মহিউদ্দিন আকবর
সাইফুল্লাহর মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। খোদ ডিন স্যার ওর দারুণ প্রশংসা করেছেন। এমনিতে জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের নতুন ডিন প্রফেসর ড. ফার্দিন ইয়াসরা স্যার সহজে কারো প্রশংসা করেন না। কিন্তু তিনিই কিনা সাইফুল্লাহকে আজ বেশ করে শাবাশ দিয়েছেন। আবার প্রেরণা দিয়ে বলেছেন, তুমি একটা বড় জেনিটিক বিজ্ঞানী হবে। ঠিকমত পড়াশুনা করো। বিশেষ করে ক্লোনোলজিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সবসময় ভালো করা চাই। মনোযোগ চাই। অবশ্য এই সুবাদে অন্যান্য সাবজেক্টে ফাঁকি দেয়াও চলবে না। তুমি যদি মনোযোগের সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যাও তাহলে আর কেউ তোমাকে সাহায্য করুক বা না করুক, আমি আছি তোমার সাথে।
এই যে স্যার বললেন, ‘আমি আছি তোমার সাথে’। এখানেই সাইফুল্লাহর আনন্দ। আনন্দ বলে আনন্দ! আনন্দে একবারে ডগমগ। এ কথাটা কাউকে না কাউকে শেয়ার না করলে সে যেন স্বস্তিই পাচ্ছে না। কি করা যায়? কি করা যায়? অনেক ভেবে পকেট থেকে সুরুৎ করে টেনে হাতের মুঠোয় তুলে আনে স্মার্টফোনটা। দ্রুত ডিজিট টাচ করে বাম কানে চেপে ধরে। হ্যাঁ, ওদিকে রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে। না, কেউ ধরছে না। হঠাৎ ‘তুত তুত তুত’ তিনটা শব্দ করে কলটা কেটে গেলো। সাইফুল্লাহ বিরক্তির চোখে স্মার্ট ফোনের মনিটরের স্ক্রিনে তাকিয়ে ডায়লগ দেখতে পেলো ‘কল অ্যাব্রোড’। আবারও কল দিলো। হ্যাঁ, ওদিকে আবারো রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে। না, কেউ ধরছে….না…. ধুত্তুরি বলে যেই না নিজেই কলটা কেটে দিতে যাবে অমনি ওপাশ থেকে খানিকটা বিরক্তিমাখা কণ্ঠ ভেসে এলো- আসসালামু আলাইকুম। কিরে খেয়েদেয়ে তোর আর কোনো কাজ নেই? দিলি তো আমার আরামের ঘুমটাকে হারাম করে।
ওদিকে ছোট মামা বিরক্ত হলেও সাইফুল্লাহ মুচকি হেসে বলে- অয়ালাইকুম আসসালাম। খেয়েদেয়ে কাজ নেই আবার, অনেক অনেক কাজ আছে। কিন্তু এই আসর ওয়াক্তে তুমি যদি নন্দলালের মতো পড়ে পড়ে ঘুম যাও তাহলে চলবে কেমন করে?
ওদিক থেকে এবার একটু চওড়া গলা শোনা যায়- কি? জ্ঞান দেয়া হচ্ছে? আরে হতভাগা, সবে তো চারটা ষোলো মিনিট। আজানেরই এখনো ঊনত্রিশ মিনিট বাকি। তা আসরের ওয়াক্ত মানে কিরে?
সাইফুল্লাহ এবার একটু আওয়াজ করেই হাসে। তারপর বলে- জি মহামান্য আরামের বাদশা! আজান হলেই তো আর মসজিদে ছুটবেন না, আপনার অজু আর এস্তেঞ্জায় সময় লাগবে কতটুকু সে কিন্তু আমি জানি।
ওপাশ থেকে ছোটমামা আবার ধমকে ওঠেন- আবারো? আরে হতচ্ছাড়া, পাক-পবিত্রতা হলো ঈমানের অঙ্গ। মুসলিম হয়ে শিয়াল-শারমেয়দের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চ্যানালে তো হবে না। সুন্নতের হক আদায় করে, সুন্দর মতো কুলুপ নিয়ে তবেই না এস্তেঞ্জা শেষ করতে হবে। তারপর অজু। সময় লাগে কি এমনি এমনি?
