব্য স্থানে সে চলছে সে স্থানটি এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তার কেবল মনে হচ্ছে, কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর সে টানে সে চুম্বকের মত এগিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রের দিকে।
‘খালিদ!’ সহসা তার ভেতর থেকে কে যেন ডেকে উঠল তাকে। কিন্তু সে সত্যি কেউ তাকে ডেকেছে মনে করে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে চারদিকে চোখ বুলালো, কিন্তু আশপাশে বালি ছাড়া আর কিছ্ ুদেখতে পেল না। আবারো আওয়াজ হলো খালিদ, একি সত্যি, যা আমি শুনেছি। খালিদ এবার চিনতে পারলো এটা কার শব্দ। এ শব্দ তার সঙ্গী ও বন্ধু আকরামার।
গতকালই আকরামা তাকে বলেছিল, যদি তুমি ভেবে থাক, মুহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত নবী তবে তুমি সে ধারণা মন থেকে মুছে ফেল। মুহাম্মদ আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজনের খুনি।
নিজের সম্প্রদায়ের দিকে তাকাও, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না সূর্য ডোবার আগেই মুহাম্মদকে হত্যা করার শপথ নিয়ে কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে!’
খালিদ অশ্বের লাগাম টেনে ধরা সামান্য ঝাঁকুনি দিল। আবার চলতে শুরু করলো ঘোড়া। তার মন আবারো চার বছর অতীতে চলে গেলো। যখন সে ওহোদ যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-কে খুঁজেছিল। সূর্য ডোবার আগেই রাসূলুল্লাহকে হত্যা করার শপথ তো সেদিন তারও ছিল। মুসলমান তীরন্দাজরা পাহাড়ের অবস্থান ছেড়ে গিয়েছিল বলেই না সেদিন সে আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের ও তার নয়জন সঙ্গীকে শেষ করতে পেরেছিল। খালিদের চাইতে এ কথা আর কে বেশি জানে সেই যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজয় বরণ করেছিল শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদেশ অমান্য করার কারণে। খালিদ ও আবু জেহেলের বেটা আকরামা যুদ্ধের কৌশলে যতই পটু থাক, তীরন্দাজরা না সরলে তাদের পরাজয় কেউ রোধ করতে পারত না।
তারপর? তারপর সেসব তীরন্দাজদের ভুল মাশুল হিসেবে যখন তারা পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করলো তখনকার ঘটনাই কি সে ভুলতে পারবে? তাদের কাছে তখন বিচ্ছিন্ন মুসলমানকে হত্যা করা কোন ব্যাপারই ছিল না। সে সময় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মুসলমানদের সাহায্য করার আর কেউ ছিল না। খালিদ দেখেছিল, মুসলমানরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মুসলমানদের বড় অংশটা ছিল বিচ্ছিন্ন, যারা রাসূলুল্লাহর কমান্ড থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। রাসূল (সা)-এর সঙ্গে তখন মাত্র গুটিকয় সাহাবী। তাদের মনে মাল-দৌলতের কোন লোভ নেই। সংখ্যায় তারা মাত্র জনাত্রিশেক। এর মধ্যে ছিলেন আবু দাজানা, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, হজরত আলী, হজরত আবদুর রহমান বিন আওফ, হজরত আবু বকর, হজরত আবু ওয়ায়দা, তালহা বিন আবদুল্লাহ, মাসআব বিন আমীর প্রমুখ। মাত্র ত্রিশজন অথচ সকলেই কেমন মৃত্যুভয়হীন। কী অনড়, অটল, সঙ্কল্পদৃঢ় চেহারা! সেই চেহারা যে জীবনে একবার দেখেছে কোনদিন তা ভুলতে পারবে না।
যে চৌদ্দজন মহিলা আহত মুজাহিদদের দেখাশোনা ও সেবা -শুশ্রƒষার জন্য এসেছিলেন, তাদের মধ্যে দুইজন মাত্র রাসূল (সা)-এর পাশে ছিলেন। একজন উম্মে আম্মারা ও অন্যজন উম্মে আয়মান (রা) যিনি ছিলেন এক হাবশী মহিলা। উম্মে আয়মান (রা) হুজুর (সা)-এর শিশুকালে দাঈ ছিলেন। বাকি বারোজন মহিলাই তখন পর্যন্ত আহদের জখমে ব্যান্ডেজ বাঁধা কাজে ব্যস্ত।
খালিদ রাসূল (সা)-কে খুঁজছিলো। কিন্তু ময়দানে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করার সুযোগ ছিল না। তার কারণ তার অধীনে চলছে সেই অশ্বারোহী বাহিনী যারা একটু আগে নিজেদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করেছে। এসময় হঠকারী সিদ্ধান্ত বা এলোমেলো আক্রমণের কোন অবকাশ ছিল না। শত্রু বিনাশের চাইতে এ বিজয় ধরে রাখাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আজ চার বছর পরও সেসব কথা, সেসব স্মৃতি কতই না জীবন্ত, কতই না বাস্তব হয়ে ধরা পড়ছে। আজ যখন সে সম্পূর্ণ একাকী মরুভূমির দিগন্ত বিস্তৃত রাস্তায় ঘোড়া ছুটাচ্ছে তখনো সে তার মাথার মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে ছুটন্ত ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে তীর-ধনুকের শন শন আওয়াজ। শুনতে পাচ্ছে মর্দে মুজাহিদ মুষ্টিমেয় মুসলমানের বজ্রনিনাদের তকবির ধ্বনি। এই তকবির ধ্বনি যে তাদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে দিচ্ছে এর ফলে যে তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে ভয়াল মৃত্যুর বিভীষিকা, এ কথা কি তারা একবারেরও জন্যও ভাবছে না? এটাকে মুসলমানদের বোকামি ভেবে তিরস্কার ও ঘৃণায় তার মুখে হাসি এসেছিল। মনে মনে ভেবেছিল, ভাল হলো, যত বেশি সম্ভব মুসলমানকে হত্যা করে নেবো এই সুযোগে। যত কমসংখ্যক বন্দী করা যায় ততই ভালো। এসব যখন ভাবছিল তখনও তার চোখ খুঁজে ফিরছিলো রাসূল (সা) কে। কিন্তু কোথায় রাসূূলে মকবুল (সা)?
