আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ|
ডিসেম্বর। বছরের শেষ মাস। কিন্তু শেষ হলেও মাসটি কম অর্থবহ নয়। বরং এটি হলো Last but not the least. ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি মাস। এ মাসটি এলেই আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হই। পুলকিত হই, শিহরিত হই। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সেদিনকে আমরা বলি স্বাধীনতা দিবস। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হই। আর এ জন্য ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয়ের দিন, Victory day. এ দিনটির জন্য সমস্ত বাংলাদেশীর এক সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল। অপেক্ষার দীর্ঘ রজনী শেষে আমরা খুঁজে পাই উদ্ভাসিত শুভ্র সকাল। বিজয়ের মাস এলেই তাই আমরা নতুন করে ভাবি।
কী ভাবি আমরা?
চোখ-কান খোলা বাংলাদেশী মাত্রই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনটি পালনের আগে ভাবেন- এক. আমরা কি চূড়ান্ত বিজয় পেয়েছি? দুই. কখনো আমরা খুঁজে পাবো প্রকৃত বিজয়? তিন. বিজয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা কী? চার. শিশু-কিশোর হিসেবে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য আমাদের কি কিছু করার আছে? আজ আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব এবার।
আমরা কি চূড়ান্ত বিজয় পেয়েছি?
এ প্রশ্নের সত্যিকার উত্তর- না। আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি, পেয়েছি লাল-সবুজের এক মহিমান্বিত পতাকা, পেয়েছি একটি জাতীয়সঙ্গীত, পেয়েছি একটি সুন্দর সংসদ, একদল স্বাধীনতাপ্রেমিক মানুষ। কিন্তু কেবল এটিই ছিল না আমাদের চাওয়া-পাওয়া।
আমরা চেয়েছিলাম প্রকৃত স্বাধীনতা। মানুষের মতপ্রকাশের, অধিকারের, আনন্দ প্রকাশের। বেঁচে থাকার এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ জীবনের স্বাধীনতা। কিন্তু বিজয়ের ৪২টি বছর পরও আমাদের সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। আজ আবার তাকাই বিবর্ণ বাংলাদেশের দিকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ বাক, ব্যক্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। সরকার জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে। সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিজিবিরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে ফালানীর ঝুলানো লাশ। প্রতিবাদ করতে পারেনি বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের। আর তারাই কি না পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে প্রতিবাদী বাংলাদেশের মা-বোনদের, বাবা-ভাইদের। এটাই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। বেশি দামে কেনা, কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা।
আমরা যেন বিদেশী বর্গির থাবা থেকে মুক্ত-স্বাধীন হয়ে আরেক দল বাংলাভাষী বর্গির দখলে চলে গেছি। নতুন স্বৈরাচার আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে।
বিজয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা কী?
প্রথমত: যারাই বাংলাদেশের ক্ষমতার যান তারাই যেন সবাই অতীত ভুলে যান। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তার দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে তিনি এ দেশটা চালান। কিন্তু বেশি দিন যেতে না যেতেই দেশের সকল দল নিষিদ্ধ করেন। সকল পত্রিকা বন্ধ করে চারটি মাত্র সরকারি পত্রিকা চালু রাখেন। একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেন। দেশের মানুষ অত্যাচারের স্টিম রোলার থেকে বাঁচার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এভাবেই নষ্ট হয় বাংলাদেশে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাতে সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার হয়ে সপরিবারে জীবন দেন দেশের স্বাধীনতার নেতা। নন্দিত নেতা থেকে নিন্দিত হয়ে তিনি বিদায় নেন।
দ্বিতীয়ত : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারেনি এখানে। ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর ’৭৭-এ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে এই জননন্দিত শাসককে হত্যা করে বিভ্রান্ত সেনা কর্মবিভাগ। ১৯৮৯ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের নলের মুখে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৯ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর। এরপর সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা চালু হয়।
কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচন হয়। যে নির্বাচনের ফলাফল সবাই মেনে নেয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বও স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় বর্তমান সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংবিধানে পরিবর্তন আনেন এবং আদালতের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় আদায় করে নেন। এভাবে তীব্রভাবে ব্যাহত হয় আমাদের গণতান্ত্রিক ধারা এবং নষ্ট হয়ে যায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
আমরা এখন সহাবস্থানের পরিবর্তে দূরত্বে বিশ্বাসী, সহিষ্ণুতার বদলে অসহিষ্ণুতার অনুসারী। শান্তিপূর্ণ মতবিরোধের পরিবর্তে সন্ত্রাস ও সঙ্ঘাতের রাজনীতিতে অভ্যস্ত।