এবার সাইফুল্লাহ বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে- জি হুজুর, আপনাকে সে কথাই তো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলাম। এবার এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন এবং…
– এবং আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি এই তো?
– জি জাঁহাপনা! তোমাকে সেদিন বলেছিলাম না, আমাদের ডিপার্টমেন্টে নতুন এক গোমরামুখো ডিন এসেছেন।
– হ্যাঁ, তো আজ আবার কী হলো?
– কী হলো মানে! হয়েছে, হয়েছে, অনেক কিছুই হয়েছে।
– আহ্, হেঁয়ালি বাদ দে তো। আসল কথাটা বলে ফেল।
– আরে তুমি যেমন সহজে কারো প্রশংসা করো না, তেমনি এই নয়া ডিন স্যারও…।
– এই আবার শুরু হলো? আমি কারো প্রশংসা করি না! না?
– করো, করো। তবে ওই স্যারের মতো। মানে সহজে করো না।
– বুঝলাম। এবার আসল কথাটা বল।
– ডিন স্যার আজ আমার খুব প্রশংসা করলেন আর বললেন, তিনি আমাকে হেল্প করবেন।
– হঠাৎ তোর প্রতি এতোটা সুপ্রসন্ন!
– হ্যাঁ মামা, তাইতো ভাবছি। তবে স্যার বেশ খোলামেলাই বললেন, ‘কেউ তোমাকে সাহায্য করুক বা না করুক, আমি আছি তোমার সাথে’। স্যার যে ট্যালেন্ট! আমাকে তিনি সাহায্য করলে তোমাকে চমকে দেয়া রেজাল্ট করবো না!!
– তা খারাপ বলিসনি। তোর মতো ডাল-কাউডাং মার্কা হতচ্ছড়া ভালো রেজাল্ট করলে অবাক তো হতেই হবে।
– এই যে এবার তো তুমিই শুরু করলে, আরে জনাব তোমার এই ভাগনেটা যেমন তেমন ছাত্র হলে কি আর ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ভার্সিটিতে চান্স পেতো নাকি?
– না, না। তা হবে কেন। আমার ভাগনে বলে কথা।
– যাক এবার লাইনে এসেছো। জানো, স্যার একেবারে সবার সামনেই বললেন, ‘তুমি একটা বড় জেনিটিক বিজ্ঞানী হবে’। আসলে মামা আমিও তো একজন বড়মাপের বিজ্ঞানী হতে চাই। বিশেষ করে ক্লোনিং বিজ্ঞানে আমিই হতে চাই এদেশের অগ্রপথিক।
– ওফ্, দিলি তো আমাকে আবেগে আপ্লুত করে। আরে, আমিও যে চাই, আমার পিচ্চি ভাগনেটা একদিন কিছু একটা হয়ে দেশের সেবায় লাগুক।
– এখনো বুঝি পিচ্চি আছি! যাক, তুমি দোয়া করো মামা।
-হ্যাঁরে, তোকে যে অস্ট্রেলিয়ার একটা ভার্সিটির নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে স্টেটাস দিতে বলেছিলাম, সেটা দিয়েছিস তো?
– সে কথা আর বলো না মামা। আসলে স্যারের উৎসাহ পেয়ে আমি সাংঘাতিক একটা দুঃখের কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ আগে তোমাকে সে খবরটাই জানানো দরকার ছিলো।
– এই আনন্দের খবরের মাঝে আবার দুঃখের খবর এলো কোত্থেকে?
– সে কথাই তো বলছি। গত রাতে আমার ফেসবুক একাউন্টটা হ্যাক হয়ে গেছে। কিছুতেই আইডিটা খুঁজে পাচ্ছি না।
– এই, এই, এইতো দিলি মুডটাকে অফ করে। তোকে না বলেছি সব সময় সাবধান থাকতে? যার তার সামনে আইডি ওপেন না করতে। এখন ঠ্যালা সামলা। আরে হতভাগা একটু অসাবধানতার কারণে হ্যাকিং-এর শিকার হয়েছে কতজন জানিস? এই অসাবধানতার কারণেই তোর ফেসবুক আইডি হাত ছাড়া হয়ে গেছে। তোকে না বার বার বলেছি, সাবধান, সাবধান।
– এখন উপায় কী তাই বলো। শুনেছি, ফেসবুক আইডি হ্যাকিং হয়ে থাকলে প্রাথমিকভাবে কী করা যেতে পারে তার সঠিক নির্দেশনার অভাবে ফেসবুক একাউন্টটি শেষ পর্যন্ত হাত ছাড়া হয়ে যায়। তো প্রাইমারিভাবে কী করতে পারি তাই বলো?