সে দেখত পেলো আবু সুফিয়ান পলায়নরত কুরাইশদের সাথে নিয়ে ফিরে এসে মুসলমান সৈন্যদের বড় অংশের ওপর আক্রমণ করে বসেছে। মুসলমানরা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও প্রাণের মায়া ছেড়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতা ও তেজের সাথে লড়াই করছে। তারা জীবনের শেষ যুদ্ধ মনে করে বীরত্ব ও নির্ভীকতার এমন সব প্রদর্শনী দেখাচ্ছে, যা দেখে কুরাইশ সৈন্যরা হতবাক হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থা দেখে খালিদ ক্ষেপে গেল। সে তার অশ্বারোহী বাহিনীকে আবু সুফিয়ানের সাহায্যে ছুটে যেতে হুকুম দিল। মুসলমানদের ওপর পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করে বসল খালিদের বাহিনী। খালিদ তলোয়ার খাপের মধ্যে রেখে বর্শা তুলে নিল হাতে। আক্রমণ করে বসলো পেছন থেকে। বর্শার আঘাতে একের পর এক মুসলিম মুজাহিদকে হত্যা করে চললো সে। তার বর্শা যখন কোন মুসলমানকে বিদ্ধ করতো তখন সে চিৎকার দিয়ে বলে উঠতো, আমি আবু সোলায়মান! প্রতিটি বর্শাবিদ্ধ মুজাহিদ শুনতে পেত সেই একই গর্জন, ‘আমি আবু সোলায়মান!’
আজ চার বছর পর যখন সে মুসলমানদের কেন্দ্রভূমি মদিনার দিকে চলেছে তখন তার সেই গর্জন ভেসে আসছে নিজের কানে, ‘আমি আবু সোলায়মান!’ তার জানা নেই তার বর্শা কত মুসলমানকে হত্যা করেছিল। খুনের নেশায় তখন সে রাসূল (সা)-এর কথাও ভুলে গিয়েছিল। একটু পরে যখন সে জানতে পারলো, মুসলমানরা তাদের নবীর (সা) আদেশে ময়দান ছেড়ে সরে পড়েছে, আর আকরামা তাদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন তার হুঁশ হলো।
যুদ্ধের অবস্থা তখন খুব নাজুক। মুসলমানরা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, দুশমনরা রাসূল (সা)কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সঙ্গী সাহাবীরা তাঁকে ময়দান থেকে সরিয়ে নিতে চাইলেন কিন্তু তিনি সঙ্গীদের ছেড়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে যেতে রাজি হলেন না। অগত্যা সাহাবীরা তাঁকে ঘেরাও করে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি জানতেন, কুরাইশরা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার ও তাঁর দলের ওপর কঠিন আক্রমণ চালাবে এখন কুরাইশরা।
তিনি সাহাবীদের সাথে নিয়ে একটি পাহাড়ি আশ্রয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, সাহাবীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে রেখেছিলেন। তিনি সামান্য পথ অতিক্রম করেছেন, আকরামা ছুটে এসে অশ্বপৃষ্ঠ থেকেই হুজুর (সা.) এর ওপর আক্রমণ করে বসলো। তার সঙ্গীরা আক্রমণ করে বসলো সাহাবীদের ওপর। রাসূল (সা.) ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের আর কারো বাঁচার বিন্দুমাত্র আশা নেই। দু’জন মহিলাসহ হুজুরের (সা.) ত্রিশজন জানবাজ সাহাবী তখনো তার সঙ্গে। তারা সবাই দেহপ্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখলেন নবীজিকে।
খালিদের স্মরণ হলো, রাসূলুল্লাহ তো শারীরিক শক্তিতেও প্রসিদ্ধ। তার বড় প্রমাণ, তিনি আরবের বিখ্যাত কুস্তিগির বীর রেকানাকে তিন তিনবার উঠিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। এখন এই যুদ্ধের ময়দানে তাঁর সেই শারীরিক শক্তি পরীক্ষার সময় এসে গেছে। তাঁর জন্য প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার তামান্না নিয়ে যারা তাঁর চার পাশে দেহপ্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছিলেন হুজুর (সা) সে প্রাচীর নিজেই ছিন্ন করলেন। হাতে তাঁর ধুনক, তীরের থলিতে তীরও আছে। খালিদ তখনও মুসলিম বাহিনীর অপেক্ষাকৃত বড় দলের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। যখন সে জানতে পারলো, রাসূলুল্লাহ (সা) দুই মহিলাসহ ত্রিশজন সঙ্গী নিয়ে কুরাইশ বাহিনীর সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করছেন, তখন সে একটু অবাকই হলো।
সে বলতে বাধ্য হলো, ‘এ আসলে শারীরিক শক্তি নয়, হতেই পারে না। এ শক্তির রহস্য অন্য কোথাও, অন্য কোন খানে।’ সেই সময় হতে তাকে একটি প্রশ্নই সদাসর্বদা অস্থির করে রেখেছে, কোন বিশ্বাসটি এই শক্তি হতে পারে? সে তার নিজ সম্প্রদায়ের কারো কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আশা করতে পারে না। কারণ খুব শীঘ্রই তার ওপরও এ অপবাদ আসবে, মুহাম্মদের জাদুর প্রভাব পড়ছে তার ওপর।
আজ সে এই প্রশ্ন মাথায় নিয়েই মদিনার দিকে চলেছে। ওহোদ পাহাড়ের চূড়া এখন দিগন্তের অন্তরাল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চার বছর আগের সেই পুরনো স্মৃতি যেন তাকে ওই পাহাড় অঞ্চলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, সেখান থেকে কেউ তাকে বারবার ডেকে যাচ্ছে, ‘আবু সোলয়মান! আবু সোলায়মান!!’
