আহমদ আবদুল্লাহ মাসউদ
যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (মাগুরা এখন আর মহকুমা নেই, জেলা) শ্রীপুর থানার মাঝাইল গ্রাম। গ্রামটি মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর স্রোত বয়ে যায় কুলকুল। দুই তীরে পাখি ডাকে কিচির-মিচির। বাঁশবনে কোকিল ডাকে কুহু-কুহু। যেদিকে চোখ যায় কেবলই সবুজ।
এমনি একটি গ্রাম মাঝাইল। যেন স্বপ্নপুরী। এই স্বপ্নপুরীতে একটি সমৃদ্ধ পরিবার সৈয়দ পরিবার। দশগ্রামের কাছে দারুণ পরিচিত। সবাই শ্রদ্ধার চোখে তাকায় বাড়িটির দিকে।
১০ জুন, ১৯১৮ সাল। সময়টা ছিল রমজান মাস। ঠিক এই দিনে, সৈয়দ পরিবারে নেমে এলেন একটি নক্ষত্রের ঘোড়া। কেউ বলেন, রাজপুত্র। আবার কেউবা বলেন সিন্দাবাদ।
পিতা সৈয়দ হাতেম আলী। আর মাতা বেগম রওশন আখতার।
পিতা ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর।
তিনিও ছিলেন যেমন সৎ, তেমনি বিখ্যাত। তার সততা আর যোগ্যতার কারণে উপাধি পেয়েছিলেন ‘খান সাহেব’। দাদার নাম ছিল সৈয়দ আব্বাস আলী। তিনিও ছিলেন একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। এমনি এক আলোকিত পরিম-লে ভূমিষ্ঠ হলেন তিনি। তিনি মানে আমাদের কবিতার রাজপুত্র ফররুখ আহমদ।
শৈশব কেটেছে তার অসীম আদর আর অপার আনন্দে। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়িতে। ফারসি জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। এরপর গ্রামের পাঠশালায় পড়েছেন কিছুদিন। তারপর পাড়ি জমালেন কলকাতা। কলকাতার তালতলা এলাকার একটি বিখ্যাত স্কুল মডেল এমই। এখানে ভর্তি হলেন তিনি। তারপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাইস্কুলে। এই স্কুলে তার শিক্ষক ছিলেন আর এক বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা। এরপর ফররুখ আহমদ ভর্তি হলেন খুলনা জেলা স্কুলে। এখানে শিক্ষক হিসেবে তিনি পেলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও সাহিত্যিক আবুল হাশিমকে। এই স্কুলের বার্ষিকীতেই জীবনের প্রথম কবিতা ছাপা হলো ফররুখের।
১৯৩৭ সাল। এ বছর প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করেন তিনি। আবার চলে গেলেন কলকাতা। ভর্তি হলেন রিপন কলেজে। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করে ভর্তি হলেন প্রথম দর্শন ও পরে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএতে। পড়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে। কিন্তু শেষ পর্র্যন্ত তিনি আর বিএ পরীক্ষা দেননি।
কবি ফররুখ আহমদ। এক বিশাল কবি। মহাকবি। কবি হিসেবে তিনি ছিলেন যেমন বড়, তেমনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন বড়। তিনি কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। হাঁটতেন বুকটান করে। মাথা উঁচু করে। তাকাতেন মার্বেলের মতো দু’টি উজ্জ্বল চোখে। সেই বুকে, সেই চোখে কোনো ভয় কিংবা দ্বিধা ছিল না। ছিল না এতটুকু কুয়াশার কুঁচি। সমুদ্রের মতো বিশাল আর সাহস ছিল তার বুকে। আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন ছোটদেরকে। তার সেই ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। আমরা তো সবাই জানি, কালে কালে ফররুখ আহমদ হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত এবং শ্রেষ্ঠ এক কবি। কিন্তু তারপরও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি ছোটদেরকে। তাদের কথা তিনি মনে রেখেছেন সারাক্ষণ। আর সেই ভালোবাসা, সেই আদর, সেই স্নেহের প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন তার অসামান্য সব হীরকসমান কিশোরতোষ কবিতায়। এমন কবিতা, যা আগে আমরা পড়িনি। কী অদ্ভুত সব নতুন নতুন চিন্তা, উপমা, ছন্দ ও শব্দের কারুকাজ! তার ‘নতুন লেখা’ বইটির প্রথম কবিতাটির কথাই ধরা যাক। এস, একটু পড়বার চেষ্টা করি :
নতুন লেখা! নতুন লেখা!
নতুন ভোরের আলোক রেখা!
