Home গল্প একটুখানি ত্যাগ মুহিব্বুর রহমান রাফে

একটুখানি ত্যাগ মুহিব্বুর রহমান রাফে

ক্যার-ক্যার-ক্যার! কল বেলটা কর্কশ আওয়াজে বেজে উঠতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় নাইমের। কতদিন থেকে আব্বুকে বলছে, কল বেলটা বদলাও, আওয়াজটা বড্ড বিদঘুটে। ওই-ই শেষ। আর কোন অগ্রগতি নেই। নতুন বেল কেনাও হয় না আর ব্যাটা বেল নিজের জায়গায় বসে আছে বহাল তবিয়তে। আবার শব্দ করে বেঝে উঠতেই নাইম দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
‘উফ! বিরক্তিকর!’ বলতে বলতে দরজা খুলতেই, সামনে দাঁড়ানো প্রিয় ব্যক্তিটিকে দেখে লজ্জা পেল নাইম।
‘আসসালামু আলাইকুম, রফিক ভাই। আপনি?’
‘ওয়ালাইকুম। বিরক্ত করলাম?’ একরাশ হাসি নাইমকে উপহার দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন রফিক ভাই।
‘না-না। ছিঃ কি যে বলেন? আসলে কথাটা আপনাকে বলিনি। বলেছি ঐ বেলটাকে, বড্ড বিচ্ছিরি আওয়াজ। আপনি আসুন তো। সাথে কে? চেনা চেনা লাগছে।’
‘ও, মাহমুদ। ওকে তো চেনার কথা। তোমাদের কলোনিতেই তো থাকে, তোমার ইয়ারে পড়ে। ডি-ব্লকে থাকে।’ বললেন রফিক ভাই।
ভালো করে তাকাল নাইম। চিনতে পেরেছে, কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন মলিন, চোখ দু’টো ছল ছল করছে। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ চিন্তিত।
‘আসুন না।’ হাত ধরে রফিক ভাইকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায় নাইম, পেছন পেছন মাহমুদও প্রবেশ করলো।
‘সময় নষ্ট করবো না। তোমার কাছে একটি কাজে এসেছি। একটা উপকার করতে হবে, ভাই।’ বসতে বসতে বললেন রফিক ভাই।
‘কি উপকার? বলুন।’ কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকাল নাইম।
‘আচ্ছা, তার আগে বলো, এক বছরের মধ্যে তোমার কোন বড় ধরনের অসুখ হয়েছিল কি না?’
‘না-তো। কিন্তু কেন বলুন তো?’
‘বলছি। আচ্ছা তোমার বয়স কতো হলো?’
‘এবার আঠারতে পা দিলাম।’
‘আর ওজন?’
‘৪৫-৪৬ হবে আর কি? কি হবে এসব জেনে বলুন তো?’
প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন রফিক ভাই। ‘চমৎকার। চার মাসের মধ্যে কাউকে রক্ত দিয়েছ?’
‘না। কিন্তু আপনি কেন এসব অদ্ভুত প্রশ্ন করছেন, তা না বললে আমি আর আপনাকে কিছু বলবো না।’
‘বলছি। মাহমুদের বড় বোনের অবস্থা খুবই খারাপ। ক্লিনিকে ভর্তি, মুমূর্ষু। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, আজ রাতের মধ্যে দুই ব্যাগ এবি নেগেটিভ ম্যানেজ না করতে পারলে তার আর কিছুই করার থাকবে না। তুমি তো জানো নেগেটিভ রক্ত পাওয়া খুব মুশকিল। আমি আগে থেকে জানতাম, তুমি এই গ্রুপের। তাই তোমার কাছে ওকে নিয়ে এসেছি।’
রফিক ভাইয়ের পাশে বসা মাহমুদের দিকে তাকালো নাইম। ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সে, আশাব্যঞ্জক কিছু শোনার অপেক্ষায়।
‘আমি! আমাকে রক্ত দিতে হবে? আগে যে কোনদিন দেইনি।’ হতচকিত নাইম জিজ্ঞাসা করলো রফিক ভাইকে।
‘সেটা কোন সমস্যা নয়। আজ থেকেই না হয় শুরু হবে।’ বললেন রফিক ভাই।
‘ইয়ে… মানে,…রক্ত দেব? এমনিতেই ইঞ্জেকশনে আমার খুব ভয় আর গরুর মতো একটা সুই দিয়ে আধা ঘণ্টা ধরে রক্ত নিলে আমি একেবারে মরেই যাব, রফিক ভাই।’
‘যা ভাবছ, একেবারে ভুল। সময় লাগবে মাত্র পাঁচ মিনিট। তুমি কলেজে পড় আর একটা পিঁপড়া কামড়ালে যে ব্যথা হয়, সেটাও সইতে পারবে না?’ জিজ্ঞাসা করলেন রফিক ভাই।
‘আর কাউকে পাননি?’ প্রশ্ন করে নাইম। চিন্তা করছে কোন ভাবে এড়ানো যায় কি না?