সে তখনো তার মনের আয়নায় দেখতে লাগলো সেই মুষ্টিময় ত্রিশজন নারী ও পুরুষকে। দেখতে লাগলো এতো বড় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে কেমন অসীম বীরত্বের সাথে লড়াই করে চলেছে তারা! রাসূলুল্লাহ তার পবিত্র হস্তে তীর বর্ষণ করে চলেছেন। তাঁর সঙ্গী সাথীরা জীবন বিপন্ন করে তাঁকে বারবার তাদের বেষ্টনীর মধ্যে ঘিরে রাখছে। নাগাজি নামক এক ঐতিহাসিক লিখেছেন, হুজুর (সা) বারবার বেষ্টনী ভেদ করে যেদিক থেকে শত্রুরা এগিয়ে আসছে সেদিকে তীর ছুড়তে থাকেন। তাঁর শারীরিক শক্তি ছিল সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি। তীর ধনুক এমন জোরে টানতেন যে, তাঁর নিক্ষিপ্ত তীর কারো গায়ে বিঁধলে তীরের ফলা তার শরীরের একদিক থেকে বিঁধে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যেত। প্রচণ্ড চাপ সইতে না পেরে রাসূল (সা)-এর ধনুকটি হঠাৎ ভেঙে গেল। তিনি তীরগুলো সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে দিয়ে দিলেন। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসও একজন নিপুণ তীরন্দাজ। তার তীরের সামনে কেউই টিকতে পারতা না। রাসূলুল্লাহ নিজেও সাদের নিশানার প্রশংসা করতেন।
একদিকে মুসলিম মুজাহিদরা আবু সুফিয়ান ও খালিদের হাতে অকাতরে শাহাদাতের পেয়ালা পান করছেন, অন্য দিকে রাসূল (সা)-এর ত্রিশজন জানবাজ সাহাবী ও দু’জন মহিলা সাহাবী এমনভাবে যুদ্ধ করছেন যেন তাদের শরীর বলে কিছু নেই, শুধু আত্মাই যুদ্ধ করে যাচ্ছে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসকি তিবারি লিখেছেন, ‘তখন একেকজন মুসলমান একই সাথে চার, পাঁচজন কুরাইশের সঙ্গে প্রাণপণে মোকাবেলা করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের ভয়ঙ্কর রূপ ও ক্ষিপ্রতা লক্ষ করে কুরাইশরা পিছু হটে যায়।’
কুরাইশরা যখন রাসূলুল্লাহর এই জিন্দাদিল সঙ্গীদের বীরত্বের ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখলো, তখন তারা পেছনে সরে গিয়ে পাথর বর্ষণ করতে শুরু করলো। অকস্মাৎ কুরাইশের কয়েকজন অশ্বারোহী ক্ষিপ্রবেগে ছুটে এসে হুজুরের ওপর আক্রমণ চালালো। কিন্তু সাহাবীদের নিক্ষিপ্ত তীর তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করলো। তারা তখন আত্মরক্ষার জন্য সামনে মেঘের মতো তীর ও পাথর বর্ষণ করতে লাগল।
খালিদকে পরে আকরামা বলেছে, সাহাবী আবু দাজানা রাসূলের (সা) সামনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পিঠ ছিল শত্রুর দিকে। তিনি একই সাথে দু’টি কাজ করছিলেন, একদিকে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে তীরের জোগান দিচ্ছিলেন। সাদ সে তীর দ্রুত নিক্ষেপ করছিলেন কুরাইশদের দিকে। অপর দিকে আবু দাজানা রাসূলে আকরামাকে তীরের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তীর ও পাথর বর্ষণের মাঝে কেউ লক্ষ্য করেনি আবু দাজানার কী অবস্থা হয়েছে। কিন্তু যখন আবু দাজানা মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন দেখা গেল তাঁর পিঠে এত তীর বিদ্ধ হয়েছে যে তার সারা পিঠ তীরের আড়ালে হারিয়ে গেছে। নতুন কোনো তীর বসার মতো জায়গা সেখানে নেই।
রাসূলে আকরাম (সা) কে বাঁচানোর জন্য তাঁর কয়েকজন সাহাবী জীবন দান করলেন। কিন্তু যাঁরা তখনো বেঁচেছিলেন তাঁরা এমন প্রচণ্ডভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যে, আকরামা ও তার বাহিনী ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেল। কুরাইশরা ততক্ষণে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাসূলে করিম (সা) সামান্য অবকাশ পেয়ে সাহাবীদের দিকে তাকালেন। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত সকলেই কমবেশি আহত। কিন্তু এখন আহত সাহাবীদের জখমে মলম ও পট্টি বাঁধার কোনো সুযোগ নেই, আর পট্টি বাঁধারও কেউ নেই।
শত্রুরা আবারো আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য পেছনে সরে গেছে।
‘আমি কুরাইশদের পক্ষ থেকে আর এক ব্যক্তির আগমনের অপেক্ষা করছি। রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের বললেন।
‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! কে সেই ব্যক্তি?’ একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কি আমাদের সাহায্য করতে আসছে?’