নতুন খুশির ঝলক মনে
ডাক দিয়ে যায় মাঠে বনে,
পাখির সুরে হাল্কা পাখায়
নতুন দিনের গান গেয়ে যায়,
নতুন চোখের দৃষ্টি মেলে
যায় যে নতুন মশাল জ্বেলে,
মেঘ বৃষ্টি আলোর দেশে
নতুন কথা কয় সে হেসে।
বলো তো, থামার কোনো উপায় আছে?
পুরো কবিতাটি পড়া শেষ না করে থামা যায় না। কিন্তু বেশ দীর্ঘ বলে জোর করে থেমে গেলাম। ফররুখ আহমদের কবিতা মানেই এমনি। পাঠের সময় চালাকি কিংবা অলসতা করার কোনো সুযোগ রাখেননি তিনি। আমরা বাধ্য হয়ে যাই কবিতার মূল থেকে কা- এবং শেষ পর্যন্ত পাতার অগ্রভাগ স্পর্শ করতে। যেমন ধরো :
নাইরে পানি বিলে ঝিলে
পাখির পাখায় আয়রে মিলে,
নাইরে পানি মাঠে ঘাটে
আয় বিষটি হাওয়ার নাটে,
শুকনো পাতা নড়ে চড়ে
আয় বিষটি পাগলা ঝড়ে ॥
এখানেও থামার কোনো সুযোগ রাখেননি কবি।
কবি ফররুখ আহমদ কৈশোর, যৌবন এবং পরবর্তী বয়সে শহরে বসবাস করলেও তিনি কখনো ভুলে যাননি তার সবুজ শ্যামল দেশ, ফসলের ক্ষেত, পাখির কলরব, নদীর আহবান, বৃষ্টির ডাক, জোছনার হাতছানি কিংবা পায়ে চলা সেইসব মেঠোপথ। কবির অসংখ্য কবিতায় তাদের উপস্থিতি আছে। তার কবিতা পড়লে বোঝাই যাবে না যে গ্রাম আর তার মনমাতানো পরিবেশ থেকে দূরে, বহুদূরে বসে এক কবি লিখেছেন :
পয়লা আষাঢ়! পয়লা আষাঢ়
হল জানাজানি,
মাঠে ঘাটে এল নেমে
খোদার মেহেরবানি ॥
খোদার রহস অঝোর ধারে
এল নেমে বন-কিনারে,
শুকনো মাটি, শুকনো মাঠে
হল কানাকানি ॥
ঢাকলো আকাশ মেঘে মেঘে
নদী নালা উঠলো জেগে,
হিজল তলায় উঠলো জমে
নিতল, গভীর পানি ॥
কে যেতে চায় ডাঙা দিয়ে,
লুকিয়ে দেখে বনের টিয়ে,
পুঁটি মাছের বিয়ে হবে;
সে হবে রাজ-রানী॥
কিংবা
বিষ্টি এল বাবুই পাখির
পাতার বাসাতে,
বিজলি আলোয় একটু হেসে
এল হাসাতে ॥
টুনটুনিকে ভিজিয়ে দিয়ে
বিষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে,
কয় সে কথা অচিন দেশের
গানের ভাষাতে ॥
পাখপাখালি গেল কোথায়
বনের আড়ালে,
বকের দেখা পাই যে শুধু
বাইরে দাঁড়ালে ॥
খোদার রহম অঝোর ধারে
ঝরে মাটির চার কিনারে,
মন ভেসে যায় মেঘের মায়ায়
নতুন আশাতে ॥
কবি ফররুখ আহমদের যে কবিতাগুলো স্কুলের পাঠ্যবইয়ে আছে, সেগুলোর কথা আমরা জানিই। কিন্তু তার সংখ্যাই বা আর কত? তিনি আমাদের জন্যে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। সেইসব কবিতার অধিকাংশই আমরা জানি না। কী চমৎকার, কী মিষ্টি মধুর সেইসব কবিতা। যেমন ধরা যাক তার ‘শরতের সকাল’-এর কথা। কবি লিখছেন :
ঝিলমিল ঝিলমিল মনজিল,
সারা রাত রয় নিঝঝুম,
রাত শেষে ভেঙে যায় ঘুম,
কেটে যায় আঁধারের ঘোর;
দুনিয়ায় নেমে আসে ভোর ॥
ঝিলমিল, ঝিলমিল, নীল
আসমানে ওড়ে গাঙচিল;
সাত রঙ রাঙা পাখনায়
মাছরাঙা বউ উড়ে যায়,
ঝুমঝুমি বাজে ঝুমঝুম
ভেঙে যায় খোকনের ঘুম ॥
আবার তার ‘পউষের কথা’ আমাদের অন্তরে বেজে যায় অন্যরকম সুর :
মাঠের ফসল আসলো ঘরে,
ধান দেখে ভাই পরাণ ভরে
কিষাণ-চাষির মন ভরে যায়
গল্পে-গানে; মিঠাই, পিঠায়,
গুড় পাটালির সোয়াদ পেলো;
পউষ এল! পউষ এল!
