Home বিজ্ঞান মঙ্গল হলো জয়

মঙ্গল হলো জয়

মাহমুদ শরীফ

৮ই মার্চ ২০১৪। রাত সোয়া ১২টা। নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা দেরিতে আকাশের শূন্যতায় উড়াল শুরু করলো মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০। গন্তব্য ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে রাত শেষ হওয়ার পূর্বেই চীনের রাজধানী বেইজিং বিমানবন্দর। বিমানের পাইলট ক্রু ও যাত্রীরা বিদায় সম্ভাষণ জানালো বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চোখ ধাঁধানো কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরকে। বিমান চলছে মোটামুটি মধ্যম গতিতে। ভূমি থেকে সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে আকাশে প্রায় এক ঘণ্টা পার করতে চলেছে বিমানটি। ইতোমধ্যেই হালকা নাস্তা পরিবেশন করে গেছেন বিমানবালারা। ২৯৭ জন যাত্রী এবং বিমানকর্মীরা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছেন। যাত্রীদের অনেকেই ঘুমে ঢুলছেন। কেউ কেউ টিভিতে চোখ রেখে অনুষ্ঠান উপভোগে নিমজ্জিত। কয়েক মিনিট পর পর নিয়ম অনুযায়ী কুয়ালালমপুর বিমানবন্দর রাডারের মাধ্যমে বেতারবার্তা পাঠাচ্ছেন পাইলট জাহারি আহমেদ শাহ ও সহকারী পাইলট ফারিক আব্দুল হামিদ। রাডারের ২৬৫ নম্বর আধুনিক ল্যাবে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে সর্বক্ষণ বার্তাগুলো দেখে নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রকৌশলী আলী আহাদ। বিমান আকাশে উড়ার শুরু থেকেই তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ এর তিন চাকা চীনের বেইজিং বিমানবন্দরের রানওয়ে না ছোঁয়া পর্যন্ত তিনি বসে থাকবেন নির্দিষ্ট কাজের জন্য।
হঠাৎ কম্পিউটারের স্ক্রিনে রেড অ্যালার্ট সঙ্কেত দেখে চমকে উঠলেন প্রকৌশলী আলী আহাদ। ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ এর সাথে তার সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাইলটদের পক্ষ থেকে পাঠানো কোন সংকেত নেই তার ইনবাকসে। তিনিও কোন মেসেজ সেন্ট করলে সেটা বার বার রিটার্ন আসছে। আলী আহাদ ভাবলেন, বিমানের ট্রান্সপন্ডারের হয়তো সমস্যা হয়েছে। বিষয়টি প্রথমে হালকাভাবে নিলেও পরবর্তীতে শত চেষ্টা করেও তিনি যোগাযোগে ব্যর্থ হচ্ছেন। তৎক্ষণাৎ হেডফোনে বিষয়টি প্রকৌশলী আলী আহাদ অবগত করলেন ঊধর্বতন অফিসার নিজাম আশফাককে। মুহূর্তের মধ্যেই সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র বিমানবন্দরে। সকল আইটি কর্মকর্তাও ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ এর সাথে প্রকৌশলী আলী আহাদের মতো ব্যর্থ, কোন প্রকার যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে পারলেন না কেউই। খবর পৌঁছে গেল মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের কাছে। এর পর যা হবার তাই হলো, সারা বিশ্বের মিডিয়ায় প্রধান খবরের স্থানে বসে পড়লো ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ সংবাদ। তোলপাড় শুরু হলো সমগ্র বিশ্বজুড়ে। বিমানযাত্রী আর পাইলট-ক্রুদের বাড়িতে কান্নার রোল বইছে। শুধু কয়েক ঘণ্টা নয়, কেটে গেল কয়েকটি দিন-রাত। তিন সপ্তাহেও কোন খোঁজ হলো না হারিয়ে যাওয়া জেট বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ এর। অনুসন্ধানে লেগে গেছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। স্যাটেলাইট চিত্রের তথ্যানুযায়ী বার বার অনুসন্ধানেও ব্যর্থ সবাই। মাথা নিচু করে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বসে আছে। কোন জবাব নেই যেন তাদের মুখে। বিশ্বজুড়ে বিমান নিখোঁজের বিষয়টি বিশ্লেষণ হতে লাগলো বিভিন্নভাবে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পশ্চিমা শক্তিশালী দেশের পক্ষ থেকে বলা হলো- সন্ত্রাসবাদীরা বিমানটি ছিনতাই করেছে। লুকিয়ে রেখেছে আফগানিস্তান কিংবা ইরানের কোন বিমানঘাঁটিতে। কেউ বললো, ছিনতাই নয়, হয়তো কোথাও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কোন কোন দেশ বিমানের ধ্বংসবাশেষ সাগরে ভাসছে বলেও কৃতিত্ব জাহির করতে কসরত চালালো। কিন্তু ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কেউই সঠিক সমাধান দিতে সমর্থ হলো না। আধুনিক বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে তল্লাশি