‘না!’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘সে আমাকে হত্যা করতে আসবে, তার তো এখন আসার কথা!’
‘কিন্তু সে কে?’ সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন।
‘উবাই বিন খালফ।’ হুজুর (সা) বললেন।
উবাই বিন খালফ রাসূলুল্লাহর কট্টর বিরোধীদের মধ্যে একজন। সে ছিল মদিনার বাসিন্দা। সে যখন জানতে পারলো রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়তের দাবি করেছেন, তখন একদিন সে রাসূলুল্লাহর কাছে এলো এবং রাসূল (সা) কে ব্যঙ্গ করলো। নবী করীম (সা) ধৈর্যের সাথে শান্তভাবে তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন।
‘তুমি কি আমাকে এতই দুর্বল মনে কর যে আমি তোমার ভিত্তিহীন বিশ্বাসকে গ্রহণ করে নেবো?’ উবাই বিন খালফ বেয়াদবের মতো বলল, ‘আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে নাও মুহাম্মদ! কোনো একদিন দেখে নিও আমার ঘোড়া যাকে এখন খাইয়ে মোটা তাজা করছি, যখন তুমি কুরাইশদের আবার যুদ্ধের হুমকি দেবে, আমি এই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসবো, আর তুমি আমাকে যুদ্ধের ময়দানে তোমার সামনে দেখতে পাবে। তুমি বদরের স্বপ্ন ভুলে যাও। আমি আমার দেবতার কসম করে বলছি, আমি তোমাকে নিজ হাতে হত্যা করব।
‘উবাই!’ রাসূলুল্লাহ একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘জীবন ও মৃত্যু সেই আল্লাহর ইচ্ছাধীন, যিনি আমাকে নবুওয়াত দান করেছেন এবং যিনি আমাকে পথহারা লোকদের সঠিক পথে আনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এমন কথা মুখে আনবে না যা আমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ পূরণ করতে পারে। এমনও তো হতে পারে তুমি আমাকে হত্যা করতে এসে নিজেই লাশ বনে যাবে!’
উবাই বিন খালফ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মুখে এ কথা শুনে তিরস্কার ও ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে হাসতে হাসতে চলে যায়।
এখন এই ওহোদ যুদ্ধের ময়দানে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মনে পড়ে গেল উবাই বিন খালফের কথা যখন তার নাম মনে পড়েছে তখন দূরে দেখা গেল একটা ঘোড়া তীর বেগে ছুটে আসছে। সকলেই সেদিকে তাকিয়ে দেখলো।
‘আমার প্রিয় সাহাবীগণ!’ রাসূলে করীম (সা) সাহাবীদের বললেন, ‘ওই আরোহীকে দেখে আমার কিন্তু মনে হচ্ছে উবাই বিন খালফই আমার দিকে ছুটে আসছে। যদি সত্যি সে উবাই হয় তবে তাকে কোন বাধা দিও না। তাকে আমার কাছে আসতে দাও।’
ঐতিহাসিক ওয়াকেদি, মাগাজি ও ইবনে হিশাম লিখেছেন, সে আরোহী উবাই বিন খালফই ছিল।
রাসূল (সা)-এর সামনে এসে সে হুঙ্কার দিয়ে বললো, সাবধান হয়ে যাও মুহাম্মদ! উবাই এসে গেছে! এই দেখ সেই ঘোড়ার ওপর উঠেই এসেছি যে ঘোড়া তোকে দেখিয়েছিলাম।
‘ইয়া রাসূলুল্লাহ!’ রাসূলে করিম (সা)-এর তিন-চারজন সাহাবী আবেগতপ্ত হৃদয় নিয়ে এগিয়ে মিনতিভরা কণ্ঠে বললেন, ‘অনুমতি দিন হুজুর, এই খবিসকে নিকেশ করে দেই।’
‘না।’ রাসুলে আকরাম বললেন, ‘ওকে আমার কাছে আসতে দাও, ওর রাস্তা ছেড়ে দাও।’ রাসূলুল্লাহর মাথায় ঝুলওয়ালা লৌহ শিরস্ত্রাণ। হাতে বর্শা, কোমরে তলোয়ার।
উবাইয়ের ঘোড়া নিকটে এসে গেলো।
‘সামনে এসো উবাই!’ রাসূলে করীম (সা) বললেন, ‘আমি ছাড়া তোমার সাথে আর কেউ লড়বে না।’