– হুম, ভেবে দেখি।
– ওসব ভাবাভাবি পরে করো, তুমি তো এ ব্যাপারে মহাবিশারদ, আমার এক্ষণি সমাধান চাই।
– ওরে বাপরে! এযে দেখছি ‘দিতেই হবে; দিতেই হবে, মানতে হবে; মানতে হবে’ মার্কা হুমকি!
– দেখো মামা ভেংচি কাটলে ভালো হবে না। আমি আছি আমার জ্বালায়….।
– দাঁড়া, দাঁড়া, দাঁড়া। খুব চেপে গেছেরে, আমি ওয়াশরুমে ঢুকলাম। এই ফাঁকে তুই তোর কম্পিউটার খুলে বস। জাস্ট পাঁচ মিনিট।
ব্যাস, ওপাশ থেকে কলটা কেটে গেলো।
২.
না। সাইফুল্লাহকে কম্পিউটার ওপেন করে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকিরের তালে তালে ওর স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠলো- soto mama.
টেবিল থেকে খপ করে সেটটা তুলে নিয়ে বাম কানে চেপে ধরে বললো- আসসালামু আলাইকুম। হ্যাঁ, বলো মামা, আমি নেট খুলে বসে আছি।
ওপাশ থেকে ছোট মামা বললেন- অয়ালাইকুম আসসালাম। হুম, নেট খুলেছিস তো, এখন এক কাজ কর।
-বলো।
– প্রথমে এড্রেস বার থেকে Facebook.com/hacked এ ঢুকে পড়।
– আবার বলো।
– গাধা! খেয়াল করে শোন, প্রথমে এড্রেস বার থেকে Facebook.com/hacked এ ঢুকে পড়।
– ইয়েস স্যার, ঢুকে পড়েছি।
– এবার My Account Is Compromised এ ক্লিক করে এগিয়ে যা।
– হ্যাঁ, কোথায় এগুবো?
– এখন যে ডায়লগ ডিমান্ড করছে সেখানে Identify Your Account থেকে তোর একাউন্ট শনাক্ত করতে- Email, phone number কিংবা Facebook username অথবাyour name and a friend’s name এই তিনটি অপশনের যেকোন একটিতে ঢুকে পড়। সেখানে যেসব তথ্য চাইবে সেসব প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে SEARCH বাটনে ক্লিক কর।
– ওকে জাঁহাপনা। আপনি এবার আপনার মোবাইলের তেল খরচ করে অপেক্ষা করতে থাকুন। আমি আপনার নির্দেশ অনুসারে কাজটুকু সেরে নেই।
স্মার্টফোন বাম কাঁধে ঠেসে দিয়ে কানের সাথে চেপে রেখে সাইফুল্লাহ নিবিষ্ট মনে কাজ করে যায়। তিন মিনিট পর মুখ খোলে- হ্যাঁ মামা, এবার কি করতে হবে বলো।
– হুম, এবার Security Check অপশনে ক্যাপচা এন্ট্রি করে এগিয়ে যা।
– করেছি। এবার বলো।
– তোর একাউন্টির ছবিসহ ইউজার নেম এসেছে?
-ইয়েস!
– এবার This Is My Account ক্লিক করে এগিয়ে যা।
– আবার পাসওয়ার্ড চাচ্ছে।
– চাইবেই তো। তোর পুরানা পাসওয়ার্ড যা ছিলো সেটাই দিয়ে দে।
– উ-উ-ম। হু-উ-ম। দিলাম। আর কি করবো?
