Home গল্প আদর

আদর

মোহাম্মদ লিয়াকত আলী

Adorছেলেটিকে সব স্যার আদর করেন। অথচ সে সব পরীক্ষায় ফেল করে। ছেলেটির নাকি খুব বুদ্ধি, কিন্তু পরীক্ষায় পাস করার বুদ্ধি নেই।
স্যার যখন ক্লাসে পড়া বোঝান তখন ছেলেটা নানা প্রশ্ন করে স্যারদের ব্যতিব্যস্ত রাখে। তাতে স্যাররা বিরক্ত হন না। জানার জন্য প্রশ্ন করা কোনো বদ-অভ্যাস নয়।
ভূগোলের স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করলেন,
– বলতো, পৃথিবীর কায় ভাগ মাটি আর কয় ভাগ পানি?
ছেলেটার পাল্টা প্রশ্ন,
– স্যার, শীতকালের না বর্ষাকালের?
বই পড়ে জানা গেছে, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি। মাত্র এক ভাগ মাটি। বাস্তবে দেখে জানার ক্ষমতা স্কুলছাত্রদের নেই। তারা দেখতে পায় শীতকালে খাল-বিল, ডোবা-নর্দমা শুকিয়ে যায়। বর্ষাকালে রাস্তা-ঘাট, নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যায়। এতে পৃথিবীর পানি ও মাটির পরিমাণে হেরফের হয় না। এই তত্ত্বকথাটা শিশুরা বুঝবে কেমন করে?
ছেলেটির প্রশ্নের কারণে স্যারকে কষ্ট করে বোঝাতে হয়।
শিশু-কিশোররা ছড়া কবিতার ভক্ত ও আসক্ত। নীতিবাক্য সহজে মুখস্থ না হলেও ছড়া কবিতা ঠোঁটস্থ হয়ে যায়। ‘সবদার ডাক্তার’ কবিতা তাই সকলের মুখস্থ। কী সুন্দর ছন্দ,
সবদার ডাক্তার / মাথা ভরা টাক তার।
স্যার জিজ্ঞেস করলে গড়গড় করে বলে যায় ছাত্ররা। কিন্তু ছেলেটা পাল্টা প্রশ্ন করে,
ডাক্তারের হাত কয়টা স্যার?
– আরে বোকা, মানুষের হাত আবার কয়টা হয়?
– দুইটাই তো হওয়ার কথা। এই কিন্তু কবিতায় যে লেখা
আমাশয় হলে পরে / দুই হাতে কান ধরে
পেটটারে ঠিক করে কিলিয়ে।
দুই হাতে কান ধরলে পেট কিভাবে কিলাবে স্যার? হয় কান এক হাতে ধরবে, না হয় পেট ঠিক করবে লাথিয়ে।
ছোটদের কবিতা, ছন্দ-মধুর হলেই হলো। এত মানে বোঝার দরকার নেই। তাই সুকুমার রয়ের অর্থহীন কবিতা স্কুলে শেখানো হয়-
হাটটি মাটিম টিম/ তারা মাটে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং।
ছেলেটা বুঝতে চায়, জানতে চায়, এটা পশু, না পাখি।
সে জানে হাঁস-মুরগি, কবুতর খুপরিতে ডিম পাড়ে। বনের পাখি নিজ নিজ তৈরি বাসায় ডিম পাড়ে। এদের কারো শিং নেই, মাঠে চরে গরু, ছাগল, ভেড়া। তাদের শিং আছে। কারো খাড়া, কারো তেড়া। এরা কেউ ডিম পাড়ে না। তবে খাড়া শিংওয়ালা কারা মাঠে ডিম পাড়ে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না কোনো স্যার। ধাঁধার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের অঙ্ক ও বুদ্ধি শেখানো হয়। একটি গাছে দশটি বক ছিল। শিকারি গুলি করে ৬টি মেরে ফেলল। গাছে কয়টি রইল। বহু পুরনো ধাঁধা। বিয়োগ অঙ্কের হিসাব এখানে চলবে না। বুদ্ধি করে বলতে হবে। গুলির শব্দে বাকি সব উড়ে যাবে।