উবাই বিন খালফ তার ঘোড়া নিয়ে রাসূল (সা)-এর কাছে এসে থামলো। মুখে তার বিদ্রƒপের হাসি। সে যে রাসূলকে হত্যা করতে পারবে এ ব্যাপারে সে যেন নিশ্চিত। তার তরবারি তখনও খাপে আবদ্ধ। রাসূল তার কাছে গেলেন। সে ছিল শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে আর হুজুর (সা) মাটিতে। সে যেই তরবারি টেনে বের করল সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম (সা) অগ্রসর হয়ে তাকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন। সে একদিকে কাত হয়ে আঘাত থেকে বাঁচতে চাইলো, কিন্তু রাসূল (সা)-এর বর্শার মাথা তার কাঁধের নিচে গেঁথে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে গেল এবং তার পাঁজরের হাড় ভেঙে গেল।
ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, রাসূলে করীম (সা)-এর আঘাত এত শক্ত ছিল যে উবাইয়ের মতো শক্তিশালী ব্যক্তি আর উঠতে পারেনি। সে পড়েছিল ঘোড়ার উল্টো পাশে, রাসূলে করীম (সা) তাকে আবার আঘাত করার জন্য ছুটে গেলেন। সে এমনটি কল্পনা করেনি। মৃত্যুর বিভীষিকা নেমে এলো তার চোখের সামনে। সে কোন রকমে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে ঘোড়া ফেলেই ছুটে পালালো। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘মুহাম্মদ আমাকে খুন করে ফেলেছে! হে কোরাইশ লোকেরা মুহাম্মদ আমাকে হত্যা করে ফেলেছে।’
কোরাইশ লোকেরা যখন দেখলো তার জখম তেমন গভীর নয়, তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, তোমাকে কেউ হত্যা করেনি, সামান্য আঘাত পেয়েছো, দুই দিনেই সেরে উঠবে। সে তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, না, না, তোমরা জানো না, মুহাম্মদ নিজের মুখে বলেছে, আমি তাঁর হাতেই নিহত হবো, আমি আর বাঁচবো না।’
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এ পর্যন্ত লিখেছেন যে, উবাই এ কথা বলেছিল, ‘যদি মুহাম্মদ আমার ওপর থুথু নিক্ষেপ করে তাতেও মরে যাবো।’
ওহোদ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো। আহত উবাই কুরাইশদের সঙ্গে মক্কা রওনা হয়ে গেল। রাস্তায় তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল। কুরাইশরা যাত্রাবিরতি করে তার সেবা যতœ করল। কিন্তু সে সবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সেখানেই মারা গেল।
চার বছর আগের এ স্মৃতি, খালিদের যেন মনে হচ্ছে কালকের ঘটনা। একদিন তার বিশ্বাস ছিল, কোরাইশরা মুসলমানদের পদদলিত করে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু মুসলমানদের কোরবানি দেখে খালিদ বড়ই অস্থিরতা বোধ করলো। তার মনে হচ্ছিল, কোরাইশদের ঘোড়াগুলোও মুসলমানদের দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। খালিদ দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে রক্তাক্ত সমর থেকে আবু সুফিয়ানকে খুঁজে বের করল এবং তার কাছে গিয়ে পৌঁছলো।
‘আমরা কি মুসলমানদেরকে শেষ পরাজয় বরণ করানোর যোগ্য নই? ’ খালিদ আবু সুফিয়ানকে বললো, কোরাইশ মাতাদের দুগ্ধ কি ব্যর্থ হলে গেল? এই মুষ্টিমেয় মুসলমানদের ভয়ে কি ভিতু হয়ে পড়েছো?
‘দেখো খলিদ!’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘যে পর্যন্ত মুহাম্মদ তাদের সাথে আছে, আর সে জীবিত ও নিরাপদে আছে, এদের শেষ রক্তবিন্দু ঝরে যাওয়া পর্যন্ত ওরা পরাজয় বরণ করবে না।’
‘আমাদের সেনাপতি হয়ে তুমি এমন কথা বলতে পারলে! ধিক আবু সুফিয়ান, ধিক তোমাকে! তবে এ দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছো না কেন?’