কার্যক্রম আরো জোরদার করা হলো। এগিয়ে এলো বিশ্বের ২৬টি উন্নত প্রযুক্তির দাবিদার দেশ। দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের প্রায় ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তল্লাশি চালানো হলেও কোন ক্লু পাওয়া গেল না। বিমান উদ্ধারকাজে বিশ্ববিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান তিন তিনটি ‘অরিয়ন‘ বিমানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, চীন ও জাপান বিমানবাহিনী অংশ নিলে তাদেরও ব্যর্থতায় মাথা নিচু। প্রযুক্তিবিদরা স্যাটেলাইটের সর্বাধুনিক ওয়াই ফাই সুবিধাকে শেষ ভরসা হিসেবে ট্রাকিং করলেন। কিন্তু সেটাও ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ এর কোন হদিস দিতে না পারায় তল্লাশি অনেকটা গুটিয়ে নেয়া হলো। কোন দেশই তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ দিতে না পারায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিমান হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আরো ধূম্রজালে আটকে গেল। বিমান উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়ায় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মাথা নিচু, মুখে যেন চুন কালি পড়লো তাদের।

দুই.
৪৭ মিটার লম্বা আর সাড়ে ৭ মিটার চওড়া বিশাল দেহ নিয়ে সিংহাসনে খুশি মনে বসে আছেন আড়াই হাজার বছর বয়সী যুবক রাজা সিপাং। মঙ্গলের একক অধিপতি হচ্ছেন এই রাজা উগ্রেং যায়াং সিপাং। যেমন দেশ দরদি তেমনি প্রজাদের প্রিয় রাজা তিনি। মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দারা রাজা সিপাংকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। আর ভালোবাসবেই না কেন; প্রজাদের কোন অভাব-অনটন, দুঃখ-বেদনা সব মৌলিক চাহিদা তিনি দূর করে দিয়েছেন। এ জন্যই প্রজারা দেড় হাজার বছর ধরে রাজা সিপাংকেই তাদের গ্রহের অধিপতি করে রেখেছেন। সৌর জগতের মঙ্গলের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় কোন রাজাই রাজত্ব করতে পারেননি। একমাত্র রাজা সিপাংই পারছেন তার কর্মদক্ষতার কারণে।
তিনি খুশি মনে হাসি মুখে তার খাস কামরা থেকে বেরিয়ে এসে সকল মন্ত্রীকে নিজ নিজ আসনে বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও ৫৫ হাজার বছর পূর্বে তৈরি রাজ সিংহাসনে বসেছেন। শুরু হলো মঙ্গল গ্রহের সংসদ অধিবেশন। আজকের কার্যসূচির শুরুতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিগেং তামাং মন্ত্রীবর্গ, ৯ বাহিনীর প্রধান, সচিবসহ সবাইকে সম্বোধন করে একটি খুশি ও সফলতার সংবাদ দিলেন। সাথে সাথে তিনি যে কারণে আজ মঙ্গল অধিবাসীদের জন্য আনন্দ বইছে, সেই বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা আর উপস্থাপনার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাজা সিপাং মুচকি হেসে অনুমতি দিতেই পার্লামেন্ট ভবনের ছাদ মুহূর্তের মধ্যেই গায়েব হয়ে গেল। শাঁ শাঁ শব্দে ওপর থেকে নেমে এলো একটি বিশাল কাচের মত ধাতব পদার্থের বাকসো। সেনাবাহিনীর চৌকস ১২০ জন সৈনিক এগিয়ে এলেন। চোখের পলকে কাচের বাকসোটির কলকব্জা, নাট-বল্টু খুলে নিয়ে তারাও গায়েব।
মন্ত্রিপরিষদের সবার সামনে বাকসো থেকে বের করা হলো পৃথিবী গ্রহের মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০। বিমানের ভেতরে কোন সাড়া শব্দ নেই। যাত্রীরা সবাই নিজ নিজ আসনে যেন ঘুমন্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ এর চার পাশে একবার চক্কর দিলেন। এর পর তিনি সকলের উদ্দেশে বললেন :
মহামান্য রাজা মহোদয় ও উপস্থিত মন্ত্রীবর্গ এবং ঊর্ধ্বতন সভাসদবৃন্দ, আজ আমাদের জন্য সত্যিই আনন্দ আর খুশির বিষয় হচ্ছে, আমাদের দীর্ঘ ৫ শ’ বছরের গবেষণা আর প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। আমরা আমাদের ‘ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টার’র দ্বিতীয় অভিযান সফল করতে পেরেছি। আমাদের সেনা বিভাগের অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা তাদের সফল অভিযানের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে এই ছোট্ট বিমানটি তুলে এনেছেন। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। আমরা পৃথিবীবাসীর সাথে জ্ঞান আর শক্তিতে যে ছোট নই তার প্রমাণ করতে পেরেছি। আর…….