– তুই যদি আমার কথামতো ঠিকপথে এগিয়ে থাকিস তাহলে পরবর্তী ধাপগুলো তুই নিজেই বুঝবি। সেভাবে এগুলে আশা করি তোর ফেসবুক আইডি ফিরে পাবি। ওক্কে পিচ্চি! আমি ওযু করতে গেলাম। আযান শুনতে পাচ্ছি।
ব্যাস, ওদিক থেকে লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। তাতে অবশ্য সাইফুল্লাহর আর কোন অসুবিধা হলো না। ঠিক ঠিক ফেসবুক আইডি ফিরে পেয়ে ও চিৎকার করে উঠলো- ইউরেকা, হা, হা, হা।
তারপর ছোট মামার সেই ইমেজটা একটা স্পেশাল টেক্সটসহ বিসমিল্লাহ বলে ওর ওয়ালে স্টেটাস দিয়ে তবেই উঠলো। এবার ফুরফুরে মনে বেরিয়ে পড়লো মসজিদের উদ্দেশে।
৩.
সালাতুল আসর শেষে হলের রুমে ঢোকার প্যাসেজে সিঁড়িতেই প্রফেসর ড. ফার্দিন ইয়াসরা স্যারের সাথে দেখা। ডিন স্যারকে সিঁড়ির ধারে দেখে মুহূর্ত জমে যায় সাইফুল্লাহ। ও ভাবতে থাকে, আগের ডিন স্যার তো কোনো দিন ছেলেদের হলে আসেননি। স্যার হঠাৎ এখানে…।
ওর চিন্তার জাল ছিন্ন করে স্যার ডান হাত এগিয়ে দেন- হ্যালো।
সাইফুল্লাহ থতমত খেয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে- আসসালামু আলাইকুম স্যার।
সালামের জবাব না দিয়েই স্যার বললেন- মাই ডিয়ার বয়। তুমি তো আমেরিকান স্কলারশিপ পেয়েছো, নাসায় স্টাডি এবং রিসার্চ করার সুযোগও পাবে। আমি আগে জানতাম না। একটু আগে প্রভোস্ট সাহেবের কাছে শুনে তোমাকে কংগ্রেস করতে এলাম।
‘কংগ্রেস’ শব্দটা শুনে সাইফুল্লাহ খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মনে মনে ভাবলো, স্যার দেখছি আল্ট্রামডার্ন ইয়াংকিদের মতো কংগ্রাচুলেশান্সকে শর্টকাট করে ফেলেছেন!
সাইফুল্লাহর কোনো ভাবান্তর না দেখে প্রফেসর ড. ফার্দিন ইয়াসরা বললেন- না, না, না। এটা যা তা কথা নয়। বাংলাদেশের মত একটা দরিদ্র দেশের ছেলে নাসা’র স্কলারশিপ পাওয়া কম কথা নয়। তোমাকেই আমার দরকার।
– আমাকে?
– হ্যাঁ, তোমাকে।
এরই মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে উপর থেকে তড়তড়িয়ে নেমে আসে সাইফুল্লাহর রুমমেট আফনান। সাইফুল্লাহকে একা একা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো দেখে ও অবাক হয়ে প্রশ্ন করে- কিরে সেই কখন আসর পড়ে রুমে এসে বসে আছি। ঢাকা ভার্সিটির টিএসসিতে যাবার কথা না? সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরতে হবে যে। আর উনি একা একা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।
আফনানের কথা শুনে ভালো করে তাকাতেই সাইফুল্লাহ দেখতে পায় প্রফেসর ড. ফার্দিন ইয়াসরা স্যার দ্রুত লনে নেমে একটা গাছের আড়ালে চলে গেলেন। স্যারের এতো দ্রুত চলে যাওয়া, তাও আবার সোজা পথে না গিয়ে, লনের ঘাস মাড়িয়ে চলে যাওয়া! ও অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
আফনানও ওকে ফলো করে লনের দিকে তাকায়। তারপর প্রশ্ন করে- কিরে ওভাবে কি দেখছিস?
সাইফুল্লাহ থতমত খেয়ে বলে- কেন দেখছিস না নতুন ডিন স্যার কত দ্রুত চলে গেলেন!
আফনান অবাক হয়ে সাইফুল্লাহর কাঁধে ঝাঁকি মারে- কিরে! তুইকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিবা স্বপ্ন দেখছিস নাকি? ডিন স্যারকে তুই দেখলি কোথায়?
