মোহাম্মদ ইউসুফ
সিয়ামদের বাড়ির পাশে একটি সুবিশাল সুন্দর বাগান আছে। তবে সেটি অনেক আগের। সিয়ামরা সে বাগানে খেলে আর মৌমাছিরা কিভাবে ফুল থেকে মধু আহরণ করে তা দেখে।
সেই বাগানে সরিষা, তুলসি, অর্কিড, গোলাপ, কুমড়া ইত্যাদি আরো হরেক রকমের ফুল-ফল গাছ আছে। আরো আছে মৌমাছি ও বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ। বাগানটিতে ছিলো একটি সুন্দর ও সুষমময় পরিবেশ, সেখানে মৌমাছি তুলসি, অর্কিড আর গোলাপরা একে অপরের সাথে মিলে মিশে থাকতো।
বাগানের রাজা ছিল গোলাপ। গোলাপই বাগানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতো। বাগানের ফুল ও ফল গাছের ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা করে। সিয়ামরা তাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই এই দৃশ্য দেখে আসছিল। বাগানের সবকিছু এত সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে দেখে সিয়ামরা ভাবতো এসবের পেছনে এক বিরাট রহস্য আছে।
আর এ দিকে বাগানে মৌমাছিরা ফুল থেকে অনবরত মধু সংগ্রহ করায় বাগানের রাজা গোলাপের কাছে একটু খারাপ লাগে। সে উপলব্ধি করল যে মৌমাছিরা শুধু নির্বিঘেœ আমাদের থেকে মধু নিয়েই যায়, কিন্তু তারা কখনো আমাদের কিছ্ইু দেয় না।
এই জন্য গোলাপ বাগানের ফুল ও ফল গাছদের নিয়ে একটি সভা ডাকে। সেই সভায় গোলাপ ফুল ও ফল গাছদের উদ্দেশ করে বলে, মৌমাছি ও এর মতো পতঙ্গেরা শুধু আমাদের থেকে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে যায় আর এতে আমাদেরকে তারা কিছুই দেয় না। এতে সভায় উপস্থিত গাছরাও বলে হ্যাঁ, ঠিকতো। মৌমাছি-পতঙ্গেরা আমাদের কিছুইতো দেয় না। আর তাই গোলাপসহ সবাই মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালায়, এবং তাদেরকে আর মধু দিবে না বলে সকলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এদিকে মৌমাছিরা গোলাপদের আন্দোলন দেখে তারাও মধু নিতে আসে না। তারা হাবাগোবার মতোই চলছে, কাউকে কিছুই বলছে না। এইভাবে দিন যায় রাত আসে, সপ্তাহ যায়, মাস আসে, চলছে নিশিদিন।
এরই মধ্যে বাগানে অবস্থিত চতুর অর্কিড লক্ষ্য করল যে তাদের নিজেদের মধ্যে ফুল এলেও ফল হচ্ছে না, বীজ হচ্ছে না। ফুল পরিপক্ব হচ্ছে না, বংশ বিস্তার হচ্ছে না। ফলে তাদের বংশবৃদ্ধি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এই সব ব্যাপার প্রায় কম-বেশি সবার মধ্যে কানাঘোষা হচ্ছে। ততক্ষণে অর্কিড গোলাপসহ সকলকে নিয়ে সভা ডেকে বলে, আমাদের এই বিলুপ্তিময় অবস্থার কারণ কী? এর কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে, নচেৎ আমাদের অস্তিত্ব টিকে রাখা বড়ই কঠিন হয়ে পড়বে। অর্কিড সকলের ওপর তাদের এই বিলুপ্তিময় অবস্থার কারণ খোঁজার দায়িত্ব দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করে।
কয়েকদিন পর অর্কিড নিজেই লক্ষ্য করল যে, মৌমাছিরা আমাদের থেকে মুধ সংগ্রহ বন্ধ করা থেকেই আমাদের এই বিলুপ্তিময় অবস্থার উদ্রেক হচ্ছিল।
অর্কিড এর আসল রহস্য উদঘাটনের জন্য অন্য একটি বাগানে যায় এবং সেখানে সে মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গের ফুলের ওপর বসা ও মধু সংগ্রহের ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করে। সেখানে অর্কিড এক বিস্ময়কর ঘটনা দেখে যে মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ ও পতঙ্গেরা বিভিন্ন ফুলের ওপর উড়াউড়ি করা কালে ফুলের গর্ভমুণ্ডে অবস্থিত পরাগরেণু মৌমাছি আর পতঙ্গের মাধ্যমে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে (পু-স্ত্রী) স্থানান্তরিত হয়।
ফলে তাদের পরাগায়ণ ঘটে। আর পরাগায়ণের পরেই পুংজনন কোষ ও স্ত্রীজনন কোষের মিলনের মাধ্যমে ঘটে নিষেক। নিষেকের ফলেই ফুলের গর্ভাশয়ে অবস্থিত ডিম্বক বীজে আর গর্ভাশয় ফলে পরিণত হয়। নিষেক (পু ও স্ত্রীজন কোষের মিলন) ব্যতীত কিছুই হয় না।
আর এই নিষেক ও পরাগায়ণ ঘটার ব্যাপারে মৌমাছি আর পতঙ্গের ভূমিকা অপরিসীম উপলব্ধি করতে পারলো অর্কিড। অর্কিড নিষেক ও পরাগায়ণের ব্যাপারটি গোলাপসহ সকল ফুল ফল গাছকে জানালে সকলেই আশ্চর্যান্বিত ও বিস্মিত হয়। তারা সকলেই বলে মৌমাছি ও পতঙ্গেরা যদি আমাদের থেকে মধু সংগ্রহ না করতো তাহলে নিষেক পরাগায়ণ হতো না, ফুল হলেও ফল হতো না, বীজ হতো না। এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব টিকে রাখা যেতো না। তারা বুঝতে পারলো যে মৌমাছি ও পতঙ্গেরা শুধু মধু নিয়েই চলে যায় না। বরং তারা আমাদের দিয়ে যায় এক অমূল্য রতন। অর্কিডরা মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের জন্য বললে তারা আবার শুধু সংগ্রহ করতে আসে এবং মধু সংগ্রহ করতে থাকে। ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বাগানের অবস্থা পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক নিয়মে চলে আসে। এতে অর্কিড, মৌমাছি পতঙ্গেরা সকলে সমস্বরে বলে ওঠে- সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেক আমরা পরের তরে।