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ না হতেই খুশির হাততালি পড়ে গেল সংসদ মিজালাং ভবন জুড়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবার রাজা সিপাং-এর দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করলেন :
মান্যবর মঙ্গল গ্রহের রাজং, আপনি বলেছিলেন পৃথিবীর মানুষেরা আমাদের গ্রহের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। ১৯৫৭ সালে তারা ‘স্পুটনিক-১‘ ও ‘স্পুটনিক-২‘ নামের দু’টি নভোযান, পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র ‘আলফা‘ নভোযান এবং একই বছরে রাশিয়া ৩ নভোচারী পাঠিয়েছিল। এর পর থেকে প্রতিনিয়ত মানুষেরা আমাদের বাসস্থান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কত বড় সাহস পিচ্চি মানুষ্য বিজ্ঞানীদের! ওরা মহাশূন্যে ‘স্কাইল্যাব‘ নামে স্টেশন নির্মাণ করেছে। এটা মানুষের অনধিকার চর্চা। মানুষেরা আমাদের মঙ্গলে নভোযান পাঠিয়ে কত ছবি আর নমুনা নিয়ে গেছে। ওরা আমাদের অবকাশযাপন কেন্দ্র চাঁদের বুকে পতাকা গেড়েছে। একের পর এক ‘স্যাটার্ন ভি’, ‘পাথ ফাইন্ডার’, ‘লুনিক’, ‘স্পুটনিক’, ‘এ্যাপোলো ১১’, ‘ঈগল’, ‘কলম্বিয়া’, ‘ভস্টক ১’, ‘ডিসকভারি’ প্রভৃতি নভোযান প্রেরণ করে আমাদের চিন্তিত করেছে। চর দখলের মত চাঁদ দখল শেষে এবার আমাদের মঙ্গলের দিকে পা বাড়িয়েছে। ওরা যখন নভোযান পাঠিয়ে সফল হয়েছে, এখন বার বার নভোযান পাঠাবে। শেষ পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এক সময় মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহ দখল করতে ছুটে আসবে। বসত গড়বে এখানে। আমাদের করবে উচ্ছেদ। কিন্তু কিছুতেই এটা করতে দেয়া যাবে না। সে জন্যই পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে কী করা যায় সে জন্য ‘ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টার‘ প্রতিষ্ঠা করে গবেষণা করা হয়েছে। আজ গবেষণার ফলস্বরূপ আমাদের বিজ্ঞানীরা তাদের তৈরি বিমানখেকো শশার মহাযান ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ পাঠিয়ে পৃথিবী থেকে সর্বপ্রথম এই ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ ছিনতাই করে এনেছে। এই বিমানটিকে আমাদের ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ এক নিঃশ্বাসে মুখে পুরে দেড় শ’ ঘণ্টা সময় নিয়ে ফিরে এসেছে। পৃথিবীবাসী এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ‘ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টার’র গোয়েন্দা সদস্যরা পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য এখনও পৃথিবীতে অবস্থান করছে অদৃশ্যভাবে। তারা কিছুক্ষণ পূর্বে শেষ মেসেজে জানিয়েছে- ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিয়ে সারা পৃথিবীতে মহা তোলপাড় লেগে গেছে। অনুসন্ধানে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে তাদের যন্ত্রগুলো। সাগর-পাহাড়-বন-মরুভূমি সব স্থানেই চলছে অনুসন্ধান। আমরা যে বিমানটি ছিনতাই করেছি মানুষের ধারণাতে এ পর্যন্ত বিষয়টি আসেনি। তবে বাংলাদেশের এক পুঁচকে বিজ্ঞানী ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ পৃথিবীর বাইরে চলে গেছে বলে মন্তব্য করলেও শক্তিধর দেশগুলো তার কথা কানে তুলছে না।

তিন.
বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র তথা বামগকে’র মিডিয়া সেন্টারে প্রেস ব্রিফিং আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। বামগকে’র মহাপরিচালক সাইদ জামান, মালয়েশিয়ান বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফ করবেন। দেশ- বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান আর প্রতিবেদকেরা অপেক্ষা করছেন। কয়েকজন সিনিয়র রিপোর্টার তো বলেই বসলেন : ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, ছাগল বলে কত জল’! বিশ্বের সকল প্রযুক্তি যেখানে হার মেনেছে সেখানে আমাদের জামান সাহেব কী তথ্যই বা দিতে পারবেন! একজন তরুণ রিপোর্টার সিনিয়রের কথা কেড়ে নিয়ে মন্তব্য দিলেন, বড় ভাই- পচা শামুকেও পা কাটতে পারে! বিজ্ঞানী সাইদ জামানকে আমরা যতই অবমূল্যায়ন করি না কেন, তার মেধার তারিফ করতেই হবে। কেননা, সমুদ্রের নিচ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করার ধারণা তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন। এই সাবমেরিনের ফলে তথ্য প্রযুক্তিতে পৃথিবী বর্তমানে একটি গ্লোবাল ভিলেজ । যার সুফল আমরা ভোগ করছি। বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সম্ভাবনার কথা তিনি বলেছেন, দেখবেন সেটাও একদিন বাস্তব হতে পারে। তা ছাড়া তিনি মালয়েশিয়ান বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে যা বলবেন যদি তার কোন প্রমাণ দিতে সক্ষম না হন, তাহলে আজকের প্রোগ্রামটি ব্রটকাস্ট করবো না। সাংবাদিকদের কথোপকথন শেষ না হতেই প্রবেশ করলেন চুল-দাড়ি ভ্রƒ সাদা ৯৮ বছর বয়সী বাংলাদেশের নামকরা সৌরবিজ্ঞানী বামগকে’র মহাপরিচালক ড. সাইদ জামান। তিনি চেয়ারে বসতে না বসতেই ক্যামেরাপারসন রিপোর্টারেরা তাদের ক্যামেরা তাক করলেন। টিভি চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিলো। কোন ভূমিকা ছাড়াই ড. সাইদ জামান কথা শুরু করলেন। তিনি ব্রিফিং করছেন মালয়েশিয়ান বিমান ফ্লাইট এম এইচ-৩৭০ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে। কিন্তু এরই মাঝে সমস্ত ক্যামেরাম্যানের গুনগুনানি শুরু হয়ে গেল। তারা একে অপরের দিকে চেয়ে থাকছেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না তারা। কারণ, একটি ক্যামেরাও অন হচ্ছে না। তাহলে কি ক্যামেরাগুলো একবারে নষ্ট হয়ে গেল? পকেট থেকে সেল ফোন বের করে অফিসে জানাতে বা আরো একটি ক্যামেরা পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতে চাইলেন তারা। কিন্তু একি! তাদের সব মোবাইলের স্ক্রিনে কিছুই নেই। কোন বাটন কাজ করছে না। এদিকে ড. সাইদ জামান মাইক্রোফোনে কথা বলেই চলেছেন। তার মিষ্টি কথাগুলো রুমের মধ্যে অনুরণিত হচ্ছে। সমস্ত ক্যামেরাম্যানের ছোটাছুটি আর ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একজন সিনিয়র ক্যামেরাম্যান উচ্চস্বরে বলেই উঠলেন, স্যার, কথা বন্ধ করুন। আমাদের ক্যামেরায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। বোধ হয় কিছু অঘটন ঘটতে চলেছে। আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না…..