‘বাজে বকো না।’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘তুমি তোমার আরোহীদের কাছে যাও, তোমার নেতৃত্ব ছাড়া ওরা অসহায় হয়ে পড়বে। মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের আক্রমণ করার জন্য আমি পদাতিক বাহিনী পাঠাচ্ছি।’
আজ মদিনার দিকে যেতে যেতে খালিদের বড়ই আনন্দ হলো, আবু সুফিয়ান তার বিরাট সঙ্কল্প নষ্ট করে দিয়েছিল বলে। সে তো মুহাম্মদ (সা) কে হত্যা করে দেবতা হোবল ও উজ্জার সন্তুষ্টি লাভ করতে চেয়েছিল। সেনাপতির নির্দেশ মান্য করা আবশ্যক ছিল বলে সেদিন সে ময়দানে তার বাহিনীর কাছে ফিরে গিয়েছিল। রাসূলে করিমের সঙ্গী তখন মাত্র কয়েকজন অথচ তাকে হত্যা করার সুযোগ না পাওয়ায় সেদিন তার খুব আফসোস হয়েছিল। কারণ তার মনে হয়েছিল, এখন তাঁকে হত্যা করা কোন কঠিন কাজ নয়। আর রাসূলকে হত্যা করতে পারলে নতুন ধর্ম ও মুসলমানদের উঠে দাঁড়ানোর আর কোন ক্ষমতা থাকবে না।
খালিদ যুদ্ধের ময়দানের অবস্থা ভালো করে দেখার জন্য এক উঁচু চূড়ায় উঠে দাঁড়াল। সে দেখতে পেল, ওহোদ প্রান্তরের দূর দূরান্ত পর্যন্ত মাটি রক্তে লালে লাল হয়ে গেছে। কোথাও ছটফট করছে আহত ঘোড়া, কোথাও মানুষ রক্তে রঞ্জিত হয়ে আর্তনাদ করছে, অথচ আহতদের উঠিয়ে নেয়ার মতো কেউ নেই।
সে আরো দেখতে পেল, কোরাইশদের পদাতিক বাহিনী রাসূল (সা)-এর কাছে পৌঁছে গেছে। হ্যাঁ, এই তো তারা এখন হুজুর (সা)-এর সাথীদের বেষ্টনী ভেঙে দিচ্ছে। কোরাইশদের তিন ব্যক্তি উতবা বিন আবি ওযাক্কাস, আবদুর রহমান বিন শিহাব এবং ইবন কুম্মা রাসূল (সা)-এর ওপর পাথর বর্ষণ করছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, উতবার আপন ভাই সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাসূলে করীমের হেফাজতের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে চলছে। রাসূলে করীমের সঙ্গীদের সংখ্যা ক্রমেই কমছিল এবং তারা যুদ্ধ করতে করতে নেতিয়ে পড়ছিল। কোরাইশরা বিরামহীনভাবে পাথর নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। সে পাথরে ধরাশায়ী হচ্ছে রাসূলে করীমের কষ্টকর জীবনের অন্তরঙ্গ সাথী ও প্রাণপ্রিয় সাহাবীগণ। বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এ লড়াইয়ের ইতি ঘটবে। নিশ্চিত পরাজয় ও মৃত্যুর বিভীষিকা গ্রাস করবে মুসলমানদের। কিন্তু এতো আঘাত এবং বিপর্যয়ের পরও একজন মুসলমানও মহানবীর সঙ্গ ত্যাগ করছে না। মুসলমানদের প্রতিরোধশক্তি আরো দুর্বল হয়ে এলো। রাসূলকে রক্ষার জন্য তারা যে দেহপ্রাচীর তৈরি করেছিল, সে বেষ্টনী ফাঁকা হতে থাকল। হঠাৎ উতবার নিক্ষিপ্ত একটি পাথর রাসূলে করীমের চেহারা মোবারকে আঘাত হানল। সে আঘাত এমন প্রচণ্ড ছিল যে, হুজুরের ঠোঁট কেটে গেল এবং দাঁত ভেঙে গেল। এর পরপরই ছুটে এলো আরেকটি পথর। আব্দুল্লাহর ছুড়ে মারা সে পাথরের আঘাতে হুজুরের কপালে সৃষ্টি হলো গভীর ক্ষত। ইবনে কুম্বা নামে এক কোরাইশ রাসূল (সা)-এর আরো নিকটবর্তী হয়ে এমন জোরে পাথর ছুড়ে মারল যে হুজুরের লৌহ শিরস্ত্রাণের কড়া ভেঙে গালের মধ্যে ঢুকে গেল। এই ভাঙা কড়া গালের নরম মাংস ভেদ করে চোয়ালের হাড়েও আঘাত হানল। তিনি বর্শা নিয়ে লড়াই করছিলেন বলে শত্রুরা তার কাছে না ভিড়ে দূর থেকে পাথর বর্ষণ করছিল, আর এক একটি পাথরের আঘাতে রক্ত ঝরছিল তার পবিত্র শরীর থেকে।
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রাসূল (সা)-এর শরীর থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছে। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়লেন। দুর্বল শরীরে ক্রমাগত আঘাতের ধকল সইতে না পেরে এক সময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সাহাবী তালহা (রা) রাসূল (সা) কে পড়ে যেতে দেখে কোরাইশদের সাথে লড়াই বন্ধ করে দৌড়ে তার কাছে গেলেন। তাঁর চিৎকার শুনে অন্যান্য সাহাবারাও ছুটলেন। পাথর বর্ষণকারী কোরাইশরা এবার তরবারি উঁচিয়ে ছুটে এলো। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস তার সহোদর ভাই উতবা বিন আবি ওয়াক্কাসকে আক্রমণ করে বসল। উতবা ভাইয়ের উত্তেজিত হঙ্কার শুনে ভয়ে তার সামনে থেকে পালিয়ে গেল।
