ড. রফিক রইচ
আজকের শরতের লেখাটি শুরু করছি একটি ছড়া দিয়ে। কি ভালো লাগবে তো? আশা করি ভালো লাগবে। কারণ ছড়া মজার কথা বলে, রানী-রাজকুমার, রাজার কথা বলে। ছড়া পড়ার, জানার ও গড়ার কথা বলে। তাই কথা না বাড়িয়ে আগে ছড়াটি বলি
শরতের সন্ধ্যায় ডাকে ঝিঁ ঝি পোকা
কাশফুল ফোটা আজ যায়না তো রোখা।
ফোটে আরো শিউলি ও বকুল টগর
মল্লিকা ফুল ভরা পল্লি নগর।
জোছনার আলো ভরা রাতের বাসর
আকাশেতে সৌখিন মেঘের আসর।
সবুজের গালজুড়ে শিশিরের খেলা
লুকোচুরি করে শুধু বেড়ে গেলে বেলা।
ধান গাছ নুয়ে থাকে ধানের ভারে
কৃষকের মনটা যে সুখপাখি নাড়ে।
ঝড় মেঘ বৃষ্টির নেই মাখামাখি
গড়ার স্বপ্ন ভরা শরতের আঁখি।
কি সম্ভাবনার বাক্স! আমার আগডুম বাগডুম বন্ধুরা, ছড়াটি ভালো লেগেছে তো! এমন চনমনে ফুরফুরে ঝরঝরে ঋতুর রানী শরতের নির্ভেজাল গন্ধ মাখানো বর্ণনা ভরা ছড়াটি মন ভরালে ভাল লাগবেই তো!
বন্ধুরা, এবার বুঝতেই পারছো আমি ঋতুরানী শরৎ নিয়ে তোমাদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে গল্প করতে করতে শরৎ রাজ্যে হারিয়ে যাব। দেখাবো মনের চোখ ভরে, জানবো মগজ ভরে ঋতুরানী শরতের রাজ প্রাসাদের রূপ সৌন্দর্য, মনিমুক্তা ঐতিহ্য ও তার অহংকার।
ষড়ঋতু অর্থাৎ ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। সকলেই এগুলোর নাম জানলেও তবুও বলছিÑগ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এসব ঋতুগুলোর সবগুলোই প্রায় প্রকৃতভাবেই এদেশের প্রকৃতিতে কড়া নাড়ে। আমাদের দেশে এগুলোর মধ্যে কোনটি আসে নীল আকাশের সাদা বক পাখির মত ডানা মেলে, আবার কোনটা আসে ঝড়ো বেগে, কোনটি নবান্নের গন্ধ নিয়ে, কোনটি ফুল আর সুবাসের সৌরভ নিয়ে, আবার কোনটা আসে প্রাণহীন, ধূসর ও মলিন প্রকৃতিকে সবুজে ভরে দিতে মহান আল্লাহতায়ালার করুণাধারা নিয়ে, কোনটি আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে অতিথি সব বর্ণিল পাখিদের ডানায় চড়ে।
আমাদের দেশ ছাড়া এমন কিছু দেশ আছে যে সব দেশে সব ঋতুই দৃশ্যমান হয় না। তবে তিনটি ঋতু যেমনÑগ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত এগুলোর প্রায় সকল দেশেই কমবেশি চোখে পড়ে।
তবে দুঃখের বিষয় কি জানোÑনিয়মিত পরিবেশ দূষণ ও এর প্রভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ঋতুগুলোর সব উপস্থিতিতে অদৃশ্য এক বাধা আসছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও ঋতুগুলোর সবকটিকে আমরা বুঝতে পারবো না, বা তার স্বাদও নিতে পারবো না। মাসের পর মাস যাবে ঠিকই কিন্তু প্রকৃতির যে পরিবর্তন সেটা বোঝা যাবে না। আর সেটা হবে খুবই অনাকাঙ্খিত। এ দেশটি কৃষি নির্ভর দেশ। কৃষকের ফসল তখনই সফলভাবে ঘরে নিতে পারবে যখন এই ঋতুগুলো নিয়ম মাফিক পরিবর্তিত হবে। যদি এ পরিবর্তনে বিঘœ ঘটে তখন আবহাওয়া তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ঋতুগুলো সঠিক সময়ে আসবে না। তখন ফসলের উৎপাদন ভাল হবে না। এতে কৃষক তথা আমাদের দেশ অনেক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যা মোটেই কাম্য নয়। তাই পরিবেশ দূষণের কবল থেকে এ প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। সর্বোপরি আমাদের বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে। তবেই ঋতু বৈচিত্র্যের কোন হেরফের হবে না। আমরা এর মজাও পাব।