এভাবে কখনোই এগোতে পারবে না আমাদের প্রিয় স্বদেশ, সুজলা-সুফলা শস্য- শ্যামলা বাংলাদেশ।
তৃতীয়ত : দেশপ্রেমের বড় অভাব
স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অভাব দেশপ্রেমের, দেশপ্রেমিক মানুষের। বক্তৃতায় সবাই বলে, ‘ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সবাই এ কথা বেমালুম ভুলে যায়।
সরকারি কর্মকর্তারা আছেন দেশের স্বার্থ বিক্রি করে, ঘুষের টাকায় ভাগ্য গড়ার তালে। রাজনীতিকরা আছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ধান্ধায়। জনগণের স্বার্থের চাইতে নিজেদেন পকেট ও ক্ষমতার চেয়ার তাদের কাছে অনেক প্রিয়। ব্যবসায়ীরা আছেন মানুষের পকেট ডাকাতি করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত।
আমাদের না আছে দেশপ্রেমিক অভিভাবক, অধ্যবসায়ী ছাত্র, যতœবান শিক্ষক, উদার রাজনীতিক, সজ্জন ব্যবসায়ী, সৎ সরকারি কর্মকর্তা, সাহসী আইন প্রয়োগকারী। ফলে দেশ ওপরের দিকে না গিয়ে ছুটছে গভীর খাদের দিকে।
চতুর্থত : কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না
বলা হয়, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ আর তাই বাংলাদেশে একই ভুলের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যে ভুল করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, সেই একই ভুল বারবার করছেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। যে ভুল করেছিলেন জিয়াউর রহমান সেই একই ভুল করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। শাসক হিসেবে কেউই কারো ভুল থেকে শিক্ষা নেননি। এর বড় কারণ হলো আমাদের জন্য উন্নত ও সঠিক ইতিহাস লেখার ও সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা নেই। আমাদের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ নেই।
পঞ্চমত : শিশুদের জন্য নেই কোনো পরিকল্পনা
দুঃখজনক হলেও সত্যি কথা এটি। আমাদের শিশুদের জন্য কোনো সঠিক সুস্থ পরিকল্পনা নেই। তাদেরকে সুস্থ দেহ, সুন্দর মন আর উন্নত চরিত্র দিয়ে গড়ে তোলার আয়োজনের অভাব। পাঠ্যবইসহ পাঠ্যক্রম আর খেলাধুলার আয়োজন পর্যাপ্ত নয়। ফলে শিশু-কিশোররা সত্যি সত্যি সব দিক মিলিয়ে স্বপ্নের শিশু হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না।
কখন খুঁজে পাবো প্রকৃত বিজয়?
চাই একটি সুন্দর বসুন্ধরা আর চাই একদল সৎ নাগরিক।
বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে সবার আগে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলীসহ প্রধান প্রধান নদীর পাড় দখলমুক্ত করতে হবে। জলাশয় বন্ধ করে যত্রতত্র আবাসন গড়ার নামে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা চলবে না। আবার হাসিতে ভরে তুলতে হবে কৃষকের মুখ। সোনালি আঁশ পাটের বাজার ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবে বাঁচাতে হবে ধরণী-পৃথিবীকে।
এ কাজ করতে হলে লাগবে একদল সৎ নাগরিক। সৎ নাগরিক, সাহসী মানুষ আর দেশপ্রেমিকের অভাব আজ সর্বত্র। কাজটি করতে হবে সবাইকে। এটি কারো একার কাজ নয়। সরকার-বিরোধী দল-সাধারণ মানুষ, প্রশাসন-ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজটি করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ বাঁচলেই আমরা বাঁচব। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সুইচ টিপলেই এ কাজ হয়ে যাবে না।
আমার সন্তান যেন বাঁচে দুধে-ভাতে
আমরা জানি ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। আজকে যে শিশু সে-ই একদিন বড় হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, বৈমানিক, সেনাপতি হবে। দুনিয়ার সব বড় মানুষই একদিন শিশু-কিশোর ছিলেন।
তার মা-বাবা, সমাজ, রাষ্ট্র তাকে বড় হতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশের শিশুদের সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ার জন্য, তাদের সবল দেহ, সুন্দর মন আর আকাশের মতো উদার হিসেবে গড়ার জন্য তেমন কোনো আয়োজন নেই। আজ সেই আয়োজন করতে হবে সবাই মিলে।
দুধে-ভাতে, মাছে-ভাতে যাদের বেড়ে ওঠার কথা আজ তাদের জন্য ডালে-ভাতে বেড়ে ওঠার সুযোগ পর্যন্ত নেই। ডাল-পেঁয়াজের দামও আকাশ ছুঁয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে অপুষ্টি আক্রান্ত হয়ে পড়বে আমাদের ভবিষ্যৎ।
তোমরা মুকুল প্রার্থনা করি ফুটিবার আগে
গোলামির ছোঁয়া যেন কভু নাহি লাগে
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়ার দুরন্ত কিশোর দুখু মিয়া বড় হয়ে আগামীর শিশুদের জন্য ওপরের প্রার্থনাটি করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলের গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্তি আন্দোলনের সময়ও যেন দেশের শিশু-কিশোররা গোলামির ছোঁয়া থেকে বেঁচে থাকে। আজ কিন্তু আমরা স্বাধীন, মুক্ত স্বদেশে আমাদের বাস। কিন্তু এক অদেখা গোলামির জিঞ্জিরে আমরা আবদ্ধ।
আমাদের শিশুদের মনে স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ার এটিই সময়। বিদেশে আমাদের বন্ধু থাকবে, প্রভু নয়। আমাদের এই পবিত্র মস্তক মহান আল্লাহর কাছেই নত হবে। অন্য কারো কাছে নয়।
আজ মহান বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের প্রার্থনা। এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
Sadinata Amra Kabe pabu ?????