তালহা (রা) রাসূল (সা) কে ধরে উঠালেন। দেখলেন তিনি সম্পূর্ণ স্বজ্ঞান আছেন। এ ঘটনা সাহাবীদের মধ্যে এমন প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া ও বেদনার সৃষ্টি করল যে, এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলল তারা। জীবনের প্রতি মায়া মমতাহীন মুষ্টিমেয় সাহাবী যখন এরপর কোরাইশদের দিকে ফিরে তাকাল, সে দৃষ্টির বর্ণনা করতে পারে এমন কোনো ভাষা পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। এই সব সাহাবীরা তখন আক্রমণ প্রতিহত করার পরিবর্তে নিজেরাই কোরাইশদের ওপর আহত সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। গুটিকয় সাহাবীর রণহুঙ্কার ও আক্রমণ এতো বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর ছিল যে, কোরাইশরা তাঁদের এ ভয়ানক রূপ দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি রাগে দুঃখে বারবার বলছিলেন, ‘আমি আমার ভাইকে হত্যা করে তার শরীরকে টুকরো টুকরো করে এর প্রতিশোধ নেবো। বেঈমানের এতবড় অস্পর্ধা, সে আমার সামনে আমার নবীজিকে আক্রমণ করে!’ তিনি কোরাইশদের পেছনে এমন বেপরোয়া ধাওয়া করেন যে তাঁকে ফেরানো মুশকিল হয়ে গেল। অবশেষে রাসূল (সা) নিজে হস্তক্ষেপ করে অতি কষ্টে তাকে থামালেন। রাসূল (সা) নিজে যদি তাকে না থামাতেন তবে তিনি কখনও থামতেন না।
দীর্ঘক্ষণ ধরে এক নাগাড়ে যুদ্ধের ফলে কোরাইশরাও ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হলো। সাহাবীগণ রাসূলে করিমের সেবাযতেœ মনোযোগ দিলেন। মহিলা সাহাবী দু’জন হুজুর (সা) কে পানি পান করালেন এবং কাপড় দিয়ে আহত স্থানগুলো পরিষ্কার করলেন। দেখা গেল, লৌহ শিরস্ত্রাণের শিকলের টুকরো হুজুরের গালের হাড় পর্যন্ত বিঁধে আছে। সাহাবী আবু ওবায়দা লোহার সে টুকরো বের করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাত দিয়ে টানাটানি করে বের করতে না পেরে শেষে দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে একটি টুকরো বের করে আনলেন। কিন্তু দ্বিতীয় টুকরাটি যখন বের করতে চেষ্টা করেন, তখন তাঁর সামনের দু’টি দাঁত ভেঙে যায়। পরে লোকেরা আবু ওবায়দাকে আল আহরাম বলা শুরু করলো, যার অর্থ হলো দুই দাঁত হারা ব্যক্তি। ইতিহাসে এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
রাসূলে আকরামের শিশুকালের ধাত্রী উম্মে আয়মান হুজুরের অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রাসূলের দিকে ঝুঁকে ব্যাকুল চিত্তে রাসূলের অবস্থা লক্ষ্য করছিলেন। হঠাৎ একটা তীর এসে উম্মে আয়মানের পেটে বিদ্ধ হলো, সঙ্গে সঙ্গে দূরে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল। চমকে সকলেই সে দিকে ফিরে দেখলেন, হুব্বান বিনুল আবকা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে, তার হাতে ধনুক, তীরটি সে-ই চালিয়েছে। সে হেসে সরে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরছে রাসূলে আকরাম একটি তীর সাদের হাতে দিয়ে বললেন, এই লোক যেন এখান থেকে এই তীর নিয়ে ফিরে যায়। সাদ ধনুকে তীর টেনে হুব্বানের প্রতি ছুড়লেন, তীরটি হুব্বানের ঘাড়ে গিয়ে বিঁধে গেল। সাদ ও অন্যান্য সাহাবীদের চেহারায় ফুটে উঠল স্বস্তির হাসি। হুব্বান দুলতে দুলতে কয়েক পা এগিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
এসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে খালিদ এগিয়ে চলেছে মদিনার দিকে। ওহোদ পাহাড় ক্রমেই নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে, সহসা কয়েকজন সঙ্গীর কথা মনে পড়ল তার। সে দেখেছে, বিশ্বাসের পার্থক্য কেমন করে ভাইকে ভাইয়ের শত্রু বানায়। খালিদের ধারণা ছিল, লোকেরা তাদের বিশ্বাস ও মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করে বেড়ায় সেই মতবাদ ও বিশ্বাসের নেতা সাজার জন্য কিন্তু মুসলমানদেরকে খুব কাছে থেকে গভীরভাবে দেখে খালিদের মনে হলো, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝবার ক্ষমতা একটি ভিন্ন জিনিস, এ নেয়ামত সবার ভাগ্যে জুটে না।
একটি প্রশ্ন তাকে আবার অস্থির করে তুললো, ‘আমি মদিনা যাচ্ছি কেন? আমার নিজের মতকে মদিনাবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিতে, নাকি তাদের মতবাদ ও বিশ্বাস নিজের ওপর চাপিয়ে নিতে?’
