Home উপন্যাস নীলটুনি আর মানুষ জননী

নীলটুনি আর মানুষ জননী

সালেহ্ বায়েজীদ

ভোরের আলোটা সূর্যমুখী ফুলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীতে সূর্যের হাসিটা যেন আজ একটু বেশিই হেসে ফেলেছে। সূর্যমুখী ফুলের মত হলুদ হলুদ একটা মিষ্টি আবহে সূর্যটা জেগে উঠেছে।
ফারিয়াল ঘুম থেকে আড় চোখে চেয়ে দেখে সূর্যটা তার ঘরের জানালার কাছে ঠক ঠক করে ডাকছে, ফারিয়াল কানে শোনে না, সে কথা সূর্যমামা ভাল করে জানে। তাইতো জানালার ফাঁক গলে একটা চিকন হাত দিয়ে ফারিয়ালকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। ফারিয়াল মূক ও বধির একজন বৃষ্টিপরী। প্রতিদিন সূর্যমামা ফারিয়াল এভাবে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। ফারিয়াল মূক ও বধির ফলে হবে ওর মত এত শার্প ব্রেনের মেয়ে এ পৃথিবীতে একটিও নেই। সূর্যমামা অবশেষে ফারিয়ালকে ঘুম থেকে জাগিয়ে চলে যায় দূর দিগন্তে। ফারিয়াল সূর্যমামাকে বলে কাল কিন্তু আবার এসো অবশ্য এ কথা বলার কোন শক্তি ফারিয়ালের নেই। সূর্যমামা ঠিক ঠিক ফারিয়ালের মনের খাতা থেকে পড়ে নেয় সে কী বলছে। ফারিয়াল দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে তার মার ঘরে যায়। ফারিয়ালের মামণি একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ফারিয়াল এসে আলতো করে মার কপালে হাত রাখে। সাথে সাথে ফারিয়ার মামণির ঘুম ভেঙে যায়। ফারিয়ালের বয়স এখন তের বছর। কিন্তু সে এখনো তার বয়সের সাথে ঠিক ভাবে বেড়ে ওঠেনি। এইতো কিছুদিন আগের ফারিয়াল পানি দেখে ভয় পেত, মামণিকে ধরে কামড় দিত অথবা রাগ করে বাসার সমস্ত জিনিসপত্র আছড়ে ভেঙে ফেলত। ফারিয়ালের আদুরে হাতের ছোঁয়া পেয়ে তার মা কুসুমের ঘুম ভেঙে যায়। প্রতিদিন ঘুম থেকে ফারিয়ালকে জাগিয়ে তুলে সূর্যিমামা আর ফারিয়াল সূর্যিমামার মত তার মামণিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে। ফারিয়াল বুঝতে পারে প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে তার মা তাকে কপালে আদর দিয়ে কেন চোখের জল ঝরায়। ফারিয়াল ময়ূরের পেখমের মত নরম হাত দিয়ে সে জল মুছে ফেলে। তারপর কুসুম অর্থাৎ ফারিয়ালের মামণি দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাশতা তৈরির কাজে লেগে যায়। ফারিয়ালদের বাড়িটা ডুপ্লেক্স ভিলা পেঁচানো সিঁড়িটা যেন ডিমের ডার হেমিকস। ফারিয়াল মাকে হাত দিয়ে নিজের মুখের ভাষা কি যেন বলে ছাদে ওঠে। ফারিয়ালকে মূক-বধির স্কুলে ভর্তি করানো হয় প্রায় তিন বছর আগে। সেখানে সে হাত দিয়ে কিভাবে নিজের অব্যক্ত কথা অপরকে বোঝানো যায় তা শিখানো হয়। স্কুলটা অনেক সুন্দর। ময়মনসিংহ জেলা লাইব্রেরির বিপরীত পাশেই ফারিয়ালের স্বপ্নের স্কুল। ছাদে আসতেই আনন্দে ফারিয়াল খলবল করতে থাকে।
বৃষ্টিপরী এসে আড়–রটার নিচে বসে আছে। ফারিয়ালদের ছাদটা অনেক সুন্দর। ছাদের আঙুরের মাচা আছে। ভুবন ভুলানো গন্ধের লেবুগাছ আছে। আরও আছে আমগাছ, ড্রাগন ফলগাছ, আর ফুলগাছের তো অভাবই নেই। বৃষ্টিপরী ফারিয়ালকে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসে।
বৃষ্টিপরীও ফারিয়ালের মতো মূক ও বধির। ওর মা বাবাকে ওকে রেখে দূর অজানার দেশে চলে যায়। ওদের পরীর রাজ্যে ওকে আর কেউ থাকতে দেয়নি। আর দেবেই বা কি করে বৃষ্টিপরী যে কথা বলতে ও কানে শোনতে পায় না। সেই থেকে পৃষ্টিপরী ফারিয়ালদের ছাদে থাকে। বৃষ্টিপরীর জন্য ফারিয়াল একটা সুন্দর দেখে হোক্ট ঘর তৈরি করে দিয়েছে ছাদে বৃষ্টিপরীর মতো ফারিয়ালের বাবা ওকে রেখে, মাকে কষ্ট দিয়ে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। যাওয়ার সময় ফারিয়ালদের এ বাড়িটা ও ওর বাবা নিতে চেয়েছিল, পারেনি কারণ এ বাড়িটাও যে ফারিয়ালের নানাভাই তার মামনি কুসুমকে দিয়ে যায়। ফারিয়াল বুঝে যে তার বাবা হয়তবা তার মেয়ের জন্যই বাড়ি থেকে দূর অজানার দেশে চলে যায়। বাবা অবশ্য একদিন এসেছিল এর মধ্যে। বৃষ্টিপরী মনের সুখে আঙুর খেতে থাকে। ফারিয়াল বৃষ্টিপরীর কাছে গিয়ে বসে। বৃষ্টিপরীর ডানাগুলো সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছিল। ডানাগুলোতে যেন আলোর এক চমৎকার খেলা শুরু হয়েছে। ফারিয়াল চোখগুলো ছানাবড়া করে সে আলোর খেলা দেখছিল। এদিকে বৃষ্টিপরী একমনে আঙুর খেয়েই যাচ্ছে। একটি বারের জন্যই ফারিয়ালকে বৃষ্টিপরী বলছে না যে তুমিই একটা খাও। ছাদের মধ্যে সকালবেলা হলুদ, কমলা, সাদা, গোলাপি নাইনও ক্লক ফুলগুলো হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে টবে।