ব্রিফিং বন্ধ করলেন ড. সাইদ জামান। ক্যামেরাম্যানদের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। একজন ক্যামেরাম্যান বিষয়টি পরিষ্কার করলেন। মুচকি হাসি দিলেন ড. সাইদ জামান। বললেন, কোনো সমস্যা নেই। আবার চেষ্টা করুন। আমি প্রথম থেকেই শুরু করছি।
মিডিয়া সেন্টারের ঠিক মাঝখানে ঝাড়বাতির সাথে লাগানো খয়েরি কালারের একটি বাল্ব এতক্ষণ জ্বলছিল। সেটা বন্ধ হয়ে গেল সবার অজান্তে। এবার ক্যামেরাগুলো ঠিকই কাজ করছে। ফ্লাস ক্যামেরার আলোর ঝলকানি আর ক্লিক ক্লিক শব্দ হলো কিছুক্ষণ। লাইভ সম্প্রচার চলছে ১০-১৫টি চ্যানেলে। ব্রিফ শেষ করলেন ড. সাইদ জামান।
প্রশ্নোত্তর পর্বে মালয়েশিয়ান বিমান ফ্লাইট – এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তার বক্তব্য কী ছিল, সেটার বিষয়ে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগেই তিনি বললেন, সাংবাদিক ভাইয়েরা! আপনারা সমস্ত ক্যামেরা অফ করে আবার চালু করুন। অফ করা হলো ক্যামেরা। কিন্তু একি আর অন হচ্ছে না। আবার সেই সমস্যা! সকলের অজান্তেই জ্বলে উঠলো খয়েরি কালারের বাল্বটি। ক্যামেরাগুলো আবার ডেড। সেলফোনও অচল। হাতের ডিজিটাল ঘড়িগুলোরও একই দশা।
সাংবাদিকরা আবারো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একজন সিনিয়র সাংবাদিক ব্যাপারটি যে ড. জামানের কারসাজি তা আন্দাজ করে ফেলেছেন। তিনি বললেন, জনাব বিজ্ঞানী, ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করার আগে অন্য বিষয়ে কিছু জানতে চাই। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মুচকি হাসি দিলেন ড. সাইদ জামান।
আমাদের ক্যামেরাগুলো আসলে পাগলামি করলো কেন? এর কি কোন জবাব দেবেন? বললেন সেই সিনিয়র সাংবাদিক।
প্রশ্ন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ড. সাইদ জামান বললেন, ক্যামেরা কাজ না করার বিষয়টি আপনাদের জন্য ছিল একটি সারপ্রাইজ। আমি দীর্ঘ ১৮ বছর চাঁদের আলো থেকে একটি যৌগ পদার্থ সংগ্রহ করেছি। এই পদার্থ দিয়ে তৈরি করেছি একটি বিশেষ বৈদ্যুতিক বাল্ব। সেই বাল্ব থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি তার আয়ত্তে থাকা সকল চার্জেবল ব্যাটারির কর্মক্ষমতা আর বৈদ্যুতিক শক্তির কাজ বন্ধ করে দিতে সক্ষম। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনাটি তারই প্রমাণ। ড. জামান ঝাড়বাতির সাথে ঝুলানো খয়েরি কালারের বাল্বটি হাতের ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন। কথা শুনে ও বাতি দেখে সাংবাদিকদের চোখ ছানাবড়া।
অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন ছুড়লেন, এই বাল্বের সাথে ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ হওয়ার সম্পৃক্ততা কোথায়?
উত্তরে ড. জামান সংক্ষেপে বললেন, আমি আগেই বলেছিলাম ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ ভিন্ন গ্রহে চলে যেতে পারে। সেটা কেউ বিশ্বাস করেনি। আজ প্রমাণ করতে পেরেছি চাঁদের আলোর যৌগ পদার্থ বা তার আলোকরশ্মির কী ক্ষমতা রয়েছে। নিখোঁজ ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ হয়তো ভিন গ্রহের বাসিন্দারা হাইজ্যাক করেছে এই চাঁদের আলোর যৌগ পদার্থ বা তার আলোকরশ্মি দিয়ে তৈরি কোন এক ক্ষমতাবলে। চাঁদের আলোর যৌগ পদার্থের আলোকরশ্মির দ্বারা তৈরি বিশেষ কোন কিছু বিমানটির সব চার্জেবল কলকব্জা বিদ্যুৎশক্তি বিকল করে দিয়েছিল। ফলে বিশ্বের কোন স্যাটেলাইট কিংবা রাডার বিষয়টি ধরতে পারেনি। তাই আমি আবারো বলতে চাই- কোন ভিন গ্রহের হস্তক্ষেপেই ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিখোঁজ হয়েছে।
ড. জামানের যুক্তির ওপর আর কোন কথা বলার সাহস দেখালেন না কোন সাংবাদিক। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি চেয়ারসহ মিডিয়াকক্ষ ত্যাগ করলেন ।

চার.