কিছুই এড়িয়ে যায় না কবির চোখ থেকে। এমনকি মশা, মাছি এবং ছোট বড় পশু-পাখিও। তিনি কী অপরিসীম দরদ দিয়ে সেসব তুলে এনেছেন মন-কাড়া, জাদুকরী ছন্দের দোলায়। লক্ষ্য করার মতো বিষয় বটে!
নদী নালার দেশে আবার আসে দূরের হাঁসগুলো, / চমকে ওঠে তাল, সুপারি, নারকেল গাছ, বাঁশগুলো / নানান রঙের ঝিলিক দিয়ে পাখিরা সব যায় চলে / হাজার সুরে দূর বিদেশের খবর তারা যায় বলে, / পর পাখনা নাড়া দিয়ে রঙিন পালক যায় রেখে; / ঝিল হাওরে, নদীর তীরে পাখিরা সব যায় ডেকে ॥
নির্মল হাসি, ব্যঙ্গ, কৌতুক-সরস কবিতাও তিনি লিখেছেন ছোটদের জন্য। ‘নোফেল বাদশা ও হাতেম তায়ীর কিস্সা’-ও তো জানতে পারলাম তার কবিতার মধ্য দিয়ে। আর ‘রাসূলে খোদার ওপর লেখা তার যে অপূর্ণ কবিতাগুলোÑতার তুলনা কোথায়?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি যা কিছু লিখেছেনÑ তার মধ্যেই রয়ে গেছে শিক্ষার দ্যুতি। অপার আনন্দের মধ্য দিয়ে, কবিতা পাঠের সম্পূর্ণ তৃপ্তির মধ্য দিয়ে তিনি ছোটদেরকে প্রকৃত শিক্ষা এবং জ্ঞানের মহিমায় উজ্জীবিত করে তুলতে চাইবেন। ছোটদেরকে বোকা, বধির এবং অলস করে তোলার বিপরীতে তিনি চাইতেন তাদেরকে সচল, আদর্শবান এবং যোগ্য করে গড়ে তুলতে।
প্রকৃত অর্থেই তিনি ভালোবাসতেন মানুষকে। বড় বেশি ভালোবাসতেন। সেই মানুষের ভেতর বড়রা আছে, আমরা আছি, আছে সকল ছোট্ট বন্ধুরাও। ছোটদেরকে তিনি ফুল, পাখি, আর চাঁদ সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে তুলনা করতেন। তাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল সাগরের মতো। তার মত এত মমতা, এত দরদ দিয়ে লেখা আর কার কাছে পাবো?
কবি ফররুখ আহমদ। তিনি ছিলেন বড়দের কবি, ছোটদের কবি, সবার কবিÑ মানুষের কবি। তার আদর্শ এবং ঐতিহ্য ছিল একমাত্র ইসলাম। তিনি তার এই আদর্শ ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে কোন সময় কারোর সাথে আপস করেননি। এমন বিরল দৃষ্টান্তের কবি আমাদের বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি আছে কি? এদিক থেকেও তিনি অনন্য, ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী এবং শ্রেষ্ঠ। হ্যাঁ, তিনি শ্রেষ্ঠ কবি, মহাকবি। তিনি মহাকবি এই শতাব্দীর বাংলা কবিতার।
১৯৭৪ সালের ১৮ অক্টোবর। এই দিনে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেলেন বাংলা কবিতার এক কালজয়ী রাজপুত্র কবি ফররুখ আহমদ। সত্যিই কি তিনি চলে গেছেন?
প্রকৃত কবিরা কি চলে যেতে পারেন কখনো?
না! তিনিও চলে যাননি। এই তো বুকে হাত রাখলে এখনো শুনতে পাই তার সেই উচ্চারণ :
আগুন, পানি ঝড় তুফানে
থামলো না যারা
তাদের সাথে চলি এবার
আমরা ভয় হারা॥
কাজের মানুষ নয়রে যারা
কথার বোঝায় মরে তারা,
ছেঁড়া কাঁথায় তাদের স্বপন
লুটায় ধূলি পারা ॥
নাইরে কাজে শঙ্কা যাদের,
নাইরে ভয়ের মানা,
তাদের কাছেই সবুজ নিশান
মেলে সবুজ ডানা ॥
তারাই ফাঁকা তেপান্তরে
নতুন দিনের মিনার গড়ে,
তারাই হেসে যায় পেরিয়ে
সাগর; সাহারা।
আমাদের ভালোবাসায় আমাদের শ্রদ্ধায় এবং আমাদের স্মরণে সব সময় অমর করে রাখবো এই মহাকবিকে, কবিতার রাজপুত্রকে।