প্রতিদিন বেশ আনন্দ করে নাইনও ক্লক ফুলগুলো বৃষ্টিপরীর সাথে। আজ তাদের আনন্দটা একটু বেশি কারণ কাল রাতে বৃষ্টিপরী তাদের একটা সুন্দর কবিতা ও গান শুনিয়েছে। তাই আজ সকালে তাদের এত আনন্দ। ফারিয়াল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ফুলগুলোর দিকে।
বৃষ্টিপরী আঙুর খাওয়া শেষ করে, হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে দেখায়, আমি তোমার সাথে তোমার স্কুলে যাব। আমিও পড়াশোনা শিখব। ফারিয়াল তার হাত ঘর ব্যবহার করে বৃষ্টিপরীর পাল্টা উত্তর দেয় না, এখন নয় আর কিছু দিন পর তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে।
নাইনও ক্লক ফুলগুলো বেশ হেলেদুলে গান গাইতে শুরু করে। সূর্যের আলো পড়ে নাইনও ক্লক ফুলগুলো আরও উজ্জ্বল হতে শুরু করে। কিন্তু ফারিয়াল জানে অল্প কিছুক্ষণ পর ফুলগুলোর আনন্দ উল্লাস শেষ হয়ে যাবে। কারণ সকাল ৯টার পর এ ফুলগুলো আর ফুটে না। ফুল আর বৃষ্টিপরীর আলোর নাচন শেষ হলে ফারিয়াল তার মার সাথে স্কুলে যায়। ফারিয়ালদের ছাদের ওপর যে কয়েকটা লেবুগাছ আছে তাতে মাঝে মধ্যে একটা অজানা পাখি আসে। নাইনও ক্লক ফুলগুলো ফারিয়ালকে দেখিয়ে ইশারা করে বলে আমাদের এখন থেকে একটু বেশি খাবার দেবে, তা ছাড়া দেখ না সারাদিন ঝিম ধরা ঘুমের মধ্যে কেমন করে সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে যায়। ফারিয়াল তার ডান হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলে, ঠিক আছে, তোমাদের এখন থেকে একটু বেশি খাবার দেব। ফুলগুলো খুশিতে ডগমগ করতে থাকে। ফারিয়াল বৃষ্টিপরীকে বিদায় জানিয়ে নিচে এসে দেখে তার মামনি নাশতা রেডি করে টেবিলে বসে আছেন। ফারিয়াল দু’হাত ভালো করে স্যাভলন সাবান দিয়ে ধুয়ে নাশতা করতে বসে যায়। এদিকে বৃষ্টিপরী চুপি চুপি ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। ফারিয়াল নাশতা সেরে মাকে হাত দিয়ে সঙ্কেত করে বোঝায় তার মনটা আজ দারুণ খুশি। কারণ নাইনও ক্লক ফুলগুলো তাকে আজ অনেক সুন্দর আর মিষ্টি গান শুনিয়েছে। ফারিয়ালদের স্কুলটা অনেক সুন্দর। ঠিক বৃষ্টি পরীদের রাজ্যের মতো। ফারিয়াল সে স্কুলে পড়ে তার মামনি কুসুম সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
ফারিয়ালকে কত কী বলেছে তার পাড়ার মানুষ। কেউ বলেছে পেঁপু পাগলী বোবা, জিনের আছরওয়ালা মাইয়া। ফারিয়ালের পরিচয় দেবে না বলেই তো তার বাবা তাকে ছেড়ে চলে যায়। অবশ্য ফারিয়ালের মামনি প্রথম প্রথম বেশ কান্না করতেন এসব ভেবে। শেষে এক ফারিয়ালকে বুকে আগলেই তার মা মূক- বধির স্কুলে চাকরি নেন। জীবনটাকে নুতন করে সাজিয়ে নেন তার মামনি কুসুম। ফারিয়াল এখন ঠিকই বোঝে তার বাবা কেন তাকে রেখে চলে যায়। তবুও ফারিয়ালের মাঝে মধ্যে বাবার কথা মনে পড়ে চোখে জল আসে। স্কুলে আজ ফারিয়ালকে শেখানো হবে কিভাবে পাটের আঁশ দিয়ে পুতুল বানাতে হয়। ফারিয়াল খুব সুন্দর করে পুতুল বানাতে পারে। আর গত বছর তো পুতুল বানিয়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও-ই পায়। এ দিকে বৃষ্টিপরী ছাদের কোনায় বসে বসে কাঁদছে, ফারিয়ালকে কত করে বোঝানোর পরও তাকে স্কুলে নিয়ে যায়নি।
বৃষ্টিপরী আগে থেকেই আজ ঠিক করে রাখে রাতে যদি ফারিয়াল ছাদে আসে তবে তাকে একটা কথা বুঝাবে হাতের মুখের ইশারায়। ফারিয়াল বোবা মেয়ে বলে অনেকেই ওকে খেলায় নিতে চায় না। ফারিয়াল এ নিয়ে কতদিন তার মার কাছে অভিযোগ করেছেÑ কেন তার বন্ধুরা তাকে খেলায় নেয় না। সন্ধ্যার পর ফারিয়াল আবার ছাদে ওঠে। আকাশে তখন কালো মেঘের আমেজ। অবশ্য সন্ধ্যার আকাশে মেঘের এমন ওড়াউড়ি বুঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টিপরীর ডানাগুলো আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ঝকমক করছিল। ফারিয়াল বৃষ্টিপরীকে বলে, চলো আমাদের ঘরে চলো, দেখছ না কেমন ঝড় আসছে। বৃষ্টিপরীকে ইঙ্গিত করে বুঝানো কথায় সে ঠিকই বুঝতে পারে ফারিয়াল কী বলছে। অগত্যা বৃষ্টিপরী ফারিয়ালের কথায় রাজি হয়ে ওর সাথে ফারিয়ালদের ঘরে চলে আসে। আকাশ বাতাস হুঙ্কার শব্দ করে ঝড় চলে যায়। আর তার পরই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। এবার বৃষ্টিপরী ফারিয়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে হাত-পা নেড়ে বলে, এখন চল আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। বৃষ্টিতে