মঙ্গল মন্ত্রিপরিষদের সামনে বিমান ফ্লাইট – এমএইচ-৩৭০। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিমানটির চার পাশে বারবার চক্কর দিচ্ছেন। তার উত্তেজনা আর কৌতূহল যেন শেষ হচ্ছে না। তিনি মুখ ভেঙচিয়ে বললেন, গর্ধভ, লোভী মানুষ! তোমরা আমাদের মঙ্গল জয় করতে চাও, শাসন করতে চাও আমাদের। তা আর হতে দেয়া হবে না। তোমাদের শায়েস্তা করার পদ্ধতি আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের গ্রহের দিকে পা বাড়ালে তোমাদের এভাবেই বিমান কিংবা নভোযানসহ আমরা হাইজ্যাক করে নিয়ে আসবো। চাঁদের আলো থেকে সে প্রযুক্তি আমরা পেয়ে গেছি। আমরা তো তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি, দখল করতে যাইনি পৃথিবী, তাহলে তোমরা কেন আসবে মঙ্গলে? এটা আমাদের গ্রহ, আমরাই এর বাসিন্দা আছি এবং থাকবো। তোমাদের কোন স্থান নেই এখানে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিগেং তামাং এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মনের খেদ মিটালেন। অন্যান্য মন্ত্রীরা তার কথায় যেন আনন্দ পেলেন। হাততালির ফোয়ারা চললো কিছুক্ষণ। এবার রাজা উগ্রেং যায়াং সিপাং খুশি মনে মুখ খুললেন। রাজার কথা শুরুর সাথে সাথে সংসদ মিজালাং ভবনজুড়ে নীরবতা। রাজা বললেন, আমরা সফল হয়েছি। ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষের আক্রমণ প্রতিহত করা যাবে। আমাদের বিমান ও নভোযানখেকো শশার ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ আরো তৈরি করতে হবে। আমি ‘ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টার’র সফলতায় অনেক খুশি। এ বছর এই প্রকল্পটির বাজেট তিনগুণ বৃদ্ধি করা হলো। আমাদের আরো শক্তিশালী শশার ‘হাড়গিল-ব তৈরি করে মানুষের মোকাবেলায় প্রস্তুত হতে হবে । আর এখন এই মৃত মানুষগুলোসহ বিমানটি পৃথিবীর কক্ষপথে ফেলে দাও, কেয়ামত পর্যন্ত বাতাসে উড়তে থাকুক।
রাজার কথায় আবার হাততালির বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু পরিকল্পনামন্ত্রী উম্রে পামাং মুখ গোমড়া করে বসে রয়েছেন। তাকে এভাবে থাকতে দেখে রাজা মুখ গোমড়ার কারণ জানতে চাইলেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এবার দাঁড়ালেন। বিজ্ঞের ভঙ্গিতে যুক্তির সাথে বললেন, মান্যবর রাজং! মানুষের এই বিমানটি পৃথিবীর কক্ষপথে ফেলে দেয়ার বিষয়ে আমি একমত হতে পারছি না। আমরা মানুষকে ভয় দেখাতে চাই। আমরা তাদের বিমান তুলে এনেছি এটা তারা অবগত নয়। বিষয়টি মানুষদের জানানো অবশ্যক। এ জন্য বিমানটি আবার পৃথিবীতে ফেরত দিতে হবে। আর যেখান থেকে হাইজ্যাক করা হয়েছে, সেই মহাসাগরেই ফেলে আসার পক্ষে আমি। কেননা, এখনো সেই এলাকায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। মানুষ তাদের বিমানটি পেয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাবে। এক সময় আমাদের শক্তিশালী শশার ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ এর বিষয়টি উদঘাটন করবে। তখন আর ভুলেও সাহস করবে না মহাশূন্যে বা সৌর জগতের ভিন্ন গ্রহে কোন নভোযান পাঠাতে। শশার ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ এর ভয়ে পৃথিবীর মানুষ মঙ্গল অভিযানে ইতি টানবে বলে আমার বিশ্বাস।
পরিকল্পনামন্ত্রী উম্রে পামাং এর কথার বরাবরই যুক্তি থাকে। রাজাও সম্মতি দিলেন তার যুক্তির পক্ষে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো শশার ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ আবার গিলে নেবে বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭ কে। দেড় শ’ ঘণ্টার উড়াল দিয়ে ছুটে যাবে পৃথিবীর ভারত মহাসাগরে। যেখান থেকে বিমানটি সে তুলে নিয়েছিল ঠিক সেখানেই ফেলে আসবে। অধিবেশন শেষ হলো। শশার ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ কে মুখে পুরে রওনা দিলো পৃথিবী অভিমুখে।

পাঁচ.