শরৎ যেহেতু এখনো আমাদের সাথে মান অভিমান করেনি, রাগ করেনি তাই তার সবটুকু উপস্থিতি আমাদের প্রকৃতি খুশি ভরে গ্রহণ করে এবং বুকে তাকে আলিঙ্গন করে। আর আমাদেরকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।
শরৎ হল বাংলা ছয় ঋতুর তৃতীয় ঋতু। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎকাল। শরৎকাল ভাদ্র মাসে শুরু হলেও এর আগের ঋতু বর্ষার বারিধারা অর্থাৎ বর্ষার ঝমাঝম বৃষ্টির ধারা অনেক সময় ধীরলয়ে চলতে থাকায় এমাসে শরৎকালের বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় না। শরৎকালের আসল চেহারাটা ফুটে ওঠে আশ্বিন মাসে। একালটা বেশ আরামের। তাই শরৎকালকে বলা হয় ঋতুর রানী।
কেউ কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে এসময়টা বেছে নিতে পারে, অবশ্য যদি পড়ালেখার কোন চাপ না থাকে।
ঋতুরানী শরতের রূপ রাজকীয় সুন্দর। এসময়ে বাংলাদেশের সেজে ওঠার দৃশ্য তুলনাহীন। বর্ষার অঝোর ধারার বৃষ্টির শব্দ নেই। প্রথমদিকে সেটি কিছুটা থাকলেও তা সৌখিন। বর্ষার ভ্যাপসা গরম কমে আসে। শীতের আগমনী বার্তা বেজে ওঠে প্রকৃতির সাইরেনে। তাই, না শীত না গরমের আরাম অনুভূত হওয়ায় শরৎ হয়ে ওঠে আদরনীয় ও জীবনযাপনের জন্য লোভনীয় এক সময়। এসময়ে আমাদের মাথার ওপরের আকাশ যেন বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র হয়ে ওঠে আর তার বুক জুড়ে সাদা সৌখিন থোকা থোকা সাদা পাল তুলে মেঘগুলো নৌকার মত ভেসে বেড়ায়। আর সবুজ জমিনের কার্পেট সবুজ ঘাস ও বিভিন্ন ফুলে এবং পানিভারে নুয়ে পড়া নদীগুলোর তীর ঘেঁষে সারি সারি ফুটে থাকে সাদা বক পালকের মত ধবধবে কাশফুল। নরম বাতাসে কাশফুলের মাথা কি পরম সৌন্দর্যে দুলতে দুলতে জানান দেয় শরৎ এসেছে শরৎ এসেছে, শরৎ এসেছে আবার। বিশ্ব কবি এতে মুগ্ধ হয়ে ওঠেন। আর তাইতো তিনি লেখেনÑ
চিক চিক করে বালি কোথা নেই কাঁদা
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
এসময় নদী-নালা খাল-বিল পানিতে টুইটম্বুর হয়ে থাকে। যার ভেতরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ঝাঁক বেঁধে এদিক ওদিক মনের আনন্দে ঘোরাঘুরি করে। কখনো কখনো হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে মাছের ঝাঁক। নীরবতা ভাঙ্গে প্রকৃতি। বিলে হাঁটু পানিতে সাদা বক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে টুপ করে মাছ শিকার করে শরতের নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে।
জোছনার রাজকীয় বাহারী রূপ আর অন্য সময়ে চোখে পড়ে না। পূর্ণ জোছনার মিষ্টি আধো আলোয় প্রকৃতি তথা রাতের বাংলাদেশ এমনভাবে সাজে যেন তাকে চাইনিজ রেষ্টরেন্টের মত অথবা সমুদ্র তলদেশের মত মনে হয়। বাংলার প্রকৃতির দিকে এসময় তাকালে যে কারো মন কেড়ে নেবে।
ভোরের নরম মধুময় রোদের আলোয় শরতের সকাল জেগে ওঠে। ঘুম থেকে উঠেই সবুজ ঘাসে পা রাখলে শিশির পরম আদরে পা জড়িয়ে ধরে। ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুগুলোকে যেন মুক্তার দানার মত মনে হয়। আর শিউলি গাছের তলায় ঝরা অজস্র শিউলিফুল শিশিরে ভিজে মিষ্টি গন্ধ ছড়ায় চারিদিকে। শরতের শিউলি বা শেফালি ফুলের নাম শুনে একটি ছড়ার কথা মনে পড়ছেÑ
আমাদের দেশটারে কত ভালবাসি
সবুজ ঘাসের বুকে শেফালির হাসি।
শিউলিতলা সবারই খুব পছন্দের। শিউলি ফুল কুড়ানোর মধ্যে এক ভিন্নরকম ভাল লাগা কাজ করে। যারা সকালের শিউলি ফুল কুড়াওনি কখনও, এবার তারা এই শরতের সুযোগকে হাত ছাড়া করবে না। নইলে কিন্তু আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সকালের আদুরে সূর্যের আলো যখন ধান গাছের সবুজ শীষের ওপর গা মেলে দেয়, তখন যে দৃশ্যের অবতারণা হয় তা শুধু উপলব্ধির বিষয় প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। জাতীয় পাখি দোয়েল ও কোয়েল পাখির সুমিষ্ট গানে আশপাশ মুখরিত করে তোলে।
শরতের ঐতিহ্য হলোÑসাদা শিউলি ফুল, ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু, পদ্ম ও কাশফুল, রূপ ঝলমল চাঁদের আলো, স্বচ্ছ নীল আকাশ ও তার বুকে ভেসে চলা বৃষ্টি ছাড়া সুন্দর সাদা মেঘ।
গ্রীষ্মের উৎকট আবহাওয়া ও গুমট গরমের তাণ্ডব লীলায় প্রকৃতির শরীর অসহ্য যাতনায় বেদনা ক্লিষ্ট, মলিন ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। বর্ষার শুভাগমনে প্রকৃতি ঝম ঝম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গোসল করে নির্ভেজাল সজিব, সতেজ ও পবিত্র হয়ে ওঠে। ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে গোসল করার পর যেমন ভালো লাগে, ফুরফুরে লাগে, সুন্দর দেখায়, ঠিক তেমনি প্রকৃতি বর্ষায় গোসল করে উঠে সতেজ হয়ে শরতের আঙ্গিনায় পা রাখে। তাই শরতের এমন মোহনীয় রূপ দেখে ঝরঝরে শরীর দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। আল্লাহর শুকরিয়া জানাই।
শরতে কৃষক ধানের ভারে নুয়ে থাকা ধান গাছ দেখে কিংবা সম্ভাবনাময়ী ধানের শীষ দেখে আশার বীজ বোনে। স্বপ্ন বোনে মনে কত কিছু গড়ার। কাজ-পাগল মানুষগুলো এসময়কে একান্ত আপন করে কাছে টানে। গ্রীষ্মের দাপদাহ ও বর্ষার বর্ষণধারায় কাজের বিঘœ ঘটে তা যেন শরতের আরাম বাতাসে ঝরঝরে আবহাওয়ায় পুষিয়ে নেয়া চাই। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সামনের দিনগুলোতে ভালভাবে চলার সময় ও গড়ার সময় এই ঋতুরানীর শরৎ। শরতের নান্দনিক সৌন্দর্যের সূর্যোদয়, নরম রোদের সকাল, সূর্যাস্তের রং মাখানো অকল্পনীয় অপরূপ রূপের ঘনঘটা, জোছনালোকিত রাতের স্বচ্ছ নীল আকাশ ও তার বুকের জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের সমারোহ দেখে এবং প্রকৃতির সাজ সাজ রব দেখে সবাই মুগ্ধ হতে পারে।