ভিজলে ফারিয়ালের মনের দুঃখগুলো বৃষ্টি সব খেয়ে ফেলে। ফারিয়াল আর বৃষ্টিপরী হাত ধরাধরি করে প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে থাকে। ছাদের মধ্যে দুই বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে। বৃষ্টিপরী তার দুটো পাখা শরীরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। যাতে করে বৃষ্টিতে তার পাখা দুটো না ভিজে। বৃষ্টি এসে ফারিয়ালকে আদর করে দেয়। বৃষ্টিপরী আর ফারিয়াল আনন্দে ময়ূরের মত পেখম মেলে নাচতে থাকে। বৃষ্টি তার রিমঝিম শব্দে ফারিয়াল আর বৃষ্টিপরীকে বৃষ্টির নূপুর পরিয়ে দেয়। বৃষ্টিপরীর মনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট আনন্দ হয়ে ঝরতে থাকে পৃথিবীতে। বৃষ্টিতে মনের আনন্দে ফারিয়াল বৃষ্টির বন্দনা করে। বৃষ্টিপরীর সমস্ত কষ্ট চলে যায় জলের তোড়ে।

নীলটুনি
গত রাতের বৃষ্টিতে পানি জমে যায় চারিদিকে। আর এমন ঝড়ে ফারিয়ালদের আঙুর গাছের কিছু ডাল ভেঙে যায়। ফারিয়াল সকালবেলা ছাদে এসে দেখে যেখানটায় কিছু আঙুর ডাল ভেঙে পড়ে আছে, ঠিক তার পাশে একটা পাখি নয় দুটো পাখি ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। ফারিয়াল দ্রুত পাখি দুটোকে নিয়ে তার মার কাছে আসে। ফারিয়ালের মা মনি দেখে বলে, আরে এ তো নীলটুনি, এ তুমি কাথায় পেলে। ফারিয়াল ইশারার মাধ্যমে হাত দিয়ে দেখায়, সে ছাদ থেকে এ পাখি দুটোকে তুলে এনেছে। নীলটুনি পাখি দুটো বেশ সুন্দর। পাখি দুটো যেন ফারিয়ালকে তার বন্ধু হিসেবে পেয়েছে। নীলটুনি পাখি দুটোকে ফরিয়াল রুমাল দিয়ে পেঁচিয়ে তার বিছানার ওপর রাখে। পাখি দুটোর খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ফরিয়াল তা বুঝতে পারে, সে পাখি দুটোর জন্য কিছু পোকামাকড় নিয়ে আসতে বলে বৃষ্টিপরীকে।
পাখি দুটো ফারিয়ালের আদর দেখে ডেব ডেব করে চেয়ে থাকে তার দিকে। একটি বারের জন্য পাখি দুটো উড়ে যেতে চায়নি।
ফারিয়ালও বুঝতে পারে যে পাখি দুটো তাকে অনেক পছন্দ করে ফেলেছে। নীলটুনি দুটো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ফারিয়ালকে একজন ভাল বন্ধু হিসেবে নেয়। পাখি দুটোর সাথে ফারিয়ালের অনেক কথা হয়। পাখি দুটো ফারিয়ালকে সরাসরি জানান দিয়েছে তারা মাচায় থাকবে না। তারা সব সময় মুক্ত বিহঙ্গ ছিল। এখনো তারা মুক্ত বিহঙ্গ হিসেবেই ফারিয়ালের বন্ধু হিসেবে থাকতে চায়। ফারিয়াল লক্ষ করে নীলটুনি দুটো অসম্ভব রকমের সুন্দর! নিলচে মায়াবী রং ওদের সারা শরীর জুড়ে। যেন নীল রঙের একটা আঁচড় কেটে দিয়েছে কোন শিল্পী তাদের সারা শরীর জুড়ে। ফারিয়ালের ভালবাসায় নীলটুনি দুটো সুস্থ হয়ে ওঠে। আর সুস্থ হয়ে যত উঠতে থাকে ওদের গায়ের নীল বর্ণ যেন আলো উজ্জ্বল হতে থাকে।
ফারিয়াল প্রতিদিন বহু পোকামাকড় আর নাম না জানা কীটপতঙ্গ ধরে নীলটুনি দুটোকে খাওয়া যায়। নীল টুনি দুটোর এভাবে বেঁচে থাকো দেখে কুসুম বেশ অবাক হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে ফারিয়ালের মামনি কুসুম বেশ অবাক হয়ে যায়। তার মেয়ের পাখি ফুল, লতাপাতার প্রতি ভালোবাসা দেখে। ফারিয়াল এমন নীলটুনিদের থাকার ঘর নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। নীল টুনিদের থাকার ঘর কিভাবে সে বানাবে। তা নিয়ে মামনির সাথে ভাব বিনিময় করে।
ফারিয়ালের মামনি হাতের মুখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় সে কথা। নীলটুনিরা প্রকৃতির সন্তান, তাদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তা ছাড়া নীলটুনিদেরকে নিজের মত করে ছেড়ে দাও, তোমার প্রতি যদি ওদের মায়া লেগে থাকে, তাহলে তোমাকে ওরা ছেড়ে যাবে না। এ কথা মেয়েকে বুঝিয়ে ফারিয়ালের মামনি ঘরে চলে আসে ছাদ থেকে। ফারিয়াল নীলটুনিদের ছাদে রেখে স্কুলে যায়। আজ তাদের স্কুলে জাপান থেকে কিছু ব্যক্তি আসবে স্কুলটা পরিদর্শন করার জন্য। ফারিয়াল সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে গোসল সেরে রেডি হয় স্কুলে যাওয়ার জন্য। সে ফারিয়াল ছোট থাকতে পানি দেখে ভয়ে জড়ো হয়ে থাকতো বরফের মত। সে ফারিয়াল এখন পানি নিয়ে প্রতিদিন খেলা ধরে। ঝরণা ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টির মত পড়তে থাকা পতিত পানিতে সে মনের আনন্দে সাঁতার কাটে। ফারিয়াল আজ সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে স্কুলে যায়। তার নিজের হাতে বানানো দু’টি পুতুল সে তার ব্যাগে নিয়ে যায়। যদি সুযোগ হয় তাহলে জাপানি ঐ পরিদর্শকদের সে দেখাবে। স্কুলে বরাবরই ফারিয়াল সময়মত আসে। মাঝে মধ্যে একা আসে, আবার কখনো কখনো তার মা তাকে নিয়ে আসে। যেদিন মমনির আসতে দেরি হয় সেদিন ফারিয়াল নিজেই স্কুলে চলে আসে। ফারিয়ালের স্কুলে বন্ধুরা ওরই মত অটিস্টিক শিশু। এখানে যে শিশুগুলো আসে সবাই খুব কষ্ট করে জীবন যাপন করে। কারও হয়তবা বাবা আবার বিয়ে করেছে অথবা কারও মা নেই, কারও হয়তবা মা-বাবা কেউ নেই।