তিন সপ্তাহ পর পৃথিবীজুড়ে আবার তোলপাড় শুরু হয়েছে। নিখোঁজ হওয়া মালয়েশিয়ান বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ আবার মিডিয়ার প্রধান শিরোনামে পরিণত। হারিয়ে যাওয়া বিমানটি অবশেষে পাওয়া গেছে। ভারত মহাসাগরের আন্দামান দ্বীপের ১২ শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোন এলাকা থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে অক্ষত বিমান ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০। বিশ্বের সকল মিডিয়ার বদৌলতে খবরটি টক অব দ্য ওয়ার্ল্ডে পরিণত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষের দৃষ্টি এখন টিভি পর্দায়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে আজ সকালে নিখোঁজ বিমানটি উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন। তবে দুঃখ আর কষ্টের কথা হচ্ছে, বিমানের কোনো যাত্রী, পাইলট, ক্রু, বিমানবালাসহ কেউই বেঁচে নেই। লাশগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোন এক হিমঘরে তিন সপ্তাহ ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। এদিকে বিমানের বাইরের রঙ পাল্টে গেছে। ধূসর সাদা রঙ খয়েরি আকার ধারণ করেছে। বিমানটি কয়েক শ’ টন ওজন হলেও পানিতে ভেসে ছিল। চাঁদের যৌগ পদার্থের নতুন খয়েরি রঙ লেপনের কারণে বিমানটি পানিতেও ডুবেনি। এই চাঁদের কারণেই জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। কোন বস্তুকে ভিজিয়ে দেয়ার কার্যকারিতা নষ্ট করার মতো ক্ষমতা আছে ঐ পদার্থের মধ্যে। সে কারণেই ভাসমান অবস্থায় মালয়েশিয়ান কোস্টগার্ড ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। লাশগুলো মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বিশেষ বিমানে নিজ নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।
বিমান উদ্ধারের সংবাদ শুনে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া ছুটে গেলেন সৌরবিজ্ঞানী বামগকে’র মহাপরিচালক ড. সাইদ জামান। ব্রিফকেস ভরে নিয়ে গেলেন দীর্ঘ ১৮ বছর চাঁদের আলো থেকে সংগ্রহ করা যৌগ পদার্থের নমুনা। যার থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মির তৈরি খয়েরি রংয়ের বৈদ্যুতিক শক্তির বাল্ব দিয়ে তিনি ইতোমধ্যেই বিমান ভিন্ন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার ছোট্ট প্রমাণ সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন। তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। সাক্ষাতে চাঁদের যৌগ পদার্থের সাথে বিমানের পরিবর্তিত খয়েরি রংয়ের যোগসূত্র নিয়ে গবেষণার অনুমতি পাওয়া গেল। প্রথম ধাপের পরীক্ষাতেই সফল ড. জামান। বিমানের পরিবর্তিত খয়েরি রং পরীক্ষা করেই তিনি প্রমাণ করলেন ভিন্ন গ্রহের কোনো শক্তিই বিমান ছিনতাই করেছিল। বিশ্বজুড়ে এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এলো ডা. জামান তথ্য। বিশ্ব নতুন করে চিনলো বাংলাদেশকে। কিন্তু শশার ‘হাড়গিল-ব ৯০৯’ এর বদৌলতে পৃথিবীর মানুষ মৃত অবস্থায় মঙ্গল জয় করলেও এ খবরটি কেউই জানতে পারল না।

SHARE

Leave a Reply