রাফিউল ইসলাম।
জিমি ম্যাথুসের কবজিতে সেদিন কী ভর করেছিল কে জানে! বল তো নয়, যেন একেকটা দুর্বোধ্য ধাঁধা ছুড়ে দিচ্ছিলেন প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশে। আর সেই ধাঁধার ধন্দে পড়ে যাচ্ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকানরা। প্রথম ইনিংসে হ্যাটট্রিক। ম্যাথুস হ্যাটট্রিক করে ফেললেন দ্বিতীয় ইনিংসেও!
টেস্ট চার ইনিংসের খেলা। তবে একজন বোলার সর্বোচ্চ দুই ইনিংসেই বল করার সুযোগ পান। তিন ইনিংসে সুযোগ পেলে কী হতো বলা মুশকিল। সেই টেস্টে যেভাবে হ্যাটট্রিকের নেশা পেয়ে বসেছিল, ম্যাথুস হয়তো হ্যাটট্রিকের হ্যাটট্রিক করেই তবে থামতেন!
পরপর তিন বলে ৩টি উইকেট। হ্যাটট্রিক! ক্রিকেটে যেকোনো বোলারের জন্য এক স্বপ্নের মতো ব্যাপার। সেই স্বপ্ন কারো জীবনে সত্যি হয়, কারো হয় না। অর্জনটা আরো গৌরবের হয়ে ওঠে, যখন কোনো বোলার কীর্তিটা গড়েন টেস্ট ক্রিকেটে। ১৩৩ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৪০টি হ্যাটট্রিক হয়েছে। হ্যাটট্রিক করেছেন মাত্র ৩৭ জন বোলার, পেরেছেন তাদের স্বপ্ন সত্যি করতে!
ফ্রেড স্পোফোর্থ নামে এক অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার ১৮৭৯ সালের ২ জানুয়ারি টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম পরপর তিন বলে ৩ উইকেট নিয়ে দেখিয়েছিলেন সারা বিশ্বকে। সেই শুরু; এবং তারপর থেকে কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াম পেসার পিটার সিডলের করা টেস্ট ক্রিকেটের সর্বশেষ হ্যাটট্রিকটি পর্যন্ত মাত্র ৩৮ বার এমন ঘটনা ঘটেছে টেস্ট ক্রিকেটে। প্রতিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি, অনেক গল্প।
৩৫ জন বোলারের মধ্যে মাত্র তিনজন দুইবার করে এই কীর্তি গড়তে পেরেছেন টেস্ট ক্রিকেটে। রেকর্ডধারী সেই খ্যাতিমান তিন ক্রিকেটার হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার অফ-স্পিনার হিউ ট্রাম্বল, ইংল্যান্ডের লেগ স্পিনার জিমি ম্যাথিউস এবং পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম। তিনজনই জোড়া হ্যাটট্রিক করেছেন একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ট্রাম্বলের হ্যাটট্রিক দু’টি দুই বছরের ব্যবধানে। প্রথমটি ১৯০২ সালে দ্বিতীয়টি ১৯০৪ সালে, দুটি হ্যাটট্রিকই হয় মেলবোর্ন, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। ম্যাথিউস হ্যাটট্রিক করেছেন একই দিনে দুইবার। সেই শুভদিনটি হচ্ছে ২৮ মে ১৯১২ সাল। ভেন্যু ওল্ড ট্রাফোর্ড আর প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। একই টেস্টে দুই হ্যাটট্রিক করা ইতিহাসের একমাত্র বোলারও তিনি।
ওয়াসিম আকরাম হ্যাটট্রিক দু’টি করেন সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে। হ্যাটট্রিক দু’টি হয় ১৯৯৯ সালের মার্চে, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। অবশ্য তিনিই একমাত্র বোলার, যিনি টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করেছেন দলের অধিনায়ক থাকাকালে।
মাত্র দু’জন বোলার আছেন, যাদের টেস্ট হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি একটি ওয়ানডে হ্যাটট্রিকও আছে। দু’জনই পাকিস্তানিÑ ওয়াসিম আকরাম ও মোহাম্মদ সামি। তাদের মধ্যে ওয়াসিম আকরাম ক্রিকেট-ইতিহাসের একমাত্র বোলার, যার টেস্ট এবং ওয়ানডে দুটোতেই ২টি করে হ্যাটট্রিক আছে। এই একটি জায়গায় একেবারে অনন্য কিংবদন্তি এই পাকিস্তানি।
টেস্ট অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করেছেন এমন বোলার আছেন তিনজনÑ ইংল্যান্ডের মিডিয়াম পেসার মরিস অ্যালম (১৯৩০), নিউজিল্যান্ডের অফ-স্পিনার পিটার প্যাথেরিক (১৯৭৬) এবং অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার ড্যামিয়েন ফ্লেমিং (১৯৯৪)।
