মোহাম্মদ মুহাইমিনুল ইসলাম|
সূর্যের আলো না ফোটা পর্যন্ত ড. তারেক তাঁর সাধের গবেষণাগারে বসে থাকলেন। রাব্বি অতি মনোযোগের সাথে ফরমুলাগুলোর ছবি তুলে যাচ্ছেন। রাব্বি ড. তারেকের চিফ অ্যাসিসট্যান্ট। ড. তারেক কম কথার মানুষ। গম্ভীর বোলচাল, রাব্বি তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। যদিও দু’জনই সমবয়সী। ড. তারেক তাঁর গবেষণাগারটি তৈরি করেছেন বাড়ির নিচে মানে মাটির নিচে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন গবেষণার আলাদা আলাদা কামরা। একটি কামরায় রয়েছে শুধু বইয়ের থাক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইয়ে ঠাসা থাকগুলো।
কেউ জানে না ড. তারেককে, তাঁর গবেষণাগারটিকে শুধু রাব্বি ছাড়া। নানা বিপদ-আপদে, সমস্যায় রাব্বি ড. তারেকের সাথে থেকেছে। ড. তারেক বিপদে পড়লে বিচলিত হন না। ঠাইমবা মাথায় সব সামলে নেন। রাব্বি তাঁকে দেখে প্রতিনিয়ত বিস্মিত হয়।
গবেষণাগারের একটি কামরা ড. তারেক নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য রেখেছেন। তিনি মাইক্রোজেনারেটর, দ্বিতীয় মাত্রার রোবটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। বিল্ট-ইন-বেসিনের কলে লাগানো মাইক্রোজেনাটের, তা পানির ট্যাপ খুলে চালু করলেই সারা গবেষণাগারে আলো-পাখা জ্বলে ওঠে। এক পয়সাও খরচ নেই।
তিনি তৈরি করেছেন একটি সরল নিউক্লিয়ার রিএক্টর। এর সাহায্যে শক্তি বের করে এনে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব কোল্ড বাল্ব জ্বালান, কিন্তু তিনি এগুলোর পেটেন্ট নেননি। মূলত তিনি আত্মপ্রকাশ ঘটাতে চান না। তবে তাঁর আবিষ্কারের লক্ষ্য একটাইÑ হিট অ্যামপ্লিফিকেশন তৈরি করা। হিট অ্যামপ্লিফিকেশন তৈরি করতে পারলে মাত্র একটা মোমবাতির আগুনের তাপ থেকে চট্টগ্রামের মতো এতো বড় শহরের যাবতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রায় ৫৭টা প্যান্টার্ন, ১৬টা মডেল তৈরি করেছেন তাঁরা। বিভিন্ন দিক বিবেচনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাঁরা ১টি প্যাটার্ন অনুযায়ী মডেল বেছে নিয়েছেন।
যন্ত্রটা অনেকটা কলসির মতো দেখতে ধাতব পাত্র বিশেষ। ড. তারেক এটা তৈরির ফরমুলাগুলোর ছবি তুলে রাখছেন। যদি কোনো রকমে বাইরে প্রকাশ হয়ে যায়, তবে যে কেউ এটা হাতিয়ে নিতে চাইবে। তাঁদের জীবনের আশঙ্কার সৃষ্টি হবে। তাই রাব্বিকে প্রতি রাতে কাগজপত্রের ফটো তুলতে হয়। মাইক্রোফিল্মগুলো লুকিয়ে রাখা হয় নানা তুচ্ছ তবে কার্যকর জিনিসের ভেতরে, যেমন গাছের টবে, মাটির হাঁড়িতে, বইয়ের খাপে ইত্যাদিতে।
তাঁরা রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এটি তৈরির লক্ষ্যে। তাঁরা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন। তাঁরা বিখ্যাত হবেন। জগৎজোড়া খ্যাতি হবে। এই উপমহাদেশের ঝুলিতে আসতে পারে আরেকটি নোবেল।
খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। হিট অ্যামপ্লিফিকেশন তৈরি হয়ে গেল। এখন তাঁদের এটা পরীক্ষা করতে হবে। অবশ্যই রাতের বেলা। পরীক্ষার জন্য তাঁরা গবেষণাগারটিকেই বেছে নিলেন। রাতে গবেষণাগারটির সব বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন তাঁরা। নিয়ম অনুযায়ী সব সেট করলেন তাঁরা।
হিট অ্যামপ্লিফিকেশন নামটি বিচিত্র, শব্দকে যেমন অ্যামপ্লিফায়ারে বাড়ানো যায়, তেমনি তাপকেও। তাপ বিবর্ধন যন্ত্র নির্মাণে সারা দুনিয়ায় গবেষণা চলছে, মাটির নিচের খনিজসম্পদ অফুরন্ত নয়। হিট অ্যামপ্লিফিকেশন তৈরি হলে কাউকে আর ভাবতে হবে না। তবে এটির ক্ষেত্রে ড. তারেক রাব্বি সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছেন।
রাব্বি ড. তারেককে জিজ্ঞেস করল, পরীক্ষ শুরু করব?
একটি ভারি কণ্ঠস্বর থেকে ধ্বনি হলো ‘করো’।
তাঁদের পরীক্ষা সফল হলো। ড. তারেক কম কথার মানুষ। খুব বেশি হাসেন না। তবুও এ দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ বিশিষ্ট লোকটির মাঝে আজ উত্তেজনা ভর করেছে। তিনি রাব্বিকে বললেন, হিট অ্যামপ্লিফিকেশন নামটি এতো অদ্ভুত কেন জানো? আমি তাপকে বাড়ানোর জন্য একটি শব্দের সাহায্য নিয়েছি। এ সাইলেন্ট সাউন্ড। কেউ শুনতে পায় না। মৃদু একটা ক¤পন মাত্র।
রাব্বি বলল, আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
এমনিভাবে নানা খোশগল্পে মেতে রইলেন দু’জন।
ভোর হবে, নতুন আলো ফুটবে, সেই সাথে শোনা যাবে তাঁদের বিজয় ধ্বনি। তাঁরা তাঁদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়েছেন। পরদিন সকালে লোকজন ভিড় করলেন তাঁদের বাড়িতে। সাংবাদিকের প্রশ্নের তোপে পাল্টা জবাব চালাচ্ছেন ড. তারেক। তাঁদের অদ্ভুত গবেষণাগার, সেই যন্ত্রটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন সবাই। সকলেই তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আবার অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, তাঁদের মতো এমন গোবেচারা লোক এসব করলেন কিভাবে? যাই হোক, অনেক রাতে অভ্যাগতরা বিদায় হলেন। সেই দু’জন যাঁরা বিশ্বকে, মানবজাতিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিলেন, তাঁরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাঁদের সাধের গবেষণাগারটিতে প্রবেশ করলেন।