– মানে! এইমাত্র আমার সাথে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। তুই এলি বলে দ্রুত চলে গেলেন।
– এই তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমি তো স্রেফ তোকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উপর থেকে নেমে এলাম।
– ধুত্তুরি, তুই নিচে নেমে আসার পরও স্যার এখানে ছিলেন। তারপরই না চলে গেলেন।
– বুঝেছি স্কলারশিপের খবরটা পাবার পর থেকেই তোকে একটু অন্যরকম দেখছি। একদাগে পঁচিশ লাখ টাকার স্কলারশিপ! মাথা তো কিছুটা গরম থাকবেই। কিন্তু এতোটা হট্ হলে তুই স্টাডিইবা করবি কেমন করে আর রিসার্চইবা করবি কেমন করে?
– একি বলছিস দোস্ত! সত্যি কি তুই ডিন স্যারকে দেখিসনি?
– না।
– একদমই না?
– না। একদম না। আরে তোর সাথে একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, আবার চলেও যাবে সেটা কেমন করে চোখ ফাঁকি দেবে। আসলে তুই একটা ঘোরের মাঝে আছিস। চল চল, টিএসসিতে যেয়ে কাজ নেই। আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় যাই। টাটকা এক মগ কফি খেয়ে ব্রেনটা ওয়াশ করে নেয়া যাবে।
– না, কফি খা-বো-না।
– আরে এভাবে বলছিস কেন! ঠিক আছে জনাব, কফি খেয়ে কাজ নেই। চলুন আপনাকে ডাশা দেখে একটা বড় আকারের আপেল খাওয়াবো।
– ধুত্তুরি, ফরমালিনের পোস্তাই খাবো আমি?
– না, না। ফরমালিনসহ তোকে আপেল খেতে হবে না। আমিও জানি, আজকাল বাজারে গিয়ে শাকসবজি, ফলমুল কিংবা মাছ যে কোনো কিছু কিনতে গিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। বাট আই ডোন্ট কেয়ার। আমার মামা শিখিয়েছেন, একটু কষ্ট করলেই আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।
– মানে?
– আরে বোকার হদ্দ! আমি হলাম ফুডনিউট্রেশনের ছাত্র। তার উপরে ফুডনিউট্রেশনিস্ট ড. লিটন হাবিবের ভাগনে। আমাদের হাতের কাছে ভিনেগার আছে না? ফলমুল খাবার আগে মাত্র পনের মিনিট সময় খরচ করবো। তাহলেই ফরমালিনসহ যে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য থেকে আমরা অনায়াসেই বেঁচে যাবো।
– সেটা আবার কি কথা বলছিস?
– বলছি না, তোকে প্র্যাকটিক্যাল করেই দেখাবো। এই ধর এক লিটার পানিতে এককাপ ভিনেগার মিশিয়ে আমাদের জন্য কেনা আপেল দু’টিকে মোটের ওপর পনেরো মিনিট ভিজিয়ে রাখবো। এরপর ভালো করে ধুয়ে নিলেই হবে। ব্যাস! আপেলগুলো হয়ে গেলো ফরমালিনসহ যে কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক মুক্ত। একইভাবে শাকসবজি অথবা মাছকেও ফরমালিনসহ যে কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক মুক্ত রাখা সম্ভব।
– ধুত্তুরি, ফল বা শাকসব্জি না হয় খাওয়া গেলো, ভিনেগার মেশানো মাছ খেলে কেমন লাগবে, ওয়াক্, আমার কিন্তু বমি বমি লাগছে দোস্ত।
– ওউফ, সবটাতে তোর বাড়াবাড়ি। আরে হাবা বললাম তো ভিনেগারে ভিজানোর পর সবকিছুই ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। আগে তো ভেবেছি তোর মাথা ভর্তি মগজ গজ গজ করে। এখন দেখছি স্রেফ কাউডাং!