এক স্যার বুদ্ধি ধাঁধাটিকে নতুনত্ব দান করেন। বক মারতে হলে স্কুল ছেড়ে অনেক দূর যেতে হয়। তাই সহজ ধাঁধা বলেন স্যার।
– টেবিলের ওপর দশটি মাছি বসা আছে। থাপ্পড় দিয়ে ৪টি মেরে ফেললে টেবিলে কয়টি থাকবে?
সব ছাত্র একযোগে উত্তর দেয়। সোজা প্রশ্ন। একটাও না। কিন্তু ছেলেটা চিৎকার দিয়ে বলে,
– ভুল স্যার, সবাই ভুল বলেছে। মরা ৪টি টেবিলেই থাকবে স্যার। মাছি তো আর বক না, যে গাছ থেকে নিচে পড়ে যাবে।
পাখি উড়ে, পশু হাঁটে। তা কারো অজানা নয়।
কিছু ব্যতিক্রম আছে। তা শুধু পড়ে জানতে হয়। কে কত পড়ে, তা দেখার জন্য স্যার প্রশ্ন করেন,
– কোন পাখি উড়তে পারে না?
যারা পড়েছে, তারা জবাব দিয়েছে,
– উট পাখি স্যার।
– ইংরেজিতে কী বলে?
এর উত্তর কেউ দিতে পারে না, যেহেতু পড়ানো হয়নি। কিন্তু ছেলেটার জবাব ভিন্ন।
– স্যার, অনেক রকম পাখি আছে, যারা উড়তে পারে না। যেমন মরা পাখি, মাটির পাখি, প্লাসটিকের পাখি, খাঁচার পাখি। উট পাখিতো দেখি নাই স্যার। তাই বলে ইংরেজি করতে অসুবিধাটা কী? ক্যামেল বার্ড।
– শুধু অনুবাদ করলেই ইংরেজি হয় না। এর আলাদা ইংরেজি আছে। উট পাখিকে বলে অস্ট্রিচ।
– জি স্যার, এভাবে না বোঝালে জানব কেমনে? অনুবাদ করলেই যদি হতো, তাহলে হাসাহাসির ইংরেজি লাফালাফি হতো।
ছেলেটির বুদ্ধি একদিনে এমন পাকেনি। বর্ণমালা শেখা থেকে শুরু হয়েছে এমন প্রশ্ন করার অভ্যাস। যেদিন স্যার পাঠদান করলেন, অজগরটি আসছে তেড়ে / আমটি আমি খাব পেড়ে।
তখনি ছেলেটি প্রশ্ন করে বসে,
– ওরে বাবা, অজগর তেড়ে আসলে কার এত সাহস স্যার, যে আম পেড়ে খায়? এত মিথ্যা কথা বইয়ে থাকলে সদা সত্য কথা বলব কেমনে স্যার?
ইশপের গল্প শিশুদের পড়ানো হলেও তার শিক্ষা সকলের জন্য। ইংরেজিতে ‘ফ্রগস অ্যান্ড দি বয়েস’ গল্পটি একদিন ক্লাসে স্যার পড়ালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
– এ গল্প থেকে তোমরা কী শিখলে?
সবাই যখন ভাবছে, তখন ছেলেটি দাঁড়িয়ে যায়,
– আমাদের লজ্জিত হওয়া দরকার স্যার। পুকুরের ব্যাঙও ইংরেজি বলে স্যার। অথচ আমরা পারি না।
ইতিহাস খুবই কঠিন সাবজেক্ট। প্রাচীনকালের বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা বারবার না পড়লে মনে থাকে না। ছেলেটার এত পড়ার ধৈর্য নেই। কিন্তু প্রশ্ন করলে জবাব একটা দেবেই।
– পানিপথে বাবর ও ইব্রাহিম লোদীর কেন যুদ্ধ হয়েছিল?
– মনে হয় তখন বর্ষাকাল ছিল। স্থলপথে সুবিধা ছিল না।
– আরে বোকা, পানিপথ একটা জায়গার নাম। সেখানে পানি ছিল না।
– শত শত বছর আগের ঘটনা। কে জানে, পানি ছিল না, শুকনা ছিল।
বিজ্ঞান একটি কঠিন ও আকর্ষণীয় বিষয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার মজাই আলাদা। পানিভর্তি প্লেটে জ্বলন্ত মোমবাতি রেখে কাচের গ্লাস দিয়ে ঢেকে রাখলে কী হবে? বাতি নিভে যাবে। পানি তিন ভাগের এক ভাগ ওপরে উঠে যাবে। কেন এমন হয়? এ জাতীয় সহজ বিজ্ঞানচর্চা শিশু-কিশোরদের আগ্রহ বাড়ায়। কিন্তু ছেলেটার বেশি আগ্রহ স্যারদেরকে বিপাকে ফেলে।