আর ফারিয়ালে মত সমাজের অনেকেই মূক-বধির ও প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে ঐভাবে দেখে না। ফেল না ঝুড়ির মত কেউ কেউ পারলে তার সন্তানকে সাত সাগর তের নদীর ওপারে ফেলে। মানুষ-এর কথা কী বলব। ফারিয়াল তার বাবাই তো তার পৃথিবীতে আসার পর তাকে ফেলে এ মমনিকে ফেলে চলে যায়। কোনদিন আর ফারিয়ালকে দেখতে আসেনি। ফারিয়াল তার জীবনে জানে না বাবার আদর কী, বাবার আদর পেতে কেমন লাগে। স্কুলে গেট দিয়ে জাপানি পরিদর্শকরা চলে আসছেন। ফারিয়াল বা শান্ত হয়ে শামুকের মত জুটি সেরে ক্লাসে বসে। মাসুমা ম্যাডাম পথ দেখিয়ে জাপানি পদির্শকদের ফারিয়ালের ক্লাসে নিয়ে আসেন। স্কুলে ফারিয়ালের মামনি ওর কাছে ম্যাম, আর বাড়িতে শুধু মামনি। ফারিয়ালরা ওঠে একটা কদমফুলের হাসি দিয়ে হাতের ইশারায় জাপানি পরিদর্শকদের স্বাগতম জানায়। ফারিয়ালরা বেশ আনন্দ করতে থাকে জাপানি পরিদর্শকদের দেখে। ওরা ওদের বিশাল থলে থেকে ক্লাসের সবাইকে দারুণ মজার মজার সব জিনিস দেন। কেউকে দেয়া হয় রুবিক কিউবস, কাউকে সুন্দর অ্যাঙকি বার্ডস, আবার কাউকে পোকমন, আবার কাউকে চকলেট ঘড়ি আরো কত কী! ফারিয়ালদের সবাইকে একটা করে ব্যাগ উপহার দেন জাপানি পরিদর্শক। যা ফারিয়ালদের কাছে এত সব উপহার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো সান্তাক্লজ এসে তাদের এতসব দিয়ে গেল। ফারিয়াল তার ব্যাগ থেকে পাটের আঁশ দিয়ে বানানো সুন্দর পুতুল বের করে। তারপর মাসুমা ম্যাম এর দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করে হাতে দেখায় ‘যে সে এই পুতুলটা জাপানি ঐ পরিদর্শকদের দিতে চায়। ফারিয়ালের দেখাদেখি অনেকেই তাদের ব্যাগ থেকে কিছু না কিছু বের করে, কেউ সুন্দর করে এঁকে আনা ড্রইং বের করে। কেউ বের করে লম্বা পুতুল অথবা সুন্দর পটারি। জাপানি এ পরিদর্শকেরা বছরের কোন না কোন সময় ফারিয়ালদের স্কুলটা পরিদর্শন করেন। ফারিয়াল তার ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর কার্ড বের করে। যে কার্ডটা সে নিজে তৈরি করে। কার্ডটা তৈরি করতে ফারিয়ালের লেগেছিল একটা আইকা, কিছু গিটার আর রংপেন্সিল, প্রথমে ফারিয়াল কার্ডটা সুন্দর করে হার্টশেপ করে কাটে। তারপর কার্ডটার চারপাশ জুড়ে আইকা দিয়ে একটা বর্ডার দেয়। আর চুমকিগুলো লাগিয়ে দেয় বর্ডার লাইনে। রৌদ্রে কড়কড়া করে সে তা শুকোয় আর নিজের মনের রংধনু থেকে সাতটি রং নিয়ে তা সাজিয়ে তুলে আপন হাতে। ফারিয়াল আজ সেই কার্ডটা জাপানি এক পরিদর্শককে উপহার দেয়। লোকটা এ উপহার পেয়ে বেশ খুশি হয়। স্কুলে সবাই একটা সুন্দর করে নাচ করে। আর ফারিয়াল থাকে সে নাচের দলের প্রধান। ফারিয়ালদের নাচ দেখে সবাই থ হয়ে যায়। বোবা, কালো আর পেঁপা বলে যে ফারিয়ালকে নিয়ে একদিন তার মার চিন্তার শেষ ছিল না। সেই ফারিয়াল আজ তার মুখ উজ্জ্বল করছে। জীবনের সমস্ত পাওনা যেন মাসুমা আজ খুঁজে পেল। নিজের জীবনের পাপ পুণ্যের হিসাব না করে প্রকৃতির সন্তান ফারিয়াল তার নীলটুনি এসব চিন্তায় যেন মাসুমা কোথায় হারিয়ে যায়।
বাড়িতে বসে ফারিয়ালের মামণি ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। ফারিয়াল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কেন তার মামণি ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। নাকি ফারিয়াল তার মামণির মনে কোনো কষ্ট দিয়েছে। ফারিয়ালদের তো সাধারণত জেনে শুনে তার মা মনির মনে কষ্ট দেয়নি কখনো, তাহলে কী আজ ওদের স্কুলে আসা জাপানি পরিদর্শকরা তার মামনিকে বকা দিয়েছে। কিছুই ফারিয়াল বুঝে উঠতে পারছে না। ফারিয়াল বার বার তার হাত দিয়ে মার চোখ মুছে দিতে থাকে। মাসুমা কখনো ভাবতে পারেনি তার মেয়ে এমন সুন্দর করে নাচতে পারে, সে মেয়েকে নিয়ে তার বাবার সাথে অনেক বার ঝগড়া অভিমান করে চলে যায়। সেই থেকে মাসুমা একা একা ফারিয়ালকে বড়ো করে তুলেছে। আর নিজে চাকরি নিয়েছে মূক-বধির স্কুলে। জীবনের রংগুলো মেয়ে ফারিয়াল এভাবে ফুটিয়ে তুলবে তা সে কখনো