– যাহ্, ইয়ার্কি করিস না।
– আসলে কি জানিস, ভিনেগার একটি শক্তিশালী এসিড জাতীয় পদার্থ। এটি যে কোনো ব্যাকটেরিয়ার আটানব্বই শতাংশ দূর করতে পারে। তাছাড়া ভিনেগার একটা উপাদেয় হজমিও বলতে পরিস। যাক সে কথা। এখন চল, আপেল কিনতে যাবো।
– তা যাবো, কিন্তু তুই সত্যি করে বল তো, ডিন স্যারকে তুই দেখতে পাসনি?
– আরে ভাই, বললাম তো স্যার কেন, স্যারের টিকিটি পর্যন্ত আমি দেখিনি।
– তাহলে?
– তাহলে কি তা তুইই ভালো জানিস। আমি বাপু এতোসব ফিউশন-টিউশনের ধার ধারি না। কোনো অশরীরীকে ভয়ও পাই না।
– আরে ধুত্তুরি! তুই আবার কথার মোড় কোন দিকে ঘুরাতে চাস? ওসবকে আমিও ভয় পাই না। ওদেরকেও আমাদেরই মতো কাল হাশরের মাঠে জাররা জাররা হিসাব দিতে হবে। জাররা জাররা বুঝিস?
– না হে পণ্ডিত, তা বুঝবো কেন? জাররা জাররা হলো চুলচেরা মানে পুংখানুপুংখ। সে দিনটার কথা মনে হলে কেঁপে উঠি দোস্তা।
– তাহলে আর ভাবনা কি। সেমতে আমল আখলাক ঠিক রেখে চলিস। দেখবি জান্নাতের আশা-ই মনের মাঝে বিরাজ করবে।
– ওরে আমার মাওলানারে! চল চল আপেল কিনতে যেতে হবে।
৪.
ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ভার্সিটির কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে সালাতুল এশা শেষে একা একাই ফিরছিলো সাইফুল্লাহ। পথে ডানের বাঁক ঘুরতেই ঠিক লনের প্রান্তদেশে একটা বড় ছাতিম গাছ। গাছটা পেছনে ফেলে সামনে এগোতেই পেছন থেকে শোনা গেলো- দাঁড়াও সাইফুল্লাহ।
ডাকটা পরিচিত। তারপরও চমকে পেছনে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো সাক্ষাৎ ডিন স্যার দাঁড়িয়ে। সাইফুল্লাহর পুরো শরীরটা নিজের অজান্তেই একটা ঝাঁকি মেরে উঠলো। কোনমতে নিজেকে সামলিয়ে স্যারকে সালাম জানালো। স্যার সালামের জবাব না দিয়ে বললেন- চলো তোমার সাথে লনে দাঁড়িয়েই একটা জরুরি আলাপ সেরে নেই।
সাইফুল্লাহ একটু ইতস্তত করে বললো- লনে কেন স্যার, চলুন আমাদের রুমে চলুন।
– না, এখানেই বলি।
– কেমন জরুরি কথা স্যার? কেউ শুনতে পেলে সমস্যা আছে?
– হ্যাঁ, আছে। তবে আপাতত কেউ কিছুই শুনতে পাবে না।
– না শুনুক, আমাদের তো এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে। বিশেষ করে আপনাকে দেখে ইন্টারেস্টেড হয়ে ছাত্ররা এগিয়ে আসবে…।
– সে ভাবনা নেই। বিকেলে তো তোমার রুমমেট কেবল তোমাকেই দেখেছে এবার কাউকেই দেখতে পাবে না।
-বলেন কি স্যার!!