‘না, ভাই।’ এবার কথা বলে উঠলো মাহমুদ। ‘তাহলে তো দিয়েই দিতাম। আমার নিজেরই বি পজেটিভ। আমাদের আশপাশের কারও সাথে মেলেনি। বড় বোনটার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে, চিৎকার করে মায়ের জন্য কান্নাকাটি করছে। ওর মা-টা যদি মারা যায়…।’ কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে মাহমুদের। দু’ চেখে অশ্রু।
মাহমুদের কান্নায় বিব্রত বোধ করে নাইম। কি করে ফেরাবে ওকে? রক্ত দিতে যদি সুই ঢোকাতে না হতো তাহলে ওদের সাথে এক্ষুণি চলে যেত। নিজের দেহে সুই ঢোকাতে হবে না-না, বাবা, এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
হঠাৎ ড্রয়িং রুমে নাইমের মা প্রবেশ করলেন। ‘আরে রফিক? কেমন আছো বাবা? কখন এলে? সাথে কে?’ একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে থামলেন তিনি। ভালো ছেলে হিসেবে এলাকার মুরুব্বিদের কাছে রফিক ভাই খুবই সুপরিচিত।
‘আমি ভালো আছি, খালাম্মা। আর এ হচ্ছে মাহমুদ। ওর বড় বোনের অবস্থা খুবই খারাপ, আজ রাতের মধ্যে দুই ব্যাগ রক্ত না দিতে পারলে হয়তো বাঁচানো যাবে না। তাই এসেছিলাম নাইমের কাছে, রক্তের জন্য।’
‘আমার নাইম রক্ত দেবে! না-না-না। কি বলছো বাবা? ও তো খুব ছোট?’ প্রবল আপত্তি তোলেন নাইমের মা।
‘আমি নাইমের কাছে সব শুনেছি। রক্ত দেয়ার সমস্ত যোগ্যতাই ওর আছে খালাম্মা।’ জবাব দিলেন রফিক ভাই।
‘তা না হয় হলো বাবা। ওকে বাদ দাও। আমার একমাত্র ছেলে। সারা জীবন কোনো কষ্ট করতে দেইনি। রক্ত দিয়ে আবার কি না কি হয়? কোন সমস্যা হলে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন খালাম্মা।
‘সব ভুল। রক্ত দিলে কোন ক্ষতি তো হয়ই না বরং চার মাস পর পর রক্ত দেয়া শরীরের জন্য উপকারী। দেহের রক্তকণা এমনিতেই চার মাস পর নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট না করে যদি কারও উপকারে লাগে, তাতে সমস্যা কি?’ বোঝাবার চেষ্টা করেন স্নেহশীল মা-কে।
‘যাই হোক, বাবা। আমি মা। আমার মন মানে না। তুমি না হয় কষ্ট করে আর কোথাও খুঁজে দেখ। দোয়া করি, অবশ্যই পেয়ে যাবে। আর শোনো, চা না খেয়ে যাবে না কিন্তু।’ বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে চলে যান নাইমের মা। মায়ের দেয়া সিদ্ধান্তে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে নাইম। যাক্ বাবা রক্ত দেয়া লাগলো না। মলিন মুখে উঠে দাঁড়ালো রফিক আর মাহমুদ।
‘আরে আরে! চা না খেয়ে যাচ্ছেন কোথায়? এক্ষুনি নিয়ে আসছি, প্লিজ একটু বসেন।’ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে নাইম।
‘তার আর দরকার নেই। অন্য দিন হবে। হাতে সময় খুব কম। দেখি, অন্য কোথাও চেষ্টা করে পাই কি না।’ রফিক ভাইয়ের কণ্ঠে হতাশা। মাহমুদের মুখে কোন ভাষা নেই।
‘আসলে… আমি… মানে রক্ত দিতেই চাচ্ছিলাম। কিন্তু মা না করেছেন। বোঝেন তো, মায়ের আদেশ পালন করা ফরজ। কিই বা করার আছে আমার?’ অজুহাত পেশ করে নাইম।