ভাবতে পারেনি। ফারিয়ালের মামনি বাসায় ওকে আগলে ধরে। আনন্দে নদীতে দুপুরে কড়া রৌদ্র চিকচিক করতে থাকে ফারিয়ালে মামনির চোখে। একটা বিরাট অজগরের মত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শেষে মেয়েকে নিয়ে দূর আকাশে উড়তে থাকে ফারিয়ালের মামনি। আজ ফারিয়ালের প্রিয় খাবার ম্যাকরমি রান্না করবে তার মা মনি। ফারিয়াল মাথায় নীলটুনি এসের ভর করে। যেন তার মাথার ভেতর থেকে শত শত নীলটুনি উড়ে চলে যাচ্ছে এ আনন্দের সংবাদে। ফারিয়াল নীলটুনির সাথে দেখা করার জন্য ছাদে যায়। এদিকে নীলটুনিদ্বয় বৃষ্টিপরীর সাথে বসে বসে আঙুর খাচ্ছে। নীলটুনিদ্বয় ফারিয়ালকে দেখে নাচতে নাচতে ওর সামনে হাজির হয়। ফারিয়াল নীলটুনি দুটোকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। নীলটুনি ফারিয়ালের আদর পেয়ে চোখ বুজে থাকে। নীলটুনিদ্বয় এখন বেশ উৎফুল্ল। ফারিয়ালকে দেখে বৃষ্টিপরী বলে, কী ব্যাপার ফারিয়াল তোমরা চোখে মুখে এত আনন্দের রেখা কেন? ফারিয়াল নীলটুনিদ্বয়কে কাঁধে বাসিয়ে হাতের ইশারায় বলে আমি আজ স্কুলে নাচ করে জাপানি পরিদর্শকদের চমকে দিয়েছি। তাছাড়া আমার নিজের হাতের বানানো কার্ড পেয়ে ওরা দারুণ খুশি হয়। এ কথাগুলো বুঝে বৃষ্টিপরী আঙুর খাওয়া রেখে ফারিয়ালকে অভিনন্দন জানায় অটিস্টিক শিশুরা যে এ সমাজের বোঝা নয়, ফারিয়াল যেন সে কথা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। নীলটুনিরা এবার ফারিয়ালকে তাদের পাখা নেড়ে বলে, আমরা কোথাও যাবো না, তোমাদের ছাদে যে লেবুগাছটা আছে তাতে আমরা তুলো দিয়ে বাসা তৈরি করবো।
ফারিয়াল তার দু’হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলে, নীলটুনিরা তোমরা বাসা করতে চাও ভাল কথা, তার আমার মামনির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে, কারণ গাছটা মামনি লাগিয়েছে তাই। ফারিয়াল টুনিদ্বয়কে কথা দেয় যে তার মামনি রাজি হতে পারে। ফারিয়ালের মামনি ছাদে এসে দেখে তার মেয়ে নীলটুনিদের সাথে ভাব বিনিময় করছে। এমনি সময় ওদের গেটে কে যেন শব্দ করছে। গৃহকর্মী রহিছা গিয়ে গেট খুলে দিয়ে দেখে একটা মধ্য বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাসুমা এসে ড্রইং রুমে বসে। লোকটা ঠিক মাসুমা অর্থাৎ ফারিয়ালের মামনি জিজ্ঞেস করছে চাচা কি জন্য এসেছেন, লোকটা বলছে… মাগো দুইদিন হয় কিছু খাই নাইক্কা, আমাকে এডা কাম দিবাইন। ফারিয়ালের মামনি কী ভেবে জানি লোকটাকে দেখে মায়া লেগে যায়।
লোকটাকে দুপুর বেলায় ফারিয়ালের মামনি পেট ভরে এত খাওয়ায় যে লোকটা দুপুরে ভাত খেয়ে একটা ভাত ঘুম দেয়। সে সময় লোকটা ভুঁস ভুঁস করে নাক ডাকছে। মনে হচ্ছে লোকটার নাকের ভেতর থেকে কেউ যেন একটা সুন্দর তরল বাঁশি বাজাচ্ছে। নীলটুনিদ্বয় এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ফারিয়াল নীলটুনিদ্বয়ের জন্য অল্প চাল নিয়ে ছাদে যায়। নীলটুনিরা ঘুট ঘুট করে চাল খেতে থাকে। ফারিয়াল লক্ষ্য করে নীলটুনি একটা বেশ সুন্দর আর অন্যটি তার চেয়ে একটু কম সুন্দর। ফারিয়াল জানে পাখিদের মধ্যে পুরুষ পাখিটা দেখতে সুন্দর হয়, আর মেয়ে পাখিটা দেখতে তার চেয়ে একটু কম সুন্দর। পাখি দু’টি যে এত অল্প সময়ে এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে তা ফারিয়ালকে বেশ আশ্চর্য করে তোলে। নীলটুনি আনন্দে তিড়িং বিড়িং করে উড়তে থাকে দূর আকাশে এতক্ষণ বাড়িতে আসা লোকটার নাক ডাকা বন্ধ হয়ে যায়। ফারিয়াল নীলটুনিদ্বকে কোলে নিয়ে রুমে ফিরে।

মা জননী ও লেবুগাছ
ফারিয়ালদের বাড়িতে আসা নতুন লোকটা তার মামনি মালি সেই সাথে দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ করে। লোকটা তো বেশ খুশি নতুন চাকুরি পেয়ে। যেন লোকটা কোন সোনার হরিণ তার হাতে পেয়েছে। ফারিয়ালের কেন জানি লোকটার আধা পাকা দাড়ি কাঁচা-পাকা চুল আর ঝুলে পড়া মুখটা দেখে বড় মায়া লাগে। লোকটা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে ফারিয়াল কথা বলতে ও কানে শোনতে পায় না। ফারিয়াল জানে না যে লোকটার পৃথিবীতে কেউ নেই। ফারিয়ালেকে লোকটা এত মায়া করে তা সে ঠিক বুঝতে পারে না। ওর মা ওকে বুঝিয়ে বলে যে, লোকটার নাকি তার মত একটা মেয়ে ছিল, সেও কথা বলতে পারত না, ঢাকার পথে লোকটার মেয়েটা নাকি কমলাপুর রেলস্টেশনে হারিয়ে যায়। সেই থেকে লোকটা একা ত্রিভুবনে আপন বলতে তার কেউ নেই। ফারিয়াল লোকটার সহজ সরল আর বোকা বোকা চেহারা দেখে বেশ আনন্দ পায় মাঝে মধ্যে। ফারিয়ালের মামনির অনেক দিনের ইচ্ছে তাদের ছাদে বড় ড্যামগুলোতে কয়েকটা লেবু গাছ লাগাবে। আর লেবুর বুনো গন্ধে ফারিয়ালের মনটা ভরে যায়। লেবু ছাড়া মা-মেয়ের একবেলাও পেটের ভেতর খাবার ঢুকে না। অনেক রাতে ফারিয়ালের আম্মু মধ্যে মধ্যে আগে লেবুর ঘ্রাণ নেয়ার জন্য ছাদে যেত। মালি ওদের ছাদে বেশ কয়েকটা লেবুগাছ লাগিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে লেবুগাছগুলো তরতর করে বড় হয়ে যেতে থাকল। মাসুমা ও তার মেয়ে এসে প্রায়ই লেবু গাছটাকে খাবার খাইয়ে দেয়। পানি লাগলে পানি দেয়, আরো কত রকমের খাবার যে লেবুগাছটাকে খাওয়ানো হয় তা কেউ জানে না।
লেবুগাছটাও ওদের মা মেয়ের আদর আর ভালোবাসা পেয়ে গা এগিয়ে দেয়। লেবুগাছ আধা কচি নরম সবুজ কচি পাতা দিয়ে যেন এখন লেতল ঝরছে। সবুজ কুচকুচে পাতায় ওপর যখন সূর্যের সোনালি রৌদ্দুর ছড়িয়ে পড়ে তখন লেবুগাছটা আনন্দে খলবল করতে থাকে। লেবুগাছটাকে জড়িয়ে ধরে ফারিয়ালের সে কী আনন্দ তখন। ফারিয়ালের সে আনন্দ কেবল তখন তার মাই বুঝে।
নীলটুনিদ্বয় প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে তুলে নিয়ে আসে।
আর সেই তুলো ঝুঁটি, নিয়ে লেবুগাছে একটা সুন্দর বাসা তৈরি করে। পুরুষ নীলটুনি লেবুর পাতা সূক্ষ্ম সুঁই দিয়ে কেটে সুতা দিয়ে ফুঁড়ে তৈরি করে একটা বাসা।
প্রতিদিন পুরুষ নীলটুনি অনেক দুরদূরান্ত থেকে এসব নিয়ে এসে বাসা তৈরি করতে থাকে। বাসাটা তৈরি করতে পুরুষ নীলুটুনির অনেক কষ্ট হয়।
বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করার পর নীলটুনিদের বাসা তৈরি হয়ে যায়। এদিকে বেশ কয়েকদিন ধরে ফারিয়ালে মামনির মনটা খারাপ মনে হচ্ছে। ফারিয়ালের মা মনির মনের ওপর কোন অক্টোপাস তার কালো কালি ছুড়ে মেরেছে। ফারিয়াল ছাদে গিয়ে লক্ষ্য করে তার মা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ডেকে কান্না করছে লেবু গাছটার এখানে। ফারিয়াল মামনির চোখের দিকে তাকিয়ে হাত মুখের মাধ্যমে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে। মা মনি তুমি কান্না করছ কেন? নীলটুনিরা লেবুগাছে বাসা করেছে বলে। ও আবার বলে যাচ্ছে আমি নীলটুনিদের লেবুগাছে বাসা বাঁধতে না করে দিব। এবার যেন ফারিয়ালের আর একটু শব্দ করে কান্না করছে। আসলে এ মুহূর্তে ফারিয়ালের আব্বুর কথা মনে পড়ে যায়। কেন এমন বোকা কানে শোনে না মেয়ে তার কাছে এলো? সে বিষয়টা নিয়ে মাসুমা আক্ষেপ করছে। অগত্যা ফারিয়ালকে বুকে জড়িয়ে নিজের অতীতকে ভোলার চেষ্টা করছে সে। ফারিয়াল মার আদর পেয়ে নীলটুনি পাখির মতো মামনির কোলে মাথা রেখে কোন অজানার দেশে হারিয়ে যায়। এতক্ষণ করে পুরুষ নীলটুনি মা মেয়ের এ আবেগ মনকষ্টের দৃশ্য দেখে ওর ও চোখে পানি চলে আসে।
ফারিয়ালের মামনির চোখের নোনা পানি এসে ফারিয়ালের জালে পড়ে। সে দিন মা মেয়ে দু’জনে মিলে কী এক গভীর কষ্টের সাগরে ডুব দেয়। নীলটুনি পুরুষ পাখি বুঝতে পেরে সেদিন আর বেশি ওড়াউড়ি করেনি। ফারিয়াল তার মাকে নিয়ে ছাদ থেকে ঘরে আসে।
দুপুরে ভাত খেয়ে ফারিয়াল একটু ঘুমাতে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফারিয়াল এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে পায়। স্বপ্ন ছিল এরকম এক ছোটপরী ঠিক দেখতে বৃষ্টিপরীর মত, সে এসে ফারিয়াল একটি ম্যাজিক বক্স দিয়ে যে ম্যাজিক বক্সের সাহায্যে ফারিয়াল যা ইচ্ছে হয় তাই করতে পারবে এমনি মনে যদি ইচ্ছে হয় সে যে মেঘপরী হবে তবে তাই হাতে পারবে। স্বপ্নটা দেখতে দেখতে কখন যে ভোরের সূর্যিমামা এসের ওর জানালার ফাঁক গলে চুলে বিলি কাটতে থাক ও টের পায়নি। সূর্যিমামার মায়ায় ফারিয়াল প্রতিদিন নীলটুনিদের সাথে ঘুম ভাঙে। ফারিয়াল বুঝতে পারে কেন তার মার এত কষ্ট। ফারিয়াল প্রতিবন্ধী বলে সবাই ওরে মাকে কত কটাক্ষ করে। অথচ ওর আব্বু বোবা মেয়ে হয়েছে বুঝতে পেরে ওর আম্মুকে রেখে চলে যায় অন্য কোন দেশে। ফারিয়ালদের ছাদের মধ্যে লেবু গাছটা ধীরে ধীরে তার বিশাল ডানাগুলো মেলে ধরতে থাকে। ডানাগুলো যেন আনন্দ এসে এসে ভর করছে। তাইতো এমন করে খলবল করে বেড়ে উঠতে থাকে। লেবুগাছটার বিস্তার দেখে ফারিয়ালের মনটাও সব সময় আনন্দে খলবল করে। নীলটুনি ততদিনে লেবুগাছে সুন্দর করে তার বাড়ি বানিয়ে ফেলে। ফারিয়াল একদিন বিকেল বেলা তার মাকে ছাদে টেনে নিয়ে আসে।