– হ্যাঁ, আমরা এখন একটা লেসার বলয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। এটা একটা ডিভাইসের ক্যারিশমা। এই দেখ আমার হাতে ছোট্ট পেনসিল টর্চের মতো একটা জিনিস। এটাই সে ডিভাইস। তোমার পকেটের স্মার্ট ফোনটাও একটা ডিভাইস। তবে ওর কাজ আর আমার হাতের ডিভাইসের কাজ এক নয়। তুমিও এমন একটা ডিভাইস আমার কাছ থেকে পেতে পারো। এর চারটা বাটন আছে। একটা বাটনের কাজ হলো আট স্কয়ার জায়গা জুড়ে ও একটা ইনভিজুয়্যাল লেজারপ্যারাস্যুট বলয় সৃষ্টি করে। এর ব্যবহারকারীকে পৃথিবী সবার দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যায়। এমনকি পৃথিবীতে আবিষ্কৃত কোন শক্তিশালী রাডার বা স্যাটেলাইটেরও সে বলয় ভেদ করা সম্ভব নয়।
– তাহলে আমি যে আপনাকে দূর থেকেও দেখতে পেলাম। বিকেলে যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনও দেখেছি।
– হ্যাঁ, শুধুমাত্র তুমি দেখেছো। তোমার রুমমেট কিন্তু দেখতে পায়নি। এটা আমার ডিভাইসের সেকেন্ড বাটনের কাজ। এর মাধ্যমে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির রেটিনা অপারেশন কানেক্ট রেখে তার ব্রেনকে ডিভাইস ব্যবহারকরীর সাথে নেনোবেইজড ফ্রিকোয়েন্সিতে রাখা হয়। যেমন তুমি এখন আছো। এ অবস্থায় আমি তোমাকে আমার সুপারস্পেসে তুলে নিলেও কেউ দেখতে পাবে না।
ডিন স্যারের কথায় সাইফুল্লাহ এবার রীতিমত ভড়কে যায়। ও তোতলাতে তোতলাতে বলে- ইয়ে.. মানে, সুপার.. স্পেস! সেকি বলছেন স্যার!!
– হ্যাঁ, আমার সুপারস্পেস রাখা আছে এই লনেরই এক প্রান্তে। তাকেও ডিভাইসের ক্যারিশমা দিয়ে আইসোলেটেড করে রেখেছি। এবার বলো, তোমার এমন একটা ডিভাইস চাই? চাইলেই পেয়ে যাবে এবং রাতারাতি তুমি বর্তমান বিশ্বের সুপার হিরো বনে যাবে। তবে এটা পেতে হলে তোমাকে আমার একটা উপকার করতে হবে।
– কী উপকার স্যার?
– তোমার আব্বা তো দেশের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের প্রধান পরমাণু বিজ্ঞানী, আমাকে তার অফিসে একটু দেখা করার সুযোগ করে দেবে তুমি।
– এটা কোনো ব্যাপার হলো স্যার? আপনি তো আমাদের বাসায় গেলেই আব্বার সাথে নিরিবিলি আলাপ করতে পারেন।
– না, না। আমার পরমাণু কেন্দ্রটাও ভিজিট করা দরকার।
– উইথ দ্য পারমিশন স্যার, আব্বার সাথে আপনার মুখ্য আলাপের বিষয়টা জানতে পারি কি?
– হোয়াই নট। অবশ্যই জানতে পারো। উনাকে বলবে আমি…।
প্রফেসর ড. ফার্দিন ইয়াসরা কথাটা বলে শেষ করতে পারেন না। অমনি চারদিক থেকে একটা অ্যালার্ম বেজে ওঠে। কিন্তু ঠিক কোনদিক থেকে শব্দটার উৎপত্তি ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। সাথে সাথে ড. ফার্দিন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঠিক পড়া মুখস্থ বলার মতো এক দমে বললেন- সর্বনাশ হয়ে গেছে! আমি যে পৃথিবী থেকে পরমাণুসমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তি ধার করতে এসেছি সেটা আমাদের শত্র“ পক্ষ টের পেয়ে গেছে। ওদের আল্ট্রাসনিক সুপার রাডারে আমার অবস্থান ধরা পড়ে গেছে। মাই ডিয়ার সান, আমার হাতে আর সময় নেই। এক্ষনি মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে পাড়ি জমাতে হবে। আমি আসলে ওখানেরই অধিবাসী। তোমাদের পৃথিবীর মানুষ যাকে বলে ইলিয়ন। আমি তাদেরই একজন। আপাতত কাউকে তোমার আর আমার মাঝে ঘটে যাওয়া কোন একটি কথাও বলো না। আমি সুযোগ করে আবার আসবো- বাই মাই ডিয়ার ফিউচার ক্লোন-সায়েন্টিস্ট। সুড গুড লাক…।
প্রফেসর ড. ফার্দিন ইয়াসরা স্যারের আর কোন কথা সাইফুল্লাহর কানে ঢুকলো না। ও হঠাৎ দু’চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে হাসপাতালের শুভ্র বিছানায়।
Good.