রফিক ভাই বলে ওঠেন, ‘দেখো নাইম। মানবিকতার অনুভূতিটা একান্তই নিজের। আর একটা জিনিস মনে রেখো, বিপদ যে কোন মুহূর্তে যে কোন ব্যক্তির ওপরই আসতে পারে। তাই মানুষকে বিপদে সহযোগিতা করলে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করেন। আসি।’ ভঙ্গুর মনে নাইমদের বাসা থেকে বেরিয়ে যান রফিক ভাই আর মাহমুদ। দরজা বন্ধ করে কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নাইম। রফিক ভাইয়ের বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো খুব দংশন করছে তাকে। কিইবা ক্ষতি হতো তার? কল্পনায় হঠাৎ সুইয়ের কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে সে। না বাবা। এ কাজ আসলেই তার দ্বারা সম্ভব নয়। মাথা নাড়ে নাইম।
তিন দিন পার হয়ে গেছে এ ঘটনার পর। কলেজ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই নাইমের সাথে দেখা হয় রফিক ভাইয়ের।
‘আসসালামু আলাইকুম। আরে রফিক ভাই! কেমন আছেন?’ জিজ্ঞাসা করে নাইম।
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আছি, আলহামদুলিল্লাহ।’ জবাব দিলেন তিনি।
‘আচ্ছা, ওই যে আপনার সাথে এসেছিল ছেলে কি যেন নাম? ওর বোনের খবর কি?’ মনে পড়তেই জানতে চাইল নাইম।
‘মাহমুদের বোন সে তো মারা গেছে।’ ভাবলেশহীন মুখে জবাব দিলেন রফিক ভাই।
অপরাধ বোধ জেগে উঠলো নাইমের মনে। ‘রক্ত পাওয়া যায়নি?’ জানতে চাইলো সে।
‘শেষ পর্যন্ত জোগাড় করতে পারিনি। কি আর করা।’
‘আমি দুঃখিত, রফিক ভাই।’ মাথা নিচু করে বললো নাইম।
‘না-না। তুমি দুঃখিত হবে কেন? হাজার হলেও তুমি তো ক্ষতি থেকে বেঁচে গেলে, সেটাও বা কম কি?’
‘আসলে…?’ লজ্জা আর গ্লানিতে মাথা উঁচু করতে পারলো না নাইম।
‘আমার মনটা ভালো নেই, ভাইয়া। আমি আসি। পরে কথা হবে, কেমন?’ কথা না বাড়িয়ে রওনা দেন রফিক ভাই। বিষণœ মনে ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় নাইম।
কাছে আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ কানে এলো তার।
কি ব্যাপার? দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতর। ড্রয়িং রুমে কয়েকজন পুরুষ আর ভেতরে প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা মা-কে ঘিরে রয়েছে। অঝোর ধারায় কাঁদছেন মা।
‘কি হয়েছে, মা?’ নাইমকে দেখতে পেয়ে অবেগ উথলে উঠলো তার। জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলেন।
‘কি হয়েছে, মা? আমাকে সব খুলে বল?’ ব্যাকুল কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
‘তোর বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। হাসপাতালে আছে। অজ্ঞান।’
কি বলছো মা কিভাবে হলো? কোথায় হলো? চিৎকার দিয়ে ওঠে নাইম।’
‘অফিসের সামনে। রিকশার পেছনে ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে তোর বাবার। পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগবে। রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ কাঁদতে থাকেন মা।
‘কোন হাসপাতালে, বাবার কাছে কে আছে? আমি যাব সেখানে।’ জানতে চায় নাইম। নাইমের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি নেমে আসে।
‘তোর চাচা-ফুফুরা সবাই আছে। তুই বরং তোর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে খুঁজে দেখ বাবা, রক্ত মেলে কি না?’
ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে নাইম। বাবাকে নিয়ে একটার পর স্মৃতি ভেসে উঠছে তার মনে। না! বাবার ক্ষতি সে কোনো ভাবেই কল্পনায় আনতে পারে না। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে রক্ত।
কার কাছে পাবে, কোথায় যাবে ভাবতে থাকে নাইম। হঠাৎ মনে ভেসে ওঠে মাহমুদের কথা। ওর গ্রুপ আর বাবার গ্রুপ তো একই। মনে পড়ে মাহমুদের অশ্রুসিক্ত মুখ, যেদিন সে এসেছিল নাইমের কাছে, ওর বোনের জন্য। রক্তের অভাবে মারা গেছে সে। আর কোন মুখ নিয়ে সে দাঁড়াবে তার সামনে। নাহ। এটা সম্ভব নয়।
উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকে নাইম। গন্তব্য জানা নেই। ভাবছে কোন সংস্থার কাছে যাবে কি না? কিন্তু সবার রক্ত তো নিরাপদ নয়?
হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পায় মাহমুদকে। মাহমুদও নাইমকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে।
‘আরে নাইম। তুমি এখানে? তোমার বাবার খবর কি? এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে তোমাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম।’ নাইমের হাত দুটো ধরে জিজ্ঞাসা করে মাহমুদ।
‘খবর ভালো না, মাহমুদ। প্রচুর রক্ত লাগবে। পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘তাই নাকি? কোন গ্রুপ?’
‘বি পজেটিভ’।
‘আরে, আমারও তো একই গ্রুপ। আমিই দেব রক্ত। এক্ষুণি যাব। চল।’ ব্যস্ত কণ্ঠে বলে মাহমুদ।
মাহমুদের মহানুভবতায় নিজেকে খুব ছোট মনে হয় নাইমের। যাকে কয়েকদিন আগেই সে নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিল, মুমূর্ষু বোনটির জন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাহায্য করেনি আর আজ সেই কিনা তার বাবাকে রক্ত দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে নাইম, ‘রক্ত দেবে তুমি? আমার বাবার জন্য?’
‘কেন নয়, ভাই? আমার সামান্য এক ব্যাগ রক্তে যদি একজন ভালো মানুষের জীবন বেঁচে যায়, এতটুকু ত্যাগ করা কি একজন মুসলমানের কর্তব্য নয়?’ মাহমুদের কথা শুনে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে নাইম। দু’ হাতে সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরে মাহমুদকে।
‘আমাকে ক্ষমা করো মাহমুদ। আমি খুব লজ্জিত।’ মাহমুদের চোখেও পানি, বোনকে হারাবার বেদনায়।
‘তার প্রয়োজন নেই। সে চলে যাবে এটাই হয়তো আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল। চলো ভাই। হাসপাতালে যাই। দেরি হলে চাচার ক্ষতি হতে পারে।’
‘হ্যাঁ, তাই চল’। দু’জনে হাতে হাত রেখে রওনা দিল হাসপাতাল পানে। দু’জনের চোখেই আনন্দাশ্রু। বসন্তের শান্তিময় সুবাতাস আর আত্মত্যাগ ও সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ দু’টি হৃদয় এক হয়ে মিশে যেন একাকার হয়ে গেল।

SHARE

Leave a Reply