পশ্চিম আকাশটা তখন লাল হলুদের মিশেল একটা সুন্দর হাসি দিয়েছে। যেদিন পশ্চিম আকাশে সূর্যটা এমন হাসি দেয় ফারিয়ালের মনের সমস্ত কপাটগুলো তখন খুলে যেতে থাকে। লেবুগাছের মধ্যে নীলুটনি এত সুন্দর করে বাসা তৈরি করছে দেখে ফারিয়ালের চেয়ে মনে হচ্ছে ওর মা আরো বেশি আনন্দিত হয়েছে। নীলটুনির বাসাটা দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে। আর লেবুপাতা মিষ্টি গন্ধে তো সবসময় ওদের মনটা তার তাজা থাকে। নীলটুনি এসে ফারিয়াল কাঁধে বাস। এই প্রথম ফারিয়ালের মামনির সামনে নীলটুনি এসে তার কাঁধে বসে। নীলুটনির সাহস আর দূরদর্শিতা দেখে মাসুমা বেশ অবাক হয়ে যায়। নীলটুনি তার দু’টি ডানা দিয়ে যে এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে তা মাসুমা দেখে বেশ অবাক হয়ে যায়। নীলটুনি তার দু’টি ডানা মানুষের মত দু’হাত হিসেবে ব্যবহার করায় কথা বলতে পারে তা ফারিয়ালের আম্মুর জানা ছিল না।
স্বরায়ন করতে হয় সবকিছু নীলটুনি সুন্দর করে শিখিয়ে দেয় ফারিয়ালকে। ফারিয়াল তার মাকে কথা দেয় যে সে ভাল করে পড়াশোনা করে দেখিয়ে দিবে যেয়ে সে প্রতিবন্ধী নয়। লেবুগাছটাতে এখন ফুলের ফুটে ছেয়ে গিয়েছে। সাদা লেবু ফুলের মৌমেও গন্ধে ফারিয়াল দেয় পুরাটা বাড়ি ভরে গিয়েছে। এ দিকে নীলুটুনি পাখিরা খুব যতন করে তাদের বাড়িটা বানানো শেষ করেছে। ফারিয়াল তাকে মাকে নিয়ে লেবু ফুল দেখতে ছাদে আসে। লেবু ফুলগুলো ফারিয়ালদের আগমন দেখে একটা মৃদু হাসি দেয়। ফারিয়াল বুঝতে পারে লেবু ফুলগুলো তাকে দেখেই এমন হাসি হেসেছে। ফুলগুলো ফারিয়ালদের দেখে যে এমন হাসি হেসেছে তা তারা বুঝেও না বুঝার ভান করে। লেবুগাছের ডালে যেখানটায় নীলটুনি বাসা তৈরি করেছে। ফারিয়াল সেখানে ঠায় গিয়ে দেখে নীলুটুনিদ্বয় বাসার ভেতর মুখগুঁজে বসে আছে। ফারিয়াল নীলটুনিদ্বয়কে আদর করে মাথার ঝুঁটির কাছে হাত বুলিয়ে দেয়।
নীলটুনি বুঝতে পারে ফারিয়াল তাকে কত ভালবাসে লেবুগাছটা পুরো শরীরজুড়ে থোকায় থোকায় লেবু হয়েছে ফারিয়ারে মামনির যখনই লেবু খেতে ইচ্ছে করে তখন কেবল শুধু একবার মেয়েকে বোঝাতে পারলেই হল সাথে সাথে ফারিয়াল ছাদ থেকে একটা লেবু নিয়ে আসবে।

বোকা মালি
সকালবেলা ফারিয়ালদের দারায়োন বুড়ো লোকটার চিৎকার চেঁচামেচিতে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। ফারিয়ালের মামণি চোখ দুটো খুলে দেখে দারায়ান কোথা থেকে জানি একটা কালেম পাখি ধরে নিয়ে এসেছে। কালেম পাখিটার লম্বা চোখ দিয়ে পিটপিট করে ওদের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। মালি লোকটা যে আবার কিনা ফারিয়ালদের বাড়ির দারোয়ান সে দ্রুত পা ফেলে পাখিটাকে এনে ফারিয়ালের মামনির হাতে দিয়ে গেটের দিকে চলে যায়। ফারিয়াল ঘুম থেকে উঠে দেখে তাদের বাড়িতে বিশাল বড় একটা কালেমা পাখি তার মার হাতে। ফারিয়াল তার মার হাত থেকে পাখিটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূর আকাশে উড়িয়ে দেয়। পাখিটাকে এভাবে আকাশে উড়ে যেতে থাকলে দারোয়ান বুড়ো লোকটার মুখ পানসে হয়ে যায়। ফারিয়াল জানে কাউকে বন্দী করে রেখে তার ভেতর এ পদ্মফুল ফুটানো যায় না। কালেম পাখিটা আকাশে উড়ে যেতে থাকা অবস্থায় বার বার ফারিয়ালের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে। কালেম পাখিটা বুঝতে পেরে বিশাল চোট ফাঁক করে একটা হাসি দেয়। মালিটার এসব কাণ্ডকারণে মাঝে ফারিয়ালের আম্মু মেজাজটা বেশ খারাপ হয়ে যায়।
সেদিন সকালবেলা ফারিয়ালের আম্মু বোকা মালিটাকে বলছে, ‘তোমাকে না কয়দিন বলেছি যে লেবুগাছটার বাড়িতে যতœ-আত্তি নেয়ার জন্য যেমন গাছটায় কিছু সার দিবে, আর শোন সারগুলো অবশ্য গোবর দিয়ে পচিয়ে তারপর দেবে।’
নীলুটনিদ্বয়ে পুরুষ পাখিটা তার দু’টি ডানা খুলে ডেফ স্কুলে ম্যাডামদের মত ফারিয়ালের সাথে কথা বলছে। নীলটুনি পুরুষ পাখিটা বলছে, আচ্ছা ফারিয়াল তোমার আম্মু এত কষ্ট কিসের মাঝে মধ্যে লেবু গাছটার এখানে দাঁড়িয়ে কান্না করে।
ফারিয়াল ইশারার মাধ্যমে বলছে আসলে নীলটুনি তুমি কত জান না আমি প্রতিবন্ধী বলে, আমার আব্বু আমায় ছেড়ে দূর অজানার দেশে চলে যায়। এ কথা বুঝার পর নীলটুনি খানিকটা বিচলিত হয়ে যায় এমন বিমর্ষ দেখতে থাকে নীলটুনিকে। নীলটুনি আবার তার ডানা দুটো একটু ঝেড়ে বলছে, ফারিয়াল চলো আমরা এমন একটা বুদ্ধি বের করি যাতে করে তোমার আম্মুর মন সবসময় ভালো থাকে। নীলুটুনি বলে তুমি ফারিয়াল এখন থেকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে মেডিটেশন করবে, যোগব্যায়াম করবে। আর স্বরায়ন করবে। দেখবে ঈশ্বর চায় তো তুমি হয়ত বা মামনি বলে ডাকতে পারে। ফারিয়াল বেশ অবাক হয়ে যা নীলটুনির কথা শোনে। ফারিয়ালকে নীলুটনি সব কিছু শিখিয়ে দেয়। কিভাবে মেডিটেশন করতে হয়। যোগব্যায়াম করতে হয়।