স্যার যখন ক্লাসে সহজ পাঠদান করেন, লবণ পানিতে গলে যায় কিন্তু কেরোসিনে গলে না। বরফ কঠিন পদার্থ। তবু বরফ পানিতে ভাসে। এতই সহজ বিষয়, যে ঘরে বসে যে কেউ পরীক্ষা করতে পারে। ছেলেটা স্যারকে প্রশ্ন করে,
– স্যার, বরফ কেরোসিনে ভাসে, না ডুবে?
– তাতো বইয়ে লেখা নেই।
– লেখার দরকার কী স্যার? ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বের করে টিনের মধ্যে ছেড়ে দিলেই দেখা যায়।
– তা তুমি দেখ না কেন?
– এই বয়সে আপনিই দেখেননি, আমি আর কী দেখব? প্রশ্নটা যখন মাথায় ঢুকছে, আমি না দেখে ছাড়বো না। তবে কেরোসিনের দাম একটু বেশি। পানিই যখন মিশে না, বরফ কি আর মিশবে? বোধ হয় কেরোসিন ভালই থাকবে। নষ্ট হবে না
ভূগোল শিক্ষক পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি বোঝান। পৃথিবী কিভাবে নিজ অক্ষের ওপর ২৪ ঘণ্টায় একবার আবর্তন করে। কিভাবে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায় একবার ঘুরে। এই আবর্তন ও ঘূর্ণনের ফলে কিভাবে রাত-দিন হয়, ঋতু পরিবর্তন হয়। কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। কিন্তু ছেলেটা প্রশ্ন করে,
– স্যার, শুধু কি পৃথিবী ঘুরে? না আকাশসহ ঘুরে?
– তোমার কী মনে হয়?
– আমার তো মনে হয় আকাশসহ ঘুরে। শুধু পৃথিবী ঘুরলে তো পূর্ব দিকে যাওয়ার জন্য যানবাহন লাগত না। শুধু শূন্যে ঝুলে থাকতে পারলেই হতো।
– কথা তো ঠিকই। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার তো উপায় নেই।
– আমি দেখেছি স্যার। বাসের ছাদে এক যাত্রী ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ব্রিজের লোহা ধরে ঝুলে রইল। বাস চলে গেল, কিন্তু সে রয়ে গেল। কিন্তু বাসের ভেতরে হ্যান্ডেলে ঝুলে থাকলে বাসের সাথেই যেতে হবে।
– সাংঘাতিক যুক্তি দিয়েছো। আমরা তাহলে বাসের ভেতরের মতো বাতাসসহ ঘুরছি।
– আর একটু সহজ পরীক্ষা করতে পারেন স্যার। একটা বল ওপরে ছুড়ে চলন্ত বাসের ভেতরে আবার ধরতে পারবেন। কিন্তু জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাইরে ছুড়ে ধরতে পারবেন না। বল পেছনে চলে যাবে। ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে লাফ দিয়ে আগের জায়গায় পড়া যাবে না। পেছনে পড়তে হবে। কিন্তু ভেতরে লাফ দিলে আগের জায়গায় পড়ব। এত জায়গা ঘুরেছেন, কখনো লাফ দিয়ে দেখেননি?
– আমরা পড়ালেখা আর গবেষণায় ব্যস্ত থাকি। ফালতু কাজে সময় নষ্ট করি না।
– পৃথিবীর গতি বোঝার জন্য এসব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি ফালতু কাজ?
– তোমার জন্য ফালতু নয়। তাইতো পরীক্ষায় ফেল করেও আদর পাও।

SHARE

Leave a Reply