গতকাল আবু সুফিয়ান তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কি সত্য, তুমি মদিনা যাচ্ছো?
ওয়ালিদের শোণিত ধারা কি তোমার শিরা থেকে মুছে গেল?’
মদিনার উদ্দেশে যখন থেকে সে মরুভূমির ধুলো উড়ানো শুরু করেছিল তখন থেকেই এ শব্দগুলো তাকে তাড়া করে ফিরছিল। বলতে গেলে পুরো পথটাই এসব শব্দ তাকে অনুসরণ করেছে। আর এর সাথে লড়াই করতে গিয়ে সেই সব বন্ধুদের কথা তার স্মরণে এলো, এক সময় যাদের বিরুদ্ধে সে লড়াই করেছে, যাদের রক্তের স্রোতধারা বইতে দেখেছে সে মরুভূমির তপ্ত বালিরাশিতে। এদেরই একজন ছিলেন মাসয়াব বিন আমীর।
কোরাইশরা যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে বেশ কিছু দূরে চলে এসেছে। খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে আবু সুফিয়ানকে ধরলো। বললো, ‘তোমরা যুদ্ধের অর্ধেকটা রেখে কোথায় যাচ্ছ? এখন মুসলমানদের নিঃশ্বাস তো শেষ পর্যায়ে।’ আবু সুফিয়ানও চাচ্ছিল, এ যুদ্ধেই মুসলমানদের সাথে শেষ ফয়সালা করতে। ইসলামের নাম নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে মুছে দিতে।
এ কথায় তারা আবার ফিরে এসেছিল ময়দানে। আবু সুফিয়ান খালিদকে তার বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই এসেছিল নবী করিমে ওপর আক্রমণ করতে।
ইবন কামআ লড়াই করতে করতে মুসলমানদের বেষ্টনী ভেঙে রাসূল (সা) এর কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছিলো। সে সময় রাসূলে আকরাম (সা)-এর কাছে ছিলেন মাসআব বিন আমীর ও উম্মে আম্মারা। উম্মে আম্মারা আহতদের পানি পান করাচ্ছিলেন। তিনি যখন কোরাইশদের আবার হামলা করতে দেখলেন, তখন এক আহত মুজাহিদের তরবারি উঠিয়ে কোরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। কোরাইশদের প্রথম যে আরোহীটি তার কাছে এলো তিনি তার নাগল না পেয়ে তলোয়ার দিয়ে তার ঘোড়ার ওপর এমন আঘাত করলেন যে ঘোড়াটি শুয়ে পড়লো। আরোহী ঘোড়ার অপর দিকে ছিটকে পড়েছিলো। উম্মে আম্মারা ঘোড়ার ওপর দিয়েই লাফিয়ে কোরাইশ লোকটিকে আঘাত হানলো। আহত অশ্বারোহী কোন রকমে উঠেই দৌড়ে পালাল।
মাসআব বিন আমীর শরীরের গঠন ও আকৃতির সাথে রাসূলে করিমের বেশ সাদৃশ্য ছিল। ইবন কামআ মাসআব (রা) কে রাসূলে আকরাম মনে করে তার ওপর আক্রমণ করে বসলো। মাসআব প্রস্তুত ছিলেন, তিনি ইবনে কামআর আঘাত ফিরিয়ে দিলেন। এরপর কিছুক্ষণ দু’জনের তলোয়ার ক্রমাগত ঠোকাটুকি করে চললো। অকস্মাৎ ইবনে কামআ এমন একটি আঘাত করলো যা তিনি আর ফেরাতে পারলেন না। আঘাতে খেয়েই পড়ে গেলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। উম্মে আম্মারা মাসআবকে পড়ে যেতে দেখে রাগে গর্জন করে ইবন কামআর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইবনে কামআ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক যোদ্ধা আর আঘাতকারিণী একজন মহিলা হওয়ায় সহজেই সে আত্মরক্ষা করে পাল্টা আঘাত হানল। উম্মে আম্মারা কাঁধে আঘাত পেলেন এবং সামান্য মোকাবেলা করে আহত হয়ে পড়ে গেলেন।
রাসূলে করীম (সা) এগিয়ে এলেন ইবনে কামআ’র মোকাবেলায়। ইবনে কামআ রাসূলের ওপর প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানল। আঘাতটি রাসূলের কাঁধে জখম সৃষ্টি করে বর্মের ওপর দিয়ে পিছলিয়ে যায়। রাসূলের পেছনে ছিল একটা গর্ত, তিনি আহত হয়ে পিছু সরতে গিয়ে গর্তে পড়ে যান। ইবনে কামআ পেছন ফিরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘আমি মুহাম্মদকে হত্যা করেছি।’
এরপর সে আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করতে করতে যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেল। তার চিৎকার ধ্বনি কোরাইশ ও মুলসমানরা উভয়েই শুনতে পেলো।
কোরাইশদের জন্য এ ছিল যেমন খুশির খবর মুসলমানদের জন্য ছিল তেমনি বেদনা ও বিপর্যয়ের। এ চিৎকার মুসলমানদের জন্য ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক আঘাত। যুদ্ধের ময়দানে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়লো। মুসলমানরা সাহস হারিয়ে ওহোদের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে সরে যেতে লাগল।