ফারিয়াল নীলটুনিদের পরামর্শ মত কয় দিন চলে। কিন্তু কিছুতেই তার গলায় স্বর আসছে। যাও একটু উন্নতি হয়েছিল তা যেন কোথায় হারিয়ে যায়। ফারিয়াল দুপুরের দিকে তার মাকে বলা হাতের পাঁচটি আঙুলের সাহয্যে মা মনি আমি যদি কোন দিন তোমাকে মা বলে ডাকতে পারতাম। মেয়ের আকুতি দেখে মাসুমার চোখে পানি চলে আস। এ পৃথিবীতে সব কিছুই সম্ভব আল্লাহ তায়ালা যা চান তাই সম্ভব। ফারিয়ালের মা মনি তার মেয়েকে হাতের পাঁচটি আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে বলে, মা তুমি এমন থেকে নামাজ পড়ে তোমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার কাছে, এ দোয়া করবে ওনি যেন তোমার মুখের জড়তা কাটিয়ে তোমাকে মামনি বলার ক্ষমতা দেন, ফারিয়ালের চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে, মায়ের এমন আকুতি দেখে। জোহরের আজান হচ্ছে দূর মসজিদে, নীলটুনিরা চুপ করে বসে আছে তাদের বাসায় লেবুগাছটায়। এ দিকে সারের অভাবে লেবু গাছটা শুকিয়ে আস্ত থাকে। তার মনে লেবুগাছের ভেতর বয়ে চলা শক্তি নেই। মালি বাজারে গিয়েছে আজ কিছু সায় আয় খৈল কেনার জন্য।
ফারিয়ালের মা মনির দেয়া কথাটা মালি সম্পূর্ণ ভুলে। আত্মভুলা মালি সার আর খৈল না ভিজিয়ে সরাসরি গাছের গোড়ায় নিয়ে সার খৈল নিয়ে আসে।
সরাসরি গাছে যে সার খৈল দিতে নেই তা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে। নীলটুনিরা দেখছিল এ ঘটনা। সত্যিই লেবুগাছটার খুব কষ্ট হচ্ছিল এমন করে গাছ খৈল পেয়ে ধীরে ধীরে অতিরিক্ত সার খৈল পেয়ে লেবুগাছটা শুকিয়ে আসছিল। এদিকে নীলটুনিরা পড়েছে মহা বিপদে।
যদি গাছটা মারা যায় তাহলে নীলটুনিদের কী হবে তা একমাত্র আল্লাহ পাকই বলতে পারেন। নীলটুরিা অবাক দৃষ্টিত লেবুগাছটার তড়পানি দেখাছিল। কিছু দিন পর ফারিয়াল লক্ষ্য করে লেবু গাছটা কেমন হলুদ হয়ে আসছে। এদিকে বৃষ্টিপরী ফারিয়ালকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। বৃষ্টিপরীদের খুব শখের দম ছিল এ লেবুগাছ। আর বোকা মালির জন্য গাছটা রমেন দিশা হয়েছে। ফারিয়ালের আম্মু বোকা মালিটাকে আচ্ছা মতন বকাঝকা করেছে। অবশেষে যেখানটায় বেশি বেশি সার পড়ছিল তা ফারিয়াল খুন্তি দিয়ে সরিয়ে দেয় মাটিসহ নীলুটনিসহ ফারিয়াল রব্বুল আলামিনে দুই জাহানের মালিক পরম দয়ালু আল্লাহর কাছে তাদের কষ্টের কথা বলে হে আল্লাহ লেবুগাছটার প্রাণ আপনি ফিরিয়ে দেন, নীলটুনিদের কথা ভেবে অতন্ত একটি বারের জন্যও হলেও আল্লাহ আপনি লেবুগাছটাকে ভাল করে দেন। আল্লাহ তায়ালা মানুষের সৎ বাসনা কখনো অপূর্ণ রাখেন না। একদিন সকাল ভোরের শুভ্র আলোয় ফারিয়াল নীলটুনিদের বাসা দিকে যাবে, লেবুগাছটার দিকে চোখ পড়তেই সে লক্ষ্য করে লেবুগাছটা আবার সবুজ সবুজ হয়ে গিয়েছে পাতায়। ফারিয়াল মনে মনে আল্লাহ তায়ালকে কৃতজ্ঞতা জানায়। নীলুটানিদের ঘরে আলো হয়ে তিনটি হানা হয়েছে। নীলটুনিরো আনন্দে খলবল করছে। তাদের আনন্দ আরো বাড়িয়ে দেয়। আল্লাহ কিভাবে ফারিয়াল প্রতিদিন নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে বলত মনের ভেতরে কিছু কথা আল্লাহ ফারিয়াল এর কথা রেখেছে। একদিন স্কুল থেকে মামনি অর্থাৎ মানুষ জননী মাকে সে তার অস্ফুট মুখে। মা, মানি … নিলে ডাক দেয়। নীলটুনি নিজের ঘরে তিনজন নুতন অতিথি এসেছে ফারিয়াল মেডিটেশন যোগব্যায়াম স্বরায়ন বাদ দিয়ে এখন প্রতিবেলায় নামাজ এরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলে, সে যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে স্মরণ করে যে আল্লাহ তার প্রতিবন্ধী মুখে মা ডাক দেয়ার ক্ষমতা দিয়ে হেসে আল্লাহকে সে সারাজীবন আরাধনা করবে। লেবুগাছটার কাছে দাঁড়িয়ে এসব কথা মনে মেনে আলোড়ন তুলছিল নীলটুনির তিনটি ছানা থেকে মাথা তুলে ফারিয়ালকে মিটমিট চোখে দেখাছিল গাছের ও যে কষ্ট হয় সে কথা ফারিয়াল এখন জানে, সেই থেকে বৃষ্টিপরী ফারিয়াল, নীলটুনি সবসময় যেকোনো কাজে সর্বপ্রথম আল্লাহকে স্মরণ করে নীলটুনিরা এখন আজানের শব্দ শুনলে চুপ করে আজানের মর্মরধ্বনি শুনে। ফারিয়াল চোখেমুখে এমন মামনি বলতে না পারার কষ্ট নেই। তার মা মানুষ জননী সবাইকে আপন করে নুতন ভাবে বাঁচার জন্য দৃপ্ত পদক্ষেপ শপথ নেয়।
সমাপ্ত

SHARE

Leave a Reply