জিমি ম্যাথিউস, ডমিনিক কর্ক (ইংল্যান্ড), মোহাম্মদ সামি ও জারমেইন লসন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) হ্যাটট্রিক করেছেন ফিল্ডারদের কোনো রকম সহযোগিতা ছাড়াই। মানে, এসব ক্ষেত্রে বোলাররা ব্যাটসম্যানদের আউট করেছেন বোল্ড, এলবিডব্লিউ অথবা কট অ্যান্ড বোল্ড করে। কোর্টনি ওয়ালশ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), মার্ভ হিউজ (অস্ট্রেলিয়া) ও লসনের হ্যাটট্রিক করতে দুই ইনিংস করে লেগেছে। এই তিনজনের মধ্যে হিউজ আবার একটি বিরল রেকর্ডের অধিকারী। তার হ্যাটট্রিকের ৩টি বল হয়েছে ৩টি আলাদা ওভারে। ১৯৮৮ সালের ৩ ডিসেম্বর পার্থে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে নিজের ৩৬তম ওভারের শেষ বলে অ্যামব্রোসের উইকেটটি পেয়েছিলেন হিউজ। ৩৭তম ওভারের প্রথম বলে প্যাট্রিক প্যাটারসনকে আউট করার পর অলআউট হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের প্রথম বলেই গর্ডন গ্রিনিজকে আউট করে বিরল হ্যাটট্রিকটি অর্জন করেন হিউজ।
পরপর চার বলে ৪ উইকেট নেয়ার ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি টেস্ট ক্রিকেটে। ওয়ানডেতে যদিও শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গার এমন একটি কীর্তি আছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, তবে টেস্ট ক্রিকেটে এর কাছাকাছি গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের মরিস অ্যালম। ১৯৩০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করা তার হ্যাটট্রিকটি হয়েছিল ওভারের শেষ ৩টি বলে। ওভারের দ্বিতীয় বলেও একটি উইকেট পেয়েছিলেন অ্যালম। ৫ বলে হ্যাটট্রিকসহ ৪ উইকেট পাওয়া টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র বোলার তিনি।
৫ বলে ৪ উইকেট নিয়েছেন, কিন্তু হ্যাটট্রিক হয়নিÑ টেস্ট ক্রিকেটে এমন দুর্ভাগা বোলারও আছেন দু’জন। তারা হলেন ইংল্যান্ডের ক্রিস ওল্ড (১৯৭৮, প্রতিপক্ষ পাকিস্তান) এবং পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম (১৯৯১, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। ২ উইকেট নেয়ার পর একটা নো বল করে আবারও ২ উইকেট নিয়েছিলেন ওল্ড। ওয়াসিম আকরামের ক্ষেত্রে উইকেটবিহীন বলটি ‘ডট’ গিয়েছিল।
গৌরবের এই তালিকায় একটা বাড়তি কৃতিত্ব আছে একমাত্র বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে জায়গা পাওয়া অলক কাপালিরও। ২০০৩ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের বিপক্ষে করা হ্যাটট্রিকের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর ২৪০ দিন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটি তাই এখনো তার দখলে। একটু কৃতিত্ব দিতে হবে সাবেক ইংলিশ অফ-স্পিনার টম গডার্ডকেও। ৩৮ বছর ৮৭ দিন বয়সে হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি, ১৯৩৮ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। টেস্ট ক্রিকেটে তার চেয়ে বেশি বয়সে আর কোনো বোলার হ্যাটট্রিক করেননি। সবচেয়ে আনন্দের হ্যাটট্রিকটা বোধ হয় করেছেন পিটার সিডলই। পরপর তিন বলে ইংল্যান্ডের তিন ব্যাটসম্যানকে আউট করার দিনটি ছিল তার জন্মদিন।
অর্জনটা ব্যক্তিগত হলেও দলীয় কিছু মজার পরিসংখ্যানও জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। টেস্ট ক্রিকেটে ১০টি দলের বোলারই হ্যাটট্রিকের স্বাদ পেয়েছেন। ভারতের হ্যাটট্রিক খরা ঘুচিয়েছিলেন হরভজন সিং, ২০০১ সালে। সর্বোচ্চ ১২টি হ্যাটট্রিক করেছেন ইংলিশ বোলাররা, ১১টি হ্যাটট্রিক অস্ট্রেলীয়দের নামে। মোট হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশ কিন্তু আছে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে এবং শ্রীলঙ্কারও ওপরে। বাংলাদেশের হ্যাটট্রিক যে হয়ে গেল দু’টি! এর মধ্যে সোহাগ গাজী হ্যাটট্রিকের এই তালিকায় পেয়েছেন অনন্য গৌরব। বাকি ৩৬ জনের তো আর একই ম্যাচে সেঞ্চুরিও নেই!
মোট হ্যাটট্রিকের শতকরা ৫৮ ভাগ এসেছে এই দুই দলের বোলারদের কাছ থেকে। টেস্ট খেলুড়ে সব দেশের অন্তত একটি করে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তানের সব হ্যাটট্রিকই হয়েছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। দু’জন ভারতীয় বোলার (হরভজন সিং ও ইরফান পাঠান) হ্যাটট্রিকের স্বাদ পেলেও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটে কখনো ভারতের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করতে পারেনি কেউ!